ড. সাজ্জাদ হোসেন
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বাঙালি অর্জন করে স্বাধীনতার লাল-সবুজের পতাকা। বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন দেশে মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন। এই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। বাস্তবায়ন করেছিলেন অনেক অসাধ্য কাজ। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে একদল কুচক্রী, পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর ও বাংলাদেশবিরোধী শক্তির হাতে নির্মমভাবে সপরিবারে নিহত হন জাতির পিতা। পথ হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ।
দীর্ঘ একুশ বছর পরে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে মনোনিবেশ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এরপর ২০০৮ সালে ফের ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। এখন টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় রয়েছে দলটি। বিগত প্রায় ১৪ বছরে দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন। আর তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা সেই দেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করার কাজটি করেছেন দক্ষ হাতে।
অভূতপূর্ব উন্নয়ন
বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরে দেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের মানুষ যেমন স্বাধীনতা লাভ করেছে, তেমনি কিছু দিনের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করে দেশ উন্নত বিশ্বের কাতারে অবস্থান করবে। এক সময়ের ঋণগ্রহীতা বাংলাদেশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে বর্তমানে আর্থিক ও মানবিক সহায়তা করছে। হেনরি কিসিঞ্জারের কথিত তলাবিহীন ঝুড়ির ধারণা বদলে গেছে। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২৮২৪ মার্কিন ডলার।
মূলত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ এখন উন্নত দেশের সারিতে আসন লাভের পথে। ভিশন ২০৪১ থেকে ভিশন ২০৭১ হয়ে শতবর্ষের ডেল্টা পরিকল্পনা বাংলাদেশের প্রভাবকে ছড়িয়ে দেবে বিশ্বময়। বাংলাদেশে মানব উন্নয়ন সূচকের উন্নতি এখন বিশ্বজুড়ে আলোচনার বিষয়। নারী-পুরুষের ক্ষমতার ভারসাম্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশের অর্জন বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।
উন্নত দেশের পথে
শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশকে দিয়েছে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে দাঁড়াবার সাহস। নিম্ন আয়ের কাতার থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম বৃহৎ অর্জন। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উন্নয়ন, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, কয়লাভিত্তিক রামপাল থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পায়রাবন্দর নির্মাণ প্রকল্প এবং সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পগুলোর কিছু চালু হয়েছে। কিছু বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশের এ সকল উন্নয়ন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার একক নেতৃত্বের গুণে অর্জিত হয়েছে।
উচ্চশিক্ষায় অগ্রগতি
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, কৃষি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে উচ্চশিক্ষার যাত্রা শুরু হয়। দেশে এখন ১৬২টি বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার প্রসারে কাজ করে চলেছে। উচ্চশিক্ষায় অগ্রগতির একটি বড় পদক্ষেপ হলো উচ্চশিক্ষায় বাজেট বৃদ্ধি। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যয় নির্বাহের জন্য ৮ হাজার ৪৮৫ কোটি ১২ লাখ টাকার বাজেট বরাদ্দ করা হয়, যা বিগত বছরগুলোতে রেকর্ড গড়েছে। উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্যতম কাজ হলো- গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি ও সন্ধান, যা দেশের টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। আর গবেষণার জন্য আর্থিক প্রণোদনাও গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষা-গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি এই খাতে গতি সঞ্চার করেছে। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের তথ্যমতে, উচ্চশিক্ষায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের গবেষণার জন্য ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মূল বাজেটে ৬৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত অর্থবছরে শিক্ষা-গবেষণায় মূল বাজেটে ৬৪ কোটি ৫৮ লাখ বরাদ্দ ছিল। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা গবেষণাকে বিশ্বমানে উন্নতিকরণের লক্ষ্যেই সরকারের এই প্রচেষ্টা। শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী করতে বিভিন্ন ধরনের বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বেতন মওকুফের ব্যবস্থা করা হয়েছে নারী শিক্ষার্থীদের। প্রায় বিনামূল্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে থাকার ব্যবস্থা বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল অনুষদে সর্বোচ্চ ফল অর্জনকারীকে প্রদান করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক। এছাড়াও গবেষণার জন্যও বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ডিজিটালাইজেশন
শেখ হাসিনার সরকারে অন্যতম বড় অর্জন ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। ডিজিটাল বাংলাদেশে ইভিএম একটি ঝামেলাবিহীন এবং স্মার্ট প্রক্রিয়া। ভোটার ও ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য স্বস্তি বয়ে এনেছে ইভিএম। ইভিএম পদ্ধতিতে একজন ভোটার একবারই ভোট দিতে পারেন। সাধারণ ব্যালট ভোটের মতো কেন্দ্রেও সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে পোলিং এজেন্ট ও পর্যবেক্ষকরা থাকবেন। সনাতনী পদ্ধতির সঙ্গে ইভিএম-এর পার্থক্য হলো- কাগজের ব্যালটে সিল দেওয়ার পরিবর্তে ভোটার পছন্দের প্রতীকের পাশের সুইচ টিপে ভোট প্রয়োগ করেন। ফলে, ভোগান্তি কমছে সবার।
পাশাপাশি কমছে আর্থিক অপচয়। সুরক্ষিত হচ্ছে পরিবেশ। ইভিএম ব্যবহারের ফলে কোটি কোটি সংখ্যক ব্যালট ছাপানোর খরচ সাশ্রয় হবে। এ প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় অন্য কাগজের খরচ, এসবের পরিবহনের ব্যয়, ভোট গণনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকবলের খরচ- এমন অনেক ব্যয় সাশ্রয় হবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৩ সালের শেষে অথবা ২০২৪ সালের শুরুতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। নানামুখী সুবিধার কথা চিন্তা করেই আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অর্ধেক আসনে ইভিএম ব্যবহার করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, একটি জাতীয় নির্বাচনে এক হাজার ৮৭ কোটি টাকার মতো বিরাট আর্থিক খরচ রয়েছে। অন্যদিকে, ইভিএম পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা গেলে সেখানে প্রায় নয়শ’ কোটি টাকায় খরচ মেটানো সম্ভব। এটি একটি নির্বাচন আয়োজনের হিসাব।
সনাতন পদ্ধতির প্রতিটি নির্বাচনই নতুন ব্যালট পেপার ও কাগজ ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু একটি ইভিএম মেশিন বারবার নির্বাচনে ব্যবহার করা যায়। একই মেশিন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন বা উপনির্বাচনেও কাজে লাগানো যায়। ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের একটি সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার অংশ।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনা
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব পৃথিবীর সামনে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে নানা সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এগুলো হলো- প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্পর্কিত গবেষণা ও উদ্ভাবনমূলক কার্যক্রম বাড়ানো। এ লক্ষ্যে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত একটি করে বিশেষায়িত গবেষণা কোষ স্থাপন। জ্ঞান ও দক্ষতায় শিল্পক্ষেত্রের ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ ও সমন্বয় বৃদ্ধি করার কর্মকৌশল নির্ধারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি ও এফবিসিসিআইয়ের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ।
প্রযুক্তিগত গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে অর্থ ব্যয় করতে শিল্প-প্রতিষ্ঠানসমূহকে উদ্বুদ্ধকরণ। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলা ও শিক্ষাদান পদ্ধতিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো। শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানভিত্তিক সিলেবাসে প্রয়োজনে সংশোধনী আনয়ন। বিগত দশ বছরে আইসিটি খাতে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কালে বাংলাদেশ হবে শিক্ষা-গবেষণা ও প্রযুক্তির ডেস্টিনেশন। ইলেকট্রনিক ইন্ডাস্ট্রিতে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে কাজ হচ্ছে। সাইবার নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখছে আমাদের আইসিটি সেক্টরের মেধাবী তরুণরা।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও হাইটেক পার্কগুলোতে আইসিটি মন্ত্রণালয় নানাভাবে যুক্ত রয়েছে। পরিকল্পিতভাবে দক্ষ আইসিটি টেকনোলজিস্ট তৈরি করা হচ্ছে, যাতে তারা দেশের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে পারেন। এই সামগ্রিক কার্যক্রমে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবদান রাখছে। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এক্ষেত্রে বড় অবদান রাখতে পারে।
বাঙালি জাতি কোভিড-১৯ মহামারির ধাক্কা সামলে নিয়েছে সফলভাবে। পৃথিবীর কাছে তা মডেল হয়ে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অবৈতনিক তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে শ্রম, মেধা ও সততার সঙ্গে নিরলস পরিশ্রম করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। মহামারির ধকল সামলে উঠে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব শতবর্ষ উদ্যাপন ইতিহাসে বিরল ঘটনা। বাংলাদেশ একান্ন বছর পেরিয়ে বায়ান্ন বছরে পদার্পণ করছে। সময়ের বাধা পেরিয়ে আমাদের দেশ আজ পরিণত, সমৃদ্ধ ও সুখী। তবে ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। ’৭১-এর পরাজিত শক্তি আজও বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করার অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে দেশকে নিয়ে নানারকম মিথ্যা ও গুজব ছড়াচ্ছে। তাই ২০২২ সালের বিজয়ের মাস ডিসেম্বর আমাদের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দিন বদলের অঙ্গীকারকে এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর থাকতে হবে প্রত্যেক বাঙালিকে।
Discussion about this post