এম, সারওয়ার
এমপিওহীন (মান্থলি পে-অর্ডার) শিক্ষকদের দীর্ঘ আন্দোলন,ধর্মঘট, অনশনে সমাধানের আশ্বাস মিলেছে শুধু ! কাজের কাজ কিছুই হয়নি।এটা ভাবা সত্যিই কঠিন যে কিছু মানুষের অবিমৃষ্যকারিতায় দেশের হাজার হাজার শিক্ষক নিকৃষ্ট জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু দেশের শিক্ষার চাকা সচল রাখতে এই নন-এমপিও শিক্ষকরা বিনা পয়সায় শ্রম দিয়েছেন বছরের পর বছর, কেউ কেউ প্রায় ১৫-২০ বছর ধরে। শ্রমের ন্যূনতম স্বীকৃতিটুকু পর্যন্ত না পেয়েও তাঁরা শ্রম দিয়ে গেছেন শুধু এই আশায় যে একদিন তাঁদের কাজের স্বীকৃতি মিলবে। আজ সেই দিন এসেছে! ভাগ্য বদলেছে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর।
সামাজিক পরিচয় মানুষ গড়ার কারিগর সম্মানিত শিক্ষক।কিন্তু বাস্তবে ছাত্র-ছাত্রীদের বিনা পয়সায় পড়াতে হচ্ছিল বছরের পর বছর। ঘরে নুন আনতে পানতা ফুরোয়!বুকে জমে থাকা এ কষ্ট থেকেই দু বছর আগে আমরণ অনশনে নামা স্কুল শিক্ষক আলী আকবর স্মৃতিচারণ করছিলেন কান্নাজড়িত কন্ঠে- সেদিন হাজারো শিক্ষক, পুরুষ মহিলা কাফনের কাপড় নিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়েছিলাম।‘এমপিও দিন জীবন বাঁচান’–অশ্রুভেজা এমন শ্লোগানে রাজপথের পাথরও ভিজে গিয়েছিল।ক্ষুধায় তৃষ্ণায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন অনেক সহকর্মী।তাদের আহাজারিতে সংবাদকর্মীরাও অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি।
শিক্ষিকা হাসিনা বেগম বলেন, ১৫ বছরের শিক্ষকতা জীবনে হাজার হাজার ছাত্রকে পড়িয়েছি। কেউ আজ ডাক্তার কেউ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত। অথচ আমরা যারা তাদের গড়েছি, তারাই আজ মানবেতর জীবন যাপন করছি! এ কষ্ট সইবার মত নয়।
শিক্ষক জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত অসুস্থ শিক্ষক হায়দার চৌধুরীর আক্ষেপ- সাধারণভাবে গড়ে এ দেশে একজন মানুষের চাকরিজীবন বছর ত্রিশেক। যৌবনেই প্রাণী সর্বাপেক্ষা সৃজনশীল। জীবনের স্বর্ণপ্রসূকালের দুই-তৃতীয়াংশই এসব নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীর রইল নিষ্ফলা। কে তার দায় নেবে? যে যুবক ২০ বছর বিনা পয়সায় শ্রম দিচ্ছেন তাঁর যৌবনের হারানো ২০টি বছর কে ফিরিয়ে দেবে? যারা আন্দোলন করতে করতেই চরম হতাশা নিয়ে মারা গেছেন তাদের জন্য কি বলার আছে? এসব প্রশ্ন তাড়িত করবে কি এই অন্ধ সমাজকে!
এমন হাজারো কষ্টের অবসান হয়েছে আজ ২০২০-এ।যুগান্তর কষ্টের ফসল হিসেবে বুধবার(২৯ এপ্রিল) ঘোষিত এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকায় নিজেদের প্রতিষ্ঠানের নাম দেখে যুগপৎ আনন্দ বেদনায় অশ্রুসিক্ত হয়েছেন অনেকে । সংগ্রামটা দীর্ঘ হলেও শেষ ভরসা ছিল যাঁর প্রতি সেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের নিরাশ করেননি। শেষ হয়েছে তাদের শত শত মানববন্ধন, ধর্মঘট-অনশনের মত কর্মসূচিও। প্রতিষ্ঠানের তকমাও এখন নন-এমপিও থেকে এমপিও। বছরের পর বছর বেতন ছাড়া খেটে আসা কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের পরিবারের মুখেও আজ হাসি। কারণ, আন্দোলন-ধর্মঘটের কষ্টটা যে তাদের একেবারেই শেষ হয়েছে। অপেক্ষা এখন শুধুই নিয়মতান্ত্রিকতা।
তথ্যমতে, নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বশেষ এমপিওভুক্ত করা হয়েছিল ২০০৯ সালের ১৬ জুন। সেবার সারাদেশের এক হাজার ৬০৯টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে (স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি) এমপিওভুক্ত করা হয়। প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী সে সময় সরকারি বেতনের আওতায় এসেছিলেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই হাজার ৭৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ঘোষণা দেন। এরপর গত নভেম্বরে আরো সাতটি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরও ছয় মাস ধরে নানা যাচাই-বাছাইয়ের কবলে পড়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মধ্যে এই নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের হাহাকার আরো দীর্ঘ হচ্ছিল। অবশেষে সাধারণ ছুটির মধ্যেও কাজ অব্যাহত রেখে যাচাই-বাছাই শেষ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত বুধবার মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এক হাজার ৬৩৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিও কোড দেওয়ার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে। আর বৃহস্পতিবার(৩০ এপ্রিল) কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগ ৯৮২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিও কোড প্রদানে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ও মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে। এখন শিক্ষক-কর্মচারী হিসেবে তাঁদের এমপিওভুক্তির এবং বেতন-ভাতা পেতে আর কোনো বাধা থাকল না।
কিন্তু কবে বেতন পাবেন সদ্য চূড়ান্ত তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা? জানতে চাইলে মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, তালিকাভুক্ত হওয়া প্রতিষ্ঠানকে এখন যে কাজটি করতে হবে, তা হলো- বিধি অনুযায়ী নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীরা তাদের প্রতিষ্ঠানপ্রধানের মাধ্যমে এমপিওভুক্তির আবেদন করবেন এবং আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষ করবেন। এরপরই তারা বেতন-ভাতা পাবেন। আদেশ এখন জারি হলেও পূর্বঘোষণা অনুযায়ী এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা গত বছরের ১ জুলাই থেকে বেতন-ভাতা পাবেন।
বুধবারে ঘেষণা আর ‘বৃহস্পতিবারের মধ্যেই স্কুল-কলেজের এমপিও কোড প্রদান শেষ করে এরপর শনিবার (২ মে) থেকেই অনলাইনে আবেদন করতে পারছেন শিক্ষকরা! এ প্রসংগে মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক আরও বলেন, যেহেতু এসব কাজ অনলাইনে হয়, তাই শিক্ষক-কর্মচারীরা ঘরে বসেই তাঁদের প্রতিষ্ঠানের এমপিও কোড জানতে পারবেন। আমরা চেষ্টা করব মে মাসের এমপিও মিটিংয়েই বেশির ভাগ শিক্ষক-কর্মচারীকে এমপিওভুক্ত করতে। যদিও জুন মাসে এমপিওর সভা নেই, তার পরও প্রয়োজন হলে ওই মাসে বিশেষ মিটিং করে তাঁদের এমপিও প্রদান করা হবে। আমরা চলতি অর্থবছরেই প্যাটার্নভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের সবার এমপিও নিশ্চিত করতে চাই।’
এত দ্রুত এতসব কাজ ও প্রক্রিয়া হয়ে যাবে তা যেন ছিল কল্পনারও অতীত! নুতন এমপিওভুক্ত সকল শিক্ষক কর্মচারী ও সকল শিক্ষক সংগঠন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষাউপমন্ত্রী এবং শিক্ষা অধিদপ্তরের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
Discussion about this post