আফসার আহমেদ
প্রফেসর মুস্তাফা নূরউল ইসলাম আমার শিক্ষক। শুধু শিক্ষক নন, তিনি আমার মতো অসংখ্য মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর মৃত্যুর ঠিক পরপর তাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে শুরুতেই মনে হচ্ছে, ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের ইতি ঘটলো।
তিনি একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রতিকৃতি। মুস্তাফা স্যারকে যখন প্রথম দেখেছিলাম, তা ভাবলেই মনে পড়ে আমাদের প্রথম বর্ষের পরিচিতি অনুষ্ঠানে দেখা অসাধারণ সুন্দর একজন মানুষের কথা। একজন কৈশোর উত্তীর্ণ তরুণ, আমার কাছে মনে হয়েছিল গল্প-পুরাণে শোনা কোনো দেবতা সামনে বসে আছেন। হাফ হাতা রঙিন হাওয়াই শার্ট পরা তাপস। সেই যে মুগ্ধতার শুরু তা আজও বিদ্যমান আমার সমস্ত চেতনায় এবং সেই তিনি হয়ে উঠতে থাকলেন আমার কাছে ধ্রুব এবং জ্যোতিষ্ফ্মান একজন মানুষ, যিনি নির্ভরতার ভুবন তৈরি করে দিলেন আমার মনে।
মুস্তাফা স্যারের সঙ্গে শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক আজ প্রায় চল্লিশ বছর। বিভাগের ছাত্র হিসেবে দেখেছি, আবার তার সহকর্মী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করার পরে তাকে দেখেছি। একজন মানুষ কতটা আধুনিক হতে পারেন তার উদাহরণ ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। সময়কে ধারণ করতে পারেন, বরণ করতে পারেন অনায়াসে এবং সময়ের আবর্তে হারিয়ে না গিয়ে সময়কে নতুন করে নির্মাণ করতে পারেন মুস্তাফা স্যার। তাকে দেখলে আমার মনে হয়েছে বরাবর, জ্ঞান এবং মৃত্তিকালগ্নতার অপূর্ব সমন্বয় তাকে মানুষের কাছ থেকে দূরবর্তী করেনি। আর তাই তো তিনি ছাত্রদের কাছে প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় হয়ে আছেন, থাকবেন। একবার তার কাছে পৌঁছাতে পারলে তিনি এক মুগ্ধতার জগৎ নির্মাণ করেন শ্রোতার চেতনায়। আমি দেখেছি ৪০ বছর, কম তো নয়। এক জীবনে স্যারের সঙ্গে এতগুলো বছর সম্পর্কিত থাকা সে এক পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম স্যার এক অননুকরণীয় শৈলী নির্মাণ করেছিলেন তার চলায়, কথায়, লেখায় এবং ভাষণে। আমরা শ্রেণিকক্ষে দেখতাম আর ভাবতাম এত সুন্দর করে একজন মানুষ কী করে কথা বলতে পারেন! তিনি আধুনিক সাহিত্য পড়ানোর সময় আমাদের বোধে নির্মাণ করতেন আধুনিক হয়ে ওঠার মানসিকতা। একজন প্রকৃত শিক্ষক তাই করেন, ছাত্রদের লেখাপড়ার পথটি চিনিয়ে দেন, জানবার বাসনাকে উসকে দেন আর প্রত্যয় জাগিয়ে তোলেন শিক্ষার্থীর অন্তরে। তিনি তাই করেছেন সারাজীবন। শিক্ষকতাকে জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছেন তিনি। শিক্ষকতার পাশাপাশি পত্রিকা সম্পাদন করেছেন। নতুন লেখককে লেখা শিখিয়েছেন একজন যোগ্য ও সতর্ক সম্পাদক হিসেবে। আমার মনে আছে, আমি তার সম্পাদিত ‘সুন্দরম’ পত্রিকায় লেখার সময় বিষয় নির্বাচন ও বিষয়বিন্যাস থেকে শুরু করে কী করে একজন লেখকের স্বতন্ত্র রীতি তৈরি হয়, সেই পরামর্শ দিয়েছেন। সুন্দরমের প্রতিটি সংখ্যা ছিল বিষয়ে স্বতন্ত্র। দিনের পর দিন বাংলা একাডেমির প্রেসে বসে প্রুফ দেখেছেন, পত্রিকা ছাপা হলে পত্রিকার কপি ও লেখক সম্মানী নিয়মমাফিক প্রদান করেছেন। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি কোনোদিন।
আমি নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সভাপতি হলাম যখন, তখন স্যারকে আমাদের বিভাগে অতিথি অধ্যাপক করে নিয়ে এসেছি। প্রায় ছয় বছর টানা নিয়ম করে বিভাগে এসে ক্লাস নিয়েছেন স্যার। আমরা ছাত্রদের দেখাতে চেয়েছি স্যারের মতো একজন শিক্ষকের কাছে পড়ার সৌভাগ্য হলে জীবন কেমন করে বদলে যেতে পারে। স্যার করিডর দিয়ে হেঁটে ক্লাসে যেতেন, করিডরে ছাত্রছাত্রীরা শ্রদ্ধায় তাকিয়ে থাকত। স্যার ক্লাসে রবীন্দ্রনাটক পড়াতেন। আমাদের ছাত্রদের কাছে সে এক সুবর্ণ সঞ্চয়। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম যেদিন জাতীয় অধ্যাপক হলেন আমরা বললাম স্যার আমাদের বিভাগের সঙ্গে আপনি সংশ্নিষ্ট থাকবেন। আমাদের অনুরোধে স্যার সম্মত হলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ পেল একজন জাতীয় অধ্যাপক। আমাদের গৌরবের সীমা নেই। স্যারের আসা-যাওয়ায় কষ্ট হতো। তাও আসতেন। এসে বক্তৃতা করতেন। স্যার যেদিন আসতেন সেদিন আমাদের বিভাগের ছাত্র-শিক্ষক সবাই তার বক্তৃতার শ্রোতা থাকত। বিভাগটি হয়ে উঠত উৎসবমুখর।
মুস্তাফা স্যার আমার পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। স্যারকে ভালোবাসি যেমন, ভয়ও পাই তেমনি। আর এই ভয় আসে শ্রদ্ধা থেকে এবং তার কাছে গেলে নিজের অসীম মূর্খতার প্রকাশ ঘটে- এ জন্য ভয় পেতাম। তবু স্যার স্মিত হেসে কথা বলতেন আর আমাদের সামনে স্পষ্ট সাহিত্য ও রাজনীতির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ- কত বিচিত্র বিষয়ে তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। বিশ্বসাহিত্য ও সমকালীন রাজনীতি সবকিছু একাকার হতো সেই আলাপচারিতায়। কথা বলতেন স্যার, আর আমরা মুগ্ধ শ্রোতা। পিএইচডির একটি অধ্যায় একদিন স্যারের কাছে দিলে তিনি পাতা উল্টান আর কেটে দেন। সব পৃষ্ঠা কেটে তিনি বললেন নতুন করে লিখে আনতে। আমার খুব কষ্ট হলো, অভিমান হলো। এত কষ্ট করে লিখলাম, স্যার না পড়েই কাটলেন। আমি এক সপ্তাহ পরে সেই একই লেখা এদিক-সেদিক করে আবার স্যারের কাছে দিলাম, ভাবলাম ধরতে পারবেন না। স্যার পড়েন কিন্তু এবার আর কাটেন না। আমি খুশি। যাক তাহলে ধরতে পারেননি। আমার ভুলটা টের পেলাম স্যারের ভ্রুকুঞ্চন দেখে। লেখাটি টেবিলে রেখে তিনি আমার দিকে তাকালেন। বললেন, তোমার কেন মনে হয়েছে আমি না পড়েই তোমার লেখা কেটেছি? আমি ভয় ও লজ্জায় পালাতে পারলে বাঁচি। আবার লিখে আনতে বললেন। আমার সঙ্গে কথা বললেন। কোনো রাগ নেই- সৌম্য এক সন্তের মুখচ্ছবি। আমি পনেরো দিন খেটে নতুন করে লিখে আনলাম। স্যার দেখে বললেন, ঠিক আছে পরের অধ্যায় লেখো। আমি জানলাম কী অসাধারণ ধীমান পাঠক স্যার এবং কী অপরিসীম ধৈর্য তার। আমার জীবনের সেই শিক্ষা আজও আমাকে অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত করে।
মুস্তাফা স্যার রাজনীতির কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু, তার প্রিয় মুজিব ভাইয়ের গল্প শোনাতেন। একজন প্রকৃত নেতার প্রতিচ্ছবি নির্মিত হতো স্যারের কথায়। মানুষের সঙ্গে মিশে, মানুষের কথা বলে এবং মানুষকে ভালোবেসে কী করে একজন মানুষ বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন সেই গল্প শোনাতেন স্যার। বাংলাদেশের রাজনীতির সংবাদ রাখতেন নিয়মিত, এখনও রাখেন, যদিও ভালো করে দেখতে পারেন না বলে পত্রিকা পড়া তার হয়ে ওঠে না। বঙ্গবন্ধুর কন্যা দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং তার নিরলস দেশসেবার কথা স্যার বিশ্নেষণ করতেন এবং তার কাজের মূল্যায়ন ও প্রশংসা করে লেখা খুব প্রয়োজন এ কথা স্যার বলতেন।
মুস্তাফা স্যার একজন মুক্তিযোদ্ধা। লন্ডনে পিএইচডি করার সময় পরিবার-পরিজন দেশে রেখে গিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় পরিবারের কোনো খবর পাননি। সেই সময় প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরির কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। দেশের প্রতি, দেশের স্বাধীনতার প্রতি প্রবল ভালোবাসা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাধীনতা পদক দিয়ে সম্মানিত করেছে, জাতি সম্মানিত হয়েছে।
মুস্তাফা স্যার অবসরে যাওয়ার পরও আমার সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। কয়েকদিন যোগাযোগ না হলে তিনি অস্থির হয়ে উঠতেন। তার এই মমত্ববোধ আমাকে নির্ভয় করত। ভাবতাম, একজন মানুষ তো আছেন যিনি মাথার ওপর ছায়া হয়ে রয়েছেন। স্যার সম্পর্কে এত অল্প পরিসরে সব বলা যায় না, সম্ভবও নয়। আমার ছাত্র কামরুল ইসলাম মুস্তাফা স্যারের জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করছেন। আমি তার তত্ত্বাবধায়ক। কামরুলের কাজের ভেতর দিয়ে এই জ্ঞানতাপসের জীবনের বিবিধ দিক উঠে আসবে।
আমার প্রতি স্যারের অপরিসীম স্নেহের একটি স্মৃতি টেনে এই লেখা শেষ করব। আমি তখনও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর। প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর যখন হই স্যার খুশি হয়েছিলেন কিন্তু এ কথাও বলেছিলেন লেখাপড়া ছেড়ে এই উটকো ঝামেলায় কেন গেলাম। আমাদের অল্প সময়ের কার্যকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক শিক্ষক তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর আনোয়ার হোসেনের পদত্যাগের দাবিতে একটি আন্দোলন তৈরি করে। এই আন্দোলনে সৃষ্ট অরাজকতা দীর্ঘ কয়েক মাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও সব প্রশাসনিক কার্যক্রম অচল করে দেয়। আন্দোলনের ফলে আমরা দুই প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর চৌদ্দ দিন ভাইস চ্যান্সেলর অফিসে আটকা পড়ে থাকি। ঘেরাও থাকা অবস্থায় আমরা বাইরে আসার কোনো সুযোগ পাইনি। সেই সময় মুস্তাফা স্যার ফোন করলেন। আমি ক’দিন যোগাযোগ করতে পারিনি এই ভয়ে ফোনে তটস্থ। স্যার বললেন, তোমার খবর না পেলে আমি যে উদ্বিগ্ন থাকি এটা জানো না? আমার চোখে পানি এসেছিল। এত মায়াময়, এত স্নেহপরায়ণ আমার শিক্ষক প্রফেসর মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। আমি তখন জেনেছি শিক্ষকের এ রকমই হতে হয়। ছাত্রের জন্য এবং কেবলই ছাত্রের জন্য যারা উদ্বিগ্ন থাকেন। ছাত্রের আনন্দে ও কষ্টে সমানভাবে আনন্দ ও কষ্ট পান।
প্রফেসর মুস্তাফা নূরউল ইসলাম বাংলাদেশের গৌরব। একজন প্রকৃত শিক্ষকের প্রতিচ্ছবি। জ্ঞান বিতরণ ও আহরণে যিনি পুরোটা জীবন পার করেছেন। সব কূপম ূকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন সব সময়।
প্রিয় শিক্ষক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম পরিণত বয়সে মহাসিন্ধুর ওপারে গেলেন, তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের আলোকবর্তিকা হয়ে অনন্তকাল।
Discussion about this post