মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম
এ, কে,এম,আই,খায়রুল আলম, সিনিয়র সহকারি শিক্ষক, নিউ মডেল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা
গত দুই দশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমপ্রসারণের সাথে সাথে মানুষ তার অর্জিত জ্ঞানের ব্যাপক পারস্পরিক আদান-প্রদান করছে। আমাদের জ্ঞানের পরিধি যেমন দ্রুত সমপ্রসারিত হচ্ছে তেমনি জানার কৌশলগত দিকও দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতি, রাজনীতি, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাকুরীর ক্ষেত্রের ধরন, প্রাকৃতিক পরিবেশ, মানুষের নাগরিক চেতনাবোধ, বিশ্বায়নের ধারণা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান পরিবর্তন হচ্ছে, সাথে সাথে মানুষের জীবনযাত্রার মানও বাড়ছে। গত কয়েক দশকে পৃথিবী যেভাবে এগিয়ে গেছে তাতে দেখা যায় যে, শিখণের ধরন, পদ্ধতি, প্রয়োজন সহ অনেক কিছুই বদলে গেছে। বিংশ শতাব্দির শেষের দিকের শিক্ষার্থী আর বর্তমান একুশ শতকের শিক্ষার্থীর চাহিদা,আগ্রহ, রুচিবোধ, বিশেষ ঝোঁক, চিন্তা-চেতনা প্রভৃতির মধ্যে অনেক ব্যবধান। এখন শিক্ষার্থীরা শুধু শ্রেণিকক্ষে বা তাদের আবাসস্থলে বসে বই-এর পড়া মুখস্ত করে পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করলেই বর্তমান শতকের উপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবে না। এছাড়া নতুন শিক্ষানীতি অনুযায়ী এখন শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞান এবং নানা ধরনের চিন্তনদক্ষতা ও কর্মদক্ষতা যাচাই করার পদ্ধতি ভিন্ন হওয়ায় তারা না বুঝে শুধু মুখস্ত করে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে পারবে না। একুশ শতকের শিক্ষার্থীদের জীবন এবং জীবিকা সম্পর্কে দক্ষতা, নতুন নতুন শিখন কৌশল উদ্ভাবনের দক্ষতা এবং তথ্য, মিডিয়া ও প্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষতাসহ নানাবিধ পারস্পরিক যোগাযোগের দক্ষতা অর্জন করতে হবে। আর শিক্ষার্থীদের এই দক্ষতাগুলো মূল্যায়নের ক্ষেত্রে, শিক্ষাক্রমে, পেশাগত উন্নয়নে ও শিখন পরিবেশে শিক্ষকদেরও প্রয়োগ করতে হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শিখন-শেখানো কৌশল।
তথ্য ও প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ডিজিটাল যুগে শিক্ষাকে অনেক বেশি আনন্দদায়ক, সহজবোধ্য, শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক করে তোলাই হচ্ছে যে কোনো সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ার অন্যতম পূর্বশর্ত। সেদিক থেকে আমাদের বাংলাদেশও তার ব্যাতিক্রম নয়। “মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম” এবং “শিক্ষকদের দ্বারা ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি” কর্মসূচি শিক্ষার আধুনিকায়নে দুইটি মডেল। “তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষা নয়, বরং শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি” এই মূল মন্ত্র ধারণ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম এবং শিক্ষকদের দ্বারা ডিজিটাল কনটেন্ট। প্রতিটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে থাকবে কমপক্ষে ১টি ল্যাপটপ অথবা ডেস্কটপ কম্পিউটার, ১টি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ইন্টারনেট সংযোগ এবং অন্যান্য প্রচলিত উপাদান যেমন: টেক্সট বই, হোয়াইটবোর্ড/ব্ল্যাকবোর্ড, মার্কার/ চক, ডাস্টার প্রভৃতি। বিষয় শিক্ষকগণ নিজ নিজ বিষয়ের উপর প্রয়োজনীয় ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরি অথবা সংগ্রহ করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে ব্যবহার করে শ্রেণির কাজ পরিচালনা করেন। তবে এক্ষেত্রে শিক্ষকদেরকে আমাদের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ, ধর্মীয় মূল্যবোধ, নৈতিকতা প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত কিছু রীতি-নীতি, শিখন-শেখন কার্যাবলীর ধারাবাহিক নিয়ম (Pedagogy) এবং পাঠ সংশ্লিষ্ট ডিজিটাল উপকরণের যথার্থ ব্যবহার অর্থাত্ ICT Value অনুসরণ করে ডিজিটাল কনটেন্ট ডেভেলপ করতে হয়। বিষয় শিক্ষকগণ পাঠসংশ্লিষ্ট ডিজিটাল কনটেন্ট প্রস্তুত করার সময় সহজে বোঝা যায়, আকর্ষণীয়, তথ্যবহুল, শিক্ষার্থীর চিন্তন দক্ষতা উন্নয়নে সক্ষম এবং নিজস্ব সংস্কৃতি নির্ভর ছবি, ভিডিও, বিভিন্ন এনিমেশন প্রভৃতি পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করেন যাতে শিক্ষার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণের সম্পূর্ণ সুযোগ থাকে। ফলে শিক্ষার্থীরা কঠিন ও বিমূর্ত অথচ জীবনের জন্য অপরিহার্য বিষয়গুলো মুখস্ত না করে সহজে শিখতে পারছে। একসময় শিক্ষার্থীরা কঠিন ও বিমূর্ত বিষয়গুলো না বুঝে শুধু মুখস্ত করতো এবং পরীক্ষার খাতায় তা অনুরুপভাবে লিখতো। এতে তাদের মনে কখনই ঐ বিষয়বস্তু সম্পর্কে তেমন আগ্রহ বা মনোযোগ কোনটাই থাকতো না। বর্তমানে শিক্ষায় বিমূর্ত বলতে কিছু থাকবে না। শিক্ষার সব কিছুই শিক্ষার্থীর কাছে মূর্ত হয়ে ধরা দেবে। শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণে শেখন-শিখানো কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয় বিধায় লেখা-পড়ার প্রতি তাদের আগ্রহ সৃষ্টি হয়, মনোযোগ বৃদ্ধি পায় এবং শিখন দীর্ঘস্থায়ী হয়। শ্রেণিকক্ষে বসেই বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা থাকায় শিক্ষার্থীদের লুকিয়ে থাকা প্রতিভা ও বিশেষ দক্ষতা প্রকাশ পাবে।
শিক্ষার্থীরা এখন শিখনের ক্ষেত্রে সংশ্লেষণ, বিশ্লেষণ, মূল্যায়নের দক্ষতা অর্জনে নিজেরাই মুক্ত চিন্তা করতে সক্ষম হবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং শিখন-শেখানো পদ্ধতি এই দুইয়ের সমন্বয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের নিজস্ব চিন্তাশক্তি আর জ্ঞানের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় নিত্য নতুন জ্ঞানের উন্মেষ ঘটবে। শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহারিক দিকের যতই উন্নতি হবে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিমাণ এবং দক্ষতার মাত্রা দ্রুত বেড়ে যাবে। সময়ের এই অনিবার্য দাবীকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে নব উদ্ভাবিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য সারাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে পর্যায়ক্রমে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা এবং সেখানে শিক্ষকদের তৈরি ডিজিটাল কনটেন্টের সাহায্যে শিখন-শেখানো কার্যাবলী পরিচালনা করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে শিক্ষকগণ নিজেদের মধ্যে শিখন-শেখানো তথ্যসমূহ আদান-প্রদান করার কাজটি খুব সহজে করার জন্য ইতোমধ্যে একসেস টু ইনফরমেশন শিক্ষকদের জন্য তৈরি করেছে “শিক্ষক বাতায়ন” নামে এক Web portal (www.teachers.gov.bd)। এই Web portal-এ শিক্ষকদের তৈরি বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল কনটেন্ট নিজেরাই আপলোড করে রাখেন যা ইচ্ছে করলে অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ নিজে কনটেন্ট তৈরি না করেও তা শ্রেণিকক্ষে ব্যবহার করতে পারছেন।
Discussion about this post