বই-পুস্তকে অনেক ধরণের আত্মকথা পড়েছি।কিন্তু কোন প্রধান শিক্ষকের আত্মকথা চোখে পড়েনি।যদিও একজন প্রধান শিক্ষকের আত্মকথা লিখার মত যথেষ্ট আকর্ষণীয় উপাদান রয়েছে।তাই আমি আমার অতি সাধারণ এবং অপ্রকাশিত স্মৃতিকথা লেখার সিদ্ধান্ত নিলাম।
প্রধান শিক্ষকের আসন পাওয়া যে চাট্টিখানি বিষয় নয় ;তা আমি মর্মে মর্মে টের পেয়েছি।একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে আমার প্রধান শিক্ষকের পদপ্রাপ্তির ইচ্ছে হয়েছিল।আমার পরিচিত কেউ কেউ ফাঁকেফাঁকে এই সোনার হরিণ পেয়েও গিয়েছিল;যদিও শিক্ষাগত যোগ্যতায় তেমন আহামরি কিছুই ছিলনা।একজন নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তাঁর উঁচু যোগ্যতা নিয়ে চায়ের দোকানে বসে বলছিল।আমি নীরবে শুনে গেলাম।কিছুই বলার ছিলনা।
সেদিন শরতের পড়ন্ত বিকেলে বিষণ্ণতা আমাকে ঘিরে ধরেছিল।প্রাইভেট টিউশনির বাজার মন্দা।আজকাল পড়ালেখার নিয়ম কানুনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে।গণিত শিক্ষক হিসেবে আমার বেশ সুনাম ছিল।এখনও আছে।কিন্তু সৃজনশীল পদ্ধতি কেন জানি অধরা রয়ে গেল।ফলে টিউশনিতে জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলি এবং আয়ে ভাটা পড়ে। এমতাবস্থায়, উচ্চপদ ব্যতীত সংসার চালানো কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।প্রধান শিক্ষকের বেতন সহকারি শিক্ষকের প্রায় দ্বিগুণ।ফলে এই পদের প্রতি আমার অনিবার্য আকর্ষণ ছিল কিন্তু অর্জন কঠিন ছিল।
আজ আমি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক।বাংলাদেশের ছোট্ট এক কোণে আমি বসবাস করি। আমার প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তির তিন বছর পূর্ণ হল। আজ মনে হল আমার একটা আত্মজীবনী লেখা উচিত।এই তিন বছরের অভিজ্ঞতা, অর্জন নিয়ে লেখা নিশ্চয় এই সমাজের চিত্র।অন্য অনেক প্রধান শিক্ষক আছেন যাদের সাথে আমার অভিজ্ঞতার অভিন্নতা খুঁজে পাওয়া যাবে।
প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগপ্রাপ্তি
বিগত দু’তিন বছর বেসরকারি পর্যায়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে NTRC.২০০৭ সাল থেকে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়।ধীরেধীরে এই প্রক্রিয়া পরিপূর্ণতা পাচ্ছে।যদিও শিক্ষা আইনের অভাবে এটি বিশৃঙ্খলাপূর্ণ বলে অভিজ্ঞজন মনে করেন।সে যাই হোক,সত্য হচ্ছে এই যে স্কুল কমিটির হাতে সহকারি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা রইল না।তাদের হাতে পিয়ন,আয়া, কেরানি, লাইব্রেরিয়ান, সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দানের ক্ষমতা রইল।ইতোমধ্যে আমার সমবয়সী অনেকেই সহকারী শিক্ষক থেকে একলাফে প্রধান শিক্ষক হয়ে গেলেন।নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হত।
প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হব -এই আশা মোটেই ছিল না।কারণ,পরীক্ষার মাধ্যমে পদ পাওয়ার আশা ক্ষীণ। কারণটি আপনাদের বলতে যাচ্ছি। তিনবার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়ে আমার এই বোধোদয় হয়েছে।লিখিত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েও প্রার্থী নিয়োগ লাভে ব্যর্থ হয়েছে।আমি নিজেই এর স্বাক্ষী। পরে সবই জানলাম এবং বুঝলাম।বিশ্বস্ত জনৈক সরকারি কর্তা বললেন,আপনি অফিস বুঝেননা;কিভাবে নিয়োগ পাবেন?চতুর্থবার আর ভুল করিনি।অফিস বুঝবার চেষ্টা করেছি এবং সফলভাবেই বুঝিয়েছি।কিন্তু অফিসের বাইরেই ছিল আসল কর্মকাণ্ড।
স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেয়া হল।আমি দরখাস্ত করলাম।দশজন প্রার্থী দরখাস্ত করল।প্রত্যেকেই কমিটির সভাপতির সাথে যোগাযোগ শুরু করল।আমিও যোগাযোগ শুরু করলাম। আমি ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতার সাহায্য চাইলাম।ভদ্রলোকের পড়া-লেখার দৌড় খুব একটা নেই;তবে চতুর মানুষ। বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মেম্বার নির্বাচিত হন।তার বিপক্ষে কেউ প্রার্থী হতেই সাহস করেনি।লোকে তাকে মাছ মন্ডল বলে চিনে।তিনি সহাঁস্যে আমাকে সাহায্য করতে রাজি হলেন।তবে শুরুতেই বললেন,স্যার আপনি মানি-সম্মানি মানুষ;জানেনতো বিনাপানিতে চিড়া ভিজেনা।তারপর অভ্যাসমত একটা অট্টহাসি দিলেন।তারপর আবার বললেন,স্যার উপরের নেতারা শুধু নিজেদের আখের ঘুচাচ্ছে।যারা পার্টির জন্য নির্যাতিত হয়েছে,জেল খেটেছে, তারা কিছুই পায়নি।তার কণ্ঠে তীব্র ক্ষোভ।তারপর বিনীত স্বরে বললেন,কিছু মনে করবেন না স্যার; একটা সিগারেট খাচ্ছি।”আরে না, কিছু মনে করব কেন?” অতঃপর বেনসন সিগারেটের প্যাকেট টেবিলের উপর রাখলেন।আমার দিকে অতি ভদ্রভাবে প্যাকেট এগিয়ে দিলেন।লাইটারে ফ্লাস দিয়ে আমাকে ধরিয়ে দিলেন এবং কণ্ঠে গাম্ভীর্য এনে বললেন, স্যার হেডমাস্টারি না করলে হয়না? দেখবেন একদিনের জন্যও শান্তি পাবেননা।ঐ স্কুলের পরিবেশ খুবই খারাপ। সভাপতি একটা শয়তান।দেখবেন সব কাজে ভাগ বসাবে। কতবার শালিস করতে হল।আমি বললাম,ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চললে একটু আধটু ঝামেলাতো হবেই।আশাকরি সব ঠিক হয়ে যাবে।আশে পাশেতো আপনারা আছেন।
মন্ডল মেম্বার খুশি হলেন।আমি এর ফাঁকে নিঃশর্তভাবে তাকে পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা খাম দিলাম এবং বললাম নিয়োগ নিশ্চিত হলে আরো একলাখ দেয়া হবে। তিনি বললেন, আপনি নিঃশ্চিন্ত থাকুন,চেয়ার আপনিই পাচ্ছেন।আপনার যোগ্যতা আছে ;আমরা জানি।কিন্তু এখন যেভাবে দেশ চলছে আপনাকেও সেভাবে চলতে হবে।মাগরিবের আযান পড়ল।আমি বিদায় চাইলাম আর আশাবাদী মন স্বপ্নপুরণের সময়ের অপেক্ষা করছে।আমার মন উড়ছে। চা দোকানের বিশৃঙ্খল চিৎকার চেঁচামেচি মনে হলো,বেটোফেনের অনন্য সুরের ইন্দ্রজাল।
Discussion about this post