ড. মইনুল ইসলাম
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম কর্তৃক প্রকাশিত ‘দ্য স্টোরি অব ভিয়েতনামস ইকোনমিক মিরাকল’ শীর্ষক নিবন্ধটিকে ফোকাস করে কিছু আলোচনা-বিশ্লেষণ এই কলামে তুলে ধরছি। ভিয়েতনাম প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে ১৯৭৫ সালে, বাংলাদেশের চার বছর পর। তিন দশকের চরম-বিধ্বংসী স্বাধীনতাযুদ্ধের কারণে ওই সময় ভিয়েতনাম বাংলাদেশের মতো বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হিসেবে বিবেচিত হতো। বিশ্বের জনগণের কাছে ভিয়েতনাম হলো সবচেয়ে বেশি রক্ত-ঝরানো স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয়ী দেশ। সমাজতন্ত্রী ভিয়েতনাম বিশ্বের একমাত্র দেশ, যে দেশটি বিশ্বের দু-দুটো সুপার পাওয়ার ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত করে নিজেদের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে, ফ্রান্স পরাজয় বরণ করেছে ১৯৫৪ সালে এবং যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৫ সালে।
বাংলাদেশকেও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের জীবন এবং ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বিজয় অর্জন করতে হয়েছে। বিজয় অর্জনের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ হিসেবে, যেখানে রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি ছিল জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। এই দুটো দেশের জনগণের মুক্তিযুদ্ধকে ইতিহাস চিরদিন পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম যখন স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল, তখন ‘জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়’—সুকান্তের এই অবিস্মরণীয় কবিতার লাইনটি আক্ষরিকভাবে প্রযোজ্য ছিল ভিয়েতনামের বীর জনগণের ক্ষেত্রে। যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য স্বাধীন ভিয়েতনামকে মার্কিনরা অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে পঙ্গু রাখারও ব্যবস্থা করেছে দুই দশক। এতদ্সত্ত্বেও ভিয়েতনাম কখনোই কোনো দেশের কাছে মাথা নত করেনি, ভিক্ষার জন্য হাত পাতেনি।
এমনকি অনুদান ও ‘সফট লোনের’ আশায় জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত হতেও আবেদন করেনি। অথচ, কী দারুণ কষ্টকর ছিল ১৯৭৫-পরবর্তী বছরগুলোতে ভিয়েতনামের জনগণের জীবন! ভিয়েতনামের জনগণের মাথাপিছু আয় ১৯৭৪ সালে ছিল মাত্র ৬৫ ডলার, ১৯৮৫ সালে ছিল ২৮৫ ডলার। ২০২১ সালে আইএমএফের প্রাক্কলন মোতাবেক ভিয়েতনামের মাথাপিছু নমিনাল আয় ৩ হাজার ৩৫৬ ডলারে পৌঁছে গেছে, যেটাকে ‘মিরাকল’ আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ক্রয়ক্ষমতার সমতা (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি) ভিত্তিতে ভিয়েতনামের মাথাপিছু আয় ২০১৭ সালে ছিল ৬ হাজার ৭৭৫ পিপিপি ডলার, আর ২০২১ সালে তা পৌঁছে গেছে ৮ হাজার ৫৯ পিপিপি ডলারে। ভিয়েতনামের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০০৫ সালে সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল, এক দশক ধরে তা ৬ দশমিক ৫ থেকে ৭ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রয়ে গেছে। ২০২১ সালে ভিয়েতনামের মাত্র ৫ শতাংশ জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে বলে প্রাক্কলিত হয়েছে। ২০২২ সালে ভিয়েতনামের মানব উন্নয়ন সূচক শূন্য দশমিক ৬৯, যেখানে বাংলাদেশের সূচক এখনো শূন্য দশমিক ৬২। মানব উন্নয়ন সূচকের বিশ্বের র্যাঙ্কিংয়ে ভিয়েতনামের অবস্থান ১১৫ নম্বরে, বাংলাদেশের অবস্থান ১২৯।
ভিয়েতনামের এই মিরাকলের পেছনের কাহিনি কী? ভিয়েতনামের রাষ্ট্রনেতারা এখনো তাঁদের রাষ্ট্রকে ‘সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম’ হিসেবেই অভিহিত করে থাকেন, কিন্তু ১৯৮৬ সালে ‘দোই মোই’ সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার ৩৬ বছর পর এখন পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক উন্নয়ন-চিন্তকেরা ভিয়েতনামের অর্থনীতিকে ‘সোশ্যালিস্ট-ওরিয়েন্টেড মার্কেট ইকোনমি’ হিসেবে বর্ণনা করছেন।
দোই মোই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের প্রধান তিনটি ডাইমেনশন হলো: ১. অত্যন্ত শক্ত হাতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য উদারীকরণ, ২. অত্যন্ত দ্রুত অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির বি-নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি হস্তক্ষেপ হ্রাসের মাধ্যমে ব্যবসা করার খরচ ও বাধাবিঘ্ন কমিয়ে ফেলা এবং ৩. রাষ্ট্রীয় খাতের বিনিয়োগ প্রবলভাবে জোরদার করার মাধ্যমে মানব উন্নয়ন (শিক্ষা) ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নকে প্রথম অগ্রাধিকারে পরিণত করা। বিশেষত, প্রাইমারি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক (ভোকেশনাল) শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে ভিয়েতনাম ২০০০ সালের মধ্যেই তার পুরো জনসংখ্যাকে শতভাগ শিক্ষিত ও জনগণের বিশাল একটি অংশকে প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনে সফল করে তুলেছে। একইভাবে উল্লেখযোগ্য যে ভিয়েতনাম তার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বৈষম্য তেমন একটা বাড়তে দেয়নি।
ভিয়েতনামের জনগণের ৯১ শতাংশ ২০২১ সালে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় সেবা পেয়ে চলেছে। জনসংখ্যা নীতির ব্যাপারে ভিয়েতনাম কঠোরভাবে ‘দুই সন্তান নীতি’ অনুসরণ করে চলেছে, যে নীতিটা বাংলাদেশের বহু আগেই নেওয়া উচিত ছিল। আয় ও সম্পদবৈষম্যের ক্ষেত্রেও ভিয়েতনাম অত্যন্ত সযতনে বৈষম্য বৃদ্ধির প্রবণতাকে প্রতিরোধ করে যাচ্ছে। আয়বৈষম্য পরিমাপক জিনি সহগ ২০১৬ সালে ভিয়েতনামের ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৩৫৩, আর বাংলাদেশের ২০১৬ সালে হয়ে গেছে শূন্য দশমিক ৪৮৩ (মানে, অনেক বেশি আয়বৈষম্য বাংলাদেশে)। বাংলাদেশ ধনকুবের প্রবৃদ্ধির হারে ২০১৭ সালে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করলেও ভিয়েতনাম সক্রিয়ভাবে ধনাঢ্য ব্যক্তি সৃষ্টিকে নিরুৎসাহিত করে চলেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফলকে কয়েকটি নগরে কেন্দ্রীভূত না করে ভিয়েতনাম গ্রামীণ জনগণের মাঝে উন্নয়নের সব ডাইমেনশনকে পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর।
১৯৯৫ সালে ভিয়েতনাম আসিয়ানের সদস্য হয়েছে। একদা চরম শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২০০০ সালে এবং পরে গণচীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ এক ডজন দেশের সঙ্গে ‘ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট’ করেছে ভিয়েতনাম, যার ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এসব দেশ থেকে বিপুল শুল্কহ্রাস ও সহজ প্রবেশাধিকার সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে দেশটির পণ্য। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য হতে ভিয়েতনামকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। বৈদেশিক বিনিয়োগকে প্রবলভাবে উৎসাহিত করে চলেছে ভিয়েতনাম।
স্যামসাং, এলজি, অলিম্পাস, পাইওনিয়ার—এসব কোম্পানির দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় হাব এখন ভিয়েতনামে। (ভিয়েতনামে যাওয়ার আগে স্যামসাং বাংলাদেশের কোরিয়ান ইপিজেডে ফ্যাক্টরি করার জন্য প্রবল আগ্রহ দেখিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল)।
এখন ভিয়েতনামে প্রতিবছর বৈদেশিক বিনিয়োগপ্রবাহ দাঁড়াচ্ছে ২০-২৫ বিলিয়ন ডলার, যেখানে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ এখনো ৪ বিলিয়নের নিচে থাকছে। গ্লোবাল কমপিটিটিভনেস রিপোর্টে ২০০৬ সালে ভিয়েতনামের অবস্থান ছিল ৭৭তম, আর ২০১৭ সালে সেটা উন্নীত হয়েছে ৫৫তম অবস্থানে। বিশ্বব্যাংকের ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ র্যাঙ্কিংয়ে ভিয়েতনাম ২০০৭ সালের ১০৪তম থেকে ২০১৭ সালে ৬৮তম অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। (বাংলাদেশের অবস্থান এ ক্ষেত্রে অবনমিত হয়েছে।) ভিয়েতনামের ব্যাংকিং ব্যবস্থা এখনো রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রয়ে গেছে, কিন্তু ব্যাংকঋণে উদ্যোক্তাদের অভিগম্যতা উল্লেখযোগ্যভাবে সহজ ও বহুলবিস্তৃত করা হয়েছে। বিশেষত, গ্রামীণ উৎপাদনকারীদের কম সুদে ঋণ পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে এবং ছোট ও মাঝারি (এসএমই) প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সুলভে ও দুর্নীতিমুক্ত প্রক্রিয়ায় ব্যাংকঋণ পৌঁছে দেওয়ার পারঙ্গমতায় ভিয়েতনাম অনুকরণীয় নজির সৃষ্টি করেছে।
এই ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক গতিশীলতার পেছনের চাবিকাঠি হলো ভিয়েতনামে দুর্নীতির প্রকোপ অনেক কম, ভিয়েতনামের শ্রমশক্তি ও মানবপুঁজি বাংলাদেশের চেয়ে অনেক শিক্ষিত, দক্ষ এবং পরিশ্রমী। ভিয়েতনামের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন চমকপ্রদ। বন্দর, মহাসড়ক ও সুলভ গণপরিবহনের ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম দ্রুত আধুনিকায়নে সফল একটি দেশ। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনাম এখন বাংলাদেশকে হটিয়ে মাঝে মাঝে গণচীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানটি দখল করে নিচ্ছে। ইলেকট্রনিকস পণ্য রপ্তানিতে এখন সিঙ্গাপুরের পর ভিয়েতনাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। চাল রপ্তানিতে থাইল্যান্ডকে হটিয়ে ভিয়েতনাম ভারতের পর বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। ব্রাজিলের পর কফি রপ্তানিতে ভিয়েতনাম বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। সাড়ে ৯ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভিয়েতনামের মোট রপ্তানি আয় বাংলাদেশের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।
২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারি আঘাত হানার আগে ২০১৯ সালে ভিয়েতনামের রপ্তানি আয় ছিল ২৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। (স্যামসাং একাই ভিয়েতনামের রপ্তানি আয়ের এক-চতুর্থাংশ নিয়ে আসছে)। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গণচীনের চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে গণচীনে উৎপাদনরত অনেক শিল্পকারখানা এখন ভিয়েতনামে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা দুর্বল হলেও তা ভিয়েতনামের একদলীয় সরকারব্যবস্থার চেয়ে বিশ্বের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হতো। কিন্তু ২০০৮ সালের পর ২০১৪ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হওয়ায় এ ক্ষেত্রে আমাদের গণতান্ত্রিক পরিচয় আমরা হারিয়ে বসেছি। ভিয়েতনাম থেকে রাজনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শিক্ষা নিতে পারে প্রতিনিধিত্বমূলক স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের বিষয়টিতে। উৎপাদনের সব ক্ষেত্রে সমবায়ব্যবস্থার মাধ্যমে শ্রমজীবী জনগণের ক্ষমতায়ন এবং গ্রাম সমবায়ের ক্ষেত্রেও ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে পথ দেখাতে পারে। সোভিয়েত স্টাইলের সমাজতন্ত্রকে যে যুগোপযোগী সংস্কার করতেই হবে, এটা বুঝে নিয়েই ভিয়েতনাম ‘দোই মোই’ সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে। ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির’ আফিমের মৌতাতে বুঁদ না হয়েও যে ‘একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের দর্শন’ অনুসরণ করে অর্থনৈতিক ‘মিরাকল’ ঘটানো সম্ভব, সেটারই অকাট্য প্রমাণ তুলে ধরেছে ভিয়েতনাম।
লেখক: ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post