শিক্ষার আলো ডেস্ক
১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যোগ দিয়ে বহিষ্কৃত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে বহিষ্কার হন তরুণ ছাত্রনেতা ও আইন বিভাগের ছাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই আন্দোলনে তিনি শুধু যোগ দেননি, দিয়েছেন নেতৃত্বও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, এ ধরনের বহিস্কারাদেশ দেওয়ার আগে সাধারণত আত্মপক্ষ সমর্থনের লক্ষ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে সেটি করা হয়নি। ওই সময় তিনি ছাড়াও আরও চার নেতাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। শর্ত ছিল ১৫ টাকা জরিমানা দিয়ে অভিভাবক এসে মুচলেকা দিলে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হবে।
বঙ্গবন্ধু বাদে বাকি চারজন তথা এমএ প্রথম পর্বের কল্যাণচন্দ্র দাসগুপ্ত, এলএলবি দ্বিতীয় বর্ষের নাঈমউদ্দিন আহমেদ, এমএ প্রথম পর্বের ছাত্রী নাদেরা বেগম ও বিএ প্রথম বর্ষের মুহাম্মদ আবদুল ওয়াদুদ শর্ত মেনে মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফিরে পান। কিন্তু মুচলেকায় অস্বীকৃতি জানান শেখ মুজিব।
পরাজয় যাকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি, সেই মানুষটি জরিমানা-মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফিরে পাবেন, তা হয়! মাথা উঁচু করেই ক্যাম্পাস ছাড়েন তরুণ এই ছাত্রনেতা। ছাত্রত্ব ফিরে পেতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো দেনদরবারও করেননি তিনি।
বহিষ্কৃত ক্যাম্পাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সংবর্ধিত হওয়ার কথা ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ক্যাম্পাসের মঞ্চও ছিল প্রস্তুত। কিন্তু ঘাতকেরা ক্যম্পাসের রঙিন মঞ্চে ওঠার আর সুযোগ দেয়নি। ওই দিন বিপদগামী সেনা কর্মকর্তারা রাতের আঁধারে কাপুরুষাচিত হামলায় রক্তাক্ত মঞ্চ তৈরি করেছিল বঙ্গবন্ধুর প্রিয় ধানমণ্ডির সেই ৩২ নম্বরের বাড়িটি।
তবে ২০১০ সালে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব বাতিলের আদেশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারে বলা হয়, ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তিকৃত ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন ও নেতৃত্বদান ছিল তার অসাধারণ দূরদর্শী ও জ্ঞানদীপ্ত গণতান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ। অধিকন্তু এটি ছিল ওই সময়ের সাহসী ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে একটি সাহসী পদক্ষেপ। কর্মচারীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনে তার অংশগ্রহণ ছিল যথার্থ। তাকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক, অনৈতিক, ন্যায়বিচার এবং বিধি পরিপন্থী ছিল।’
বহিষ্কারাদের প্রত্যাহারের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, ছাত্রত্ব বাতিলের বিষয়টি পর্যালোচনার জন্যে শেখ মুজিবুর রহমান নিজে যেখানে কখনো আবেদন করেননি, এমনকি তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরও ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাষ্ট পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যসহ তিনি নিহত হন।
আর তাই ৬১ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সিদ্ধান্তের কোন ব্যবহারিক মূল্য হয়তো নেই। তবে এর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার ভুল সংশোধন করে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছিলেন, আমি বঙ্গবন্ধুকে বহিষ্কারের রেকর্ড দেখলাম। তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ। রেকর্ড দেখে আমার আমার মনে হলো- তার ওপর যে বহিষ্কারাদেশ রয়েছে, সেটা ইতিহাস থেকে প্রত্যাহার করা আমাদের দায়িত্ব।
তার ভাষ্য, আমি যখন তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সাথে আলাপ করতাম; তখন দেখতাম তারাও চায় এই আদেশ প্রত্যাহার হোক। কারণ, আদেশটি থাকলে আমাদের জন্য একটি কলঙ্ক থাকে। এভাবেই আমার এবং অনেকের চিন্তা একসাথে আলাপ-আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার বলে মনে করলাম। পরে এটিকে সিন্ডিকেটে নিয়ে গেলাম। সিন্ডিকেট আমি প্রশ্ন উত্থাপন করলাম এবং সিন্ডিকেটের সবাই সর্বসম্মতিক্রমে সকলে বলল- এটি আমাদের করা দরকার, আমরা করব। আমরা ১৪ আগস্ট ২০১০ সালের সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত নিলাম- পরদিন ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের প্রাক্কালে এ রায় দিয়ে আমরা জাতিকে জানাব যে, আমাদের ইতিহাসের যে কলঙ্ক ছিল বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সেটা কলঙ্কমুক্ত হলো।
জানা যায়, ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের সংযুক্ত ছাত্র ছিলেন তিনি। থাকতেন মোগলটুলীতে। একটি সাইকেলে চড়ে আসতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে আহূত ধর্মঘটে পিকেটিং করার সময় গ্রেফতার হন তরুণ ছাত্র শেখ মুজিব। রোষানলে পড়েন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর।
১৯৪৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যোগ দিয়ে বহিষ্কৃত হন। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আর পড়াশোনা করা হয়ে উঠেনি তার। তবে দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরেন স্বাধীনতার এই মহানায়ক।
সিন্ডিকেট সভার কার্যবিবরণীতে যা ছিল: ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঙ্গবন্ধুর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়। সেই বছরের ১৪ আগস্টের সিন্ডিকেট সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ১৯৪৯ সালের আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য তৎকালীন আইন বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র (রোল-১৬৬, এসএম হল) শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক্সিকিউটিত কাউন্সিল ২৬ মার্চ, ১৯৪৯ সালে যে জরিমানা ও অভিভাবক প্রত্যায়িত মুচলেকা প্রদানের ও অনাদায়ে ছাত্রত্ব বাতিলের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল, আজকের সিন্ডিকেট সেই সিদ্ধান্তকে অগণতান্ত্রিক ও ন্যায় বিচারের পরিপন্থি হিসাবে গণ্য করে।
বিবরণীতে আরও বলা হয়, সভা মনে করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তিকৃত ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন ও নেতৃত্বদান ছিল তার অসাধারণ দূরদর্শী ও জ্ঞানদীপ্ত গণতান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ। অধিকন্তু এটি ছিল ওই সময়ের সাহসী ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে একটি সাহসী পদক্ষেপ। কর্মচারীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনে তার অংশগ্রহণ ছিল যথার্থ। তাকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক, অনৈতিক, ন্যায়বিচার ও রুল অব অডি আলট্রাম পার্টেম-এর পরিপন্থি ছিল বলে আজকের সভা মনে করে। তাই ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল কর্তৃক গৃহীত উক্ত বহিষ্কারাদেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সর্বসম্মতিক্রমে প্রত্যাহার করছে।
বিবরণীতে আরও বলা হয়, এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সিদ্ধান্তানুযারী জরিমানা ও মুচলেকা প্রদান না করে সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান যে সাহসী প্রতিবাদী ভূমিকা রেখেছিলেন তা এ সভা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৪৯ সালে ৪র্থ শ্রেণি কর্মচারীদের আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন, এ সভা তাদের প্রতিও গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে। এ সভা মনে করে, এ বহিষ্কারাদেশ বহু পূর্বেই প্রত্যাহার করা উচিত ছিল।
Discussion about this post