পীযূষ কুমার ভট্টাচার্য্য
নজরুল সেনা জীবনে প্রবেশ করেন ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে। তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা বাহিনীর ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদানের মাধ্যমে সেনা পরিবারের সদস্য হন। নজরুল ১৯২০ সালের মার্চ মাস অবধি করাচি সেনা নিবাসে সৈনিক জীবন যাপন করেন। তাঁকে সৈনিক জীবন স্থিরভাবে কাব্য ও জ্ঞান চর্চার সুযোগ এনে দিয়েছিল। নজরুলের করাচির সৈনিক জীবনকে তাঁর প্রতিভার সাজঘর বলা হয়। সে সময় তাঁর কবিত্বের ব্যপক বিকাশ ঘটে। পাশাপাশি করাচির বাঙালি পল্টনের সেনাকুঞ্জে সহযোদ্ধা সঙ্গীত প্রেমীদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল গীতল মধুচক্র। সে সময় সৈনিকদের অনেকে গান-বাজনা জানতেন। হাবিলদার নিত্যানন্দ ভাল অর্গান বাজাতে পাড়তেন। তাঁর কাছে নজরুল অর্গান বাজানো শিখেছিলেন। গোপী নামে এক সৈনিক খুব ভাল ক্ল্যারিওনেট বাজাতেন। নজরুল তাঁর কাছে ক্ল্যারিওনেট বাজানো শিখেছিলেন। সৈনিক ফণিভূষণ মুখোপাধ্যায় ভাল গাইতেন। তাঁদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ব্যারাকে বসত গান-বাজনার আসর। এক কথায় বলা যায় নজরুল ও তাঁর সহকর্মীরা মিলে সেনাকুঞ্জের পরিবেশকে গীতলতার মধুকুঞ্জে পরিণত করেন। ব্যারাকের এই সাংস্কৃতিক পরিবেশও যে নজরুলের পরবর্তী মধুময় সঙ্গীত জীবনকে প্রভাবিত করেছিল এ ব্যাপারে সন্দেহের কোন আর অবকাশ থাকে না। নজরুল সেনা পরিবারের সদস্য হবার পরে নিয়মিত কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকীতে লেখা পাঠাতেন। সৈনিক কবির লেখাগুলোতে লেখকের নাম থাকতো ‘হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম’।
নজরুল সেনা ছাউনি থেকে লেখা পাঠানো প্রসঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বাল্যবন্ধু শৈলজানন্দকে চিঠির মাধ্যমে লিখে জানাতেন। দুজনায় তখন পত্রালাপ হতো। এ প্রসঙ্গে শৈলজানন্দ ‘আমার বন্ধু নজরুল’ গ্রন্থে লিখেছেন : নজরুলের চিঠি এসেছে। আমার পাশের খবর পেয়ে আনন্দিত হয়ে লিখেছে, ‘তোমাকেও একটা আনন্দের খবর দিই। এখান থেকে কলকাতার কয়েকটা কাগজে গল্প পাঠিয়েছিলাম। একটাও ফিরে আসেনি। সব ছাপা হয়েছে। 49th Regiment-এর একজন বাঙালী সৈনিক করাচি ক্যান্টনমেন্ট থেকে লেখা পাঠাচ্ছে দেখে বোধহয় ভয়েই ছেপে ফেলছে। এন্তার লিখছি এখানে বসে বসে।’ কিছুদিন পরে ‘মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ নামে একখানি ত্রৈমাসিক সাহিত্য-পত্রিকা নজরুল আমাকে পাঠিয়ে দিলে। দেখলাম, তাতে নজরুলের একটি গল্প ছাপা হয়েছে। চিঠিতে লিখেছে ‘আমি ‘লান্স নায়েক’ হয়েছি।’ আরও কিছুদিন পরে জানালে, ‘এখন আমি হাবিলদার।’ আমি লিখলাম, ‘বহুত বহুত সালাম হাবিলদার-সাহেব! এবার চুটিয়ে একটা কবিতা লিখে পত্রিকায় পাঠিয়ে দাও। গল্প আর লিখো না।’ জবাবে নজরুল জানালে, ‘কবিতাও লিখেছি দু’একটা। কিন্তু পাঠাতে ভরসা হয় না। আমার কবিতা বোধহয় ছাপবে না।’ আমার নিজের তখন ইচ্ছে করছে- কবিতা ছেড়ে দিয়ে গল্প লিখি (শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় : আমার বন্ধু নজরুল, পৃষ্ঠা-২১৭ ও ২১৮)।
নজরুলের মুক্তক স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত ‘ক্ষমা’ কবিতাটি প্রকাশের জন্যে তিনি পাঠিয়েছিলেন, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায়’। কিন্তু ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ কবিতাটির ‘ক্ষমা’ নাম পরিবর্তন করে ‘মুক্তি’ নামে ছাপিয়ে ছিলেন। কবিতাটির পাদটীকায় লেখা ছিল : ‘ইহা সত্য ঘটনা। ১৯১৬ সালের এপ্রিল মাসে এই দরবেশের শোচনীয় মৃত্যু ঘটে। তাঁহার পবিত্র সমাধি এখনও ‘হাত বাঁধা ফকিরের মাজার শরীফ’ বলিয়া কথিত হয় (রফিকুল ইসলাম : কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও সৃজন, পৃষ্ঠা-৩৬)।
রাণীগঞ্জের অর্জুনপট্টির বাঁকে নিম গাছের তলায় হাত বাঁধা ফকিরের মৃত্যুর ঘটনা কবি চিত্তে গভীর রেখাপাত করায় তারই ফলে ‘মুক্তি’ কবিতাটি তিনি রচনা করেন। এ কবিতায় হাত বাঁধা ফকির অর্থাৎ ফকির দরবেশের প্রতি নজরুলের আকর্ষণের পরিচয় বহন করে। প্রথম প্রকাশিত এই ‘মুক্তি’ কবিতাটি নির্ঝর কাব্যগ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। এটি নজরুলের দ্বিতীয় প্রকাশিত রচনা ও প্রথম প্রকাশিত কবিতা। কবিতাটির কিছু অংশ তুলে ধরা হলো:
‘রাণীগঞ্জের অর্জুনপট্টির বাঁকে
যেখান দিয়ে নিতুই সাঁঝে ঝাঁকে ঝাঁকে
রাজার বাঁধে জল নিয়ে যায় শহুরে বৌ কলস কাঁখে-
সেই সে বাঁকের শেষে
তিন দিক হতে তিনটে রাস্তা এসে
ত্রিবেণীর ত্রিধারার মত গেছে একেই মিশে।’
(কাজী নজরুল ইসলাম : নজরুলের কবিতা সমগ্র, পৃষ্ঠা–৬২৮)
‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় ‘মুক্তি’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ায় নজরুল সেনা ছাউনি থেকে পত্রিকার সম্পাদককে একটি চিঠি লেখেন। তখন ত্রৈমাসিক বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, যুগ্ম-সম্পাদক ভোলার মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, সহকারী সম্পাদক মুজফফর আহমদ। সে সময় বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ কাজী ইমদাদুল হক সাহেব ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র একজন কর্মকর্তা ছিলেন। সাহিত্য পত্রিকার লেখাও তিনি মাঝে মাঝে সম্পাদনা করতেন। নজরুলের লেখা পত্রটি ‘প্রথম ঢাকা হতে কাগজে ছাপা হয়। পরে ঢাকা হতেই প্রকাশিত ‘নজরুল রচনাসম্ভার’ নামক পুস্তকেও (প্রকাশকাল ২৫ শে মে, ১৯৬১ সাল) তা স্থান পেয়েছে। কলকাতার ‘বিংশ শতাব্দী’ মাসিক পত্রিকায়ও তা আরও অনেক পরে ছাপা হয়েছে। আমরা এই পত্রখানা ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় তখন ছাপিনি (মুজফফর আহমদ : কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা, পৃষ্ঠা–২৮)।’
ঢাকা থেকে পত্রটি প্রথম প্রকাশের কারণ হিসেবে জানা যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেবের সাথে পত্রটি ঢাকায় চলে গিয়েছিল। মুজফফর আহমদ জানিয়েছেন, ‘পরে খবর পেয়েছি যে শহীদুল্লাহ্ সাহেবের সঙ্গে পত্রখানা ঢাকা চলে গিয়েছিল। আমার দীর্ঘ অনুপস্থিতির সময়ে তিনিই তা ‘মাসিক সওগাত’-এ ছেপেছিলেন (মুজফফর আহমদ : কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা, পৃষ্ঠা–২৯)।’
নজরুলের ‘মুক্তি’ কবিতাটি ছাপা হওয়ায় তাঁর আনন্দ, উচ্ছ্বাস ও বিনয় প্রকাশ করে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’র সম্পাদককে তিনি ১৯ আগস্ট ১৯১৯ সালে যে চিঠিটি দিয়েছিলেন সেটি তুলে ধরা হলো:
‘From:
QAZI NAZRUL ISLAM
Battalion Quartermaster Havilder
49th Bengalis,
Dated, Cantonment, Karachi
The 19th August, 1919
আদাব হাজার হাজার জানবেন!
বাদ আরজ, আমার নগণ্য লেখাটি আপনাদের সাহিত্য পত্রিকায় স্থান পেয়েছে, এতে কৃতজ্ঞ হওয়ার চেয়ে আমি আশ্চর্য হয়েছি বেশী। আমার সবচেয়ে ভয় হয়েছিল, পাছে বেচারী লেখা ‘কোরকে’র কোঠায় পড়ে। অবশ্য যদিও আমি ‘কোরক’ ব্যতীত প্রস্ফুটিত ফুল নই; আর যদিই সে-রকম হয়ে থাকি কারুর চক্ষে, তবে সে বে-মালুম ধুতরো ফুল। যা হোক, তার জন্যে আপনার নিকট যে কত বেশী কৃতজ্ঞ, তা প্রকাশ করার ভাষা পাচ্ছিনে। আপনার এরূপ উৎসাহ বরাবর থাকলে আমি যে একটি মস্ত জবর কবি ও লেখক হব, তা হাতে-কলমে প্রমাণ করে দিব, এ একেবারে নির্ঘাৎ সত্যি কথা। কারণ, এবারে পাঠালুম একটি লম্বা চওড়া ‘গাথা’ আর একটি ‘প্রায় দীর্ঘ’ গল্প আপনাদের পরবর্তী সংখ্যা কাগজে ছাপাবার জন্যে, যদিও কার্তিক মাস এখনও অনেক দূরে। আগে থেকেই পাঠালুম, কেননা, এখন হতে এটা ভাল করে পড়ে রাখবেন এবং চাই কি আগে হতে ছাপিয়েও রাখতে পারেন। তা ছাড়া আর একটি কথা। শেষে হয়তো ভাল ভাল লেখা জমে আমার লেখাকে বিলকুল রদ্দি করে দেবে, আর তখন হয়তো এত বেশী লেখা না পড়তেও পারেন। কারণ আমি বিশেষরূপে জানি, সম্পাদক বেচারাদের গলদঘর্ম হয়ে উঠতে হয় এই নতুন কাব্যিরোগাক্রান্ত ছোকরাদের দৌরাত্ম্যিতে। যাক, অনেক বাজে কথা বলা গেল। আপনার সময়টাকেও খামকা টু’টি চেপে রেখেছিলুম। এখন বাকি কথা ক’টি মেহেরবাণী করে শুনুন।
যদি কোন লেখা পছন্দ না হয়, তবে ছি’ড়ে না ফেলে এ গরীবকে জানালেই আমি ওর নিরাপদে প্রত্যাগমণের পাথেয় পাঠিয়ে দেব। কারণ, সৈনিকের বড্ড কষ্টের জীবন। আর তার চেয়ে হাজারগুণ পরিশ্রম করে একটু আধটু লিখি। আর কারুর কাছে ও একেবারে Worthless হলেও আমার নিজের কাছে ওর দাম ভয়ানক। আর ওটা বোধ হয় সব লেখকের পক্ষেই স্বাভাবিক। আপনার পছন্দ হলো কি না, জানবার জন্যে আমার নাম-ঠিকানা লেখা একখানা Stamped খামও দেওয়া গেল এর সঙ্গে। পড়ে মতামত জানাবেন।
আর যদি এত বেশী লেখা ছাপাবার মত জায়গা না থাকে আপনার কাগজে, তা হলে যে-কোন একটা লেখা ‘সওগাতে’র সম্পাদককে hand over করলে আমি বিশেষ অনুগৃহীত হব। ‘সওগাতে’ লেখা দিচ্ছি দু’একটা করে। যা ভাল বুঝেন জানাবেন।
গল্পটি সম্বন্ধে আপনার কিছু জিজ্ঞাস্য বা বক্তব্য থাকলে জানালেই আমি ধন্যবাদের সহিত তৎক্ষণাৎ তার উত্তর দিব, কারণ, এখনও সময় রয়েছে।
আমাদের এখানে সময়ের money-value; সুতরাং লেখা সর্বাঙ্গসুন্দর হতেই পারে না। Undisturbed time মোটেই পাই না। আমি কোন কিছুরই কপি duplicate রাখতে পারি না। সেটি সম্পূর্ণ অসম্ভব।
By the by, আপনারা যে, ‘ক্ষমা’ বাদ দিয়ে কবিতাটির ‘মুক্তি’ নাম দিয়েছেন, তাতে আমি খুব সন্তুষ্ট হয়েছি। এইরকম দোষগুলি সংশোধন ক’রে নেবেন। বড্ডো ছাপার ভুল থাকে, একটু সাবধান হওয়া যায় না কি? আমি ভাল, আপনাদের কুশল সংবাদ দিবেন। নিবেদন ইতি।
খাদেম
নজরুল ইসলাম
[নজরুল রচনাসম্ভার হতে উদ্ধৃত]’
(মুজাফফর আহমদ : কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা, পৃষ্ঠা–২৯ থেকে ৩১)
চিঠিটির ভাষায় বিনয়, নম্র, রস ও কৌকুতাশ্রিত ভঙ্গী চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। কেবল যে একজন লেখকের সাফল্যজনিত আনন্দ প্রকাশ পেয়েছে সেটি শুধু নয়। চিঠিটিতে তাঁর সৈনিক জীবনের ব্যস্ততার ছবি সুস্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে। ‘মুক্তি’ কবিতায় বাস্তব ঘটনা প্রস্ফুটিত হবার পাশাপাশি শ্রদ্ধাবোধও জেগে উঠেছে। যা থেকে আলোর দিশা পাওয়া যায়। তাঁর কবিতা সবসময়ই তারুণ্যশাণিত ও স্বতঃস্ফূর্ত।
লেখক : নজরুল গবেষক
Discussion about this post