রুমান হাফিজ, চবি
সৌন্দর্যের রানী, শাটলের ক্যাম্পাস, সবুজ চত্বর এবং দেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যাপীঠ এমন নানা বিশেষণে বিশেষিত দেশের দক্ষিণ-পূর্বে অঞ্চলের জ্ঞানাধার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। আয়তনে দেশের সর্ববৃহৎ ২১শ একর ভূমির ওপর অবস্থিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর। পাহাড়ঘেরা, শাটলের এই ক্যাম্পাস আজ পা রেখেছে ৫৭ বছরে। সাফল্যের এক দীর্ঘ যাত্রায় এ জ্ঞান মাতৃকা পেছনে ফেলে এসেছে ৫৬টি বছর।
চারটি বিভাগ আর ৮জন শিক্ষক নিয়ে শুরু করা চবিতে বর্তমান বিভাগ রয়েছে ৪৮টি। ৯টি অনুষদ আর ছয়টি ইনস্টিটিউটে বর্তমানে ২৬ হাজার ৬০৪ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধার জন্য রয়েছে ১২টি হল।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করে। বোটানিক্যাল গার্ডেন, ঝুলন্ত ব্রিজ, ফরেস্ট্রি, চালন্দা গিরিপথ, সুইচ গেট এবং ঝর্ণাসহ পুরো ক্যাম্পাস পাঠ্যসূচির সহচর বিনোদন কেন্দ্র।
মহান মুক্তিযুদ্ধে চবির ১৫ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী তাদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হোসেন পেয়েছেন বীরপ্রতীক খেতাব। এছাড়া ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০’র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ দেশের ক্রান্তিলগ্নে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল দৃঢ়চেতা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্ব বিকাশে এখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। ৫৬ বছরের এই পথচলায় চবি জন্ম দিয়েছে অসংখ্য রথী-মহারথীর। যাদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ভৌতবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম, সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ সৈয়দ আলী আহসান, চিত্রশিল্পী মূর্তজা বশীর, ঢালী আল মামুন, অধ্যাপক আবুল ফজল, অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সাবেক ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান প্রমুখ।
করোনাকালে করোনা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গবেষণায় সরব ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। করোনার জিন বিন্যাস, করোনা পরীক্ষা থেকে অনেক কিছুই হয়েছে এখানে। এতো প্রাপ্তির মধ্যেও কিছু অপ্রাপ্তির বোঝা এখনও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে।
আবাসন সংকট:
এর মধ্যে অন্যতম। প্রতিষ্ঠার সময় এটি সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় বলা হলেও বর্তমানে ২৭ হাজার ৫৫০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে ১১টি আবাসিক হল ও একটি হোস্টেলে আসন রয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৩০টি, যা মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১৮ শতাংশ। তবে উদ্বোধন হলেও এখনো চালু হয়নি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল।
প্রতিষ্ঠার ৫৬ বছর পেরিয়ে এখনো নিশ্চিত হয়নি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পূর্ণ আবাসন ব্যবস্থা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশকে ক্যাম্পাস থেকে যথাক্রমে ২২ ও ২৪ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম শহরে অবস্থান করতে হয়। ফলে অনেকাংশে পরিবহন নির্ভর হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্ববিদ্যালয়ে দিন দিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও শাটল ট্রেনে বাড়েনি কোনো বগি। প্রতিবছর মোট বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় এ খাতে। এছাড়া স্থানীয় নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাস-সিএনজি মালিকসের কাছে এক প্রকার জিম্মি হয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বাড়ছে না খাবারের মান:
আবাসিক হলে পরিবেশন করা হচ্ছে নিম্নমানের খাবার। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির দোহাই দিয়ে এসব হল ডাইনিং ও ক্যান্টিনে নিম্নমান ও অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বাধ্য হয়ে হলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাসের আশপাশে বিভিন্ন দোকানে খেতে হচ্ছে। এতে খরচ হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। নানা সময় হল, ক্যান্টিনের খাবার নিয়ে অভিযোগ কিংবা তালা দিলেও আশ্বাসেই শেষ হয়ে যায় সমাধান।
নিয়োগ বানিজ্যের কালো থাবা:
নিয়োগ বাণিজ্যের কালো থাবা থেকে বের হতে পারছে না আয়তনে দেশের সর্ববৃহৎ এ বিদ্যাপীঠ। চলতি বছরেই শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের কারণে বারবার খবরের পাতায় শিরোনাম হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ নিয়ে প্রার্থীর সঙ্গে টাকা-পয়সা নিয়ে দরকষাকষির অডিও ক্লিপ প্রকাশিত হয়েছে। এসব ঘটনায় মূল হোতারা যেন অজ্ঞাত কারণে প্রশাসনিক বিচারের আওতার বাইরেই থাকছেন।
রাজনৈতিক অস্থিরতা:
রাজনৈতিক অস্থিরতা যেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। ঠুনকো ঘটনায় বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ লেগেই থাকে। এতে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
সমাবর্তনে পিছিয়ে চবি:
প্রতিষ্ঠার ৫৬ বছরে চবিতে সমাবর্তন হয়েছে মাত্র ৪টি। গড়ে এক যুগেও হচ্ছে না একটা করে সমাবর্তন। চবির সর্বশেষ সমাবর্তন হয় ২০১৬ সালে। এদিকে আগামী ১৯ নভেম্বর ৫৩তম সমাবর্তন আয়োজন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তবে চবির বর্তমান উপাচার্য দায়িত্বে আসার পর বেশ কয়েকবার সমাবর্তন আয়োজনের ঘোষণা দিলেও বাস্তবে সে রকম কিছু দেখা যায়নি এখন পর্যন্ত।
এছাড়াও ১০টিরও বেশি বিভাগে এখনও দুই থেকে আড়াই বছর পর্যন্ত সেশনজট আছে। প্রতিষ্ঠার এত বছরেও এখনো টিএসসি নির্মিত হয়নি। সংরক্ষিত আসন থাকার পরও দেড়যুগ ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শারমিন চৌধুরী বলেন, দেশের অন্যতম সৌন্দর্যের ক্যাম্পাস চবি। অসংখ্য সম্ভাবনা থাকলেও যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ নেই বলেই উল্লেখযোগ্য কিছু হচ্ছে না। সংকট যেন চবির নামের সঙ্গেই লেগে আছে। শাটলে বগি সংকট, হলে সিট সংকট, খাবারের মান নিম্নমুখী, ইন্টারনেট সুবিধা মাত্রাতিরিক্ত খারাপ। এসব সাধারণ চাহিদাগুলো থেকে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ৫৬ বছর পেরিয়ে আসা একটি সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র এখনো এমন। সুতরাং পরিবর্তনটা কতটুকু এবং কতোটা দ্রুত জরুরি তা সবার অনুমেয়।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমার অনেক বড় স্বপ্ন। জানি না সব স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো কি না। এরই মধ্যে কিছু কিছু বাস্তবতা দেখতে পাচ্ছেন নিশ্চয়ই। যখন উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পাই তখন আমাদের সামনে ছিলো আইটি পার্ক করা, কিন্তু সেটা জটিলতায় থেমে আছে। চায়নার সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছে, তারা আমাদের ছয়তলা একটি ভবন নির্মাণ করে দেবে। সেখানে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট হবে। প্রাথমিকভাবে আমরা দ্বিতীয় কলা অনুষদের কয়েকটি রুমে কার্যক্রম শুরু হবে। তথ্যকেন্দ্র থেকে শুরু করে কমফোর্ট জোন নির্মিত হচ্ছে। আগামী দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক সমৃদ্ধির সঙ্গে অবকাঠামোগত উন্নতি চলমান রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে একটু আধুনিক মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
Discussion about this post