রাশেদ রউফ
জাতির পিতা মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষাভাবনার মূলে রয়েছে মানবসত্তার চূড়ান্ত বিকাশ। শিক্ষকদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তাঁকে শিক্ষার প্রতি মনোযোগী করে তুলেছিল। ফলে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন ত্যাগী দেশপ্রেমিক মানুষ গড়তে শিক্ষাব্যবস্থাকে তিনি ঢেলে সাজাতে সচেষ্ট ছিলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তাঁকে আমাদের ‘অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মানবিক, ধর্মনিরপেক্ষ, বিজ্ঞানমনষ্ক দক্ষ সার্থক মানুষ গড়াই ছিল তাঁর শিক্ষানীতি। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি শিক্ষা নিয়ে ভাবতেন। তাঁর সমস্ত জীবন, কর্ম, চিন্তা, চেতনা, দর্শন ও মানসগঠনে রয়েছে তাঁর শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ও প্রভাব। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা ও বিভিন্ন সূত্র থেকে তাঁর শিক্ষকদের সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমরা পেয়েছি। জানা যায়, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু লেখাপড়া করেন টুঙ্গিপাড়া গিমাডাঙ্গা এমই স্কুল, গোপালগঞ্জ সীতানাথ একাডেমি, মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুল, গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুল, গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল, কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
শৈশবে বঙ্গবন্ধুর জন্য বাড়িতে তিনজন শিক্ষক রেখেছিলেন তাঁর পিতা। একজন ইসলাম ধর্ম শিক্ষার জন্য মৌলভি সাহেব, দ্বিতীয়জন সাধারণ শিক্ষার জন্য পণ্ডিত সাখাওয়াত উল্লাহ পাটোয়ারী, তৃতীয়জন কাজী আবদুল হামিদ। বঙ্গবন্ধু মৌলভি সাহেবের কাছে আমপারা আর পণ্ডিত সাখাওয়াত উল্লাহর কাছে বাংলা বর্ণমালা ও নামতা পড়তেন এবং কাজী আবদুল হামিদের কাছে পড়তেন কবিতা-গল্প ইত্যাদি।
বঙ্গবন্ধুর জীবন-চরিত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অনেক রাশভারী ও গম্ভীর শিক্ষকও তাঁকে বিশেষ স্নেহ করতেন, যেমনটা করতেন গোপালগঞ্জ খ্রিস্টান মিশনারি হাই স্কুলের শিক্ষক গিরিশ বাবু। শিক্ষকদের সিদ্ধান্ত বা আদেশকে তিনি যেভাবে শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নিতেন তা ছিল অতুলনীয়। তিনি শিক্ষকদের কাজের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্তও করতেন। যেমনটা দেখা গেছে ছাত্রজীবনে তাঁর অন্যতম ‘আদর্শ শিক্ষক’ কাজী আবদুল হামিদের প্রতিষ্ঠিত ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র জন্য কাজে এবং পরবর্তী সময়ে এর দায়িত্ব নেওয়ার মাধ্যমে। এই ‘আদর্শ’ শিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ তাঁকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিলেন সেই প্রসঙ্গ বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘১৯৩৭ সালে আবার আমি লেখাপড়া শুরু করলাম। এবার আর পুরোনো স্কুলে পড়ব না, কারণ আমার সহপাঠীরা আমাকে পিছনে ফেলে গেছে। আমার আব্বা আমাকে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমার আব্বাও আবার গোপালগঞ্জ ফিরে এলেন। এই সময় আব্বা কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি মাস্টার সাহেবকে আমাকে পড়াবার জন্য বাসায় রাখলেন। তাঁর জন্য একটা আলাদা ঘরও করে দিলেন। গোপালগঞ্জের বাড়িটা আমার আব্বাই করেছিলেন। মাস্টার সাহেব গোপালগঞ্জে একটা ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন। যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠাতেন সকল মুসলমান বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রবিবার আমরা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাল উঠিয়ে আনতাম এবং এই চাল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার ও অন্যান্য খরচ দিতেন। ঘুরে ঘুরে জাগগিরও ঠিক করে দিতেন। আমাকেই অনেক কাজ করতে হতো তাঁর সঙ্গে। হঠাৎ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। তখন আমি এই সেবা সমিতির ভার নেই এবং অনেক দিন পরিচালনা করি। আর একজন মুসলমান মাস্টার সাহেবের কাছে টাকা পয়সা জমা রাখা হতো। তিনি সভাপতি ছিলেন আর আমি ছিলাম সম্পাদক।’
১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সময়ে টুঙ্গিপাড়ার গিমাডাঙ্গা জি টি স্কুলে বঙ্গবন্ধু পড়েছেন তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক বেজেন্দ্রনাথ সূত্রধর ও সহপাঠী সৈয়দ নুরুল হক মানিককে ঢাকা আসার জন্য খবর পাঠান। নির্দিষ্ট তারিখে তাঁরা দুজন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য গেটে উপস্থিত হয়ে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি চান। বঙ্গবন্ধু খবর পেয়ে সব প্রটোকল ভেঙে তাঁর প্রাইমারি স্কুলজীবনের শিক্ষকের কাছে নিজেই ছুটে যান এবং স্যারের পায়ে ধরে সালামের পর বুকে জড়িয়ে ধরেন। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় জানা যায়, গেটেই তখন অভাবনীয় দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। অতঃপর বঙ্গবন্ধু তাঁর শৈশবের খেলার সাথি স্কুলজীবনের বন্ধু মানিককেও জড়িয়ে ধরেন। বঙ্গবন্ধু সেই শিক্ষককে নিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী অর্থাৎ তাঁর অফিসকক্ষে। তিনি শিক্ষককে নিয়ে নিজের চেয়ারে বসিয়ে উপস্থিত মন্ত্রী, এমপিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গর্বভরে বলেন, ‘আমার শিক্ষক।’ অতঃপর বঙ্গবন্ধু তাঁর স্কুলজীবনের শিক্ষক ও সহপাঠীর নানা খোঁজখবর নেন। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শিক্ষকের হাতে কিছু টাকা দেন তাঁর ঘর তোলার জন্য।
বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৪১ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়তেন, সেই সময় এক অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য একজন মুসলমান ছাত্র অন্যায়ভাবে মারপিটের শিকার হয়। তখন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন নরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। ওই সময় বঙ্গবন্ধু স্কুলের শিক্ষকের কাছে বিষয়টির মীমাংসা চান। প্রধান শিক্ষক নরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত অন্যান্যের সহায়তা নিয়ে বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে মিটমাট করেন। ওই শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর সিদ্ধান্ত মেনে নেন। এবং সেই স্কুলে আর কখনো এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ঘটনার উল্লেখ পাই বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে। তিনি লিখেছেন- ‘১৯৪১ সালে আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেব। পরীক্ষায় পাস আমি নিশ্চয়ই করব, সন্দেহ ছিল না। রসরঞ্জন বাবু ইংরেজির শিক্ষক, আমাকে ইংরেজি পড়াতেন। আর মনোরঞ্জন বাবু অঙ্কের শিক্ষক, আমাকে অঙ্ক পড়াতেন।’ এই লেখার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আরো দুই শিক্ষকের নাম আমরা পেলাম।
ইসলামিয়া কলেজে পড়াশোনা করেন বঙ্গবন্ধু। মুতাসিম বিল্লাহ তাঁর ‘বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষাঙ্গন’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, স্পষ্টবাদিতা, সাহস, ন্যায্যতা, নিষ্ঠা, মানবিকতা ও সাংগঠনিক নেতৃত্বের কারণে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ইসলামিয়া কলেজে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৪৩ সালে মন্বন্তরের সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ওই সময় দুর্ভিক্ষের অবস্থা, বেকার হোস্টেলের ছাত্রদের সহায়তা এবং কলেজের শিক্ষক সাইদুর রহমান, আইএইচ জুবেরী, নারায়ণ বাবুসহ অধ্যাপকদের সহমর্মিতা সম্পর্কে জানা যায়। এ সময়ে বঙ্গবন্ধু লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহযোগিতায় চালু হওয়া লঙ্গরখানাগুলোয় দিনে একবার করে খাবার দিতেন। দিনভর কাজ করতেন। ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ড. জুবেরীও বঙ্গবন্ধুকে খুব ভালোবাসতেন। মন্বন্তরের সময় অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে বঙ্গবন্ধু অসুস্থ হলে অধ্যক্ষ মাঝেমধ্যে খবর নিতেন। তাঁর ভাষায়, ‘শিক্ষকরা আমাকে সকলেই স্নেহ করতেন।’ বিএ পরীক্ষা দেয়ার সময় অধ্যক্ষ বঙ্গবন্ধুকে সহায়তা করেছিলেন, সে প্রসঙ্গে তাঁর আত্মজীবনী থেকে জানা যায়। লেখক গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ জানিয়েছেন, ‘স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার সময়ও অধ্যাপক সাইদুর রহমানের পায়ে হাত দিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে দেখেছি।’
বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন শিক্ষিত জাতি ছাড়া বাংলার মুক্তি সম্ভব নয় এবং তাঁর জীবন ও কর্মে তিনি শিক্ষকের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানে অত্যন্ত আন্তরিক, শ্রদ্ধাশীল ও আবেগপ্রবণ ছিলেন। তিনি শিক্ষার্থী হিসেবে ছিলেন বিনয়ী। শিক্ষকদের প্রতি ছিল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী
Discussion about this post