ভারত এবং পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর (১৯৪৭) উপনিবেশিক শাসনের ক্ষতিকর দিকগুলি দূরীভূত করার জন্য একটি পরিকল্পিত ও ব্যাপক শিক্ষা বিষয়ক পুনর্গঠনের দায়িত্ব নতুন পরিকল্পনাকারীদের ওপর অর্পিত হয়।
১৯৪৭ পরবর্তী পর্যায় ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৭ সালে। এই সালটি এক জলবিভাজিকা, যেমন রাষ্ট্রনৈতিকভাবে তেমনি শিক্ষার ক্ষেত্রেও। এরপর বাংলাদেশের শিক্ষানীতি ও শিক্ষা কার্যক্রম যে পথ ধরে অগ্রসর হয়, তা ভারতীয় ধারা থেকে স্বতন্ত্র। এ বিষয়ে দুদেশের যে সম-ঐতিহ্য, তার প্রভাব মুছে যায়নি, যেহেতু ব্রিটিশ শাসনামলে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানগুলির অস্তিত্ব অব্যাহত থাকে। এর পর যে প্রতিষ্ঠানগুলির পত্তন হয়, সেক্ষেত্রেও পুরানো আদল, অল্পবিস্তর পরিবর্তনসহ, অনুসৃত হয়। যেমন জীবনে তদ্রুপ শিক্ষা ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ ছেদের অবকাশ নেই।
ব্রিটিশ শাসন রেখে গিয়েছিল একটি উত্তরাধিকার। সংক্ষেপে, পশ্চিমি ধারায় ১৮৩৫-এর ভারতীয় শিক্ষা প্রসঙ্গে মেকলের প্রস্তাবানুযায়ী (Mecaulay’s Minute, 1835) শিক্ষার মাধ্যম স্থির হয়েছিল ইংরেজি, আর শিক্ষার বিষয়গুলি এসেছিল পশ্চিমের উদারনৈতিক শিক্ষার বিবিধ বিদ্যা থেকে। শিক্ষায় গৃহীত হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলের সম-অধিকারের নীতি। সনাতন প্রাচ্যবিদ্যা ভিত্তিক শিক্ষার জন্য সরকার কোন দায়-দায়িত্ব বহন করবেনা, এদের দায়িত্ব এরাই পালন করবে। সরকারের সবিশেষ দৃষ্টি ছিল উচ্চশিক্ষার উপর; ভাবা হয়েছিল, সুসংগঠিত উচ্চশিক্ষার প্রভাব পড়বে নিম্নতর মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরসমূহে।
১৯৪৭ সালের পরিস্থিতির মধ্যে সাধারণভাবে সেকালে নির্দেশিত ও পরবর্তীকালে বিভিন্ন কমিটি-কমিশন দ্বারা সমর্থিত ব্রিটিশ নীতির প্রতিফলনই দেখা যায়। সার্জেন্ট কমিটির রিপোর্ট (১৯৪৪), যা পুরোপুরি সরকারি ব্যবস্থাপনায় এক নতুন প্রাথমিক শিক্ষা-ব্যবস্থার সুপারিশ করেছিল, ওই সময়ে পাকিস্তানের অংশে পরিণত বাংলাদেশের জন্য কার্যকর হলো না। একে যথাযোগ্য গুরুত্ব দিয়েছিল ভারত, পাকিস্তান দেয় নি। ইতোমধ্যে শিক্ষা পরিণত হয়েছে প্রাদেশিক বিষয়ে; করাচি, পরে ইসলামাবাদের কেন্দ্রীয় সরকার দূর থেকে নজরদারি করেছে। মাঝে-মধ্যে যে হস্তক্ষেপ করেছে তার মধ্যে সদিচ্ছার প্রকাশ যেমন ছিল, আবার অজ্ঞতা-প্রসূত ও কুফল প্রদায়ী হস্তক্ষেপও কোন কোন ক্ষেত্রে ঘটেছে।
স্বাধীনতা লাভের পর পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক সরকার স্কুল পর্যায়ে একটি নতুন পাঠ্যক্রম প্রস্ত্ততির লক্ষ্যে প্রবীণ রাজনীতিক ও ইসলামি শাস্ত্রে সুপন্ডিত মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ’র নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে। কমিটির সুপারিশকৃত প্রাথমিক শিক্ষা হবে সম্পূর্ণ মাতৃভাষা ভিত্তিক। ধর্মশিক্ষা থাকবে, তবে তা হবে মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ ছিল এক কথায় দুঃখজনক। দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা ১৯২০-এর আইনে যে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে আসছিল, তা কেড়ে নেওয়া হলো। সরকারকে দেওয়া হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা এর মধ্যে উপাচার্যের নিয়োগও ছিল এক নতুন ও ব্যাপক ক্ষমতা, যা আরও দুঃখজনক। বহু-সংখ্যক কলেজ, কিছু সরকারি, অধিকাংশ বেসরকারি, সবই অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা ছাড়াই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক নিয়ন্ত্রণে আনা হলো। এই বিশ্ববিদ্যালয় জন্মাবধি ছিল একটি অধিভুক্তিহীন শুদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যে সকল দায়িত্ব প্রায় শতবর্ষকাল পালন করে এসেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সকল দায়িত্ব পালনের না ছিল অভিজ্ঞতা, না ছিল যোগ্যতা, বা কিছুমাত্র আগ্রহ। নতুন ব্যবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পেল দারুণ আঘাত, আর কলেজসমূহের ভাগ্যে ছিল নামে মাত্র অ্যাকাডেমিক নজরদারি।
১৯৪৭ সালে শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক পরিস্থিতি এ রকম উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে প্রায় সম্পূর্ণ সরকারি অর্থানুকূল্যে পরিচালিত একটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং নিচের স্তরে, কলেজসমূহ ও প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্কুলসমূহ নিয়ে একটি বেসরকারি সেক্টর। এর ফলে শিক্ষার দুটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সরকারের সম্পৃক্ততার প্রয়োজন ও যৌক্তিকতা দেখা দেয়। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সরকার যেভাবে এই চাহিদায় সাড়া দিয়েছে, তা কখনও যদিও বা সঠিক হয়েছে, অন্য সময়ে তা আবার হয়ও নি। কখনও লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছে ও লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থতা দেখা দিয়েছে কিন্তু সকল ব্যর্থতার পরও, এই প্রদেশে, পরবর্তীকালের বাংলাদেশ রাষ্ট্রে যা ঘটেছে, তা হলো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ধারাবাহিক ও রৈখিক অগ্রগতি।
প্রাথমিক শিক্ষা প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার ওপরই বর্তমান সরকারের মনোযোগ সর্বাধিক। বিশ শতকের শেষ দশক থেকেই এর সূচনা। গুরুত্বানুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন ঘটেছে, পাঁচটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা-পরম্পরায় সেটা ধরা পড়ে। এর উৎস রয়েছে সংবিধানের (১৯৭২) ১৫ ও ১৭ নং অনুচ্ছেদে এবং ১৯৭৪-এর শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের সুস্পষ্ট সুপারিশের মধ্যে। সংবিধান ও রিপোর্ট, দুটিতেই প্রাথমিক শিক্ষা চিহ্নিত হয়েছে সরকারের দায়িত্ব হিসেবে। ১৯৭৪-এ, সংবিধানের ব্যবস্থামতে, সরকার কর্তৃক জারিকৃত জাতীয়করণ ডিক্রির আওতায় আসে ৩৬,১৬৫টি প্রাথমিক স্কুল। শিক্ষার ইতিহাসে এ ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। এরপর, একাদিক্রমে প্রত্যেক পাঁচশালা পরিকল্পনায় প্রাথমিক শিক্ষাখাতে ব্যয়বরাদ্দ নিয়মিতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, আবর্তক ও উন্নয়ন উভয় খাতেই। বর্তমানে বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা সরকারি স্কুলের প্রায় সমান। এর অধিকাংশই গ্রামাঞ্চলে। এগুলি বহুলাংশে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত। তবে এদের পূর্ণ দায়িত্ব সরকার নেয় নি। নগরস্থ যে সকল স্কুলের ইংরেজির প্রতি ঝোঁক, যদিও জাতীয়ভাবে গৃহীত পাঠ্যক্রম এরাও মোটের উপর অনুসরণ করে, প্রায় ক্ষেত্রেই এরা সরকারি সাহায্য-নির্ভর নয়। এর পরও স্কুল-বয়সী ছেলে-মেয়ে যারা স্কুলে যায়না তাদের সংখ্যা বিস্তর। কিছুদিন থেকে কতিপয় বেসরকারি সংস্থা (NGO) পরিচালিত উপআনুষ্ঠানিক শিক্ষার একটি সমান্তরাল ধারার বিকাশ ঘটেছে। এছাড়া কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ইউনিসেফ ইত্যাদি প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান অংশীদার পরিচয়ে দেখা দিয়েছে। এই তালিকায় এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে আরও কিছু সংস্থা ও কয়েকটি রাষ্ট্র।
আলোচ্য সেক্টর যে গুরুত্ববিচারে এগিয়ে রয়েছে এবং এর মর্যাদাও যে ক্রমবর্ধমান, তার একটি কারণ প্রাথমিক শিক্ষার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার। ১৯৯০-এর মার্চে থাইল্যান্ডের জোমটিন (Jomtein)-এ অনুষ্ঠিত হয় সর্বজনীন শিক্ষা বিষয়ে বিশ্বসম্মেলন। এই সম্মেলনে ও সেপ্টেম্বর ১৯৯০-এ নিউ ইয়র্কে শিশু আধিকার বিষয়ে বিশ্ব শীর্ষ সম্মেলনে যে লক্ষ্য ঘোষিত হয়, বাংলাদেশ তার প্রতি পূর্ণ একাত্মতা প্রকাশ করে। উপরন্তু ডিসেম্বর ১৯৯৩-এ দিল্লির উচ্চ জনসংখ্যা বিশিষ্ট ৯টি উন্নয়নশীল দেশের ‘সবার জন্য শিক্ষা’ বিষয়ে শীর্ষ ঘোষণার প্রতিও বাংলাদেশ দায়বদ্ধ।
Discussion about this post