ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোনও একক ব্যক্তিমাত্র নন, অবিনশ্বর এক আদর্শ ও প্রেরণার নাম। এটি একটি রাষ্ট্রের প্রতিবিম্ব। যার মধ্যে রয়েছে আন্দোলন, সংগ্রাম ও মুক্তির ঐকতান। তিনি ছিলেন স্বাধীনতার রূপকার ও অবিসংবাদিত অকুতোভয় নেতা। জাতির জন্য ‘স্বাধীনতা’ এনে দিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বদরবারে নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতিও আদায় করেছিলেন। কূটনৈতিক ভালো দক্ষতার কারণে খুব অল্প সময়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং দেশকে এগিয়ে নিতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্র সর্বদা দেশের অগ্রগতি থামানোর চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। ফলে স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছর পরই এই মহানায়ককে পরিবারসহ নৃশংসভাবে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধীরা। বেদনাবিধুর ও কলঙ্কের কালিমায় কলুষিত বিভীষিকাময় ইতিহাসের এক ভয়ংকর দিন হলো ১৫ আগস্ট। ইতিহাসের জঘন্যতম সেই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শুধু স্বাধীনতার স্থপতিকেই হারায়নি বাঙালি, দীর্ঘকালের শাসন-শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে জাতীয় জীবনের যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল তাও উল্টোপথে যাত্রা শুরু করে। এ হত্যাকাণ্ডে আমরা যেমন শোকে মুহ্যমান ও বেদনাবিধুরতায় নিমজ্জিত হই, তেমনি লজ্জিতও হই। লজ্জিত হই এজন্য, যে মানুষটি বিশ্বের বুকে বাঙালির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাকেই আমরা সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছি! এমন জাতিও পৃথিবীতে বিরল। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আবার জেঁকে বসে এ দেশের বুকে, যে স্বপ্ন-চেতনায় স্বাধীন হয়েছিল দেশ, তাও হয় অবদমিত। দুই দশকের বেশি সময় পর ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত সেই বঙ্গবন্ধুই থেকে যান অগোচরে, উপেক্ষিত থেকে যায় তার নীতি-আদর্শ। বিকৃত করা হয় ইতিহাস।
শোক হোক বাংলাদেশের শক্তি
কী বীভৎসতা সেই রাতের! একটি বাড়ি থেকে রক্তগঙ্গা বইছে, সবকিছু এলোমেলো আর প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু লাশ হয়ে। তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। নিথর দেহের পাশেই তাঁর ভাঙা চশমা ও অতি প্রিয় তামাকের পাইপটি। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করছে জাতি, তখন সঙ্গত কারণেই নবীন প্রজন্মকেও স্মরণ করিয়ে দিতে হবে, তিনি এমন একজন নেতা ছিলেন যে নিজের জীবনের চেয়ে দেশের মানুষকে বেশি ভালোবাসতেন। ফাঁসি নিশ্চিত জেনেও যিনি পাকিস্তানি কারাগারে বসে আপস করেননি স্বাধীনতার প্রশ্নে, ভয়ংকর কালরাত ১৫ আগস্টেও ঘাতকদের মেশিনগানের মুখেও ছিলেন অকুতোভয়, প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?- সেই অনির্বাণ সূর্যের প্রখর ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুর দৈহিক বিনাশ ঘটলেও তাঁর আদর্শের মৃত্যু হতে পারে না। মানুষের মৃত্যু অবধারিত কিন্তু আদর্শ অমর। এমন ব্যক্তির জীবনযাপন, চলাফেরা ও কথাবার্তা সবকিছুই অনুকরণীয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁর নাম ইতিহাস থেকে চিরতরে মুছে ফেলবে। কিন্তু তাদের সে হীন চক্রান্ত সফল হয়নি। হিংস্র ঘাতকের দর্প চূর্ণ করে বাংলাদেশ আজ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে। ফলে শোক ও স্মরণে তার সব কার্যক্রম ও চিন্তাধারাকে আমরা নিজের ব্যক্তি জীবনে লালন-পালন করতে পারলে দেশের জন্যই মঙ্গল হবে।
১৫ আগস্টের প্রেক্ষাপট
বাংলার আকাশে কালো মেঘের আনাগোনার দিন হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। কারণ, এই দিনে স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির পিতার পরিবারসহ ১৮ জনকে হত্যা করা হয়। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বারবার মিডিয়ায় বলার চেষ্টা করে যে তারা কারও দ্বারা প্ররোচিত হয়ে নয়; বরং নিজেরাই বুদ্ধি-পরামর্শ করে তাকে হত্যা করে। এমন জঘন্য কাজের পর তাদের মধ্যে কোনও অনুশোচনা, অনুতপ্ত বলে মনে হয়নি। তারা স্বীকার না করলেও একটি বিষয় স্পষ্ট যে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিদ্বয়ের মদতে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। হত্যার আগে ওই দুই দেশ থেকে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা নিয়মিত ঢাকা সফর করতে শুরু করে। তবে কাজটি করার পর সবাই ভেবে অবাক যে এমন মানুষকে আসলেই হত্যা করা সম্ভব কিনা? এই ঘটনায় মূল দায়ী হিসেবে আমরা প্রায় সবাই যাদের নাম জানি তারা হলো, খন্দকার মোশতাক, কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশিদ, মেজর ডালিম। এরা মূলত ঘাতকের কাজটি করলেও পর্দার আড়ালে থেকে যায় বিদেশি রাষ্ট্রের পরিকল্পনাকারী ও এজেন্টরা। তারা এমনভাবে পরিকল্পনা করেছিল যে কাজটি হওয়ার পর যেন তারা কোনোভাবে পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারে। আসলেই তেমনটাই হয়েছিল আর এত অল্প সময়ের মধ্যে এমন নারকীয় একটি হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন হবে সেটি কল্পনার বাইরে ছিল। ভায়াল সেই রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করতে আসা মেজর মহীউদ্দিন আসলে জানতেনই না তাকে খুন করা হবে। যদিও তার আগে সেখানে কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার পর দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করেন লোভী মোশতাক। ফলে স্বাধীন দেশে শুরু হয় ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয়। খুব অল্প দিনের মধ্যে রাষ্ট্রের সব অর্গান অকার্যকর হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের সত্যিকার অগ্রগতির পথে বাধা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চারটি মূলনীতি হলো গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র। বঙ্গবন্ধু সর্বদা চাইতেন দেশের সব মানুষের ধর্মচর্চার জায়গা থাকবে স্বাধীন। যার যা ইচ্ছে সেভাবে ধর্ম পালন করবে। প্রতিটি ধর্মের মানুষ সমান সম্মান নিয়ে দেশে বসবাস করতে পারবেন। দেশের প্রতিটি সিদ্ধান্ত হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। যেকোনও কাজে দেশের প্রতিটি মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। আর দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষরা একসঙ্গে বাংলাদেশি হিসেবে বাস করবে। সবার অধিকার সব ক্ষেত্রে সমান থাকবে। দেশে কোনও শ্রেণিবৈষম্য থাকবে না। সবাই সবকিছুতে সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সরকার ছাড়া কোনও রাজনৈতিক দলই এই চারটি মূলনীতির বিষয়ে কাজ করেনি। বরং তারা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল তৈরি ও সেভাবে কাজের নকশা করে। দেশের মানুষের মধ্যে সমান অধিকারের বিষয়ে কখনও সোচ্চার ছিল না। এসবই হলো দেশের অগ্রগতির মূল বাধা।
কলঙ্কিত রাত না এলে দেশ যেমন হতো
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খুব ভোরে বাংলাদেশের মানুষ কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার খবর শোনার। কারণ, তিনি শুধু একটি দেশের রাষ্ট্রপতি বা রাজনৈতিক নেতা নন, দেশের সব মানুষের আস্থার ব্যক্তিত্ব। আসলেই তার মতো ব্যক্তিকে যে হত্যা করা সম্ভব হবে সেটি কল্পনাও করতো না বাংলার সাধারণ মানুষ। বঙ্গবন্ধু মানেই তখন দেশ ছিল, আর তার বুক গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে অর্থাৎ দেশের বুকে আর কিছু নেই। তবে শোক না কাটতে বঙ্গবন্ধুর হত্যার কয়েক ঘণ্টা পর রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথগ্রহণ করেন ক্ষমতালোভী মুশতাক। এই রাতের পর থেকে দেশের সব গণতান্ত্রিক চর্চা বন্ধ হয়ে যায়, রাষ্ট্র পরিচালনা করতে শুরু করে সামরিক লোকজন। এতে প্রতিনিয়ত স্বাধীনতা পাওয়া দেশের মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও পছন্দ-অপছন্দের জায়গা সংকুচিত হতে থাকে। ফলে স্বাধীনতা অর্জন হওয়ার পর প্রকৃত স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয় দেশের মানুষ। ঘন ঘন সামরিক শাসক পরিবর্তন হলেও দেশের কোনও লাভ হয়নি। বরং সামরিক সরকাররা বারবার দুর্নীতি উচ্ছেদ ও গণতন্ত্রের আশ্বাস দিলেও কাজের কাজ কিছু করেনি। এই হত্যাকাণ্ড না ঘটলে দেশ আরও আগে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতো। অর্থনৈতিক অবস্থা আরও অনেক বেশি ভালো হতো। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা আরও অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতো। এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরনে। বাবার আদর্শে গড়া দলকে আবারও নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। পরে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসেন এবং বিকৃত ইতিহাসগুলো মুছে মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস প্রজন্মের সামনে নিয়ে আসেন। পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যার বিচার সম্পন্ন করেছেন তার আদর্শ কন্যা। বর্তমানে তার হাত ধরেই বাংলাদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপ নিয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পথে বাংলাদেশ
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘নারীদেরও সমান অধিকার প্রদান করা হবে। তারা আর দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক থাকবে না।’ যুদ্ধে বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু প্রণীত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে নারীর সমঅধিকার বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একটি বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলেন, যেখানে নারী-পুরুষ কোনও ভেদাভেদ থাকবে না। এমন একটি বাংলাদেশ জাতির পিতা চেয়েছিলেন যেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে সমানভাবে নারীরও অংশগ্রহণ থাকবে। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করেন। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায়ও তিনি নারীদের মন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু নির্যাতিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবে ভূষিত করেছিলেন। ‘বীরাঙ্গনা’ অর্থ ‘বীর নারী’। তিনি এভাবে নারীদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ড’। নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন এবং আবাসনের জন্য এ বোর্ড গঠিত হয়েছিল। আজকের বাংলাদেশের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখতে পাই, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষ সমান তালে অংশগ্রহণ করছে। রাজনীতি কিংবা অর্থনীতি, শিক্ষা কিংবা চিকিৎসা, প্রতিরক্ষা, আইটি কিংবা দেশের জন্য পরিকল্পনা প্রতিটি ক্ষেত্রেই অংশ নিচ্ছেন নারীরা। দেশের এই চিত্রই বলে দেয়, ষড়যন্ত্রকারীদের বাংলার মানুষ ঘৃণার আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে। আর জাতির পিতার স্বপ্নেরই বাস্তবায়ন ঘটেছে।
লেখক: অধ্যাপক; সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি); পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) এবং প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি, আমরাই ডিজিটাল বাংলাদেশ।
Discussion about this post