শিক্ষা ব্যক্তি ও সামাজিক উন্নয়নের সবচাইতে শক্তিশালী মাধ্যম হলো শিক্ষা। উপাদানের স্বল্পতার কারণে প্রাচীনকালে বাংলায় কোন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল তার বর্ণনা দেওয়া, এমনকি সে সস্পর্কে একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা খুবই কঠিন। তবে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে একটি সাধারণ ধারণা লাভ করা যায় মাত্র। অবশ্য উপনিবেশিক আমলে শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কিত তথ্য বা এ সময়ের শিক্ষার উন্নয়নের ধারা সস্পর্কে অধিকতর সুসঙ্গত বিবরণ বিদ্যমান।
প্রাচীন যুগ প্রাচীনযুগে বাংলার শিক্ষার পদ্ধতি ও প্রকৃতি যথার্থভাবে নিরূপণ করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। সেযুগে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে প্রাপ্ত সূত্রাদিতে শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
বৈদিক আর্যরা প্রাচীন বাংলার জনগণকে দস্যু ও ম্লেচ্ছ বলে মনে করত। কিন্তু কালের স্রোতধারায় আর্যভাষা ও সংস্কৃতিই (সম্ভবত মৌর্য আমল থেকে) বাংলায় প্রবেশ করে।
সম্ভবত খ্রিস্টীয় ছয় শতকের পূর্বে বাংলার পন্ডিত সমাজ সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের সাথে সুদৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন নি। তবে চেষ্টাটা বোধ হয় কয়েক শতক আগেই শুরু হয়েছিল ও বৌদ্ধ সংঘারাম এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মকেন্দ্রগুলি ছোট-বড় শিক্ষায়তন হিসেবে গড়ে উঠেছিল। তাই দেখা যায়, ফা-হিয়েন তাম্রলিপ্তিতে দুবছর অবস্থান করে অধ্যয়ন ও পুথি নকল করেছিলেন। সাত শতকে যখন হিউয়েন-সাং কজঙ্গল, পুন্ড্রবর্ধন, কামরূপ, সমতট, তাম্রলিপ্তি এবং কর্ণসুবর্ণ ভ্রমণে এসেছিলেন তখন বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা-দীক্ষার প্রসার আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি জনগণের জ্ঞানস্পৃহা ও জ্ঞানচর্চার ভূয়সী প্রশংসা করেন। এ সময় কজঙ্গলে ৬/৭টি বৌদ্ধ বিহারে তিনশর উপর বৌদ্ধ শ্রমণ; পুন্ড্রবর্ধনের ২০টি বিহারে তিন হাজারের উপর শ্রমণ; সমতটের ৩০টি বিহারে শ্রমণ সংখ্যা দুহাজারের উপর; কর্ণসুবর্ণের ১০টি বিহারে দুহাজারের উপর এবং তাম্রলিপ্তির ১০টি বিহারে একই সংখ্যক শ্রমণ ছিল। পুন্ড্রবর্ধনের পো-সি-পো বিহার এবং কর্ণসুবর্ণের রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার যে খুবই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল, হিউয়েন-সাং-এর সাক্ষ্যই তার প্রমাণ।
নালন্দা মহাবিহারের সঙ্গে ছয়-সাত শতকের বাংলার জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এ মহাবিহারের মহাচার্য শীলভদ্র ছিলেন বাঙালি। তিনি ছিলেন সমতটের ব্রাহ্মণ্য রাজবংশের সন্তান এবং হিউয়েন সাং-এর গুরু। তিনি সমস্ত শাস্ত্রে ও সূত্রে সুপন্ডিত ছিলেন। তাঁর সময়ে নালন্দা মহাবিহারের শ্রমণসংখ্যা ছিল দশ হাজার। তাম্রলিপ্তির শিক্ষাদীক্ষার কথা আরও একাধিক চৈনিক শ্রমণের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়। তা-চেঙ-টেঙ নামে এক চীনা শ্রমণ বারো বছর তাম্রলিপ্তিতে অবস্থান করে সংস্কৃত বৌদ্ধ-গ্রন্থাদি পড়াশোনা করে বৌদ্ধধর্মে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তাও-লিন্ তিন বছর তাম্রলিপ্তিতে অবস্থান করে-সংস্কৃত ভাষা শেখেন এবং সর্বাস্তিবাদ-নিকায়ে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ই-ৎসিঙ্ ৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে তাম্রলিপ্তিতে এসেছিলেন। পো-লো-হো বিহারে তা-চেঙ-টেঙ-এর সাথে তাঁর দেখা হয়েছিল। তিনি সেখানে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন।
বাংলার বৌদ্ধ বিহার সংঘারামগুলির প্রত্যেকটিই ছিল বৌদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষার কেন্দ্র। তবে এখানে যে শুধু বৌদ্ধ ধর্মের চর্চা এবং বৌদ্ধ শাস্ত্রই পাঠ করা হতো তা নয়, বরং ব্যাকরণ, শব্দবিদ্যা, হেতুবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, চতুর্বেদ, সাংখ্য, সংগীত ও চিত্রকলা, মহাযান শাস্ত্র, যোগশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি জ্ঞানের বিভিন্ন দিকও বৌদ্ধ শ্রমণদের অধিতব্য বিষয়ের অন্তর্গত ছিল। হিউয়েন-সাং অনেক দেবমন্দিরের উল্লেখ করেছেন। এখানে বাস করতেন বেশ সংখ্যক ব্রাহ্মণ-আচার্য-উপাধ্যায় এবং অগণিত দেবপূজক। দেবপূজকগণ যে শুধু ব্রাহ্মণ্য ধর্মশাস্ত্রেরই চর্চা করতেন তা নয়, তারা নানা পার্থিব, দৈনন্দিন সমস্যাগত জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষার চর্চাও করতেন। এভাবে দেখা যায় যে, ছয়-সাত শতকের মধ্যে বাংলায় সংস্কৃত ভাষা এবং বৌদ্ধ-জৈন-ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে আশ্রয় করে আর্য-জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষার বীজ বপন করা হয় এবং এক শত বছরের মধ্যেই তা সুফল বয়ে আনে। সাত শতকের লিপিগুলির অলঙ্কারময় কাব্যরীতিই তার প্রমাণ।
ব্যাকরণ চর্চায় বাংলার অতিপ্রাচীন কালেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। সাত শতকে ই-ৎসিঙ যেসব বিদ্যা অনুশীলন করার জন্য তাম্রলিপ্তি এসেছিলেন তার মধ্যে শব্দবিদ্যা অন্যতম। প্রাচীন বাংলার বিখ্যাত বৈয়াকরণিক চন্দ্রগোমী চান্দ্রব্যাকরণ পদ্ধতির স্রষ্টা। তিনি সাত শতক বা তার আগে কোন এক সময়ের লোক। তিনি বৌদ্ধ ছিলেন ও তার জন্মভূমি ছিল বরেন্দ্রীতে। তিনি যে শুধু বৈয়াকরণিক ছিলেন তা নয়, তিনি তর্কবিদ্যায়ও পারদর্শী ছিলেন। তিনি নালন্দা মহাবিহারে আচার্য স্থিরমতির নিকট অধ্যয়ন করেন এবং ব্যাকরণ, সাহিত্য, জ্যোতিষবিদ্যা, তর্কশাস্ত্র, চিকিৎসাবিদ্যা এবং নানা কলায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।
প্রাচীনকালে ব্যাকরণ ও তর্কশাস্ত্র ছাড়া দর্শনের আলোচনায়ও বাংলা প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। আগম-শাস্ত্রগ্রন্থ গৌড়পাদকারিকা এ যুগেরই লেখা। কৌটিল্য ও গ্রীক ঐতিহাসিকবর্গ হতে শুরু করে হিউয়েন-সাং পর্যন্ত সকলেই প্রাচ্য দেশকে হাতির লীলাভূমি বলে বর্ণনা করেছেন। তাই হাতির চিকিৎসা সম্বন্ধে আলাদা একটি শাস্ত্রই গড়ে উঠেছিল এতদঞ্চলে। খ্রিস্টীয় ছয়-সাত শতকে রচিত হস্ত্যায়ুর্বেদ (গজ চিকিৎসা) খ্যাতি লাভ করেছিল।
সাত শতকে যে অলঙ্কৃত কাব্যরীতির সূচনা হয়েছিল, তার পরিপূর্ণ বিকাশ পরিলক্ষিত হয় পাল আমলের গোড়ার দিকেই। সমসাময়িক লিপিমালা ও চতুর্ভুজের হরিচরিত কাব্যে দেখা যায় যে, বাংলায় অন্যান্য বিদ্যার সঙ্গে বেদ, আগম, নীতি, জ্যোতিষ, ব্যাকরণ, মীমাংসা, বেদান্ত, শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ প্রভৃতি সব কিছুরই চর্চা হতো। এসব বিচিত্র বিদ্যার চর্চা যে শুধু ব্রাহ্মণ পন্ডিত ও বিদ্বজ্জন সমাজেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, মন্ত্রী, সেনানায়ক প্রভৃতি রাজপুরুষেরাও এসব শাস্ত্র অনুশীলন করতেন। কিভাবে বিভিন্ন শাস্ত্রের চর্চা হতো সে সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে মনে হয়, ব্রাহ্মণ পন্ডিতেরা নিজেদের গৃহে কিংবা বড় বড় মন্দিরকে আশ্রয় করে ছোট-বড় চতুষ্পাঠী গড়ে তুলতেন এবং সাধ্যানুযায়ী বিদ্যার্থী গ্রহণ করতেন। বিদ্যার্থীরা এক বা একাধিক শাস্ত্র একজনের নিকট শিক্ষা শেষ করে অন্য শাস্ত্র পাঠ করার জন্য অন্য আচার্যের কাছে যেতেন। কোন বিশেষ শাস্ত্রে কেউ পারদর্শী হতে চাইলে তার জন্য বিশেষজ্ঞ আচার্য পাওয়া যেত। বাঙালি ছাত্ররা অনেক সময় পড়াশোনার জন্য ভারতের অন্যান্য প্রদেশে যেতো। ধর্মপ্রচার কিংবা বিদ্যাদানের জন্য বাঙালি আচার্যগণ অনেক সময় বাংলার বাইরে যেতেন। অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা যারা করতেন, রাজা মহারাজ ও সামন্ত-মহাসামন্তগণ তাদেরকে অর্থদান, ভূমিদান করতেন। পন্ডিত, কবি, আচার্য প্রভৃতিদেরকে মাঝে মাঝে তারা পুরস্কৃত করতেন।
এ সময়ে পন্ডিতগণ সংস্কৃত ভাষাতেই তাদের গ্রন্থাদি রচনা করেন। কিন্তু এ ভাষা সর্বসাধারণের ভাষা ছিল না বলে পাল যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার শিক্ষিত উচ্চ স্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। চতুর্ভুজের হরিচরিত কাব্যে দেখা যায় যে, বরেন্দ্র ব্রাহ্মণগণ শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ, ব্যাকরণ ও কাব্যে বিচক্ষণ ছিলেন। হরিবর্মদেবের মন্ত্রী ভট্টভবদেব দর্শন, মীমাংসা, অর্থশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, অস্ত্রবেদ, সিদ্ধান্ত, তন্ত্র এবং গণিতে পারদর্শী ছিলেন।
সেনযুগ তো সংস্কৃত ভাষায় বিদ্যাচর্চা, কাব্যচর্চা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার সুবর্ণ যুগ। তাই এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, প্রাচীন বাংলায় শিক্ষাব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ না করলেও শিক্ষার প্রসারই বিভিন্ন শাস্ত্র চর্চার পথ সুগম করেছিল। মধ্যযুগের টোল/পাঠশালারই কোন কোন আদি সংস্করণ প্রাচীনযুগে বিদ্যমান ছিল। তবে গুরুগৃহে, আশ্রমে বা বৌদ্ধ বিহারেই শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। তবে শিক্ষা যে সমাজের উচ্চশ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। রাজপৃষ্ঠপোষকতা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় সহায়ক ভূমিকা অবশ্যই পালন করত। ধর্ম চর্চার পাশাপাশি পার্থিব বিষয়াদির যে চর্চা হতো, তা প্রাচীন যুগের প্রাপ্ত গ্রন্থরাজি থেকেই প্রমাণিত হয়। তবে এসব গ্রন্থাদিতে শিক্ষা ব্যবস্থার স্বরূপ সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য নেই বললেই চলে।
মধ্যযুগ বাংলার মুসলমান সুলতানগণ তাঁদের ধর্মীয় দায়িত্বসমূহ সম্পন্ন করার জন্য প্রাথমিক বা উচ্চতর সবরকম শিক্ষা বিস্তারেই উৎসাহ প্রদান করতেন। শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে শাসক, সুফি, উলামা, অভিজাতবর্গ, গোষ্ঠীপ্রধান এবং জনহিতৈষী ব্যক্তিবর্গ সকলেরই অবদান রয়েছে। মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলার বিভিন্ন স্থানে মসজিদ ও মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। এ প্রতিষ্ঠানগুলি ইসলামি সংস্কৃতি ও শিক্ষার কেন্দ্ররূপে ব্যবহূত হতো। সে সময় ধার্মিক ও বিদ্বান ব্যক্তিগণ স্ব-প্রণোদিত হয়ে সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন কাজে নির্দেশনা দিতেন। শাসকগণ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য এসব ব্যক্তিকে বিনামূল্যে ভূমিদান করতেন। অবস্থাপন্ন লোকেরা এঁদেরকে গৃহশিক্ষক নিয়োজিত করার মাধ্যমে তাদের এলাকায় অভ্যন্তরীণ শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করতেন।
তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থা ধর্মীয় রীতি-নীতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল। সে কারণে দুটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়- হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে তাদের স্ব স্ব ঐতিহ্য অনুযায়ী পৃথক দুটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং জীবনপদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন প্রকৃতির হলেও ধর্মীয় কার্যাদি সম্পাদন এবং জীবিকা নির্বাহের স্বার্থে দুই সম্প্রদায়ের শাসক ও অভিজাতগণ সারা মধ্যযুগে শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।
Discussion about this post