প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
এই অঞ্চলের প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি ইডেন মহিলা কলেজ। স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠা থেকে ধরলে এর বয়স দেড়শ বছর। শুধু অন্যতম প্রাচীন বলেই নয়, এই অঞ্চলের নারী শিক্ষা বিস্তারে ইডেন কলেজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দেড়শ বছর আগে নারীদের জন্য আলাদা একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং সেটি সেটি চালিয়ে রাখা অনেক লড়াইয়ের ব্যাপার।
তাই দেড়শ’ বছরের পুরোনো একটি মহিলা কলেজ যে কোনো দেশের জন্য, যে কোনো এলাকার জন্য গৌরবের, অহঙ্কারের। শুধু শিক্ষা বিস্তার নয়, নারীদের রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ার ক্ষেত্রেও ইডেন কলেজের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তবে রাজনৈতিক সচেতনতার পাশাপাশি রাজনৈতিক সংঘাতেও পিছিয়ে নেই ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় হেলেন জেরিন খানদের মাস্তানির কথা সারাদেশের মানুষ জেনেছে। তবে গত এক যুগ ধরে বাংলাদেশের আরো অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত ইডেন কলেজও ছাত্রলীগের একক নিয়ন্ত্রণে। তাই সে অর্থে কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছিল না অনেকদিন। কিন্তু প্রতিপক্ষ না থাকায় ছাত্রলীগ এবার নিজেরাই দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে।
অনেকদিন পর দেশবাসী ইডেনের ছাত্রীদের চুলাচুলির ছবি দেখেছে। সম্প্রতি ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে সিট বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে গণমাধ্যমে কথা বলেন কমিটির সহ-সভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌসী। এরপর রিভা ও রাজিয়ার উপস্থিতিতে জান্নাতুলকে মারধর করার অভিযোগ ওঠে। এ নিয়েই ছাত্রলীগের দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব, মারামারি। অভিযোগ ওঠার পর ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি অভিযুক্তদের নয়, অভিযোগকারীদের বহিষ্কার করে।
অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের আলাদা আলাদা গ্রুপ থাকে। ইডেনেই ব্যতিক্রম। এখানে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জোটবদ্ধ। আর তাদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগেরই কমিটির অন্য নেত্রীরা অভিযোগ আনছেন। অভিযোগের বহর অনেক লম্বা- আবাসিক হলের সাধারণ শিক্ষার্থীদের জোর করে রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেওয়া, প্রতিবাদ করলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, বিনা কারণে ছাত্রীদের মারধর ও গালমন্দ করা, হল থেকে বের করে দেওয়া, ব্যক্তিগত কাজে সাধারণ ছাত্রীদের ব্যবহার, সিটবাণিজ্য, ইডেন কলেজের পাশে ফুটপাথে বিভিন্ন দোকান থেকে চাঁদাবাজি ইত্যাদি ইত্যাদি।
কদিন আগে এক ছাত্রীকে হুমকি দিয়েছিলেন তামান্না জেসমিন রিভা। তার সে হুমকির অডিও ভাইরাল হয়েছিল। তার যে ভাষা, যে ভঙ্গি তা লজ্জিত করেছে সবাইকে। পরে অবশ্য রিভা ফেসবুকে ক্ষমাও চেয়েছিলেন। তবে অডিও কেলেঙ্কারির রেশ কাটতে না কাটতেই এখন অন্তর্দ্বন্দ্বের আগুনে পুড়ছে ইডেন।
অভিযোগটি সত্য নাকি নিছকই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য আনা, আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু অভিযোগটি গুরুতর এবং এই অভিযোগটি বাকি সব অভিযোগের মত উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। আর এটি নিছক রাজনৈতিক অভিযোগ নয়, তাই নিছক সাংগঠনিক ব্যবস্থায় এটি নিষ্পত্তির সুযোগ নেই।
যে অভিযোগ আনা হয়েছে দেশের প্রচলিত আইনে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অনুরোধ তারা যেন অভিযোগটি খতিয়ে দেখেন। প্রয়োজনে নিয়মিত মামলা দায়ের ও তদন্তের মাধ্যমে যেন সত্যটা তুলে আনা হয়। আমি চাই অভিযোগটা মিথ্যা হোক। যদি মিথ্যা হয়, তাহলে যেন অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। তবে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির অধঃপতিত হতে হতে যে তলায় নেমেছে, তাতে অভিযোগটি সত্যি হতেও পারে। সত্যি হলে যারা এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত তাদের সবার বিরুদ্ধে যেন প্রচলিত আইনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। এবং এই ঘটনার আর কোনো পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে তা কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
অভিযোগটি গুরুতর, কারণ এর সাথে নারীর সততা, সম্ভ্রম, ইডেন কলেজের ভাবমূর্তি জড়িত। অভিযোগটি আসার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানান মত আসছে। একটি পক্ষ, দেড়শ বছরের ঐতিহ্যবাহী ইডেন কলেজের সম্মান ধুলায় মিটিয়ে দিতে মরিয়া। ইডেন কলেজে এখন ৩৫ হাজারের বেশি ছাত্রী পড়াশোনা করছে। এই মহলটি ইডেন কলেজের সকল শিক্ষার্থীর নৈতিকতা, সততা নিয়েই প্রশ্ন তুলছে। শুধু বর্তমান শিক্ষার্থীই নয়, ইডেন কলেজের সকল শিক্ষার্থীর সততা নিয়েই তারা প্রশ্ন তুলতে চাইছে।
অভিযোগটি সত্য না মিথ্যা সেটা নিষ্পত্তি করা জরুরি। কারণ এমনিতেই বাংলাদেশের একটি মহল নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে। এই অভিযোগকে তারা বড় অস্ত্র হিসেবে বছরের পর বছর ব্যবহার করবে। ঢাকার বাইরে থেকে পগড়তে আসা অনেক মেয়ে ইডডেন কলেজের হোস্টেলে থাকেন। এই অভিযোগ আসার পর মেয়েদের ঢাকার পড়তে পাঠানো বা হোস্টেলে রাখার ব্যাপারে দ্বিধায় ভূগবেন অভিভাবকরা।
এমনিতেই বাংলাদেশের মেয়েদের পড়াশোনা করতে অনেক প্রতিবন্ধকতা ডিঙাতে হয়। এই অনির্দিষ্ট অভিযোগ তাদের সে লড়াইকে আরো কঠিন করে তুলবে। নারীদের সাফ ফুটবল জয় নারীদের লড়াইয়ের পথ কিছুটা হলেও সহজ করতে পেরেছিল। এই অভিযোগ সেই পথকে আরো বন্ধুর করে তুলবে।
আমি ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রতি অনুরোধ করছি, ফেসবুকের ট্রল দেখে আপনারা মন খারাপ করবেন না। নিজের সততায়, নিজের নৈতিকতায় আস্থা রাখুন। আর চোখ কান খোলা রাখুন। সত্যি যদি এমন কোনো ঘটনা ঘটতে দেখেন, হাতেনাতে তাদের ধরে ফেলুন, প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।
ইডেন কলেজে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব আপনাদেরও। আবারও বলছি, যে অভিযোগটি এসেছে, তা নিয়ে আপনারা মন খারাপ করবেন না। এ কলঙ্ক ইডেন কলেজের নয়; এ কলঙ্ক, এ লজ্জা, এ গ্লানি আমাদের অধঃপতিত ছাত্র রাজনীতির।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
Discussion about this post