আরিফুল ইসলাম
১৯৭১ সালে কুড়িগ্রাম জেলা ছিল আটটি থানা নিয়ে গঠিত একটি মহকুমা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কুড়িগ্রাম জেলার অর্ধেক অংশ ছিল ৬ নম্বর সেক্টর এবং বাকি অংশ ছিল ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে। শুধুমাত্র ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন রৌমারী ছিল মুক্তাঞ্চল। সেখানে চলতো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী কুড়িগ্রামকে হানাদার মুক্ত করতে শহীদ হন ৯৯ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও কুড়িগ্রাম হানাদার মুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর। মাঝখানের ১০ দিন জেলার মুক্তিযোদ্ধারা কী করেছিলেন, দেশের স্বাধীনতা ও বিজয় নিয়ে তাদের অনুভূতি কেমন ছিল, বাংলা ট্রিবিউনকে তা জানালেন বীর প্রতীক আব্দুল হাই সরকার।
আব্দুল হাই সরকার মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রায় অর্ধশতাধিক অপারেশনে অংশ নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কুড়িগ্রামে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনে নেতৃত্বদানকারী কে ওয়ান, এফএফ কোম্পানি কমান্ডার।
জেলা সদরের মোঘলবাসা ইউনিয়নে জন্ম নিলেও বর্তমানে জেলা সদরের বেলগাছা ইউনিয়নের মুক্তারাম গ্রামে নিজ বাড়িতে বসবাস করছেন তিনি। এই মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭১ সালে ছিলেন ১৬ বছরের কিশোর। কিন্তু দেশ মাতৃকার টানে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। অস্ত্র হাতে সম্মুখযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়াসহ অংশ নেন গেরিলা অপারেশনে। তিনি জানালেন সেদিনের বিজয়ের কথা।
১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের আগেই কুড়িগ্রাম হানাদার মুক্ত হলেও বাকি দিনগুলো কীভাবে কাটিয়েছেন, জানতে চাইলে বীর প্রতীক আব্দুল হাই সরকার বলেন, ‘আমি ছিলাম কিশোর যোদ্ধা। অনেকগুলো অপারেশনে অংশ নিলেও আমি ক্লান্ত হইনি। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত করে আমি জেলার বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সেভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকি। কিন্তু কুড়িগ্রাম দখলে নেওয়ার পর আমার ওপর নির্দেশ এলো যে, আমাকে আর সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে না। তখন আমি আমার ৩৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কুড়িগ্রাম কলেজে (বর্তমানে সরকারি কলেজ) অবস্থান নিই। আমরা অপেক্ষা করতে ছিলাম, পুরো বাংলাদেশ কখন বিজয় লাভ করবে। এর মধ্যে ১৬ ডিসেম্বর সকালে আমরা জানতে পারি পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। বিকালে আমরা রেডিওতে জানতে পারি পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে।’
কীভাবে বিজয় উদযাপন করলেন এমন প্রশ্নের জবাবে এই বীর প্রতীক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর বিকালে রেডিওতে আত্মসমর্পণের খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে কুড়িগ্রাম কলেজ মাঠে আকাশের দিকে বন্দুকের গুলি ছুড়ে বিজয় উল্লাস করেছি। আমার সঙ্গে থাকা যোদ্ধারা এবং কুড়িগ্রাম পিটিআই মাঠে থাকা মিত্রবাহিনীর সবাই বন্দুকের গুলি ছুড়ে বিজয় উদযাপন করেছি।’
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর চেতনা কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে জানতে চাইলে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে না পারলেও আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করতে পেরেছি, স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার করতে পেরেছি। এখন লক্ষ্য শোষণ, বৈষম্যহীন ও ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ার; যা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল। যেহেতু ৫০ বছরে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত সত্ত্বেও আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পেরেছি সেহেতু আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও বাস্তবায়ন করতে পারবো। কারণ এটাকে মুছে দেওয়ার মতো কেউ নেই। আর এটি বাস্তবায়ন হলে জাতি সুফল ভোগ করতে পারবে।’
স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এই বীর প্রতীক। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বর্তমান সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও দেশবাসীকে বিজয়ের শুভেচ্ছা জানান জাতির এই বীর সন্তান।সৌজন্যে-বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post