প্রফেসর ডক্টর মোঃ মাহমুদুল হাছান
বাংলাদেশে শিক্ষা কার্যক্রমে কয়েকটি মাধ্যমের শিক্ষা ধারা রয়েছে; বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি ভার্সন ও ইংরেজি মাধ্যম। এছাড়া মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাও বাংলাদেশের আরো দু’টি শিক্ষাধারা। সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য মা-বাবার চিন্তার অন্ত থাকে না। কোন স্কুলে পড়লে ভালো হবে, কোন মাধ্যমে পড়লে পাকাপোক্ত হবে সন্তানের অনাগত দিন, এসব বিষয় নিয়ে দোটানায় পড়েন মা-বাবা। অনেক বাবা-মা চিন্তা করেন তাদের সন্তান যেন ভালো একটি স্কুলে ভর্তি হয়, সেখানে মাধ্যম যাই হোন না কেন। আবার অনেকে মনে করেন ইংরেজি ভার্সনই ভালো এবং সমাজের এক শ্রেণি বাবা-মা আছেন যাদের টাকা-পয়সা একটু বেশি, তারা মনে করেন ইংরেজি মাধ্যমেই তাদের সন্তানেরা পড়ালেখা করবে এবং বড় হয়ে দেশের বাইরে অবস্থান করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে। কিন্তু তারা হয়ত জানেন না আসলে কোন মাধ্যমটি ভালো এবং কোনটিতে পড়ে তারা তাদের ভবিশ্যত ভালো করতে পারবে। সুতরাং ছেলে-মেয়েদের কোনো একটি মাধ্যমে পড়াশোনা করাতে সবার আগে মাধ্যমগুলি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। সন্তানকে নিয়ে অভিভাবকদের ভবিষৎ চিন্তা, সন্তানের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, তাদের আর্থিক সংগতি, বাসস্থান, চাকরি বা ব্যবসা ইত্যাদির সঙ্গে সমন্বয় করে তারপরই এগোতে হবে। তাহলে আমাদের দেশের শিক্ষা ধারার মিডিয়াম বা মাধ্যমগুলি সম্পর্কে জেনে নেয়া যাকঃ
বাংলা মিডিয়ামঃ বাংলাদেশের ভৌলিক অবস্থান ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানদের জন্য বাংলা মিডিয়ামকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। বাংলা মিডিয়ামে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা বোর্ডের কারিকুলাম অর্থাৎ বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এন সি টি বি) এর শিক্ষা বিধি অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করানো হয়। এই মাধ্যমে সব কিছুর নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা বোর্ড, যার সংখ্যা ৯টি। শিক্ষা বোর্ডের বিধিমালা অনুযায়ী একমাত্র ইংরেজি ১ম ও ২য় পত্র ব্যতিত নির্ধারিত সকল পাঠ্যপুস্তক ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বাংলা ভাষায় পাঠদান করা হয়। বাংলা মাধ্যমে প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে। সম্প্রতি তথ্য জরীপে জানা যায় বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা রয়েছে ১,২৬,৬১৫টি, মাধ্যমিক ৩৫,৫৮৯টি, নিম্নমাধ্যমিক ৩,৪৯৮টি, মাদ্রাসা ৯৩১৪টি, উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ২৩০০টি, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৭,৯২৫টি। এসকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে দেশীয় শিক্ষা প্রদান করতে এগুলির ভূমিকা প্রনিধানযোগ্য।
ইংলিশ ভার্সন : বর্তমানে ইংলিশ ভার্সনে শিক্ষার চাহিদা সর্বসাধারণ অভিভাবকদের কাছে বেশ গ্রহনযোগ্য একটি শিক্ষার মাধ্যম। বাংলা মিডিয়ামে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা বোর্ডের কারিকুলামভুক্ত বইগুলোর ইংরেজি অনুবাদই হচ্ছে ইংলিশ ভার্সন। বাংলা মিডিয়ামের পাঠ্যসূচির পাশাপাশি একই সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশে ইংলিশ ভার্সন চালু করে সরকার। এই মাধ্যমে বাংলাদেশের মূলধারার শিক্ষাক্রম ইংরেজি ভাষায় পড়ানো হয়। বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত বই-ই মূলত এ মাধ্যমের শিক্ষাধারায় পড়ানো হয়ে থাকে। বাংলা মাধ্যম ও ইংরেজি ভার্সনের মাঝে পার্থক্য হলো বাংলা মাধ্যমে শিক্ষার মাধ্যম বাংলা ভাষা এবং ইংরেজি ভার্সনে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি ভাষা। উল্লেখ্য যে বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনের উভয় শিক্ষা ধারার এস এস সি ও এইচ এস সি-র সার্টিফিকেট প্রদান করে থাকে বাংলাদেশের শিক্ষা বোর্ডসমূহ। এইএসসি পাশ করার পরে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহন করতে দেশে বা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়ে থাকে। তবে সাধারণত এ মাধ্যমের অধিকাংশ শিক্ষার্থী আমাদের দেশের সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উচ্চ শিক্ষার স্তরসমূহ শেষ করে থাকে।
ইংলিশ মিডিয়ামঃ ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা বর্তমান বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় একটি শিক্ষা ধারা। এ শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ব্যয় অনেক বেশি যা সমাজের বিত্তশালী ব্যতিত সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজ ও ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন বা এডেক্সেল, এই দুটি বোর্ডের অধীনে ইংলিশ মিডিয়ামের স্কুলগুলোর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। উভয় কারিকুলামের শিক্ষাবর্ষ হয় জুলাই থেকে জুন, তবে কোনো কোনো স্কুলে জানুয়ারী ট্যু ডিসেম্বরও তাদের শিক্ষাবর্ষ করে থাকে। বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যমের সব পরীক্ষা ও ফলাফল ব্রিটিশ কাউন্সিল নিয়ন্ত্রণ করে। ইংলিশ মিডিয়ামের পাঠ্যসূচি যুক্তরাজ্যের বাস্তবতায় তৈরি। উল্লেখ্য যে বাংলাদেশে আই বি কারিকুলাম নামেও একটি শিক্ষা ধারা রয়েছে যার সংখ্যা ক্যামব্রিজ ও এডেক্সেলের তুলনায় অনেক কম। বর্তমানে বাংলাদেশে ইংলিশ স্কুলেরও শিক্ষাবোর্ড থেকে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। সে হিসেবে রেজিস্টার্ড ইংলিশ মিডিয়ামের সংখ্যা দুই শতের অধিক নয়, তবে ব্রিটিশ কাউন্সিল অধিভুক্ত এ মাধ্যমের স্কুলের সংখ্যা দুই হাজারেরও বেশি।
ইন্টারন্যাশনাল কারিকুলামে পরিচালিত এ শিক্ষা ধারায় পড়াশোনার পুরোটাই হয় ইংরেজি ভাষায়। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে বাংলায় এস এস সি ও এইচ এস সি সমমানের ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল, সার্টিফিকেট দেয়া হয়, যা বর্তমানে আই জি সি এস ই ও আই এ এল নামে পরিচিত। এ সার্টিফিকেটগুলি প্রদান করা হয় সরাসরি ক্যামব্রিজ ও এডেক্সেল বোর্ড থেকে। এ মাধ্যমে যে সকল ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে, তাদের অধিকাংশের ইচ্ছা থাকে উচ্চশিক্ষার জন্য তারা দেশের বাইরে যাবে অথবা বাংলাদেশের কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। তবে এ কথা সত্য, যে সকল শিক্ষার্থী ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করে ও’ লেভেল এবং এ’ লেভেল সার্টিফিকেট অর্জন করে তাদের ইংরেজি ভাষায় পূর্ণাঙ্গ দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি বিজ্ঞান ও ব্যবসা শাখার অন্যান্য বিষয়েও এদের স্বচ্ছ ধারণা থাকে।
আগেই বলা হয়েছে, উপরোক্ত তিনটি মাধ্যম ছাড়াও বাংলাদেশে আরো দু’টি শিক্ষা ধারা রয়েছে; যার একটি হলো মাদ্রাসা শিক্ষা ধারা ও অন্যটি হলো কারিগরি বা টেকনিক্যাল শিক্ষা ধারা। মাদ্রাসা শিক্ষা ধারায় শিক্ষার ব্যয়ভার অনেক কম। বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় আবার দু’টি বিশেষ শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। একটি সরকারের সরাসরি অনুমোদন নিয়ে পরিচালিত আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এবং আরেকটা হলো বেসরকারিভাবে পরিচালিত বিফাকুল উলুম কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। মাদ্রাসা শিক্ষা ধারায় শিখন-শিক্ষণের মাধ্যমে আরবি ভাষার প্রাধান্য বেশি। তবে এ মাধ্যমে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার পান্ডিত্যও একেবারে কম নয়। এ শিক্ষাধারা থেকে পাশ করে শিক্ষার্থীরা দেশ বিদেশের খ্যতিমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে বেশ কৃতিত্ব অর্জন করে থাকে।
অপরদিকে, কারিগরি শিক্ষা ধারাও বর্তমানে সাধারণ শ্রেণি-পেশার মানুষের অনেক পছন্দ। এ শিক্ষা ধারা থেকে পাশ করে দ্রুত কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকে বলে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার দিকে অগ্রসর না করে ডিপ্লোমা বা শর্ট কোর্স করে কর্মস্থলে যোগ দিয়ে থাকে। তবে কারিগরি শিক্ষা গ্রহন করেও অনেক ছেলেমেয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে থাকে। কারিগরি শিক্ষাকে অনেকে বৃত্তিমূলক শিক্ষাও বলে থাকেন। বর্তমানে এ শিক্ষার চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ শিক্ষা ধারায় ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেট কোর্সের মূল্য আমাদের দেশ ছাড়াও বিদেশে বেশ কদর পেয়েছে।
মাধ্যম হিসেবে যে যেটিই পছন্দ করুক না কেন, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন অনেক আধুনিক। জাতীয় শিক্ষাক্রমে পরিচালিত বাংলা মিডিয়াম, ইংলিশ ভার্সন কিংবা মাদ্রাসা ও কারিগরি ধারায় পড়াশোনা করে বাংলাদেশের অনেক ছেলে-মেয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন এবং রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করে চলেছেন। আবার ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলে-মেয়েরাও অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকেন। তাদের ইংরেজী ভাষায় বিশেষ দক্ষতা থাকার কারণে অতি অল্প সময়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে একটি আস্থার জায়গা করে নিতে পারে বলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরি-বাকরিতে তারা অনেক সুখ্যাতি অর্জন করতে পারেন। তবে এ কথাটি অসত্য নয় যে, বাংলা মিডিয়াম, ভার্সন, মাদ্রাসা ও কারিগরি থেকে পাশ করা ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চ শিক্ষার জন্য বেশি সুযোগ পেয়ে থাকে, এমনকি সরকারি চাকরিতেও তাদের অবস্থান বেশ সন্তষজনক। তবে কোন বাবা-মা যদি তাদের সন্তানদেরকে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহন করাতে চান তাহলে তাদের জন্য ইংলিশ মিডিয়াম কারিকুলাম বেশ উপযোগী। সেটি এডেক্সেল হোক, ক্যামব্রিজ বা আই বি কারিকুলামে হোক তাতে কোন সমস্যা নেই। বাংলাদেশে অনেক ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে এডেক্সেল ও ক্যামব্রিজ উভয় কারিকুলাম থেকে পড়াশোনা করে ও’লেভেল এবং এ’লেভেল সার্টিফিকেট অর্জন করা যায়। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা বাংলাদেশের অন্যতম একটি ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে ভিন্ন ভিন্ন ক্যাম্পাসে এডেক্সেল-ক্যামব্রিজ কারিকুলাম ও ইংলিশ ভার্সন কারিকুলামে পড়ার সুযোগ রয়েছে। দেশের অসংখ্য শিক্ষার্থী এ প্রতিষ্ঠান থেকে ও’লেভেল এবং এ’লেভেল পাশ করে প্রতি বছর দেশের বাইরে স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করছে।
সুতরাং সন্তান কোন মাধ্যমে পড়বে বাংলা ভার্সন, ইংরেজি ভার্সন, ইংরেজি মাধ্যম নাকি মাদ্রাসা বা কারিগরি মাধ্যম-তা নির্ভর করবে মা-বাবাদের বিবেচনাপ্রসুত সিদ্ধান্তের উপরে। তবে যে মাধ্যমেই পড়ুক না কেন বিষয় ভিত্তিক জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদেরকে উৎসাহ দিতে হবে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির এ যুগে ক্যারিয়ার ভিত্তিক বিদ্যার্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা শেষ করে শিক্ষার্থীরা যেন তাদের কর্ম ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে পারে এমন দক্ষতা সম্মৃদ্ধ শিক্ষা আমাদের সমাজে এখন খুব দরকার। নেতৃত্ব দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা, উদ্যোগ দক্ষতা, ক্যারিয়ার দক্ষতা ইত্যাদি নানাবিধ দক্ষতা রয়েছে যা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জানা আবশ্যক। শুধু একাডেমিক রিজাল্ট ভালো হলেই সে ক্যারিয়ার জগতে ভালো নাও করতে পারে। তাই অভিভাবক তার সন্তানের জন্য যে শিক্ষা মাধ্যমই পছন্দ করুক না কেন তাদের শিক্ষা যেন ক্যারিয়ার ভিত্তিক শিক্ষা হয় তা নিশ্চিত করা খুবই আবশ্যক।
Discussion about this post