জাকিয়া আহমেদ
কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের পর থেকে বিশ্বের বেশিরভাগ হাসপাতাল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত ট্রায়াজ (কোভিড সন্দেহভাজন রোগী বাছাই প্রক্রিয়া) ব্যবস্থাপনা মেনে সন্দেহভাজন রোগীদের ভর্তি করছে। এই ব্যবস্থাপনা যেসব হাসপাতালে সুচারুভাবে মেনে চলা হচ্ছে সেগুলোতে রোগী থেকে রোগীতে এবং রোগী থেকে চিকিৎসক ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট কর্মীদের মধ্যে করোনা ছড়ানোর হার একেবারেই কম। বিশ্বের সব উন্নত দেশ এমনকি পাশের দেশ ভারতেও এই প্রক্রিয়ায় রোগী বাছাই হচ্ছে। ভারতের কেরালা ও কর্নাটকে এই ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা থাকায় সেখানে কোভিড রোগীদের শনাক্ত ও চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে সুফল পাওয়া গেছে।
ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা হচ্ছে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত একটি বিশ্বজনীন রীতি (ইউনির্ভাসেল প্রটোকল)। ট্রায়াজ শব্দের অর্থ আলাদা করা বা বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা। করোনার ক্ষেত্রে কোনও রোগীকে লক্ষণ অনুযায়ী ভাগ করে চিকিৎসা দেওয়া হলে তাদের থেকে সংক্রমণের সংখ্যা অনেকাংশেই কমে যায়। জ্বর, সর্দি কাশি, শ্বাসকষ্ট এসব উপসর্গ নিয়ে কেউ এলে তাদের কোথায় যেতে হবে সে সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া থাকে এতে। এমনকি এ ধরনের রোগীর টিকিট কাউন্টারেও যেতে মানা। সোজা কথায়, অন্য সব রোগীর সংস্পর্শে যাতে কোভিড আক্রান্ত রোগীকে যেতে না হয় তার সব ব্যবস্থাই থাকে ট্রায়াজে।
এই ব্যবস্থাপনা সারা বিশ্বে অনুসরণ করে সুফল পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোভিড-১৯ বিষয়ক সমন্বিত কন্ট্রোল রুমের যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. মো. রিজওয়ানুল করিম। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘‘ভারতের কেরালা, কর্ণাটকসহ বেশ কিছু প্রদেশে ট্রায়াজ সিস্টেম করে তারা ভীষণ সুফল পেয়েছে। তারা ট্রায়াজটাকে খুব ‘মেটিকুলাসলি’ করেছে এবং তার সুফলও পেয়েছে দারুণ। আর দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্যের কথা পুরো বিশ্ব জানে। যে যত ভালোভাবে এই ট্রায়াজ সিস্টেম মেনে চলেছে সেই দেশ তত ভালো ফল পেয়েছে। কারণ, এতে করে শুরুতেই রোগীরা পৃথক হয়ে যায় অন্যদের থেকে।’’
তবে বাংলাদেশে ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনার বাস্তবতা সারা বিশ্বের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। দেশে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত (ডেডিকেটেড) হাসপাতালগুলোতে ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা অনুসরণ হচ্ছে। তবে সাধারণ চিকিৎসার হাসপাতালগুলোতে এ ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না মানায় সেগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই রোগী থেকে আক্রান্ত হচ্ছেন চিকিৎসক, নার্সসহ চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট কর্মীরা। লকডাউন হচ্ছে পুরো হাসপাতাল। এ অবস্থায় সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা সব হাসপাতালেই ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা মেনে চলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। একইসঙ্গে সব হাসপাতালে ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা এখনও চালু না হওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের নজরদারির অভাবকেই দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত ২৭ এপ্রিল করোনাভাইরাসে ২৯৫ জন চিকিৎসক, ১১ জন নার্স ও ২৪৯ জন অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীসহ মোট ৬৬০ জন আক্রান্ত হওয়ার তথ্য দেয় বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। পরদিন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ৮ চিকিৎসকসহ ২৯ জন এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় সংখ্যাটা আরও বেড়ে ৩০৩ জন চিকিৎসকসহ মোট ৬৮৯ জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত দেখাচ্ছে।
ওই দিন বিএমএ’র মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী নন কোভিড হাসপাতালে প্রবেশে ট্রায়াজ সিস্টেম চালু করে সেখানে কর্মরত সব চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উপযুক্ত পিপিই, এন-৯৫ বা সমমানের মাস্ক নিশ্চিত করার দাবি জানান সরকারের কাছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনার কারণে দেশের কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক ও নার্সদের সংক্রমিত হওয়ার সংখ্যা কম। কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতালের মতো ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে ট্রায়াজ ব্যবস্থা মেনে চলা হচ্ছে শুরু থেকে। এসব হাসপাতালে এখনও চিকিৎসক বা চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু, যেসব হাসপাতালে ডেডিকেটেড বলার পরেও সব নিয়ম মানা সম্ভব হয়নি, আক্রান্তের ঘটনা আছে সেখানে। তবে সাধারণ হাসপাতালগুলোতে করোনার চিকিৎসা দেওয়া না হলেও অন্য লক্ষণ নিয়ে হুটহাট হাজির হচ্ছেন করোনা আক্রান্ত রোগীরা। কখনও তারা জেনেশুনেই যাচ্ছেন ও হাসপাতালে গিয়ে তথ্য গোপন করছেন, কখনও না জেনেই যাচ্ছেন–ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা না থাকায় এমন রোগীদের মাধ্যমে করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন চিকিৎসক, নার্সসহ চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা। এজন্য রোগীকে দায়ী করার পাশাপাশি চিকিৎসকরা প্রশ্ন তুলছেন মাস্ক, পিপিই-র সংকট বা মান নিয়ে। আর বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন এসব হাসপাতালে ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা না মানাকেই। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা এখন পরামর্শ দিচ্ছেন সব রোগীকেই করোনা রোগী ধরে নিয়ে চিকিৎসকদের যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই চিকিৎসা দেওয়ার। তারও আগে সব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছেন তারা।
ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনার সুবিধা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, এতে শুরুতেই জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের অন্যদের থেকে পৃথক করে ফেলা যায়, তাতে করে অন্য রোগীদের সঙ্গে তাদের মিক্সিং হয় না। একইসঙ্গে সব চিকিৎসকও এক্সপোজড হন না এবং খুব সহজেই তাদেরকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। ট্রায়াজেই চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নেন কোনও রোগীকে তারা আইসোলেশনে রাখবেন, হাসপাতালে ভর্তি করাবেন নাকি বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোভিড-১৯ বিষয়ক সমন্বিত কন্ট্রোল রুমের যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. মো. রিজওয়ানুল করিম এ বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনার সাফল্য তুলে ধরে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যে যত ভালোভাবে এই ট্রায়াজ সিস্টেম মেনে চলেছে সেই দেশ তত ভালো ফল পেয়েছে। কারণ, এতে করে শুরুতেই রোগীরা পৃথক হয়ে যায় অন্যদের থেকে।
ডা. রিজওয়ানুল করিম আরও বলেন, কোভিড-১৯ এর গাইডলাইনে ট্রায়াজের নীতিমালার কথা উল্লেখ করা রয়েছে। সে নীতিমালা যে হাসপাতাল যত তাড়াতাড়ি অনুসরণ করবে ততই ভালো ফল পাওয়া যাবে। হাসপাতালে যে সংক্রমণের ঘটনাগুলো ঘটছে, সেগুলো ট্রায়াজ না থাকার কারণে হচ্ছে।
কোভিড ডেডিকেটেড নয় এমন সাধারণ হাসপাতালগুলোতে ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা শুরু থেকে মেনে চলা হয়নি স্বীকার করে তিনি বলেন, যদি দেশে এখনও সব হাসপাতালে ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা করা হয় তাহলে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের ভেতরে এক রোগী থেকে অন্য রোগীর সংক্রমণ হওয়ার যে ঘটনাগুলো (ক্রস কন্টামিনেশন) ঘটছে, সেগুলো বহুলাংশে কমে যাবে।
যখন কোনও পেন্ডেমিক (মহামারি) চলে তখন স্বাস্থ্যসেবা চলমান রাখতে হলে ট্রায়াজ মেইন্টেইন করতেই হবে জানিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে যদি শুরু থেকে এই ট্রায়াজ সিস্টেম করা হতো তাহলে এত চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা আক্রান্ত হতেন না, রোগী পুরো হাসপাতালে ছড়িয়ে পড়তো না। কিন্তু, সেদিকে একেবারেই নজর দেওয়া হয়নি। যার কারণে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের চেয়ে নন কোভিড হাসপাতালগুলোতে আক্রান্ত হওয়া চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা বেশি। যদিও ট্রায়াজ নিয়ে করোনা সংক্রান্ত গাইডলাইনে বলা হয়েছে, তবে সেটা কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে, বাংলাদেশে এই প্রটোকল বাস্তবায়ন হয়নি।
ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেকোনও সংক্রমণের সময় রোগী শনাক্তের নিয়ম ঠিক করে দেয়। তেমনি নিয়মের একটি হচ্ছে চিকিৎসার প্রথম স্তরে থাকা ‘ট্রায়াজ’ ব্যবস্থা। এই ট্রায়াজ হচ্ছে প্রতিটি হাসপাতালে একটি করোনা কর্নার স্থাপন করতে হবে যেখানে করোনার লক্ষণ উপসর্গসহ রোগীরা এলে তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসকরা জানবেন তিনি কোভিড সাসপেক্টেড নাকি নন। আর সে অনুযায়ী তার ব্যবস্থাপনা হবে অর্থাৎ তাৎক্ষণিকভাবে তাদের সংক্রমণ শনাক্ত করা এবং নমুনা সংগ্রহ করে প্রকৃতই তিনি করোনায় আক্রান্ত কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া।
এদিকে, ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনার কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় উপকৃত হয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ফিভার ক্লিনিক করা হয়েছে যেটা কিনা মূল ভবন থেকে পৃথক। আর এর কারণে অন্যান্য নন কোভিড হাসপাতালের চেয়ে এ হাসপাতালে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলক কম। এই রকম ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা যদি সব জায়গায় করা যেতো তাহলে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্তের হার কম হতো।
তিনি বলেন, দেশে এখন পর্যন্ত চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্তের হার আশঙ্কাজনক। এটা হয়েছে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ‘ফেইল’ করার কারণে এবং দেশের নন কোভিড হাসপাতালে ট্রায়াজ সিস্টেম না থাকার কারণে।
এদিকে, ট্রায়াজের অংশই হচ্ছে আইসোলেশন ওয়ার্ড করা জানিয়ে ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, কোনও রোগীকে পরীক্ষার পর সন্দেহ হলে তাকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে রাখতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব তার নমুনা সংগ্রহ করাতে হবে এবং নেগেটিভ-পজিটিভ অনুযায়ী তার চিকিৎসা হবে।
বাংলাদেশে এখনও এই ট্রায়াজ করার সুযোগ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখনও সেই সুযোগ রয়েছে। গত একমাস আগে থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ট্রায়াজ চালু করা হয়েছে, চালু করা হয়েছে সাভার উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স, কেরানীগঞ্জ হেলথ কমপ্লেক্সে। এসব প্রতিষ্ঠান সফলতার সঙ্গে ট্রায়াজ চালু করেছে এবং এর সুফল পেয়েছে।
একারণে দেশের হাসপাতালে দ্রুত ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা চালুর ওপরে গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
Discussion about this post