- মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী
- ড. দীনেশ চন্দ্র সেন এই বাংলার কাদা মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলেই তাঁর মননে লোকসাহিত্যই প্রাধান্য পেয়েছিল। আমরা জানি, লোকসাহিত্যে এবং লোকঐতিহ্যে কখনো সাম্প্রদায়িক বিভেদ ঢুকতে পারেনি। সেই পরিচ্ছন্ন চেতনা দিয়েই তিনি আরেক নিবেদিতপ্রাণ লোকসাহিত্যের সাধক চন্দ্রকুমার দের মাধ্যমে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র গান ও পালাগুলো সংগ্রহ করেন। এই সংগ্রহ সমগ্র বিশ্বের মনীষীদের প্রশংসা পেয়েছে। বিশ্ব দরবার থেকে ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ বাঙালিদের জন্য কুড়িয়ে এনেছে অপরিসীম গৌরব।
- আচার্য ড. দীনেশচন্দ্র সেন ১৮৬৬ সালের ৩ নভেম্বর মানিকগঞ্জ পৌর এলাকার বগজুরি গ্রামে মামা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ঢাকার ধামরাই উপজেলার সুয়াপুর গ্রামে। তাঁর বাবা ঈশ্বরচন্দ্র সেন মানিকগঞ্জ আদালতে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
- ১৮৮২ সালে দীনেশচন্দ্র সেন জগন্নাথ স্কুল থেকে এনট্রান্স, ১৮৮৫ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এফ.এ পাস করেন এবং ১৮৮৯ সালে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। দীনেশচন্দ্র সেন ১৮৮৭ সালে সিলেটের হবিগঞ্জ স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি ১৮৮৯ সালে কুমিল্লার শম্ভুনাথ ইনস্টিটিউশন ও ১৮৯০ সালে ভিক্টোরিয়া স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৯০ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনকালে গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে প্রাচীন বাংলার পুঁথি সংগ্রহ করেন এবং সেসব উপকরণের সাহায্যে ১৮৯৬ সালে ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ শিরোনামে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনা করেন। ১৯১১ সালে তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব বেঙ্গলি লিটেরেচার’ প্রকাশিত হলে তা সর্বমহলে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে। ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলোশিপ’ প্রদান করে এবং এর আওতায় তিনি মৈমনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা সম্পাদনা করেন।
- আচার্য ড. দীনেশচন্দ্র সেনের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : বঙ্গভাষা ও সাহিত্য (১ম ও ২য় খন্ড) (১৮৯৬), তিন বন্ধু (১৯০৪), রামায়নী কথা (১৯০৪), বেহুলা (১৯০৭), সতী (১৯০৭), ফুল্লরা (১৯০৭), জড় ভরত (১৯০৮), সুকথা (১৯১২), গৃহশ্রী (১৯১৬), নীলমানিক (১৯১৮), মুক্তা চুরি (১৯২০), সরল বাংলা সাহিত্য (১৯২২), বৈদিক ভারত (১৯২২), ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য (১৯২২), আলোকে আঁধারে (১৯২৫), চৌকির বিড়ম্বনা (১৯২৬), ওপারের আলো (১৯২৭), পৌরাণিকী (১৯৩৪), বৃহৎ বঙ্গ (১ম ও ২য় খন্ড) (১৯৩৫), আশুতোষ স্মৃতি কথা (১৯৩৬), শ্যামল ও কাজল (১৯৩৬), পদাবলী মাধুর্য্য (১৯৩৭), পুরাতনী (১৯৩৯), বাংলার পুরনারী (১৯৩৯), প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান (১৯৪০), হিন্দু সমাজ ও বৈষ্ণব।
- ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আচার্য ড. দীনেশচন্দ্র সেনকে ডি-লিট ডিগ্রি প্রদান করে। ভারত সরকার তাঁকে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধিতেও ভূষিত করেন। ১৯২৬ সালে তার লেখা ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ গ্রন্থটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। এরপর দীনেশচন্দ্র সেন রচিত গবেষণাধর্মী ‘বৃহৎবঙ্গ’ গ্রন্থটি বাঙালির ইতিহাস চর্চায় নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। ১৯২৯ সালে হাওড়ায় অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন। তিনি এই সম্মেলনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩১ সালে ড. দীনেশ চন্দ্র সেনকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ‘জগত্তারিণী’ পদক প্রদান করে। ১৯৩২ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৩৫ সালে ‘বৃহৎ বঙ্গ’ বইটি দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়।
- সলিমুল্লাহ খান একটি নিবন্ধে লিখেছেন:
বিশ্ববিদ্যালয় হইতে অবসর লইবার পর দীনেশচন্দ্র সেন তাঁহার ‘বৃহৎ বঙ্গ’ বইখানি লিখিতে শুরু করেন। এই গ্রন্থই—বইয়ের উৎসর্গপত্রে তিনি আশংকা প্রকাশ করিয়াছিলেন—সম্ভবত তাঁহার হাতে লিখিত শেষ গ্রন্থ হইতে যাইতেছে। জসীম উদ্দীন স্মরণ করিতেছেন, “বাংলাদেশের ওপর এ পর্যন্ত যত বইপুস্তক ছাপা হইয়াছে, জেলাওয়ারিভাবে যতগুলি জেলার ইতিহাস লেখা হইয়াছে, হিন্দু-সমাজের নানা বর্ণের যেসব ‘কুলপরিচয়’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হইয়াছে সবগুলি সংগ্রহ করিয়া এই জ্ঞানসাধক মহাতপস্যায় সমাসীন হইলেন। সকাল হইতে দুপুর-দুপুর হইতে সন্ধ্যা কি একাগ্রভাবে তাঁহার অধ্যয়ন চলিতে লাগিল! তিনি শুধু পড়িতেন না, পড়িয়া পড়িয়া নোট গ্রহণ করিতেন। খাতার পর খাতা ভর্তি হইয়া চলিল। এইভাবে প্রায় বৎসরখানেক চলিয়া গেল। এইবার তিনি তাঁহার মহাগ্রন্থ রচনা আরম্ভ করিলেন। ‘বৃহৎ বঙ্গ’ তো নয়—বাঙালি জাতির অতীত জীবনের মহাভারত”। - বলা বাহুল্য নহে, ‘বৃহৎ বঙ্গ’ লিখিবার সময় দীনেশচন্দ্র সেনের বয়স হইয়াছে। কিন্তু তাঁহার পরিশ্রমের যেন বয়স নাই। জসীম উদ্দীন সেই দিনের কাহিনী আবারও বলিতেছেন, “আবার সেই সকাল হইতে দুপুর -দুপুর হইতে সন্ধ্যা -সন্ধ্যা হইতে অর্ধরাত। অতীতের মহা তিমিরাবরণ ভেদ করিয়া বাঙালি জাতির যেখানে যত গৌরবের কথা, শিল্পকলার অমর অবদানের কথা ভেলকিবাজির মতো দুই হাতে কুড়াইয়া আনিয়া তিনি তাঁর মহাগ্রন্থে শামিল করিতে লাগিলেন”।
- তিনি কিভাবে কাজ করিতেন তাহার একটা অন্তরঙ্গ ছবিও পাওয়া যাইতেছে জসীম উদ্দীনের এই লেখায়, “এই সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁহার পাশে বসিয়া থাকিয়াছি। সত্তর বৎসরের বৃদ্ধ যেন নবযৌবনের উদ্যম ও দীপ্তি পাইয়াছেন। বাহিরের কোন কোলাহল-কোন দুর্ঘটনার সংবাদ কিছুই তাঁহাকে এই মৌন তপস্যা হইতে বিরত করিতে পারে নাই। লোকজন আসিয়াছে তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে। তিনি অভ্যাগত কাহাকেও ফিরাইয়া দিতেন না।
- তাহাদের সঙ্গে কথা বলিতেন, সেই সঙ্গে তাঁহার লেখনীও সমানে চলিয়াছে। তাঁহার সেই ধ্যানময় জগতে তখনও তিনি সমান বিরাজমান। এই সময়ে তাঁহার বড় আদরের নাতনি পরী মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়িল। এই ছোট্ট মেয়েটি সবসময়ই তার দাদুর কাছে থাকিত। কত আপনজনের চিরবিদায় -বার্তা তাঁহার কানে পৌঁছিল। চোখের জল মুছিতে মুছিতে তখনও তিনি সমানে লিখিয়া চলিয়াছেন। কত বড় বিরাট পুস্তক। সুদীর্ঘ দুই বৎসরের মধ্যে তিনি তাঁর জীবনের শেষ দান ‘বৃহৎ বঙ্গ’- বাংলাদেশকে যাঁহারা ভালোবাসেন তাঁহাদের জন্য এক নূতন মহাভারত-লিখিয়া শেষ করিলেন।”
- উনিশ শতকের জাতীয় ভাবাবেগ দ্বারা ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের মানস গঠিত। বাঙালির ঐতিহ্য অনুসন্ধানের নিরলস সাধনায় ব্যাপৃত হয়ে তিনি সাহিত্য সাধনা করে গেছেন। ১৯৩৯ সালের ২০ নভেম্বর লিখতে লিখতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁর ডান হাতের আঙুলে নাকি কালির দাগ ছিল মৃত্যুর মুহূর্তে।
- গবেষক রোঁমারোঁলা বলেছেন, “মেটারলিংক ও ফরাসির সর্বপ্রধান লেখকদের নায়ক-নায়িকা অপেক্ষা বাংলার পল্লী গীতিকার নায়ক-নায়িকারা শ্রেষ্ঠ। …যুগে যুগে সমালোচকরা ইহাদের নতুন নতুন সৌন্দর্য আবিষ্কার করিবেন”। আরো অনেক মনীষী অনেক মূল্যবান কথা বলেছেন, কেঁদেছেন কাহিনীগুলো পড়ে।
- মৈমনসিংহ গীতিকা’র ভূমিকায় ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বলেছেন, “হিন্দু ও মুসলমান যে বহু শতাব্দীকাল পরস্পরের সহিত প্রীতির সম্পর্কে আবদ্ধ হইয়া বাস করিতেছিলেন, এই গীতিকাগুলোতে তাহার অকাট্য প্রমাণ আছে”। মনীষী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদও বাংলা সাহিত্যের পুঁথি সংগ্রহের সময় হিন্দু-মুসলমান বাছ-বিচার করতেন না। তাঁর সংগৃহীত পুঁথিতে থাকত হিন্দু-মুসলমানের মিলনের দৃষ্টান্ত। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের সূচনায় পাঠান সুলতানদের যে গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠপোষকের অবদান আছে তার স্বীকৃতি দিয়ে ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বলেছেন, “বাদশাহের পরিবারে হিন্দু ললনার আমদানি হাওয়ায় এবং এ দেশের বহু হিন্দু, মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পরে বাদশাহী দরবারে বাংলাভাষা আদর লাভ করিয়াছিল …পাঠান প্রাধান্যকালে বাদশাগণ একেবারে বাঙ্গালী বনিয়া গিয়েছিলেন, তাঁহাদের দলিলপত্র অনেক সময় বাঙ্গালা ভাষায় লিখিত হইতো।… তাহারা হিন্দু পুরাণ ও অপরাপর শাস্ত্রের মর্ম জানিবার জন্য আগ্রহশীল ছিলেন। সংস্কৃত সম্পূর্ণ অনধিগম্য এবং বাঙ্গালা তাঁহাদের কথ্যভাষা ও সুখপাঠ্য ছিল, সে জন্য তাঁহারা হিন্দুর শাস্ত্রগ্রন্থ তর্জমা করিতে উপযুক্ত পণ্ডিতদিগকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন।” (ড. ওয়াকিল আহমদ-সুলতান আমলে বাংলা সাহিত্য, স্টুডেন্ট ওয়েজ-১৯৬৭-পৃ. ১১-১২)।
- স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের আনুকূল্যে চন্দ্রকুমার দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক মৈমনসিংহ গাথা সংগ্রহাক হিসেবে ড. দীনেশ চন্দ্র সেন মহাশয়ের কাছ থেকে নিম্নের পালাগুলো সংগ্রহ করে আনেন।
মহুয়া (রচয়িতা দ্বিজ কানাই), রচনাকাল-১৬৫০ সালের দিকে বলে ধারণা করা হয়। এর প্রধান চরিত্র মহুয়া, নদের চাদ। এটি বিয়োগাত্মক প্রেমকথন।
চন্দ্রাবতী (রচয়িতা নয়নচাঁদ ঘোষ),
কমলা (রচয়িতা দ্বিজ ঈশান),
দেওয়ানা মদিনা (রচয়িতা মনসুর বয়াতী), এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র হল আলাল, দুলাল, মদিনা, সোনাফর।
দস্যু কেনারামের পালা (রচয়িতা চন্দ্রাবতী),
কঙ্ক ও লীলা {(১) দামোদর দাস ,(২)রঘুসুর ,(৩)শ্রীনাথ বেনিয়া ,এবং (৪)নয়ানচাঁদ ঘোষ প্রণীত },
মলুয়া (এই পালাটির সূচনাতে ইতিহাস প্রসিদ্ধ কবি চন্দ্রাবতীর একটি বন্দনা রয়েছে বলে এর রচয়িতা হিসেবে চন্দ্রাবতীকে মনে করা হয়),
দেওয়ান ভাবনা (চন্দ্রাবতী প্রণীত)
কাজলরেখা,
‘রূপবতী মহুয়ার পালা’, রচয়িতা : দ্বিজ কানাই, সংগ্রাহক : ড: দীনেশ চন্দ্র সেন (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)। - অসাধারণ স্মৃতিচারণ করেছেন পল্লীকবি জসীমউদ্দীন তার, ‘যাদের দেখেছি’ বইতে। ফরিদপুরের পল্লীগ্রাম থেকে জসীমউদ্দীন কলকাতায় গিয়েছিলেন কাব্যে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য। তিনি উদার পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ এবং ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের। জসীমউদ্দীন ‘দীনেশ চন্দ্র’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ পাশ্চাত্য মনীষীদের প্রশংসা অর্জন করেছে সেটি এবং তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ বইটি বাঙালি সমাজে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
- জসীমউদ্দীন বলেছেন, “কিছু গ্রাম্য গান সংগ্রহ করিয়াছিলাম। পরলোকগত যতীন্দ্রমোহন সিংহ মহাশয় সেগুলি পড়িয়া বলিলেন, তুমি দীনেশ বাবুর সঙ্গে দেখা কর। ময়মনসিংহের গ্রাম্য গানগুলি সংগ্রহ করিয়ে তিনি অসম্ভব কাণ্ড করেছেন। দেশ-বিদেশের মনীষীবৃন্দ সেই গানগুলি পড়ে তারিফ করেছেন।” তারপর জসীমউদ্দীন বলেছেন, “এই সেই ডাক্তার সেন, যাঁহার ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ রাত জাগিয়া জাগিয়া পড়িয়াছি। পদ্মার তীরে কত গভীর রজনীতে যাঁর বই পড়িয়া, দারিদ্র্যের কাহিনী জানিয়া নিজের জীবনকে এক উঁচু আদর্শে গড়িয়া লইতে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি।”
- জসীমউদ্দীন তখন আইএ ক্লাসের ছাত্র। ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাম্যগাঁথা সংগ্রাহক হিসেবে নিযুক্তি পেয়েছিলেন মাসে ৭০ টাকা বেতনে। জীসমউদ্দীন যখন আইএ ক্লাসের ছাত্র তখন ‘কবর’ কবিতা লিখেছিলেন। ছাপা হয়েছিল ‘কল্লোল’ পত্রিকায়। সেটি পড়ে ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বলেছিলেন, “দূরাগত রাখালের বংশীধ্বনির মতো তোমার কবিতা আমার অন্তরকে স্পর্শ করেছে। তোমার কবিতা পড়ে আমি কেঁদেছি”।
- ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের সহযোগিতায় জসীমউদ্দীনের ‘কবর’ কবিতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিক ক্লাসের পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন কবি বিএ ক্লাসের ছাত্র। রোগশয্যায় বসে ড. সেন জসীমউদ্দীনের সুবিখ্যাত ‘নকশীকাঁথার মাঠ’ কাব্যের প্রুফ দেখে দিয়েছিলেন। পত্রপত্রিকায় তার সুদীর্ঘ প্রশংসামূলক আলোচনা লিখে দিয়েছিলেন। ‘সোজনবাদিয়ার ঘাট’ কাব্য পড়ে ড. সেন বলেছিলেন, “আমি হিন্দু। আমার নিকট বেদ পবিত্র, গীতা পবিত্র, কিন্তু সোজনবাদিয়ার ঘাট পুস্তক তাহার চাইতেও পবিত্র। কারণ ইহাতে আমার বাংলাদেশের মাটির মানুষগুলির কথা আছে। আমার গ্রামগুলির বর্ণনা আছে।” (যাদের দেখেছি- পলাশ প্রকাশন,-১৯৯৯)।
- ‘ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্য’ নামে সরসভঙ্গিতে ড. সেন যে আত্মজীবনী লিখেছেন, সেখানে বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে লিখেছেন, “কুমিল্লার জলবায়ু, ধান চালের অবস্থা, লোকসংখ্যা, স্কুল-কলেজের কথা প্রভৃতি সমস্ত বিষয়েই আলাপ চলিল। যতবার আমি সাহিত্য সম্বন্ধে আলাপ করিতে চেষ্টা করিলাম, ততবার তিনি সে কথা এড়াইয়া ধান্যাদি সম্বন্ধে প্রশ্নের অবতারণা করিতে লাগিলেন।…তিনি মনে করিলেন, আমি একটি কৃষক যুবক, সুতরাং লাঙল, ফাল ও চাষাবাদের কথা ছাড়া আর কিছু বলিবার উপযুক্ত নহি।” রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছেন, “রবিবাবু শ্রেষ্ঠ কবি, শ্রেষ্ঠ লেখক; অপরাপর লেখকের কাব্য পড়িলেই তাঁহার মধ্যে যাহা ভালো তাহার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু রবীন্দ্রবাবুর সমস্ত লেখা পাঠ করিলেও তাঁহার সম্বন্ধে অনেক জানিবার বাকি থাকে; তিনি রূপ দিয়া চক্ষু ভুলান, গুণে আখি ঝরে। কণ্ঠস্বরে মিষ্টত্ব, বন্ধুর সহৃদয়তা ও ঋষিতুল্য ধর্মভাব দিয়া মন হরণ করেন, তাহার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশিবার পর অন্য সমস্ত প্রসঙ্গ ছায়ার ন্যায় মন হইতে চলিয়া যায় এবং ছবির মত তিনি সমগ্র মনটি দখল করিয়া বসেন।”
- বঙ্কিম মানস আর রবীন্দ্র মানসের পার্থক্য ড. দীনেশ চন্দ্র সেন ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে। রবীন্দ্র বিদ্বেষীদের বিস্তৃত আলোচনা আছে এ বইতে। ১৯৩৮ সালে লিখেছেন ‘প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান’ বইটি। অসামান্য গবেষণা। সেখানে এক জায়গায় বলেছেন, “এই হিন্দু মুসলমানের মধ্যে আমরা যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা লক্ষ্য করিতেছি, তাহার গুরুত্ব কিছুই নাই। বৈদিক যুগের যুদ্ধাদি এবং পরবর্তী যুগে হিন্দু জৈন বৌদ্ধের সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের এই সঙ্গে তুলনা করিলে, এখনকার এই দাঙ্গা-হাঙ্গামা ষট প্রকোষ্ঠ রাইফেলের গুলির কাছে, পটকার আগুনের মত নগণ্য।” অর্থাৎ দ্বন্দ্ব শুধু হিন্দু-মুসলমানে নয়, অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও ছিল তার প্রমাণ দিলেন। বাঙালিত্ব সম্পর্কে বলেছেন, “বাঙ্গালার জনসাধারণ বলিতে কাহাদিগকে বুঝিতে হইবে? খ্রিস্টান নহেন, হিন্দু নহেন, মুসলমান নহেন – ইহারা বাঙালি”।
- ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় নাম। তার অপরিসীম সাহিত্যানুরাগ, দেশহিতৈষণা জাতীয়তাবোধ তাঁকে বাঙালির দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। আমাদের বাংলাদেশেরই কৃতী সন্তান তিনি। ১৮৯০ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক থাকা অবস্থায় পল্লী অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে প্রাচীন বাংলার পুঁথি সংগ্রহ করে, তা থেকে উপকরণ নিয়ে ১৮৯৬ সালে ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ নামে বাংলা ভাষার ইতিহাস রচনা করেন। ১৯১১ সালে তাঁর ‘হিস্টরি অব বেঙ্গলি লিটারেচার’ বইটি প্রকাশিত হলে পাশ্চাত্য মনীষীদের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন। তাঁর সুবিখ্যাত ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ বইটি ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নিদর্শনগুলো আবিষ্কার ও সেসবের আধুনিক বিশ্লেষণে বাংলা সাহিত্যকে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্য করার জন্য প্রয়োজনীয় গ্রন্থ প্রণয়ন করেন ড. দীনেশ চন্দ্র সেন। বাঙালি জাতির স্বরূপ সন্ধানে তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।
Discussion about this post