আবদুল মান্নান
কারাগারের সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রথম পরিচয় ১৯৩৮ সালে, যখন তিনি গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের ছাত্র, তাও আবার হত্যা মামলার আসামি হিসেবে। বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক (এখন মুখ্যমন্ত্রী বলা হয়) গোপালগঞ্জ সফরে আসবেন, সঙ্গে শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তাঁদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হবে। দায়িত্ব পড়ল শেখ মুজিবের ওপর। তিনি তাঁর সমবয়সী হিন্দু, মুসলমান সবাইকে নিয়ে গঠন করলেন বেশ বড় একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। কদিন পরে দেখা গেল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে হিন্দু স্বেচ্ছাসেবকরা কেটে পড়ছে। জানা গেল তাদের কংগ্রেস থেকে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার মন্ত্রী, অতএব তাঁদের সংবর্ধনা দেওয়া যাবে না। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি হয় এবং রমাপদ দত্ত নামের একজন ছুরিকাহত হন। শেখ মুজিব ও অন্য মুসলমান ছাত্রদের নামে হত্যা মামলা হয় এবং শেখ মুজিবসহ অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে সেই মামলা থেকে শেখ মুজিব খালাস পান। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের শুরুতেই এ ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে বঙ্গবন্ধু ১৮ বার জেলে গেছেন, মোট সাড়ে ১১ বছর জেলে কাটিয়েছেন, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন দুবার। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ঘটনাপঞ্জি বিবৃত করা হয়েছে। ১৯৬৬-৬৯ সালে কারাগারে থাকাকালে তিনি তাঁর এই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ রচনা করেছেন। তাঁর এই অসাধারণ কাজটি করার পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুননেসা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর কাছে তিনি রেণু। উচ্চ শিক্ষিত না হয়েও বঙ্গবন্ধুর জীবন ও যৌবনের কিছু কথা লিখে যাওয়ার তাগিদ তিনি অনুভব করেছেন এবং সেভাবে স্বামীকে তিনি উৎসাহ জুগিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং লেখার জন্য খাতা কিনে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছেন।
বেগম মুজিব তাঁর অসাধারণ কাজটি পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুকে যখন ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গ্রেপ্তার করা হয় তখনো চালু রেখেছেন। নিয়মিত তাঁর স্বামীকে লেখার জন্য খাতা সরবরাহ করেছেন, বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির অত্যন্ত এক ক্রান্তিকালে কারাগারে বসে তাঁর দিনলিপি লেখার চেষ্টা করেছেন, যা বেগম মুজিব সযত্নে সংরক্ষণ করেছেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু পরিবারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর দুই কিস্তিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে খাতাগুলো উদ্ধার করেন, যা কয়েক দিন আগে বাংলা একাডেমি ‘কারাগারের রোজনামচা’ হিসেবে প্রকাশ করেছে। বঙ্গবন্ধু বইটির মূল নাম দিয়েছিলেন ‘থালা বাটি কম্বল, জেলখানার সম্বল’। এটি একনাগাড়ে পড়ার মতো একটি বই-ই শুধু নয়, একজন মহামানবের একটি অসাধারণ মানবিক দলিলও বটে। বইটির বেশ দীর্ঘ একটি ভূমিকা লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর এই রোজনামচা প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয় অনেক আগে। শুরুতে তাঁর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এনায়েতুর রহিম। ২০০১ সালে তিনি ঢাকায় এসে উত্তরায় তাঁর এক আত্মীয়ের বাসায় উঠলে সেখানে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রফিউদ্দিন আহমদের সূত্র ধরে। তখন প্রথমে জানতে পারি এই রোজনামচার কথা। তবে তিনি বিস্তারিত কিছু তেমন একটা জানাননি, আর আমিও এই বিষয়ে কিছু বলার জন্য তাঁকে পীড়াপীড়ি করিনি। তিনি শুধু বলেছিলেন, এই রোজনামচা প্রকাশ হলে মানুষ বুঝতে পারবে একজন বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের জন্য নিজের জীবনকে কতভাবে উৎসর্গ করেছিলেন। ২০০২ সালে হঠাৎ ড. রহিমের মৃত্যু হলে কাজটি থেমে যায়। তারপর এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন ইতিহাসবিদ ড. সালাহউদ্দীন আহমদ, ড. সামসুল হুদা হারুন, বেবী মওদুদ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানসহ আরো কয়েকজন। প্রথম তিনজনের হঠাৎ মৃত্যু হলে শেষতক পুরো গ্রন্থটি আলোর মুখ দেখে শামসুজ্জামান খানের কল্যাণে এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে।
পুরো বই নিয়ে এখানে আলোচনা করার সুযোগ নেই। আগ্রহ থাকলে পাঠক মূল বই সংগ্রহ করে নিশ্চয়ই পড়বেন। শুধু কয়েকটি বিষয় আলোচনা করব। রোজনামচার শুরু ২ জুন, ১৯৬৬ সালে। দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার হয়ে শেখ মুজিব (তখনো তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হননি ) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ৭ জুন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ছয় দফার দাবিতে সারা দেশে হরতাল ডাকা হয়েছে। এই হরতাল সামনে রেখে মোনেম খাঁর সরকার চারদিকে ধরপাকড় শুরু করেছে। বাদ যাচ্ছে না সাধারণ দিনমজুরও। ঢাকা থেকে প্রকাশিত মুসলিম লীগঘেঁষা দৈনিক মর্নিং নিউজে ভাসানী ন্যাপের নেতা মশিয়ূর রহমান যাদু মিয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘ছয় দফা কর্মসূচি কার্যকর হইলে, পরিশেষে উহা সমস্ত দেশে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব জাগাইয়া তুলিবে। এমনকি তিনি (যাদু) যদি প্রেসিডেন্ট হতেন তাহলে ছয় দফা বাস্তবায়িত হতে দিতেন না।’ শেখ মুজিব লিখছেন, ‘এদের এই ধরনের কাজেই তথাকথিত প্রগতিবাদীরা ধরা পড়ে গেছে জনগণের কাছে।’ যাদু মিয়া ভাসানী ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রসদ সরবরাহের ঠিকাদারির কাজ করতেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জেনারেল জিয়া যাদু মিয়াকে উপপ্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। যাদু মিয়াদের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে শেখ মুজিব আরো লিখেছেন, ‘এরা নিজেদের চীনপন্থী বলেও থাকেন। একজন এক দেশের নাগরিক কেমন করে অন্য দেশপন্থী হয়? আবার জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চিৎকার করে?..এর আগে মওলানা ভাসানী সাহেবও ছয় দফার বিরুদ্ধে বলেছেন, কারণ দুই পাকিস্তান নাকি আলাদা হয়ে যাবে।…মওলানা সাহেব পশ্চিম পাকিস্তান গিয়ে এক কথা বলেন, আর পূর্ব বাংলায় এসে অন্য কথা বলেন। যে লোকের যে মতবাদ সেই লোকের কাছে সেভাবেই কথা বলেন।’ শত বাধা উপেক্ষা করে সেদিন দেশের বিভিন্ন শহরে হরতাল পালিত হয়েছিল। মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি চালালে সরকারের প্রেসনোট অনুযায়ী ১০ জন নিহত হয়েছিল। পরে হাসপাতালে একজন মারা যান। প্রথম দিকে এত মানুষের প্রাণহানির খবর শুনে শেখ মুজিব বেশ বিচলিত বোধ করলেও তিনি লিখেছেন, ‘মনে শক্তি ফিরে এলো এবং আমি দিব্যচোখে দেখতে পেলাম জয় আমাদের অবধারিত।’
বঙ্গবন্ধুকে যে সেলে রাখা হতো সেই সেলের কাছেই ছিল পাগলা গারদ। কেউ জেলে থাকতে থাকতে পাগল হয়ে গেছে, কেউ বা পাগল বলে পরিবারের লোকজন জেলে দিয়ে গেছে। রাতে প্রায়ই পাগলরা চিৎকার জুড়ে দিত, যার ফলে শেখ মুজিব ঘুমাতে পারতেন না। শেখ মুজিব বেগম মুজিবকে বলেছিলেন, ‘যদি কোনো দিন পাগল হয়ে যাই, তবে পাগলা গারদে বা জেলের পাগলখানায় আমাকে দিয়ো না।’ পূর্ব বাংলার গভর্নর মোনেম খাঁ শেখ মুজিবকে একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। তিনি আদেশ দিয়ে রেখেছিলেন শেখ মুজিব সম্পর্কে সব সিদ্ধান্ত তিনিই নেবেন। যখন চারদিকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গণগ্রেপ্তার ও নির্যাতন চলছে, তখন শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘আমার মনে হয় মোনেম খাঁ সাহেব পশ্চিম পাকিস্তান গিয়ে কোনো কোনো বন্ধুর কাছ থেকে বুদ্ধি নিয়েছেন। তিনি ভুলে গেছেন এটা পূর্ব বাংলা, পশ্চিম পাকিস্তান নহে! আন্দোলন করা এবং নির্যাতন সহ্য করার ক্ষমতা এরা রাখে।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর মা-বাবাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। তিনি লিখেছেন, “আমার ওপর আমার মা-বাবার টান যে কত বেশি সে কথা কাহাকেও বোঝাতে পারব না। তাঁরা আমাকে ‘খোকা’ বলে ডাকেন। মনে হয় আজো আমি তাঁদের ছোট্ট খোকাটি। পারলে কোলে করেই শুয়ে থাকে। এই বয়সেও আমি আমার মা-বাবার গলা ধরে আদর করি।” মা খোকার কাছে একবার জানতে চেয়েছিল, ‘বাবা, তুই তো পাকিস্তান পাকিস্তান করে চিৎকার করেছিস, কত টাকা খরচ করেছিস—এ দেশের মানুষ তো তোর থেকেই পাকিস্তানের নাম শুনেছিল, আজ তোকেই সেই পাকিস্তানের জেলে কেন নেয়?’
প্রতি দুই সপ্তাহ পর একবার বেগম মুজিব ছেলে-মেয়েদের নিয়ে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। সঙ্গে শিশু রাসেলও থাকত। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “রাসেল একবার আমার কোলে, একবার তার মায়ের কোলে, একবার টেবিলের ওপর উঠে বসে। আবার মাঝে মাঝে আপনমনেই এদিক-ওদিক হাঁটাচলা করে। বড় দুষ্টু হয়েছে, রেহানাকে খুব মারে। রেহানা বলে, ‘আব্বা দেখেন, আমার মুখখানা কি করেছে রাসেল মেরে।’ আমি বললাম, ‘তুমি রেহানাকে মারো? রাসেল বলল, ‘হ্যাঁ মারি।’ বললাম, ‘না আব্বা আর মেরো না।’ উত্তর দিল ‘মারব।’ কথা একটাও মুখে রাখে না।” রাসেল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, ‘আব্বা বালি চলো’। কী উত্তর ওকে আমি দেব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম। ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মায়ের বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। একসময় তার মাকে বাবা ডাকা শুরু করল।”
১৯৬৭ সালের ১৭ মে বেগম মুজিব ছেলে-মেয়েদের নিয়ে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি ওই দিন সম্পর্কে লিখেছেন, “হাচিনা (শেখ হাসিনাকে তিনি এভাবেই ডাকতেন) আইএ পরীক্ষা দিতেছে। হাচিনা বলল, ‘আব্বা, প্রথম বিভাগে বোধ হয় পাস করতে পারব না, তবে দ্বিতীয় বিভাগে যাব।’ বললাম, ‘দুইটা পরীক্ষা বাকি আছে, মন দিয়ে পড়ো। দ্বিতীয় বিভাগে গেলে আমি দুঃখিত হবো না, কারণ লেখাপড়া তো ঠিকমতো করতে পারো নাই’।” বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘পূর্ব বাংলার মাটিতে বিশ্বাসঘাতক অনেক পয়দা হয়েছে, আরো হবে, এদের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকদের স্থান কোথায় এরা দেখেও দেখে না! বিশেষ করে একদল বুদ্ধিজীবী যেভাবে পূর্ব বাংলার সঙ্গে বেইমানি করছে, তা দেখে আশ্চর্য হতে হয়।’ বঙ্গবন্ধু আলফা ইনস্যুরেন্সে চাকরি করতেন। ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন, কিন্তু তাঁর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দিতে কম্পানি গড়িমসি করছিল। তিনি লিখেছেন, ‘একটু অসুবিধা চলেছে বলে রেণু বলল।’ বেগম মুজিব আরো বললেন, ‘যদি অসুবিধা হয় নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে ছোট বাড়ি একটা ভাড়া নেব…চিন্তা তোমার করতে হবে না।’
১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি রাত ১২টার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয়। কারা ফটকের বাইরে এলে তাঁকে সেনাবাহিনী আবার গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তিনি বেগম মুজিবের দেওয়া ৩২০ পৃষ্ঠার একটি খাতা সঙ্গে নিয়ে যান। সেই খাতার মাত্র ৫২ পৃষ্ঠা তিনি ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। সেনানিবাসে তাঁকে নিয়ে গিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে রুজু করা হয় কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এ রকম একটা মামলায় তাঁকে জড়ানোর চক্রান্ত চলছে, তা আগেই তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন। দেশরক্ষা আইনে শেখ মুজিবের সাজা হয়ে গেলে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুল মোমেন অ্যাডভোকেট আদালতকক্ষে থাকলেন। কক্ষ থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে বললেন, ‘আপনারা রইলেন এ দেশের মানুষের জন্য, আমি চললাম। খোদা আপনাদের সহায় আছেন।’ বঙ্গবন্ধুকে সেনানিবাসের অফিসারদের মেসের একটি বিশেষ কামরায় রাখা হতো। একই কামরায় একজন পাকিস্তানি সেনা অফিসার তাঁকে সার্বক্ষণিক নজরদারি করার জন্য অবস্থান করতেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, তাঁর কক্ষটি ছিল আলোহীন। কারণ জানালায় লাল রং লাগিয়ে আলো প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছিল। তাঁকে প্রতিদিন মেসের রুটি আর মাংস খেতে হতো, যা তাঁর পক্ষে খুবই অসুবিধা হতো। অনেক চেষ্টা করে ভাত পাওয়া গিয়েছিল কিন্তু মাংস খেতেই হলো। সেখানে তাঁকে কোনো পত্রিকা দেওয়া হতো না বা রেডিওতে পাকিস্তানি অনুষ্ঠান শোনার কোনো সুবিধা ছিল না। মাঝেমধ্যে রাতে বঙ্গবন্ধুকে বাইরে হাঁটতে নিয়ে যাওয়া হতো। কিন্তু যখন মেস এলাকার বাইরে নিয়ে যাওয়া শুরু হলো বঙ্গবন্ধু আঁচ করতে পারলেন এটি তাঁকে হত্যা করার একটি ষড়যন্ত্র। মেস এরিয়ার বাইরে গেলে পেছন থেকে গুলি করে বলতে পারবে আসামি পালানোর সময় পাহারাদার তাঁকে গুলি করতে বাধ্য হয়েছে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ঢাকা সেনানিবাসে দু-একজন মালি আর বয় ছাড়া কোনো বাঙালি ছিল না। তবে তাঁরা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারতেন না। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের মাধ্যমেই জনগণ বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করে। এরপর তিনি হয়ে ওঠেন ইতিহাসের মহানায়ক, বাঙালি জাতির জনক। এই গ্রন্থ সবারই পড়া উচিত, তবে তাদের বেশি পড়া উচিত, যাঁরা মনে করেন কোনো একজন মেজর আসমান থেকে নাজিল হয়ে বাঁশিতে ফুঁ দিলেন আর ঠিক তখনই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক
Discussion about this post