শিক্ষার আলো ডেস্ক
চাকরির ফাঁকে ছুটে যান অসহায় মানুষের দ্বারে। বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রিতদের খাবার ও নতুন পোশাক পৌঁছে দেন। অভাবগ্রস্তদের চিকিৎসার খরচ ও ভিক্ষুকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। তীব্র শীতে নিম্নআয়ের মানুষগুলো যখন অসহায়। ছুটে যান তাদের কাছে। ব্যস্ত হয়ে পড়েন শীতবস্ত্র বিতরণে। কখনও গৃহহীনদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা। আবার কখনও অভাবগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ব্যবস্থা। তিনি সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক ইদ্রিস আলী।
যিনি চোখের সামনে কোনো মানবিক বিপর্যয় দেখলেই ছুটে যান সেখানে। এলাকার মানুষদের কাছে তিনি শুধু একজন শিক্ষকই নন, মানবতার ফেরিওয়ালা হিসেবেই অধিক পরিচিত।
প্রভাষক ইদ্রিস আলীর উত্থান কোনো সিনেমার গল্পের চেয়েও কম নয়। তার জন্ম সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার সুভদ্রাকাটী গ্রামে। দিনমজুর বাবার ৯ সদস্যের পরিবারে অভাব-অনটনে বেড়ে ওঠতে হয়েছে তাকে। সময়টা ২০১০ সাল। ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পান ইদ্রিস। আর্থিক দৈন্যদশায় বাড়ির গরুটিও শেষ পর্যন্ত বিক্রি করেন। সেই টাকা দিয়ে ভর্তি হন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর শুরু হয় জীবন সংগ্রামের নতুন অধ্যায়।
দিনমজুর বাবার পক্ষে তার পড়ালেখার খরচ বহন করা অসাধ্য হয়ে উঠে। এক সময় টিউশনি শুরু করেন। শত বাধা পেরিয়ে নিজের টাকায় চালিয়েছেন পড়াশোনা। প্রথমবারেই ৩৫তম বিসিএস-এ হয়ে যান শিক্ষা ক্যাডার। যোগ দেন সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে। চাকরিতে যোগদান করে সবাই যখন আরাম আয়েশে দিন কাটাতে ব্যস্ত, তখন মানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। দিনরাত ছুটে চলেছেন অসহায়দের দ্বারে দ্বারে।
উপকূলবর্তী এলাকায় বাড়ি হওয়ায় ছোট থেকে দেখেছেন প্রকৃতির সাথে লড়াই করে মানুষের বেঁচে থাকার দৃশ্য। বন্যা, আইলা, বুলবুলসহ নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে এ অঞ্চলের মানুষেরা নিরুপায়। এখানে প্রায় সারাবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। ছোট থেকেই কাছ থেকে উপলব্ধি করেছেন দুর্যোগে অসহায় মানুষের আর্তনাদ। তখন সংকল্প ছিল প্রতিষ্ঠিত হয়ে সমাজের অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করার। এ লক্ষে চাকরিতে যোগদানের পর ২০১৮ সালের মে মাসে ‘আগে মানবতা, পরে অন্য কথা’ স্লোগানে গড়ে তোলেন সামাজিক সেবা সংগঠন ‘হিউম্যানিটি ফার্স্ট’।
এরপর থেকে শুরু করেন অসহায়দের সহায়তা কার্যক্রম। সাতক্ষীরা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে খুলনা, ফেনী, মাগুরা, লালমনিরহাট, ঢাকা, পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে এ সংগঠনের কাজ।
ইদ্রিস আলী বলেন, আমরা মূলত ৪টি প্রজেক্টের আওতায় কাজ করে থাকি। চিকিৎসা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রক্ত। সংগঠনের উদ্যোগে ৪টি প্রজেক্টের আওতায় এ পর্যন্ত প্রায় ২৫০ প্রজেক্ট সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৫টি অসহায় ও ভূমিহীন পরিবারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি আশাশুনির এক ভিক্ষুককে ২৯ হাজার টাকায় ঘর নির্মাণসহ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চিকিৎসা খাতে ব্যয় হয়েছে ১৫ লাখ টাকারও অধিক। এর মধ্যে ৮০ জনের মতো রোগীকে সাহায্য করা হয়েছে।
এ পর্যন্ত ৫ লাখের অধিক ব্যয় হয়েছে শিক্ষা খাতে। যার মধ্যে ৫০ জন মেধাবী শিক্ষার্থীর পড়ালেখার যাবতীয় খরচ বহন ও বিভিন্ন দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের ফি দিয়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি করানো হয়েছে। এছাড়া ৭টি দরিদ্র পরিবারের মেয়ের বিয়েতে সাহায্য, সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলের ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনতে ১টি বেসরকারি স্কুল নির্মাণ ও প্রত্যন্ত এলাকায় লাইব্রেরি স্থাপন করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন উৎসবে দরিদ্রদের মাঝে পোশাক বিতরণ, বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রিতদের খাবার ও নতুন পোশাক সরবরাহ, শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ, হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগীদের জন্য রক্তের ব্যবস্থা এবং অসহায় ও গৃহহীনদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে এ সংগঠন।
সংগঠনের উদ্যোগে এবার আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় প্রায় ২৫ লাখ টাকার প্রজেক্ট সম্পন্ন করেছেন ইদ্রিস আলী। আম্ফানের তাণ্ডবে যখন সাতক্ষীরা-খুলনা উপকূলের ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত। পানিবন্দি হাজারো অসহায় মানুষ। তখন মানবতার টানে ছুটে গেছে সংগঠনের সদস্যরা। অসহায়দের বাড়ি বাড়ি রান্নাকরা খাবার ও সাত দিনের শুকনো খাবার পৌঁছে দিয়েছেন তারা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে টেকসই উন্নয়নেও কাজ করেছেন।
বাঁশ দিয়ে অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ, দুর্ভোগ কমাতে বন্যাপ্লাবিত এলাকায় ৫০০টি চুলা, ৩০০ স্যানিটারি টয়লেট ও নিরাপদ পানির জন্য ১২টি গভীর নলকূপ স্থাপন করেছেন। এছাড়া দুর্গত এলাকায় ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প করে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ ও ১২ হাজার খাবার স্যালাইন বিতরণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের আয়ের উৎস হিসেবে নৌকা, ভ্যান ও সেলাই মেশিন বিতরণ করা হয়েছে। মসজিদ সংস্কার এবং শিশুদের চিত্তবিনোদনের জন্য খেলাধুলা সামগ্রীও বিতরণ করেছে তারা। বস্ত্রহীনদের সমস্যা দূর করতে বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে মানবতার দেয়াল। এখানে সামর্থবানরা অসহায়দের সেবায় বস্ত্র রেখে যান। চাহিদানুযায়ী এখান থেকে নিয়ে যায় সামর্থহীনরা।
মহামারি করোনায় দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ফলে রোজগার না থাকায় বিপাকে পড়েছে নন এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা। কর্মহীন হয়ে কষ্টে দিনাপাতি করছে এমন অসংখ্য মানুষ। এমন কিছু মানুষদেরও নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে।
সম্প্রতি খুলনা জেলার কয়রায় ও সাতক্ষীরা শহরের নিউমার্কেট এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে ‘ফ্রি মেডিসিন ব্যাংক’। যেখান থেকে গরিব ও অসহায় মানুষেরা প্রয়োজন অনুযায়ী বিনামূল্যে ওষুধ নিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও ‘যাত্রা পথে অবসরে, সময় কাটুক বই পড়ে’ স্লোগানে খুলনার কয়রায় ‘লঞ্চঘাট পাঠাগার’ স্থাপন করা হয়েছে। এখান থেকে যাত্রিকালীন অবসর কাটাতে বিনামূল্যে বই পড়তে পারবেন যাত্রীরা। এ পাঠাগারে সাজানো রয়েছে দেশি বিদেশি অসংখ্য বই।
অর্থের যোগান দেন যেভাবে
সমাজের হৃদয়বান মানুষদের সহায়তায় এগিয়ে চলেছে সংগঠনটি। ইদ্রিস আলী বলেন, ‘আমাদের ‘হিউম্যানিটি ফার্স্ট’ নামে ফেসবুকে পেজ ও গ্রুপ আছে। এখানে সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচির তথ্য তুলে ধরি। কাউকে সহযোগিতার পূর্বে আমরা প্রথমে তার সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নেই। সবাই মিলে পরামর্শ করে যে যেমন পারি অর্থ জোগাড় করি। ফেসবুকে পোস্ট দেই। জনগণকে সাহায্যের হাত বাড়ানোর অনুরোধ করি। এসব দেখে দেশ-বিদেশের অনেকে আর্থিক সহযোগিতা করেন। এক্ষেত্রে প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে।’ এসময় আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের এসব মানবিক কাজে সমাজের মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তরা বেশি সহযোগিতা করলেও বিত্তবানদের সহযোগিতা তেমন চোখে পড়ে না।’
মানুষের জন্য কিছু করতে পারার মাঝে আনন্দ খুঁজে পান ইদ্রীস আলী। তিনি বলেন, ‘মানবিক কাজের মধ্যে অন্যরকম প্রশান্তি আছে। যখন কোনো আসহায়, দুস্থ মানুষকে সাহায্যের মাধ্যমে তার মুখে হাসি ফোটাতে পারি, তখন হৃদয়টা প্রশান্তিতে ভরে যায়। এ প্রশান্তি আর কোথাও পাইনা। মানব সেবার মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জন ও পরকালীন সফলতাই আমাদের মূল লক্ষ্য। প্রত্যেকেই যদি নিজের জায়গা থেকে সমাজের অসহায় মানুষদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে, তবে এ পৃথিবীটা মানবিক বিশ্ব হিসেবে গড়ে উঠবে।’
Discussion about this post