তোফাজ্জল লিটন
ছাত্র-ছাত্রীদের জীবন বাঁচানোর জন্য এক যুবক-শিক্ষকের রক্তে রক্তিম হয়েছিল মতিহারের সবুজ ঘাস। ১৮ ফেব্রুয়ারি শহীদ হওয়া ড. শামসুজ্জোহা নামের সেই মহৎপ্রাণ শিক্ষকের কথা জানল না বাংলাদেশ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান এ শিক্ষক বলেছিলেন ‘ছাত্রদের গায়ে গুলি লাগার আগে সেই গুলি আমার বুকে লাগবে।’ এমন মহিমান্বিত কথা পৃথিবীর বুকে কে শুনেছে কবে? সেই শিক্ষকের আত্মত্যাগের কথা জানবে না দেশের আগামী প্রজন্ম- এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে!
শহীদ ড. শামসুজ্জোহা একটি নাম। একটি ইতিহাস। যে ইতিহাসটি হওয়ার কথা ছিলো সমগ্র বাংলাদেশের। সেই ইতিহাসটি হয়ে রইলো শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। আর ইতিহাসটি স্মরণ করে গেলো শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা। দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সে গৌরবজনক ইতিহাস জানলো না বাংলার আপামর জনতা।
আজকের যে শিশু বেড়ে উঠছে স্বাধীন দেশের হাওয়া আর জলে, সেই শিশু কোনো দিন জানতেও পারবে না কেমন উত্তাল ছিল ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনিত আগরতলা ষড়যন্ত্রমূলক মামলার বিরুদ্ধে বাংলার জনতা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সেই অগ্নিঝরা দিনগুলির ২০ জানুয়ারি পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আমানুল্লাহ আসাদুজ্জামান।
সেই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখ ঢাকা সেনানিবাসে হত্যা করা হয় সার্জেন্ট জহুরুল হককে। এ দুই হত্যায় দেশের মানুষের মধ্যে আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। হত্যার প্রতিবাদে ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহস্র ছাত্র-ছাত্রী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে শহরে যাওয়ার চেষ্টা করে। কাজলা গেটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সে মিছিলে গুলি করতে প্রস্তুতি নেয়। এ সময় ড. জোহা নিজের প্রক্টর পরিচয় দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সেখান থেকে সরে যেতে বলেন। পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা তার দাবি মানতে অস্বীকার করলে তাদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন জোহা । এরই এক পর্যায়ে বর্বররা তাকে গুলি করে । পরে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর বর্বররা এই প্রথম কোনো বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হলো ড. শামসুজ্জোহার নাম। তাঁর হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলেনের অনল দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তৎকালীন র্পূব পাকিস্তানের প্রতিটি শহর-বন্দও, গ্রাম-গঞ্জ আর প্রতান্ত প্রান্তরে। জোহার সেই সবুজ চেতনায় কি সজিব হতে পারবে না আমাদের সন্তানেরা ? না। কারণ, রাষ্ট্র এ জাতিকে জোহার চেতনা এবং ইতিহাস জানানোর কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। এ কেমন দেশ যারা বীরের সম্মান দিতে পারে না ! এ কেমন সরকার যারা জোহার রক্তের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে না!
যে রাষ্ট্র জোহার মতো বীরের স্বীকৃতি জানাতে কুন্ঠাবোধ করে, সেই দেশের জন্য কে জীবন দিতে হবে আগওয়ান। আজ আর দেশের জন্য কেউ আর জীবন দিতে চায় না। কেউ জীবন দেয় না। সবাই দেশ থেকে নিতে চায়। এ রাষ্ট্র এখন আমাদের লুটেরা হতে শেখায়। চাটুকার হতে শেখায়। দালাল হতে শেখায়। তাই দেশে আজ লুটেরা, চাটুকার আর দালালের জয় জয়াকার।
ড. জোহার মৃত্যুর ৩৯ বছর পর ২০০৮ সালে রাষ্ট্র তাকে শুধু স্বাধীনতা পুরস্কার এবং তার নামে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে দায় সেরেছে। একুশে পদক দেওয়া হয়নি ড. জোহাকে। এজন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার আবেদন জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।
পৃথিবীর ইতিহাসে ছাত্রদের জন্য শিক্ষকের জীবন দেওয়ার ঘটনা বিরল। ১৮ ফেব্রুয়ারি ড. জোহার শহীদ হওয়ার দিনটিকে শিক্ষক দিবস ঘোষণার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন করছে। প্রত্যেক সরকারের কাছে এই দাবি জানানো হলেও আজ পর্যন্ত কেউ কর্ণপাত করেনি। বর্তমান সরকার নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার বলে দাবি করে। অথচ এ বিষয়ে তাদেরও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
ইউনেসকো ১৯৯৪ সাল থেকে ৫ অক্টোবরকে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করছে শিক্ষকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশ স্বতন্ত্র শিক্ষক দিবস পালন করে। আমাদের পাশের দেশ, ভারত তাদের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান-এর জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বরকে সে দেশে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করে। তিনি পেশায় শিক্ষক ছিলেন। এমন কী নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকায় র্পযন্ত স্বতন্ত্র শিক্ষক দিবস পালন করে তাদের শিক্ষকদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে। বাংলাদেশে ‘হাত-ধোয়া’ দিবসের মতো দিবস পালন করা হয় সরকারিভাবে। অথচ বাংলাদেশে শিক্ষকের এতবড় গৌরবজনক ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও এ দেশে শিক্ষকদের কোনো স্বতন্ত্র দিবস নেই।
প্রশ্ন উঠতেই পারে -কী করে শিক্ষকদের প্রতি সম্মান দেখাতে শিখবে আমাদের আগামী প্রজন্ম। বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশের শিক্ষক দিবসের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় তার মধ্যে বাংলাদেশের একজন শিক্ষকের আত্মদানের ইতিহাসই মহত্তম। ১৯৬৯ সালের স্বাধীনতার পূর্বলগ্নে বাংলাদেশের ইতিহাসেই সে আত্মদানের ঘটনাটি ঘটেছে। অথচ ১৮ ফেব্রুয়ারিকে শিক্ষক দিবস করার জন্য কোনো বুদ্ধিজীবীকেও বলতে দেখা যায় না, লিখতে দেখা যায় না, এ নিয়ে কোন দাবী তুলতেও দেখা যায় না। এটাকে কি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হীনমন্যতা বললে অত্যূক্তি হবে!
ড. শামসুজ্জোর ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেরা বিশ্ববিদ্যাল থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পরও মফস্বলের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করাকে শ্রেয়জ্ঞান করেছিলেন ড. জোহা। রাজশাহীকে ভালোবেসেছিলেন, বাংলাদেশকে ভালোবেসেছিলেন। ছাত্রদের রক্ষায় নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি।
আমাদের দাবি- মহান এই ব্যাক্তির চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। বাংলাদেশে জাতীয় শিক্ষক দিবস ঘোষণা করা হোক ১৮ ফেব্রুয়ারিকে।
Discussion about this post