উদিসা ইসলাম
ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন, কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভানেত্রীও নির্বাচিত হয়েছেন। তিনিই অন্যতম, যিনি অত্যন্ত কাছে থেকে দেখেছেন পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন। জেল-জুলুম-অত্যাচার-মামলা উপেক্ষা করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন। তিনি চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। আজ তার জন্মদিন।
শেখ হাসিনার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন ঠিক কবে থেকে শুরু তার উল্লেখ করা মুশকিল। যারা তাকে দেখেছেন পুরো সময়জুড়ে তারা বলছেন, শেখ হাসিনা টানা ৪২ বছর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে রয়েছেন বটে কিন্তু তার জীবনের শুরু থেকেই রাজনীতি জড়িত। শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সদস্য ও রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইতে তিনি তার ছেলেবেলার রাজনীতির পরিবেশ ও রাজনীতির প্রতি টানের বিষয়ে লিখেছেন বিস্তর। তিনি লিখছেন, ‘১৯৬৬ সালের কথা মনে আছে। কয়েক দিন ধরে আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির সভা চলছিল। আমার তখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। প্রথম বর্ষের কয়েকটা বিষয়ের পরীক্ষা হবে, যার নম্বর দ্বিতীয় বর্ষে যোগ হবে। কিন্তু পড়ব কি! মিটিং চলছে বাড়িতে, মন পড়ে থাকে সেখানে। একবার পড়তে বসি আবার ছুটে এসে জানালার পাশে বসে মিটিং শুনি। সবাইকে চা বানিয়ে দিই। যাক সেসব। বিকেলে নারায়ণগঞ্জে বিশাল জনসভা হয় ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য। আব্বার ফিরতে বেশ রাত হলো। আমরা অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় বসে জনসভার গল্প শুনলাম। সেই জনসভায় আব্বাকে ছয় দফার উপর একটা সোনার মেডেল উপহার দেওয়া হয়েছিল। রাত বারোটায় আব্বা শুতে বিছানায় গেলেন। আমি পড়তে বসলাম।’
জেল-জুলুমের বন্ধুর পথ
রাজনীতিবিদ পিতার ঘরে জন্ম নিলেও তিনি আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় রাজনৈতিক দলের সভাপতি হবেন এবং হাল ধরে এগিয়ে নেওয়ার গুরুদায়িত্ব তার ওপরই বর্তাবে, এমন কোনও পরিকল্পনাই ছিল না। মনে করার কারণ নেই পিতার হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছেন। মনে করার কারণ নেই বঙ্গবন্ধুকন্যা হিসেবে তিনি বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন। বরং পিতার মৃত্যুর পর দেশে ফিরতে অপেক্ষা করতে হয়েছে বছরের পর বছর।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা সে সময় পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় বেঁচে যান। পরবর্তীকালে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ে ৬ বছর ভারতে অবস্থান করেন। ১৯৮০ সালে ইংল্যান্ডে থেকে তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন।
১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁকে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষ করে অবশেষে তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার পরপরই তিনি শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন। তাঁকে বারবার কারান্তরীণ করা হয়। হত্যার জন্য কমপক্ষে ১৯ বার সশস্ত্র হামলা করা হয় তাঁকে।
১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সামরিক সরকার তাঁকে আটক করে ১৫ দিন অন্তরীণ রাখে। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি এবং নভেম্বর মাসে তাঁকে দু’বার গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৮৫ সালের ২মার্চ তাঁকে আটক করে প্রায় ৩ মাস গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ১৯৮৬ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে তিনি ১৫ দিন গৃহবন্দি ছিলেন। ১৯৮৭ সালে ১১ নভেম্বর তাঁকে গ্রেফতার করে এক মাস অন্তরীণ রাখা হয়। ১৯৮৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা গ্রেফতার হয়ে গৃহবন্দি হন। ১৯৯০ সালে ২৭ নভেম্বর শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু ভবনে অন্তরীণ করা হয়। এরপরও তিনি ২০০৭ সালে আবারও কারাবন্দি হন।
মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় অবিচল শেখ হাসিনা
বৈশ্বিক ও জাতীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নতুন নতুন নাম পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন সময়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালায় জঙ্গিগোষ্ঠী। বিশ্বে যখন সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে, তখন সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল হয়ে উঠেছে শেখ হাসিনার কঠোর অবস্থানের কারণে। উগ্রবাদের বিস্তার ও জঙ্গিবাদ দমনে শেখ হাসিনার শূন্য সহিষ্ণুতা নীতির ফলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে। তার এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে সাহসী পদক্ষেপ তিনি নেন ২০০৯ সালে। সরকার পরিচালনায় দায়িত্ব নিয়ে তাঁর সরকার ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল স্থাপনের জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের আওতায় স্থাপিত ট্রাইবুনাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে এবং প্রথম সারির অপরাধীদের মামলাগুলোর রায় কার্যকর করা হয়।
শেখ হাসিনার সাহসের কথা উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, শেখ হাসিনার শক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো তাঁর সম্মোহনী শক্তি, তিনি সাহসী। শেখ হাসিনা সাহসী না হলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হতো না, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতো না।
৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬, সাপ্তাহিক রোববারে প্রকাশিত লেখায় উঠে আসে তার শেষ সময়ে কীভাবে নিজেকে ফিরে পেতে চান, সেই কথা। তিনি লিখেছেন, ‘বাবার কাছাকাছি বেশি সময় কাটাতাম। তাঁর জীবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক আলোচনা করার সুযোগও পেতাম। তাঁর একটা কথা আজ খুব বেশি করে মনে পড়ে। তিনি প্রায়ই বলতেন “শেষজীবনে আমি গ্রামে থাকব। তুই আমাকে দেখবি। আমি তোর কাছেই থাকব।” কথাগুলো আমার কানে এখনও বাজে। গ্রামের নিঝুম পরিবেশে বাবার মাজারের এই পিছুটান আমি পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন, আমাকে বার বার আমার গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। আমি এখন নিজেকে রাজনীতির সঙ্গে নিয়েছি। দেশ ও জনগণের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করতে পেরে আমি গর্বিত। আমার জীবনের শেষ দিনগুলো আমি টুঙ্গিপাড়ায় স্থায়ীভাবে কাটাতে চাই। খুব ইচ্ছে আছে নদীর ধারে একটা ঘর তৈরি করার। আমার বাবা-মার কথা স্মৃতিকথামূলকভাবে লেখার ইচ্ছে আছে। আমার বাবা রাজনীতিবিদ মুজিবকে সবাই জানতেন। কিন্তু ব্যক্তি মুজিবও কত বিরাট হৃদয়ের ছিলেন, সেসব কথা আমি লিখতে চাই।’
Discussion about this post