আসাদুজ্জামান কাজল
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষকের গাড়িতে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে রুবিনা আক্তার নিহত হন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এ ধরনের ঘটনা প্রায় অবিশ্বাস্য।
বিশ্বের প্রথম সারির কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় দেখা ও দুটিতে অধ্যয়নের সুযোগ হয়েছে আমার। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজ করবে শান্ত, স্নিগ্ধ ও নির্মল পরিবেশ। সুপরিসর গ্রন্থাগার এবং নতুন-পুরোনো হাজার হাজার বই ও জার্নালে একসেস থাকবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গবেষকদের। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করা হবে ল্যাব ও ক্লাসরুমে। বিভিন্ন বিভাগ ও অনুষদে চলমান থাকবে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ ও কনফারেন্স; যেসব জায়গায় নতুন সৃষ্ট জ্ঞান ও গবেষণাকর্ম নিয়ে চলবে আলোচনা ও বিতর্ক। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি অঙ্গনে থাকবে গবেষণা ও জ্ঞান সৃষ্টির পরিবেশ। বিতর্ক, গান, সিনেমা, অভিনয়, খেলাধুলাসহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মুখর থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়।
বিপরীতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে বহিরাগতদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর চেয়ে বহিরাগতরাই এটিকে বেশি ব্যবহার করছে। শিক্ষার্থীরা হলগুলোতে বসবাসের জন্য কক্ষ পাচ্ছে না; খাবারের মান খুবই খারাপ; লেখাপড়ার জন্য গ্রন্থাগারে বসার জায়গা নেই। এমনকি অনেক বিভাগে ক্লাসরুমে আসনের চেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। আধুনিক প্রযুক্তি ও সুবিধা-সংবলিত ল্যাবের স্বল্পতা তো রয়েছেই। এখানে হকার নিরাপদে ব্যবসা করতে পারে; রাতে ছেলেরা ফুলার রোডে বাইকের রেস করতে পারে; গাড়ি চালানো শিখতে পারে; মাদকসেবীরা নিরাপদে মাদক গ্রহণ ও কেনাবেচা করতে পারে; রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করতে পারেন; বহিরাগতরা তাদের প্রায় ব্যক্তিগত সব উৎসব-অনুষ্ঠান পালন করতে পারে; দ্রুত যাওয়া-আসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক ব্যবহার করতে পারে। এমনকি চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত পরিবেশে প্রকৃতির ডাকেও সাড়া দিতে পারে। উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব চিন্তাও করা যায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন শিক্ষা ও গবেষণা ছাড়া সবকিছুর পরিবেশ রয়েছে।
ওই দুর্ঘটনার পর সামাজিক মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ অনেকেই ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা জোরদারের দাবি জানাচ্ছেন। এই দাবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রায় চার বছর আগেই বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে যান ও বহিরাগতদের চলাচল নিয়ন্ত্রণে ২০১৮ সালে নিরাপত্তা চৌকি বসানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। রাতে নির্দিষ্ট সময়ের পর টিএসসি এলাকা হকারমুক্ত করতে চেয়েছিল, যাতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গবেষকরা নিজেদের মতো ব্যবহার করতে পারেন। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীর একটি অংশ এর বিরোধিতা করেছিল। পরিস্থিতি বিবেচনায় পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
বিষয়টি আবার নতুন করে ভাবতে হবে। কারণ টিএসসি ব্যবহার করে অনেকেই যেমন ব্যবসা করছে; তেমন অনেকে সেই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাও নিচ্ছে। কেউ কেউ তাদের অপরাধকর্মের স্থান হিসেবে বেছে নিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন ও প্রয়োজনে নিশ্চয় ক্যাম্পাসে আসবেন। কিন্তু সবকিছুর একটি নিয়ম-শৃঙ্খলা থাকতেই হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেমন বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য দিয়ে সব ব্যবস্থা করবে, তেমনই সাবেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদেরও দায়িত্ব হচ্ছে ক্যাম্পাসের পরিবেশ উন্নয়নে সহায়তা করা।
২০১৯ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংস কলেজে ঢোকার জন্য ২০ পাউন্ড দিয়ে আমাকে টিকিট করতে হয়েছিল। যেখানে শিক্ষার্থীরা বাস করে, সেখান যাওয়ার সুযোগই নেই। দূর থেকে দেখতে হয়। এমনকি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সুন্দর ঘাসের লন দেখা যায়; সেখানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ছাড়া কেউ পা-ও রাখতে পারে না।
যাই হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত ও যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এগুলো চালু রেখে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করা কখনোই সম্ভব নয়। সে কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা ও গবেষণার নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে বর্তমান ও সাবেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্মিলিতভাবেই যৌক্তিক ও জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নিরাপদ, সুন্দর ও আধুনিক ক্যাম্পাস সৃষ্টির লক্ষ্যে সঠিক ও কার্যকর পরিকল্পনা নিয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক- সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিএইচডি শিক্ষার্থী, কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া।
Discussion about this post