ড. মোঃ মাহমুদুল হাছান
শিক্ষার কালক্রম উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে শিখন ও শিক্ষণ পদ্ধতিতে রুপান্তর খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা শিক্ষকদের সৃষ্টিশীলতা ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহনমূলক পাঠগ্রহনেচ্ছার মাধ্যমেই প্রতিফলিত হয়ে থাকে। যুগ যুগ ধরে শিক্ষার যে রুপান্তর আমরা দেখতে পেয়েছি, কোভিড-১৯ পরবর্তীতে এটির ধরণ ও কৌশলধারা একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংঘটিত হয়েছে, যেখানে শিক্ষকদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে কাঠামোবদ্ধ পদ্ধতি থেকে অনলাইন পদ্ধতিতে রুপান্তরিত হওয়ার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। মূলতঃ শিক্ষায় রূপান্তর বলতে প্রচলিত শিক্ষাগত মডেলের পদ্ধতিগত পরিবর্তনকে বোঝায়। মডেলের কিছু উপাদানের সংস্কার এবং তাত্বিকভাবে সেটিকে রক্ষা করা, ঐতিহ্যগত শিক্ষা ও শেখার প্রক্রিয়াগত উপাদান বজায় রাখা এবং এর সংগঠন ও কাঠামোগুলিতে যুগোপযোগী সমন্বয় সাধনকেই শিক্ষার রুপান্তর বলা হয়ে থাকে।
এবার বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২২ এর প্রতিপাদ্য বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, “শিক্ষক দিয়ে শিক্ষার রূপান্তর শুরু হয় (The transformation of education begins with teachers”)। জাতিসংঘ (ইউনেস্কো) কোভিড-১৯ মহামারীর গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে তাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও পরিশ্রমী প্রচেষ্টার সম্মানে শিক্ষক দিবসের এই প্রতিপাদ্য উপস্থাপন করেছেন।
বিশ্ব যত দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে, শিক্ষার পদ্ধতি প্রচলিত শিক্ষা থেকে প্রযুক্তিগত, দক্ষ, পেশাদার এবং ভার্চুয়াল শিক্ষায় পরিবর্তিত হয়েছে। জাতিসংঘ (ইউনেস্কো) অতিমারী কোভিড-১৯ এর সময় সেই শিক্ষকদের প্রচেষ্টাকে সম্মান জানাতে এই থিমের সুপারিশ করেছে। করোনাকালে সারা বিশ্বের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল এবং সমস্ত মানুষ হতাশাগ্রস্ত ও আতঙ্কিত ছিল। শিক্ষার ভবিশ্যত অনিশ্চিত এক গন্তব্যের দিকে ধাপিত হতে যাচ্ছিলো। কিন্তু সেটি আমাদের শিক্ষকদের নিষ্ঠা ও সাহসকে অস্থিতিশীল করতে পারেনি। আমাদের শিক্ষকরা জানতেন যে মহামারী চলাকালীন কোনও শারীরিক উপিস্থিতির ক্লাস হবে না, তাই তারা তাদের শিক্ষার পদ্ধতিকে পুরোপুরি রূপান্তরিত করেছিলেন। শিক্ষার্থীরা ঘরবন্দিই ছিলো এবং শিক্ষকরাও ছিলেন শিক্ষাঙ্গনের বাইরে, কিন্তু তারপরও শিক্ষা কখনও থেমে থাকেনি বা বিরতিও নেয়নি। বরং শিক্ষকদের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা ও তাদের আত্মত্যাগের ফলে শিক্ষাধারা নতুনভাবে নতুন কৌশলে অব্যাহত ছিলো। টিচিং স্ট্রাটেজিতে এটিই হলো শিক্ষার রুপান্তর প্রক্রিয়া।
করোনাকালে শিক্ষকদের এ অদম্য সাহসী পদক্ষেপ ও সার্বিক সহায়তার ফলে, আজ এ ধারণাটিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, ভবিষ্যতে যে কোন দুর্যোগের সময় আমাদের শিশুদের শিক্ষাগত ক্ষতি নিয়ে আমাদের চিন্তা করার দরকার নেই। শিক্ষার পদ্ধতি যাই হোক না কেন, সর্বদা আমাদের শিক্ষকদের সেবারই প্রয়োজন হবে। তাই, “শিক্ষার রূপান্তর শুরু হয় শিক্ষক দিয়ে” এ থিমটি সারা বিশ্বের সকল শিক্ষক সম্প্রদায়ের কাছে একটি প্রশংসনীয় প্রশংসাপত্র হিসেবে স্বিকৃত হয়েছে।
করোনা অতিমারির ফলে আমাদের শিক্ষা অনেকটা সংকটের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলো এবং লক্ষ লক্ষ শিশু শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এজন্য আমাদেরকে অনেক মূল্যও দিতে হয়েছে। সংকটাপন্ন এ শিক্ষায় বৈষম্য মোকাবেলা করতে, সমস্ত শিশুর মৌলিক দক্ষতা অর্জন নিশ্চিত করতে এবং ডিজিটাল পরিবর্তনগুলি নেভিগেট করতে আমাদের শিক্ষার পুনর্বিবেচনা করা আবশ্যক হয়েছে। পরিবর্তন ও রুপান্তরের এ মহান কাজটিও করেছেন আমাদের সম্মানীত শিক্ষকগণ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজ অনেক শিক্ষক কম প্রশিক্ষিত, অবমূল্যায়িত এবং কম বেতনভুক্ত। শিক্ষার পরিবর্তন ও রুপান্তর আনতে শিক্ষকদেরকেও তাদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে সম্মান করতে হবে। শিক্ষায় বৈপ্লবিক রুপান্তর সাধন করতে শিক্ষকদের দক্ষতা, স্বীকৃতি, সম্মান এবং তাদের প্রাপ্য পারিশ্রমিক প্রদানের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরো উদার ও প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী হতে হবে।
শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক শিক্ষণ পদ্ধতি সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষার চারটি রূপান্তর চিহ্নিত করা হয়েছে, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক বেশি কার্যকর।
(ক) কর্মসম্পাদন (পারফরম্যান্স) : শিক্ষক তার অর্জিত অভিজ্ঞতা ও বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদেরকে যে পদ্ধতিতে শিক্ষা দিয়ে থাকেন তাই কর্মসম্পাদন বা পারফরম্যান্স রুপান্তর। শিক্ষায় সফল হওয়ার জন্য, যেকোনো সংস্কার প্রচেষ্টার প্রথম অগ্রাধিকার হল শিক্ষা প্রদান ও গ্রহনের জন্য শক্ত স্থাপনা তৈরি করা, শিক্ষা ব্যবস্থার কর্মক্ষমতাকে শক্তিশালী করা এবং শিখণফলকে নিশ্চিত করা।
(খ) উদ্ভাবন (ইনোভেশন): শিক্ষাধারায় নিজেকে মানিয়ে নিয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জন্য যে নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করে থাকেন তাই উদ্ভাবন বা ইনোভেশন রুপান্তর। সফল শিক্ষা ব্যবস্থাকে আগামীতে ঘটতে পারে এমন যেকোন শিক্ষা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সঠিক ফলাফল অর্জনের জন্য নতুন এবং সৃজনশীল পদ্ধতির বিকাশ করা। আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষায় ইনোভেশনের সংযুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
(গ) অন্তর্ভুক্তি (ইনক্লুসিভ): সকল শিক্ষার্থীর জন্য একই শিক্ষাধারা নিশ্চিত করাই হলো অন্তর্ভুক্তি বা ইনক্লুসিভ রুপান্তর। সফল শিক্ষা ব্যবস্থা অবশ্যই সকলের কাছে পৌঁছাতে হবে, যার মধ্যে সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত এবং প্রান্তিক শিক্ষার্থীও রয়েছে। আলোচ্য রুপান্তর পদ্ধতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শেখার ব্যবধান বন্ধ করা যাবে না, যদি না শিক্ষকরা শেখার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করার এবং সমর্থন করার জন্য অতিরিক্ত পদক্ষেপ না নেন। দরিদ্র, বৈষম্যের শিকার, কন্যশিশু এবং যারা বঞ্চনার সম্মুখীন হয় তাদের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
(ঘ) অর্থনৈতিক (ফিন্যান্স) : ভালো ও অন্তর্ভুক্তি শিক্ষাপদ্ধতি নিশ্চিত করতে বেশি অর্থ বিনিয়োগ করাই হলো অর্থনৈতিক রুপান্তর। সফল শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য বেশি এবং ভালো বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। প্রতিটি শিশুর প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে মানসম্পন্ন শিক্ষার সুযোগ রয়েছে তা নিশ্চিত করার জন্য এবং উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কলারশিপ প্রদান করার জন্য এ বিনিয়োগটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যার বাস্তবায়ন স্থানীয় ও জাতীয় সংস্থার পজিটিভ পদক্ষেপের উপর নির্ভর করে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অংশীদারিত্ব ও নেতৃত্ব দ্বারা সমর্থিত বিনিয়োগ এবং সংস্কারের প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন বিবেচনা করা যেতে পারে।
রূপান্তরের এ অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়সঙ্গত মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে এবং সকলের জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ উন্নীত করতে শিক্ষকদের নৈতিক সহযোগিতা ছাড়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। এস ডি জি-৪ এ বলা হয়েছে যে, শিক্ষার রুপান্তর কেবল একটি নৈতিক আবশ্যকতা নয়, এটি একটি দেশ সেরা অর্থনৈতিক বিনিয়োগও হতে পারে, যার ফলে শিক্ষায় রাজস্ব আসতে পারে, ভবিষ্যতের অর্থের সঞ্চয় আসতে পারে এবং ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে।
সুতরাং শিক্ষায় রুপান্তর আনতে যতগুলো কৌশল ও পদক্ষেপ নেয়া হোক না কেন, সবকিছুর মূলে রয়েছে আমাদের শিক্ষক সম্প্রদায়। আমরা দেখি যে, সমস্ত শিশুর শিক্ষার উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার জন্য শিক্ষককে প্রথমে শিক্ষার বৈষম্য কমানোর উদ্ভাবনী উপায়গুলির কথা ভাবতে হয়, যা পাঠ্যক্রম সমাপ্তির পরিবর্তে শিক্ষা ব্যবস্থাকে শিক্ষার অগ্রগতির দিকে নিয়ে যায়। শিক্ষার স্টেকহোল্ডার এবং দাতাদের অবশ্যই বিভিন্ন প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শদান পদ্ধতির মাধ্যমে শেখার ফলাফলকে কার্যকর এবং দক্ষতার সাথে উন্নত করতে এক্ষেত্রে সরকারকেও সহায়তা প্রদান করতে হবে।
যেসকল শিক্ষার্থী পিছিয়ে থাকে বা শিক্ষায় ধীরগতিসম্পন্ন, শিক্ষকরা তাদের দিকেও ফোকাস করে অভিনব উপায় খুঁজে বের করে থাকেন, যাতে নিশ্চিত করা যায় যে সমস্ত শিক্ষার্থীরা ফলাফল-ভিত্তিক নির্দেশনামূলক কৌশলগুলি গ্রহণ করতে পারে। শিক্ষায় উদ্ভাবনগুলিকে পর্যাপ্ত গ্রহণ ও সমর্থন অর্জনের জন্য শিক্ষককে একটি সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা হিসাবে প্রবর্তন করতে হয়। তাছাড়া, শিক্ষার স্টেকহোল্ডারদের পরিকল্পনা, বিনিয়োগ এবং বাস্তবায়নের পর্যায়গুলি নির্ধারণ করে শিক্ষার সকল প্রোগ্রাম কাস্টমাইজ এবং স্কেলেবিলিটি ঠিক করার জন্য উদ্ভাবনে সহযোগিতা করেও থাকেন এ শিক্ষকরাই।
কোভিডোত্তর এ সময়ে শিক্ষার্থীদের শেখার পদ্ধতিতে যেমন পরিবর্তন এসেছে, বিকশিত হয়েছে তেমন আমাদের শিক্ষকদের শিক্ষণ কৌশল। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাবে শিক্ষা পদ্ধতিতে এসেছে আমূল পরিবর্তন ও বৈপ্লবিক রুপান্তর। বিজ্ঞান নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করে এবং শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যায় রুপান্তরের এক নতুন অধ্যায়ে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, ইন্টারনেট অফ থিংকিং এবং রোবোটিক্স দ্বারা শিক্ষায় প্রবর্তিত বিস্ময়কর উদ্ভাবন আমাদের শেখানো এবং শেখার পদ্ধতিকে পরিবর্তন করেছে। সুতরাং, রুপান্তরিত শিক্ষণ-শিখণ প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের যে অত্যাধুনিক কলা-কৌশল আবিস্কৃত হয়েছে তাতে প্রান্তিকে অবস্থিত সকল শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রতি আরো মনোনিবেশ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাই আসুন, আমরা সকলে মিলে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাপনায় শিক্ষকদেরকে সামাজিকভাবে সম্মানিত করি এবং শিক্ষাদান কৌশলে অভিনব সহায়ক সামগ্রী সংগ্রহের ব্যবস্থা করি, তাহলে সর্বস্তরে শিক্ষার রুপান্তর ফলপ্রসূ হবে এবং দেশে শিক্ষার মান উন্নত হবে। কারণ, শিক্ষক দিয়েই শুরু হয় শিক্ষার রুপান্তর।
Discussion about this post