ইয়োভাল নোয়া হারারি
কম্পিউটার যুগের শুরু থেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ভয় মানব জাতিকে তাড়িত করছে। একটা সময় পর্যন্ত এই ভয় ছিল, যন্ত্রটি ভৌত উপায়ে মানুষকে হত্যা, দাসত্ব বা প্রতিস্থাপন করতে পারে। কিন্তু গত কয়েক বছরে নতুন এআই টুলস আবির্ভূত হয়েছে, যা মানব সভ্যতার অস্তিত্বের প্রতিই অপ্রত্যাশিত হুমকি সৃষ্টি করেছে। এআই শব্দ, ধ্বনি বা চিত্র দিয়ে ভাষাকে পাল্টে দেওয়া বা নতুন ভাষা তৈরি করার কিছু অসাধারণ ক্ষমতা অর্জন করেছে। বলা যায়, এআই আমাদের সভ্যতার অপারেটিং সিস্টেম হ্যাক করেছে।
প্রায় সব মানব সংস্কৃতিই ভাষা দিয়ে তৈরি। মানবাধিকার– উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমাদের ডিএনএতে খোদাই করা হয় না। বরং এগুলো সাংস্কৃতিক নিদর্শন, যা আমরা গল্প বলার মাধ্যমে এবং আইন লিখে তৈরি করেছি। টাকাও একটি সাংস্কৃতিক নিদর্শন, ব্যাংক নোটগুলো হলো কাগজের রঙিন টুকরো এবং বর্তমানে ৯০ শতাংশেরও বেশি টাকা এমনকি ব্যাংক নোট নয়; কম্পিউটারে গচ্ছিত ডিজিটাল তথ্য মাত্র। যে কারণে টাকা আমাদের কাছে মূল্যবান হয় তা হলো সেই গল্প যা ব্যাংকার, অর্থমন্ত্রী এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি গুরুরা আমাদের এটি সম্পর্কে বলেন। স্যাম ব্যাঙ্কম্যান-ফ্রাইড, এলিজাবেথ হোমস এবং বার্নি ম্যাডফ প্রকৃত মূল্য তৈরিতে বিশেষভাবে ভালো ছিলেন না, তবে তাঁরা সবাই ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ গল্পকার।
গল্প বলা, সুর রচনা, ছবি আঁকা এবং আইন ও ধর্মগ্রন্থ লেখার ক্ষেত্রে একজন অমানবীয় বুদ্ধিমত্তা গড় মানুষের চেয়ে দক্ষ হয়ে গেলে কী হবে? মানুষ যখন চ্যাটজিপিটি এবং অন্যান্য নতুন এআই সরঞ্জাম সম্পর্কে তাদের ধারণা প্রকাশ করে, তখন তারা প্রায়ই স্কুলের বাচ্চাদের এআই ব্যবহারের মাধ্যমে নিবন্ধ লেখা জাতীয় ঘটনার মধ্যেই আটকে থাকে। তাদের উদ্বেগ, বাচ্চারা এমনটা করলে স্কুল সিস্টেমের কী হবে? কিন্তু এ ধরনের চিন্তার মধ্য দিয়ে তারা গাছ দেখতে গিয়ে বনের কথাই ভুলে যায়। এসব বাদ দিয়ে বরং ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রতিযোগিতার কথা ভাবুন; তখন এআই সরঞ্জাম ব্যবহারের মাধ্যমে কী পরিমাণ ভুয়া রাজনৈতিক কনটেন্ট, ভুয়া সংবাদ এবং নতুন নতুন কাল্ট তৈরির বাণীর জন্ম হতে পারে?
আমরা হয়তো শিগগির গর্ভপাত, জলবায়ু পরিবর্তন বা ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসন সম্পর্কে দীর্ঘ অনলাইন আলোচনায় যুক্ত হবো, যেখানে প্রতিপক্ষ আমরা ভাবছি মানুষ; বাস্তবে তা এআই। মনে রাখতে হবে, মানুষের মত পাল্টানো যায়, কিন্তু এআইর মত পাল্টানো যায় না। অতএব এহেন পরিবর্তনের চেষ্টা সময়ের অপচয় ছাড়া কিছু নয়। উপরন্তু এআই তার বার্তাগুলোকে এত নিখুঁতভাবে বানাতে পারে যে, এর দ্বারা আমাদের প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা ব্যাপক। ভাষার দক্ষতার মাধ্যমে এআই এমনকি মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও তৈরি করতে পারে। আর মানুষের মত এবং বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে ঘনিষ্ঠতার শক্তির কার্যকারিতা সম্পর্কে কে না জানে!
আমরা সবাই জানি, গত এক দশকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মানুষের মনোযোগ নিয়ন্ত্রণের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। নতুন প্রজন্মের এআই উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের ফ্রন্ট মনোযোগ থেকে ঘনিষ্ঠতার দিকে সরে যাচ্ছে। আমাদের সঙ্গে জাল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির লড়াইয়ে একাধিক এআই যখন পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত হবে এবং জয়ী এআই আমাদের নির্দিষ্ট রাজনীতিবিদদের ভোট দিতে বা নির্দিষ্ট পণ্য কিনতে বোঝাতে ব্যবহৃত হবে তখন মানবসমাজ এবং মানব মনস্তত্ত্বের কী হবে?
এমনকি ‘জাল ঘনিষ্ঠতা’ তৈরি না করেও নতুন এআই সরঞ্জাম আমাদের মতামত এবং বিশ্বদর্শনের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। মানুষ ওয়ানস্টপ সার্ভিসের জন্য সবজান্তা অরাকলের মতো একটা এআইকে উপদেষ্টারূপে নিয়োগ দিতে পারে। গুগল কি এমনি এমনি আতঙ্কিত?
এমনকি এসব বিষয়েও সত্যিকারের ছবিটা ফুটে উঠছে না। আমরা যে বিষয়ে কথা বলছি তা সম্ভবত মানব ইতিহাসের শেষ। ইতিহাসের শেষ নয়, শুধু তার মানবপ্রধান অংশের শেষ। ইতিহাস হলো জীববিজ্ঞান এবং সংস্কৃতির মধ্যে মিথস্ক্রিয়া; খাদ্য ও যৌনতার মতো জিনিসের জন্য আকাঙ্ক্ষার মতো আমাদের জৈবিক চাহিদার সঙ্গে ধর্ম এবং আইনের মতো আমাদের সাংস্কৃতিক সৃষ্টির মিথস্ক্রিয়া। ইতিহাস হলো সেই প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে আইন ও ধর্ম দ্বারা খাদ্য ও যৌনতা আকৃতি পায়।
ইতিহাসের গতিপথ কী হবে যখন এআই সংস্কৃতির দখল নেবে এবং নতুন গল্প, সুর, আইন এবং ধর্ম তৈরি করতে শুরু করবে? মুদ্রণযন্ত্র এবং রেডিওর মতো সরঞ্জাম মানুষের সাংস্কৃতিক ধারণা ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছিল, কিন্তু তারা কখনোই তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধারণা তৈরি করেনি। এআই তাদের থেকে মৌলিকভাবে ভিন্ন। সে সম্পূর্ণ নতুন ধারণা; সম্পূর্ণ নতুন সংস্কৃতি তৈরি করতে পারে।
অবশ্যই এআইর নতুন শক্তি ভালো উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করা যেতে পারে। ক্যান্সারের নতুন নিরাময় থেকে শুরু করে পরিবেশগত সংকটের সমাধান আবিষ্কার পর্যন্ত অসংখ্য উপায়ে আমাদের সাহায্য করতে পারে। তবে আমার মতো ইতিহাসবিদ ও দার্শনিকের কাজ হলো বিপদগুলো তুলে ধরা। আমরা যে প্রশ্নটির মুখোমুখি হচ্ছি তা হলো কীভাবে নিশ্চিত করা যায় যে, নতুন এআই সরঞ্জাম অসুস্থতার পরিবর্তে ভালোর জন্য ব্যবহার করা যায়? এটি করার জন্য আমাদের প্রথমেই এসব সরঞ্জামের প্রকৃত ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত হতে হবে।
১৯৪৫ সাল থেকে আমরা জানি, পারমাণবিক প্রযুক্তি মানুষের সুবিধার জন্য সস্তা শক্তি উৎপন্ন করতে পারে, কিন্তু শারীরিকভাবে মানব সভ্যতাকেও ধ্বংস করতে পারে। তাই আমরা মানবতার সুরক্ষা এবং পারমাণবিক প্রযুক্তি প্রাথমিকভাবে ভালোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে– তা নিশ্চিত করতে সমগ্র আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে পুনর্র্নিমাণ করেছি। কিন্তু আমাদের এখন গণবিধ্বংসী একটি নতুন অস্ত্রের সঙ্গে লড়াই করতে হবে, যা আমাদের মানসিক এবং সামাজিক জগৎকে ধ্বংস করতে পারে। পরমাণুগুলো কিন্তু আরও শক্তিশালী পরমাণু আবিষ্কার করতে পারে না। অথচ এআই দ্রুতগতিতে আরও শক্তিশালী এআই তৈরি করতে পারে। তাই জনসমক্ষে শক্তিশালী এআই সরঞ্জাম নিয়ে আসার আগে সেগুলোর কঠোর নিরাপত্তা পরীক্ষা দাবি করা হবে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ঠিক যেমন একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি তাদের স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি উভয় পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করার আগে নতুন ওষুধ বাজারে ছাড়তে পারে না, তেমনি প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর উচিত হবে নিরাপদ প্রমাণ করার আগে কোনো এআই বাজারে না ছাড়া। নতুন প্রযুক্তির জন্য আমাদের মার্কিন খাদ্য ও ঔষধ প্রশাসনের সমতুল্য একটা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন, আসলে গতকালই এর কার্যক্রম শুরু হওয়া দরকার ছিল।
জনপরিসরে এআই মোতায়েন না করতে দিলে কি গণতন্ত্র আরও নির্মম কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে পিছিয়ে পড়বে? না; ঠিক উল্টো হবে। অনিয়ন্ত্রিত এআই মোতায়েন সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, যা স্বৈরাচারীদের কাজে লাগবে, গণতন্ত্রকে ধ্বংস করবে। গণতন্ত্র একটি সংলাপ, যা ভাষার ওপর নির্ভর করে। যখন এআই ভাষা হ্যাক করে, তখন আমাদের অর্থপূর্ণ সংলাপ করার সামর্থ্য ধ্বংস হয়। পরিণামে গণতন্ত্রও ধ্বংস হয়।
আমরা একটি অ্যালিয়েন বুদ্ধিমত্তার সম্মুখীন হয়েছি, এখানে পৃথিবীতে। আমরা এটি সম্পর্কে অনেক কিছু জানি না। শুধু জানি, এটি আমাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করতে পারে। তাই এআই সরঞ্জামের দায়িত্বজ্ঞানহীন মোতায়েন বন্ধ করা উচিত, যেন এআই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করার আগে আমরা এআইকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। নতুবা কারও সঙ্গে কথোপকথনের সময় আমি বলতে পারব না– এটি কি মানুষ, না এআই। এখানেই গণতন্ত্রের অবসান ঘটতে পারে।
এই লেখাটি একজন মানুষ দ্বারা তৈরি হয়েছে। আসলেই কি তাই?
ইয়োভাল নোয়া হারারি; জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক; ‘সেপিয়েন্স’ গ্রন্থের লেখক; দি ইকোনমিস্ট থেকে ভাষান্তর সাইফুর রহমান তপন
Discussion about this post