সময়ের পরিমাপে বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যের বয়স পঞ্চাশ অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে গড়ে ওঠা বাংলা সাহিত্য নানা দিক থেকে উল্লেখযোগ্য। বিগত পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যকে তার মৌল প্রবণতা এবং সেই প্রবণতার নিয়ন্ত্রণকারী সামাজিক-রাজনীতিক কার্যকারণকে বিভাজন রেখা হিসেবে বিবেচনা করে তিনটি পর্বে ভাগ করা যায়: প্রথম পর্ব (১৯৪৭-১৯৫৭), দ্বিতীয় পর্ব (১৯৫৮-১৯৭০) এবং তৃতীয় পর্ব (১৯৭১-)।
প্রথম পর্ব এই পর্ব দেশবিভাগের পর থেকে আইয়ুবি শাসনের পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের অব্যবহিত পরেই বাঙালি ও পূর্ববাংলা (পূর্ব পাকিস্তান) নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়। দেশবিভাগজনিত উদ্বাস্ত্ত সমস্যা, অর্থনৈতিক দুর্দশা, সাম্প্রদায়িক সমস্যা ইত্যাদির সঙ্গে ছিল পূর্ববাংলা ও বাংলা ভাষার প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের বিরূপ মনোভাব। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্পকাল মধ্যেই এদেশের মানুষ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অসারতা বুঝতে পারে। পাকিস্তানিরা পূর্ববাংলাকে তাদের একটি উপনিবেশ বিবেচনা করে শাসকসুলভ মানসিকতায় বাংলার পরিবর্তে একমাত্র উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চায়। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কারণে বাঙালিরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, যার ধারাবাহিকতায় আসে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন। এর ফলে বাঙালিরা স্বাধীকার চেতনার যে শক্তি অর্জন করে তার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যের প্রথম পর্ব।
উপন্যাস এ পর্বে বাংলাদেশে যে উপন্যাসগুলি রচিত হয় তার ভিত নির্মিত হয়েছিল বিভাগপূর্ব মুসলিম ঔপন্যাসিকদের রচনায়। তাঁদের মধ্যে মোহাম্মদ নজিবর রহমান, কোরবান আলী, শেখ ইদরিস আলী, কাজী ইমদাদুল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, আকবরউদ্দীন, আবুল ফজল, হুমায়ুন কবির প্রমুখের নাম বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। বিশ শতকের প্রথম দুই দশকের বাঙালি মুসলমান সমাজের চিন্তাচেতনাকে ধারণ করে এঁরা নির্মাণ করেন বাংলাদেশের উপন্যাসের ভিত্তিভূমি।
প্রথম পর্বের অধিকাংশ উপন্যাসই রচিত হয় গ্রামবাংলার বৃহত্তর পটভূমিতে। গ্রামীণ জীবন ও তার সমস্যা-সম্ভাবনাকে উপজীব্য করে রচিত এই সময়ের কয়েকটি স্মরণীয় উপন্যাস হলো সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র লালসালু (১৯৪৮); কাজি আফসারউদ্দীনের চর-ভাঙ্গা চর (১৯৫১), শামসুদ্দীন আবুল কালামের কাশবনের কন্যা (১৯৫৪) ও আলম নগরের উপকথা (১৯৫৪), আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান (১৯৫২), আবু ইসহাকের সূর্য-দীঘল বাড়ী (১৯৫৫), সরদার জয়েনউদ্দীনের আদিগন্ত প্রভৃতি। এছাড়া ইসহাক চাখারী, আকবর হোসেন, দৌলতুন্নেসা প্রমুখ ঔপন্যাসিকও উল্লিখিত সময়ে উপন্যাস রচনায় সক্রিয় ছিলেন। এঁদের উপন্যাসগুলি মূলত গ্রামকেন্দ্রিক।
১৯৪৭-৫৭ কালপর্বে গ্রামীণ জীবন ও তার স্বরূপ অনুসন্ধান যেমন উপন্যাসের একটি প্রধান প্রবণতা, তেমনি মধ্যবিত্তের জীবনজিজ্ঞাসা ও জীবনসংকটকেও কেউ কেউ উপন্যাসের বিষয় করেছেন। এই শ্রেণির উপন্যাসের মধ্যে আবুল ফজলের জীবন পথের যাত্রী (১৯৪৮) ও রাঙ্গা প্রভাত (১৯৫৭) উল্লেখযোগ্য।
ছোটগল্প বিভাগপূর্বকালে বাঙালি মুসলমানদের অনেকেই উপন্যাস রচনায় মনোনিবেশ করলেও ছোটগল্প রচনায় সকলে আগ্রহী ছিলেন না। আধুনিকমনস্ক জীবনবোধের অভাবই তাঁদেরকে ছোটগল্প রচনায় বিরত রেখেছিল। তখন যাঁরা ছোটগল্প রচনায় সক্রিয় ছিলেন তাঁদের মধ্যে আবুল ফজল, আবু রুশদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, আবুল মনসুর আহমদ, শামসুদ্দীন আবুল কালাম এবং শওকত ওসমান উল্লেখযোগ্য। দেশবিভাগের পরে মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে বিকাশ ঘটে তাকে কেন্দ্র করেই ছোটগল্পের ভুবন গড়ে ওঠে এবং অধিকাংশ গল্পের পটভূমি ওই মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ থেকেই গৃহীত হয়। বাংলা ছোটগল্পের আবহমান ধারাকে ধারণ করে দেশজ জীবনবোধ ও প্রবল সমাজচেতনা নিয়ে গড়ে ওঠে বাংলাদেশের ছোটগল্প। গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের রূঢ়তা এবং বাস্তবের অনুপুঙ্খ চিত্রায়ণই ছিল এ পর্বের গল্পের মুখ্য উদ্দেশ্য। তাছাড়া নাগরিক জীবনের অভিঘাত গ্রামীণ জীবনের নিস্তরঙ্গ ব্যবস্থা কীভাবে ভেঙ্গে দিচ্ছিল তার চিত্রও পাওয়া যায়। শওকত ওসমানের পিজরাঁপোল (১৯৫০), জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প (১৯৫২), সাবেক কাহিনী (১৯৫৩); শামসুদ্দীন আবুল কালামের অনেক দিনের আশা (১৯৫২), পথ জানা নেই (১৯৫৩), ঢেউ (১৯৫৩); শাহেদ আলীর জিবরাইলের ডানা (১৯৫৩); আলাউদ্দিন আল আজাদের জেগে আছি, ধান কন্যা (১৯৫১), মৃগনাভি (১৯৫৫) প্রভৃতি এ পর্বের উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ।
কবিতা দেশবিভাগের আগে থেকেই পূর্ববাংলার কবিরা কলকাতাকেন্দ্রিক কবিতার ধারাকে পরিহার করে নিজস্ব চিন্তাচেতনার প্রকাশ ঘটিয়ে কবিতা রচনার প্রয়াস চালিয়ে আসছিলেন। দেশবিভাগের পর নতুন দেশের নতুন পটভূমিতে স্বচ্ছন্দে এদেশের কবিবৃন্দ কবিতা রচনার চেষ্টা করেন। যাঁরা তখন কবিতার সূচনা করেন তাঁদের মধ্যে ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪), আহসান হাবীব (১৯১৮-১৯৮৩), আবুল হোসেন (জ. ১৯২১), গোলাম কুদ্দুস এবং সৈয়দ আলী আহসান (জ. ১৯২২) প্রধান।
দেশবিভাগের পরে ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইতিহাসকে অবলম্বন করে রোম্যান্টিক ভাবধারা-সম্পন্ন কবিতা রচনার প্রবণতা প্রকট হয়ে ওঠে। এর পাশাপাশি পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ নিয়ে রচিত কবিতাও বিশেষ স্থান দখল করে। এ ভাবধারার প্রধান কবি ছিলেন ফররুখ আহমদ। ধর্মীয় বিশ্বাসকে কবিতার আবেগে রূপান্তরিত করে তিনি সার্থক কাব্যজগৎ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। তাঁর রচিত সাত সাগরের মাঝি (১৯৪৪), সিরাজাম মুনীরা (১৯৫২) প্রভৃতি এ পর্বের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। একই বিষয়ে রচিত গোলাম মোস্তফার বনি আদম (১৯৫৮) ও তালিম হোসেনের দিশারী (১৯৫৬) এ সময়ের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ। এছাড়া সৈয়দ আলী আহসান, মুফাখখারুল ইসলাম, ছদরুদ্দীন, সুফী জুলফিকার হায়দার প্রমুখ ছিলেন উল্লিখিত সময়ের প্রধান প্রধান কবি।
এ পর্বে ধর্মীয় এবং পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে সাধারণ মানুষ, দেশের মাটি ও প্রকৃতিকে নিয়ে বিশেষ এক ধরনের কবিতা রচনার চেষ্টা হয়, যেগুলিকে অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী ধারার কবিতা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। সেগুলির মধ্যে আশরাফ সিদ্দিকীর বিষকন্যা (১৯৫৫), সাত ভাই চম্পা (১৯৫৫), উত্তর আকাশের তারা (১৯৫৮), মাযহারুল ইসলামের মাটির ফসল (১৯৫৫), মতিউল ইসলামের সপ্তকন্যা (১৯৫৭), বেগম সুফিয়া কামালের মন ও জীবন (১৯৫৭) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
দেশবিভাগের অব্যবহিত পরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আশ্রয় করে কবিতায় আরেকটি ধারা গড়ে ওঠে। এ ধারার কবিরা কবিতায় নিয়ে আসেন একটি অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁরা দেশজ উত্তরাধিকারকে তাঁদের কবিতার প্রধান উপাদান করে তোলেন; তাঁরা বিশ্বাস করতে শুরু করেন বাংলা সাহিত্যের প্রবহমান ঐতিহ্যকে। ফলে কবিতা-রচনায় ও জীবনদর্শনে তাঁরা হয়ে ওঠেন মানবতাবাদী। তাঁদের মুখপত্র হিসেবে ১৯৫০ সালে আশরাফ সিদ্দিকী ও আবদুর রশীদ খানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় নতুন কবিতা। সম্পাদকদ্বয় ছাড়াও শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর প্রমুখের কবিতায় সংকলনটি সমৃদ্ধ হয়েছিল।
একুশে ফেব্রুয়ারি এদেশের জাতীয় জীবনে যেমন, তেমনি কবিতার ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। একুশকে নিয়ে হাসান হাফিজুর রহমান ১৯৫৩ সালে একুশে ফেব্রুয়ারী নামে একটি সংকলনটি প্রকাশ করেন। তাতে পূর্বোল্লিখিত নতুন কবিতায় অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ কবিতাই পুনর্মুদ্রিত হয়। বাংলাদেশের কবিতার অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী চরিত্র নির্মাণে উল্লিখিত দুটি সংকলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ধারার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আশরাফ সিদ্দিকীর তালেব মাস্টার ও অন্যান্য কবিতা (১৯৫০), আজিজুল হাকিমের বিদগ্ধ দিনের প্রান্তর প্রভৃতির নাম উল্লেখ করা যায়।
নাটক এই পর্বে সহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো নাট্যসাহিত্য ততটা বিকাশ লাভ করে নি। নাটক সম্পর্কে ধর্মীয় ও সামাজিক নিষেধ, বিশেষত নাটকের মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা নাটকের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। এ সময়ের অধিকাংশ নাটকই ঐতিহাসিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত; সমকালীন জীবনবাস্তবতার কোনো স্পর্শ তাতে নেই। এ সব নাটকের মধ্যে আকবরউদ্দীনের নাদির শাহ (১৯৫৩) উল্লেখযোগ্য। লোককথাকে ভিত্তি করে কবি জসীমউদ্দীন রচনা করেন পদ্মাপার, মধুমালা ও বেদের মেয়ে। এই দুই ধারার বাইরে গিয়ে সমকালীন জীবনের একটি অনবদ্য রূপ অঙ্কিত হতে দেখা যায় নুরুল মোমেনের নেমেসিস (১৯৪৮) নাটকে। নেমেসিস বাংলাদেশের নাট্যধারার জীবনচিত্রণ ও আঙ্গিক বিবেচনায় সর্বপ্রথম সার্থক নাটক। এছাড়া রাজিয়া খানের সংবর্ত নাটকে পাওয়া যায় রাজনীতি-সচেতনতা। সামাজিক নাটক রচনার ক্ষেত্রে আশকার ইবনে শাইখের নাম বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। তিনি গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে অনেকগুলি নাটক রচনা করেন, যেমন: পদক্ষেপ, বিদ্রোহী পদ্মা, দুরন্ত ঢেউ, বিরোধ, অগ্নিগিরি, অনুবর্তন ও প্রতীক্ষা। এ নাটকগুলির রচনাকাল ১৯৫১ থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত। উল্লিখিত নাটকগুলিতে বিষয়-বৈচিত্র্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সেখানে ঐতিহাসিক নাটকের পাশাপাশি পাওয়া যায় রাজনীতিক চেতনাসমৃদ্ধ প্রতিবাদী নাটক, লোককাহিনীভিত্তিক নাটক, কাব্য ও ব্যঙ্গ রসাত্মক নাটক। সুতরাং বিভাগপরবর্তী বাংলাদেশের নাটক মূলত ঐতিহাসিক নাটক রচনার মধ্য দিয়ে শুরু হলেও ক্রমশ তা সামাজিক বাস্তবতা এবং অন্যান্য বিষয় অবলম্বনে অগ্রসর হয়।
বাংলাদেশের নাটককে মুনীর চৌধুরী, বলা চলে প্রায় একক প্রচেষ্টায়, আন্তর্জাতিক নাট্যসাহিত্যের সমগোত্রীয় করে তোলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তিনি রচনা করেন অসামান্য নাটক কবর (১৯৫৩)। নাটকটি কারাবন্দি অবস্থায় কারাগারে অভিনয়ের জন্য অপর রাজবন্দী রণেশ দাশগুপ্তের অনুরোধে রচিত হয়। বক্তব্য, আঙ্গিক ও সংলাপ রচনার দক্ষতায় এটি সমগ্র বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে এক অনন্য সংযোজন। কবর বাংলাদেশের নাটকের ক্ষেত্রে একটি পালাবদলকারী নাটক। গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় কবর নাটকের সঙ্গে মানুষ ও নষ্টছেলে নাটিকা দুটিও স্থান পায়। এ তিনটি নাটকের মাধ্যমে নাট্যকার সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে একটি বৃহৎ মানবিকতায় পৌঁছানোর কথা ব্যক্ত করেন।
প্রবন্ধ বিভাগোত্তরকালে রচিত প্রবন্ধগুলির অধিকাংশই সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক। রচয়িতাদের অনেকেই দেশবিভাগের আগে থেকেই এ ক্ষেত্রে খ্যাতিমান ছিলেন; মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও মুহম্মদ আবদুল হাই-এর নাম এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র লে শাঁ মিস্তিক এবং বাংলা ধ্বনিতত্ত্ববিষয়ক গ্রন্থ লে সঁ দ্যু বঁগালি ১৯২৮ সালে প্যারিস থেকে প্রকাশিত হয়। দেশবিভাগের পর এঁরা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে অসাধারণ গবেষণা করেন। শহীদুল্লাহ্ রচিত বাংলা সাহিত্যের কথা (২ খন্ড ১৯৫৩, ১৯৬৫) এবং আবদুল হাই-এর সাহিত্য ও সংস্কৃতি (১৯৫৪) প্রথম পর্বের প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দ্বিতীয় পর্ব ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন প্রবর্তনের ফলে সাহিত্যসংস্কৃতিচর্চার ধারা বাধাগ্রস্ত হয়। প্রকাশ্য রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা, গণতন্ত্রের অবয়বে একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি কারণে বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে, যা এক সময় গণ-আন্দোলনের রূপ নেয়। ১৯৬৮ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৬৯ সালে ছাত্রসমাজের ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দাবিদিবস পালন ও গণআন্দোলন, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাঙালিদের নিরঙ্কুশ বিজয়, বিজয়ী দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ষড়যন্ত্র, পরিণতিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালিদের স্বাধীনতা অর্জন এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব এসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটে। বাংলাদেশের সমাজজীবনে উল্লিখিত ঘটনাবলির প্রভাবই ১৯৫৮-১৯৭০ কালপর্বের সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে।
উপন্যাস প্রথম পর্বের মতো দ্বিতীয় পর্বেও প্রধানত গ্রামীণ জীবনকে নিয়েই উপন্যাস রচিত হতে দেখা যায়। তবে এ সময়ের উপন্যাসে মাত্রাগত পরিবর্তন যুক্ত হয়েছে, ফলে তা প্রথম পর্বের উপন্যাসের তুলনায় আলাদা। উদাহরণ হিসেবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র চাঁদের অমাবস্যা (১৯৬৪) উপন্যাসের কথা স্মরণ করা যায়। এতে গ্রামীণ জীবনকে পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করে ঔপন্যাসিক মূলত আইয়ুবি দশকের ধর্মভীতি ও সমরাস্ত্র-শাসিত সমাজজীবনকেই রূপায়িত করেছেন। এর পাশাপাশি প্রথম পর্বের উপন্যাসের মতো বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতাকে উপজীব্য করে জহির রায়হান (১৯৩৩-১৯৭২) রচনা করেন হাজার বছর ধরে (১৯৬৪)। গ্রামীণ সমাজজীবনের হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের জটিল বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে সত্যেন সেন (১৯০৭-১৯৮১) রচনা করেন পদচিহ্ন (১৯৬৮)। নাগরিক জীবনের অভিঘাত ও জটিলতা কীভাবে দক্ষিণ বাংলার গ্রামীণ জীবনের নিরাপত্তাকে ক্রমশ বিনষ্ট করছিল তার একটি বাস্তবচিত্র অঙ্কিত হতে দেখা যায় শহীদুল্লাহ কায়সারের (১৯২৫-১৯৭১) সারেং বৌ (১৯৬২) উপন্যাসে। কর্ণফুলী নদীতীরবর্তী জনপদের শ্রমজীবী মানুষের জীবনসংগ্রাম এবং শ্রেণি-অস্তিত্বরূপ লাভ করেছে আলাউদ্দিন আল আজাদের কর্ণফুলী উপন্যাসে। আহমদ ছফার সূর্য তুমি সাথী (১৯৬৮) উপন্যাসে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনসংগ্রামের চলমান রূপ বিন্যস্ত হয়েছে।
আইয়ুবি সামরিক শাসন বাঙালির জীবনচেতনা ও চিন্তাজগতে যে ছায়া ফেলেছিল, তারই প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকরা বক্তব্য প্রকাশের জন্য আশ্রয় খুঁজেছিলেন মিথরূপকের জগতে, নয়তো অনুসন্ধান করেছেন ব্যক্তির গভীর মনোজগৎ। ১৯৫৮-১৯৭০ কালপর্বে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি যে জটিল ও বহুমুখী সঙ্কটের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে, রূপকের আশ্রয়ে ওই সঙ্কটকেই শওকত ওসমান রূপ দিয়েছেন ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬৩), রাজা উপাখ্যান (১৯৭০) ও সমাগম উপন্যাসে। একইভাবে ওল্ড টেস্টামেন্টের বুক অব দ্য প্রফেট যেরেমিয়া খন্ডের মিথরূপকের আশ্রয় নিয়ে চিরায়ত সংগ্রামী জীবনকে ফুটিয়ে তুলেছেন সত্যেন সেন তাঁর অভিশপ্ত নগরী (১৯৬৭) ও পাপের সন্তান (১৯৬৯) উপন্যাস দুটিতে। সমাজ ও সময়ের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এবং প্রগতিশীল রাজনীতিক ভাবনা নিয়ে শামসুদ্দীন আবুল কালাম রচনা করেন ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান (১৯৬৩) উপন্যাসটি।
ইউরোপীয় সমাজের মধ্যবিত্তশ্রেণীর অনুসরণে এবং ব্যক্তিবোধের সূত্র ধরে অনেকেই এ পর্যায়ে রচনা করেন আধুনিক জীবনভাবনা-সম্পন্ন উপন্যাস। এসব উপন্যাসে লক্ষ করা যায় মূল্যবোধে অবিশ্বাস, প্রেমশক্তিতে অনাস্থা এবং জীবনের প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণা। নাগরিক জীবনের ব্যক্তি-মানুষের নৈঃসঙ্গ্য এবং বিচ্ছিন্নতাকে ঔপন্যাসিকরা তাঁদের উপন্যাসের উপজীব্য করে তোলেন। এ ধরনের উপন্যাসের মধ্যে রাজিয়া খানের (জ. ১৯৩৬) বটতলার উপন্যাস (১৯৫৯) এবং অনুকল্প (১৯৫৯) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সৈয়দ শামসুল হক (জ. ১৯৩৫) এ জাতীয় উপন্যাস রচনায় সিদ্ধহস্ত। তাঁর বেশকিছু উপন্যাসে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বকে সচেতনভাবে প্রয়োগের প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। তাঁর প্রধান উপন্যাসগুলির মধ্যে রয়েছে দেয়ালের দেশ (১৯৫৯), এক মহিলার ছবি (১৯৫৯), অনুপম দিন (১৯৬২) ও সীমানা ছাড়িয়ে (১৯৬৪)।
জহির রায়হানের শেষ বিকেলের মেয়ে (১৯৬০) আপাত দৃষ্টিতে একটি রোম্যান্টিক প্রেমকাহিনী হলেও তাতে সমকালের বিকাশমান বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনজটিলতাকেই চিত্রিত করা হয়েছে। আলাউদ্দিন আল আজাদের তেইশ নম্বর তৈলচিত্র (১৯৬০) ও শীতের শেষ রাত বসন্তের প্রথম দিন (১৯৬২) উপন্যাসে ব্যক্তি-মানুষের সঙ্কট ও মানসিক দ্বন্দ্ব-যন্ত্রণা প্রধান হয়ে উঠেছে। অনুরূপ এক শিল্পি-দম্পতির মানসিক সঙ্কটকে নিয়ে রচিত হয়েছে কবি আহসান হাবীবের অরণ্য নীলিমা (১৯৬১) উপন্যাসটি। রশিদ করিমের প্রসন্ন পাষাণ (১৯৬৩) উপন্যাসটি প্রকৃতপক্ষে নাগরিক মধ্যবিত্তের জীবনজটিলতার এক বিশ্বস্ত দলিল। নাগরিক জীবনের উল্লিখিত প্রবণতাগুলি নিয়ে রচিত উপন্যাসের পাশাপাশি নাগরিক মধ্যবিত্তের স্থূলতা, নৈতিকতা-বর্জিত বিত্তসর্বস্বতা, রুচিবিকার ও রিরংসাবৃত্তির বিকৃতিকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে শওকত আলীর পিঙ্গল আকাশ (১৯৬৩)। দিলারা হাশেমের (১৯৪৩) বৃহদায়তন উপন্যাস ঘর মন জানালা (১৯৬৫) মধ্যবিত্ত জীবনের সংগ্রাম ও ব্যর্থতাবোধের কাহিনী।
উপন্যাস রচনার উল্লিখিত প্রবণতার বাইরে গিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ রচনা করেন অসাধারণ উপন্যাস কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৮)। তাঁর উপন্যাসে মধ্যবিত্ত জীবনের ক্লেদ ও সম্ভাবনা যত না ধরা পড়েছে, তার চেয়ে বেশি অঙ্কিত হয়েছে ব্যষ্টি ও সমষ্টি, মানুষের বাইরের ও ভেতরের জীবন, অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ত্বের সংঘাত। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র চাঁদের অমাবস্যা ও কাঁদো নদী কাঁদো প্রকৃতপক্ষে বাংলা উপন্যাসের ধারায় ব্যতিক্রম।
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর পূর্ববাংলার রাজনীতি এবং রাজনীতিনির্ভর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়গুলি বাঙালিদের চিন্তাজগতে যেমন প্রভাব বিস্তার করে, অনুরূপ প্রভাব বিস্তার করে সৃজনশীল সাহিত্যেও। বাংলাদেশের উপন্যাসে সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাবও লক্ষ করা যায়। সমকালীন রাজনীতির গতিপ্রকৃতি এবং জাতীয়তাবাদী মুক্তিসংগ্রাম যে-সকল উপন্যাসে বস্ত্তনিষ্ঠভাবে ধরা পড়েছে, সেগুলির মধ্যে শহীদুল্লাহ কায়সারের সংসপ্তক (১৯৬৫), আলাউদ্দিন আল আজাদের ক্ষুধা ও আশা (১৯৬৪), সরদার জয়েনউদ্দীনের অনেক সূর্যের আশা (১৯৬৭), জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯), জহিরুল ইসলামের অগ্নিসাক্ষী (১৯৬৯), সত্যেন সেনের উত্তরণ (১৯৭০) এবং আনোয়ার পাশার (১৯২৮-১৯৭১) নীড়সন্ধানী (১৯৬৮) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ছোটগল্প ষাটের দশকে বাংলা ছোটগল্প সংখ্যায় যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি বৈচিত্র্যেও ঋদ্ধ হয়। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মনোযোগী হন এ পর্বের গল্পকাররা। প্রথম পর্বে যাঁরা গল্পরচনায় সক্রিয় ছিলেন তাঁরাও যেমন জীবনঘনিষ্ঠ গল্প রচনায় মনোযোগী হন, তেমনি অনেক নতুন গল্পকারেরও আবির্ভাব ঘটে। এ সময়ের গল্পকাররা তাঁদের গল্পের মাধ্যমে দরিদ্র গ্রামীণ সমাজজীবনের নানা সমস্যা বিশ্বস্ততার সঙ্গে তুলে ধরেন। এ বিষয়ক গল্পগ্রন্থগুলির মধ্যে শাহেদ আলীর একই সমতলে (১৯৬৩), সরদার জয়েনউদ্দীনের বীর কণ্ঠীর বিয়ে, নয়ান ঢুলি ইত্যাদি উল্লেখ্য। তবে গ্রামীণ জীবনচিত্রণের পাশাপাশি অনেকেই নাগরিক মধ্যবিত্তের জীবন-জটিলতা, আশা-নৈরাশ্য, কামনা-অপ্রাপ্তি, যন্ত্রণা-তৃপ্তি ইত্যাদি মানবিকবোধ নিয়ে গল্প রচনায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। যেসব গল্পগ্রন্থে নাগরিক মধ্যবিত্তের জীবন বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে সেগুলির মধ্যে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সম্রাটের ছবি (১৯৫৯), কৃষ্ণপক্ষ (১৯৫৯), সুন্দর হে সুন্দর (১৯৬০); সৈয়দ শামসুল হকের শীত বিকেল (১৯৫৯), রক্তগোলাপ (১৯৬৪), আনন্দের মৃত্যু (১৯৬৭) প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনচিত্রণের সাধারণ প্রবণতার বাইরে সমাজ-বাস্তবতাকে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে অবলোকন ও চিত্রণের চেষ্টা করেছেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। তাঁর অধিকাংশ গল্পেই শ্রেণিসংঘর্ষের নির্মম পরিণতি প্রকাশিত হয়েছে। কিন্ত তিনি মার্কসবাদী ও দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদের অনুসারী হলেও রোম্যান্টিকতায় ছিল তাঁর প্রবল উৎসাহ। ফলে এই দ্বিবিধ মানসিকতা সব সময়ই তাঁর গল্পকে বক্তব্যের দিক দিয়ে দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় জেগে আছি, ধানকন্যা (১৯৫১), অন্ধকার সিঁড়ি (১৯৫৮), যখন সৈকত (১৯৬৭) প্রভৃতি গ্রন্থে। বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীরও মার্কসবাদী দৃষ্টিতে জীবনকে দেখার চেষ্টা করেছেন। তবে আলাউদ্দিন আল আজাদের মতো তিনি প্রত্যক্ষভাবে গল্পের কাঠামো ও বিষয়ে মার্কসবাদের প্রয়োগ ঘটাননি, তিনি মার্কসবাদী হয়েও পরোক্ষ ও নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জীবন রূপায়ণে আগ্রহী। তাঁর অধিকাংশ গল্পের ঘটনা ও চরিত্র গৃহীত হয়েছে নাগরিক মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে। ফলে মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনসংগ্রামই তাঁর গল্পের মূল উপজীব্য। বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীরের উপর্যুক্ত মানসিকতা ধরা পড়ে তাঁর দূরদূরান্ত (১৯৬৮), অবিচ্ছিন্ন (১৯৬৯) ও বিশাল ক্রোধ (১৯৬৯) গল্পগ্রন্থে।
কবিতা এ পর্বেও ইসলাম ধর্ম অবলম্বনে কেউ কেউ কবিতা রচনা করেছেন, যেমন ফররুখ আহমদের হাতেম তা‘য়ী (১৯৬৬), রওশন ইজদানীর খাতামুন নবীঈন (১৯৬০), তালিম হোসেনের শাহীন (১৯৬২), সুফী জুলফিকার হায়দারের ফের বানাও মুসলমান (১৯৫৯) ইত্যাদি। ১৯৬৫ সালে পাকভারত যুদ্ধের সময় কবিরা স্বদেশপ্রেম, জাতীয় গৌরব ও সাম্প্রদায়িক বৈরিভাবকে কবিতার বিষয় করে তুলেছিলেন। তবে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে এ ধরনের কবিতা রচনার প্রয়াস ক্রমশ কমতে থাকে; জনপ্রিয় হয় মানবতাবাদে আস্থাশীল কবিতা রচনার ধারা। প্রেম, প্রকৃতি ও মানুষকে নিয়ে সরল রোম্যান্টিক ভাবোচ্ছ্বাস-সম্পন্ন কবিতাই হয়ে ওঠে ওই সময়ের প্রধান কাব্যধারা। যাঁদের রচনায় ওই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়েছিল তাঁদের মধ্যে সৈয়দ আলী আহসানের উচ্চারণ (১৯৬৮), শামসুর রাহমানের বিধ্বস্ত নীলিমা (১৯৬৭), মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের বিপন্ন বিষাদ (১৯৬৮), হাসান হাফিজুর রহমানের অন্তিম শরের মত (১৯৬৮), আল মাহমুদের কালের কলস (১৯৬৬), শহীদ কাদরীর উত্তরাধিকার (১৯৬৮), ফজল শাহাবুদ্দীনের আকাঙ্ক্ষিত অসুন্দর (১৯৬৯), সৈয়দ শামসুল হকের বিরতিহীন উৎসব, আবদুল মান্নান সৈয়দের জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ (১৯৬৬) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও মোহাম্মদ মাহফুজুল্লার জুলেখার মন (১৯৫৯), কাদের নওয়াজের নীল কুমুদী (১৯৬০), মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার মন ও মৃত্তিকা (১৯৬০) ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থের নাম উল্লেখ করা যায়।
এর পাশাপাশি আরও এক ধরনের কবিতা বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল ওই সময়, যেগুলি সমকালীন জীবনের গ্লানি, ব্যর্থতা ও হতাশাকে ধারণ করে বুর্জোয়া মানবতাবাদের সমস্যা, দ্বন্দ্ব ও অবক্ষয়কে প্রকাশ করেছে। শামসুর রাহমানের প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে (১৯৬০) ও রৌদ্র করোটিতে (১৯৬৩) এ ধারার দুটি উল্লেখযোগ্য কাব্য। অন্য যেসব কাব্য এ ধারার অন্তর্ভুক্ত সেগুলি হলো আবদুল গণি হাজারীর সামান্য ধন (১৯৬১) ও সূর্যের সিঁড়ি, সৈয়দ শামসুল হকের একদা এক রাজ্যে (১৯৬১), সৈয়দ আলী আহসানের অনেক আকাশ (১৯৬১) ও একক সন্ধ্যায় বসন্ত (১৯৬২), হাসান হাফিজুর রহমানের বিমুখ প্রান্তর (১৯৬৩), আল মাহমুদের লোক লোকান্তর (১৯৬৩) এবং আহসান হাবীবের সারা দুপুর (১৯৬৪)।
ওই সময় আরও এক ধারার কবিতা রচিত হয়েছে যাতে ধরা পড়েছে পূর্ববাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রকৃতিভিত্তিক কবিমনের বিশেষ রূপ। এ ধরনের কবিতায় দেখা যায় বিশেষ আবেগ ও অনুভূতি নিয়ে কবিরা বাংলাদেশের দিকে তাকিয়েছেন; স্বদেশপ্রেম ওই সকল কবিতায় প্রধান সুর হিসেবে ধ্বনিত হয়েছে। সানাউল হকের সম্ভবা অনন্যা (১৯৬২) ও সূর্য অন্যতর (১৯৬৩) কাব্যগ্রন্থদ্বয়ে ওই মনোভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। এ কবিতার ধারাবাহিকতায়ই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের কবিতায় বাঙালি জাতীয়তাবোধের প্রতিফলন ঘটতে থাকে।
আলাউদ্দিন আল আজাদের মানচিত্র (১৯৬১) ও হোসনে আরার মিছিল (১৯৬৪) এ সময়ের দুটি কবিতার বই। এতে সমাজের অত্যাচারিত মানুষের পক্ষ অবলম্বন করে কবিতা লিখেছেন তাঁরা। দুজনই কবিতাকে সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেছেন এবং মার্কসবাদ তাঁদের চিন্তার মূল চালিকাশক্তি। এ সময় মার্কসবাদকে নিয়ে আরও অনেকে কবিতা রচনা করেছেন।
এ সময়ের বাংলা কবিতা ক্রমশ সমষ্টির ভাবনায় উচ্চকিত হয়ে ওঠে। নির্দিষ্ট কোনো রাজনীতিক বা সামাজিক আদর্শে বিশ্বাসী না হয়েও কবিবৃন্দ পূর্ববাংলার মানুষের সমষ্টিগত বোধ ও আবেগকে ভাষা দেওয়ার চেষ্টা করেন। সৈয়দ শামসুল হকের বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা (১৯৬৯), শামসুর রাহমানের নিজ বাসভূমে (১৯৭০), আল মাহমুদের সোনালী কাবিন ও নির্মলেন্দু গুণের প্রেমাংশুর রক্ত চাই (১৯৭০) কাব্যগ্রন্থের মধ্যে এ ধরনের চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। এ সকল কাব্যগ্রন্থের মূল বিষয়বস্ত্ত এদেশের জনজীবনের দুর্দশা, জাতীয় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, জাতিগত নির্যাতন ও নিষ্পেষণ এবং তার প্রতিবাদ। কবিরা ব্যক্তির দুর্দশাকে ছাড়িয়ে সমষ্টির স্বপ্নকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানই বাংলাদেশের কবিতায় এ পালাবদল ঘটিয়েছিল। অভ্যুত্থানের কারণে কবিতায় শব্দ ব্যবহারের ধরণও পাল্টে যায়; কারণ আন্দোলনের দিনগুলিতে মিছিল, ধর্মঘট, হরতাল, শ্লোগান, সান্ধ্য আইন, পুলিশ-মিলিটারি প্রভৃতি শব্দের সঙ্গে প্রতিনিয়ত এদেশের মানুষের পরিচয় ঘটে। ফলে ওইসব শব্দ অনায়াসেই কবিতায় ঢুকে পড়ে, যার ফলে বাংলাদেশের কবিতা শব্দসম্পদের দিক দিয়ে একটি নতুন সম্ভাবনার সূচনা করে এবং পৌঁছে যায় গণজীবনের একেবারে কাছাকাছি।
নাটক সমকাল ও সমসমাজকে কেন্দ্র করে বাংলা নাটকের যে চর্চা প্রথম পর্বে শুরু হয়েছিল, দ্বিতীয় পর্বে তার বিকাশ ঘটে। এ পর্বে নাটক হয়ে ওঠে বৈচিত্র্যময় ও নিরীক্ষাধর্মী। তুলনামূলকভাবে এ সময়ের নাটকে সামাজিক বাস্তবতার নাট্যরূপ দানের প্রচেষ্টা বেশি দেখা দেয়; প্রকাশিত হয় মুনীর চৌধুরীর বিখ্যাত কয়েকটি নাটক, যার মধ্যে মৌলিক নাটকের পাশাপাশি রূপান্তরিত নাটকও রয়েছে। মুনীর চৌধুরীর দন্ডকারণ্য (১৯৬৬) সমকালীন জীবন থেকে বিষয়বস্ত্ত নিয়ে রচিত। তাঁর চিঠি নাটকটিও সাধারণ বিষয়বস্ত্তকে কেন্দ্র করে ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপের মাধ্যমে হাস্যরস সৃষ্টির উদ্দেশ্যে রচিত। ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে রচিত হলেও মুনীর চৌধুরীর রক্তাক্ত প্রান্তর সমকালীন যুদ্ধবিরোধী মানসিকতার এক অসাধারণ নাট্যরূপায়ণ। মুনীর চৌধুরীর মতো ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে সিকান্দার আবু জাফরও রচনা করেন সিরাজউদ্দৌলা (১৯৬৫) ও মহাকবি আলাউল (১৯৬৬); তবে দুটি নাটকই জীবনবোধের গভীরতা ও বক্তব্যে কেবল ইতিহাসের অংশ না হয়ে সমকালীন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। শওকত ওসমানও সমকালীন সমাজ নিয়ে নাটক রচনায় আগ্রহী হয়েছিলেন। তাঁর আমলার মামলা, তস্কর লস্কর, কাঁকর মণি ও এতিমখানা সমকালীন সামাজিক বিষয় অবলম্বনে রচিত নাটক।
বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ একটি বিশিষ্ট নাম। তিনিই প্রথম নাট্যকার যিনি বাংলা নাটকে ইউরোপীয় নাটকের রুচি ও প্রকরণ নিয়ে আসেন। তাঁর রচিত বহিপীর ও তরঙ্গভঙ্গ (১৯৬৪) বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যে ভিন্নধর্মী সংযোজন। তাঁর মতোই আধুনিক দর্শন ও শিল্পতত্ত্বের সাহায্য নিয়ে বিশ্বমানের নাটক রচনা করে বাংলা নাটককে সমৃদ্ধ করেন সাঈদ আহমদ। তাঁর কালবেলা (১৯৬২) ও মাইলপোস্ট (১৯৬৪) বিশ্বনাটকের মানের সঙ্গে তুলনীয়; আঙ্গিক কুশলতায়ও এসব নাটক অভিনব ও নিরীক্ষাধর্মী।
শ্রেণিদ্বন্দ্বকে নাটকের বিষয় হিসেবে নির্বাচন করে আলাউদ্দিন আল আজাদ রচনা করেন মায়াবী প্রহর (১৯৬৯); কিন্তু মরোক্কোর যাদুঘর (১৯৫৯) নাটকে তিনি দক্ষতার সঙ্গে রূপকের আশ্রয়ে আধুনিক জীবনের সমস্যাকে রূপায়িত করেন। একই রকম রূপক নাটক রচনায় কৃতিত্বের পরিচয় দেন সিকান্দার আবু জাফর। তাঁর শকুন্ত উপাখ্যান (১৯৬৮) একটি অনন্যসাধারণ রূপক নাটক। জিয়া হায়দার রচিত শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ (১৯৭০), আবদুল্লাহ আল-মামুনের শপথ (১৯৬৫) মূলত প্রতীকী নাটক। এছাড়া উল্লিখিত সময়ে যাঁরা নাট্য রচনায় উৎসাহী হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে আনিস চৌধুরী, নীলিমা ইব্রাহীম, আ.ন.ম বজলুর রশীদ, ইব্রাহিম খলিল, কল্যাণ মিত্র প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
প্রবন্ধ এ পর্বের প্রবন্ধে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কেই বেশি গবেষণা হয় এবং তাতে বাঙালি মুসলমান লেখকগণ প্রাধান্য লাভ করেন। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো নাজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ানের বাঙ্গালা সাহিত্যের নতুন ইতিহাস, আবদুল লতিফ চৌধুরীর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, মুহম্মদ এনামুল হকের মুসলিম বাঙ্গালা সহিত্য, মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসানের বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, কাজী দীন মুহম্মদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ও মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে চর্চার পাশাপাশি বাংলা ভাষা নিয়েও একাধিক লেখক এপর্বে গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত, মুহম্মদ আবদুল হাই-এর ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব, শিবপ্রসন্ন লাহিড়ীর সিলেটি ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা ইত্যাদি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা যায়।
বাংলা সাহিত্যে মুসলমান লেখকদের অবদান নিয়ে একাধিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে। এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলি হলো অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, কাজী আবদুল মান্নানের আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর বাংলা কাব্যে মুসলিম ঐতিহ্য, মুস্তাফা নূরউল ইসলামের মুসলিম বাংলা সাহিত্য, গোলাম সাকলায়েনের মুসলিম সাহিত্য ও সাহিত্যিক, পূর্ব-পাকিস্তানের সুফী সাধক প্রভৃতি।
এ পর্বে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে এবং সেগুলি হলো মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর রবি পরিক্রমা, আনোয়ার পাশার রবীন্দ্র ছোটগল্প সমীক্ষা, যোগেশচন্দ্র সিংহের ধ্যানী রবীন্দ্রনাথ, আনিসুজ্জামান সম্পাদিত রবীন্দ্রনাথ, সৈয়দ আকরম হোসেনের রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস: দেশকাল ও শিল্পরূপ, আহমদ কবিরের রবীন্দ্রকাব্য: উপমা ও প্রতীক, হুমায়ুন আজাদের রবীন্দ্রনাথ: রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা প্রভৃতি।
পুথিসাহিত্য সম্পাদনার ক্ষেত্রে স্বাধীনতাপূর্বকালে অনেকেই আগ্রহী হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে আলাওলের পদ্মাবতী কাব্যটির পাঠ সম্পাদনা ও সমালোচনা করেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, সৈয়দ আলী আহসান ও আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। পরবর্তীকালে সম্পাদনামূলক কর্মে প্রধানত মুসলমানদের রচিত পুথি সম্পাদনাই প্রাধান্য পায়। এক্ষেত্রে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাঁদের মধ্যে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, আহমদ শরীফ, এনামুল হক প্রমুখের নাম স্মরণযোগ্য। আহমদ শরীফ সম্পাদনা করেন দৌলত উজির বাহরাম খানের লায়লী-মজনু (১৯৫৮), আলাওলের তোহফা (১৯৫৮), মহম্মদ খানের সত্যকলি-বিবাদ-সংবাদ বা যুগ সংবাদ (১৯৫৯), জয়েনউদ্দীনের রসুলবিজয় (১৯৬৪) ইত্যাদিসহ পনেরোটিরও অধিক পুথি। এছাড়া মযহারুল ইসলাম ও মুহম্মদ আবদুল হাফিজের সম্পাদনায় দৌলত কাজীর সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী (১৯৬৯), রাজিয়া সুলতানার সম্পাদনায় নওয়াজীস খানের গুলে বকাওলী (১৯৭০) এই পর্বের পুথি সম্পাদনার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্বাধীনতাপূর্বকালে যাঁরা মৌলিক প্রবন্ধ রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে কাজী দীন মুহম্মদের সাহিত্য-সম্ভার ও সাহিত্যশিল্প, আহমদ শরীফের বিচিত চিন্তা, মযহারুল ইসলামের সাহিত্য পথে উল্লেখযোগ্য। সাহিত্যের বিষয়গত সমালোচনামূলক প্রবন্ধ বাংলা ভাষায় যত রচিত হয়েছে, তার আঙ্গিক নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনায় প্রাবন্ধিকরা ততটা উৎসাহ দেখাননি। এ ক্ষেত্রে সৈয়দ আলী আহসান পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তাঁর রচিত কবিতার কথা কিংবা আধুনিক কবিতা: শব্দের অনুষঙ্গে গ্রন্থদুটি সাহিত্যের আঙ্গিক আলোচনায় বিশেষভাবে স্মরণীয়। এছাড়া সৈয়দ আলী আশরাফের কাব্য পরিচয়, রণেশ দাশগুপ্তের উপন্যাসের শিল্পরূপ এ ধারায় বিশেষ মূল্যবান সংযোজন।
তৃতীয় পর্ব উপন্যাস এ পর্বের উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধের নারকীয়তা, তার মধ্য দিয়ে সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা এবং পরে স্বাধীনতা অর্জন সব কিছুই স্থান পেয়েছে। সৈয়দ শামসুল হক এ পর্বে যেসব উপন্যাস রচনা করেছেন তাতে ধরা পড়েছে স্বাধীনতা-উত্তর গ্রামজীবনের জটিল ও বহুমাত্রিক দ্বন্দ্ব। তাঁর দূরত্ব (১৯৮১) উপন্যাসে কলেজ শিক্ষক জয়নালের জীবনকথায় পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনের জটিল বাস্তবতার চিত্র ধরা পড়েছে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে। তাঁর মহাশূন্যে পরান মাস্টার (১৯৮২) ও আয়না বিবির পালা (১৯৮২) উপন্যাস দুটিতেও গ্রামজীবনের পরিবর্তন ও তার ভাঙ্গনের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তী কয়েক বছরের অস্থিরতা ও সমাজ-রাজনীতির চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে হাসনাত আবদুল হাই রচিত তিমি (১৯৮১) উপন্যাসে। সমুদ্রতীরবর্তী কাজলপুর ইউনিয়নের মানুষেরা কীভাবে সকল প্রকার অপশক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের অস্তিত্বের সংগ্রামে জয়ী হয় তার বিশ্বস্ত চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এ উপন্যাসে। প্রায় একই রকম চিত্র পাওয়া যায় তাঁর প্রভু (১৯৮৬) উপন্যাসে। স্বাধীনতা-উত্তর গ্রামীণ জীবনের সংঘাত ও অস্তিত্বজিজ্ঞাসার এক চমৎকার শব্দরূপ সৃষ্টি হয়েছে বশীর আল হেলালের শেষ পানপত্র (১৯৮৬) উপন্যাসে।
আঞ্চলিক জীবনের পটভূমিকায় সেলিনা হোসেন মানুষের বেঁচে থাকার চিরকালীন লড়াইকে চিত্রিত করেছেন জলোচ্ছ্বাস (১৯৭২) ও পোকামাকড়ের ঘরবসতি (১৯৮৬) উপন্যাসে। এ ধরনের আরও দুটি রচনা হলো আবু বকর সিদ্দিকের জলরাক্ষস (১৯৮৫) ও খরদাহ (১৯৮৭)। স্বাধীনতা-পরবর্তী গ্রামীণ জীবনের বিনষ্টির যে চিত্র উল্লিখিত উপন্যাসগুলিতে পাওয়া যায়, তার বিপরীতে গ্রামীণ জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তনের চিত্র পাওয়া যায় হরিপদ দত্তের ঈশানে অগ্নিদাহ (১৯৮৬) ও অন্ধকূপে জন্মোৎসব (১৯৮৭) উপন্যাস দুটিতে।
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যে বিশাল মধ্যবিত্তশ্রেণী স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের একটি বড় অংশ স্বাধীনতার পরে দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনীতিক অস্থিরতা ও অব্যাহত বিশৃঙ্খলা দেখে হতাশ হয়ে পড়ে; ফলে শুরু হয় তাদের স্বপ্নভঙ্গের পালা। ১৯৭১ পরবর্তী উপন্যাসে মধ্যবিত্ত-জীবনের সেই হতাশা ও স্বপ্নভঙ্গের চিত্রই অঙ্কিত হয়েছে। সরদার জয়েনউদ্দীনের শ্রীমতি ক ও খ এবং শ্রীমান তালেব আলি (১৯৭৩) এমন একটি উপন্যাস, যেখানে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাঙালি জীবনের সামগ্রিক অবক্ষয়ের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। যুদ্ধ-পরবর্তী জীবনের হতাশাকে পরিপূর্ণভাবে চিত্রিত না করলেও হুমায়ুন আহমদের নন্দিত নরকে (১৯৭২) ও শঙ্খনীল কারাগার (১৯৭৩) উপন্যাস দুটিতে মধ্যবিত্ত জীবনের পরিবর্তনহীনতা এবং পারিবারিক বৃত্তের মধ্যে সংঘটিত ব্যর্থতা ও নিঃসঙ্গতাকে রূপ দেওয়া হয়েছে। আর সমাজবিচ্ছিন্ন ব্যক্তির আত্মসুখ খুঁজে ফেরা ভোগবাদী মানসিকতার চিত্ররূপ দেখতে পাওয়া যায় সৈয়দ শামসুল হকের খেলারাম খেলে যা (১৯৭৩) উপন্যাসে। এর বিপরীতধর্মী উপন্যাস রচনা করেন সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়। তাঁর রচিত একজন (১৯৭৫) উপন্যাসের নায়ক যৌনসমস্যার পরিবর্তে মনের সমস্যায় জর্জরিত। রশিদ করীমের প্রেম একটি লাল গোলাপ (১৯৭৮) ও সাধারণ লোকের কাহিনী (১৯৮১) উপন্যাসেও মধ্যবিত্তের জীবনের বহুমুখী সঙ্কট চিত্রিত হয়েছে। অন্যদিকে রিজিয়া রহমানের রক্তের অক্ষর (১৯৭৮) উপন্যাসে নগরজীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন, বীভৎস ও পাশব হিংস্রতায় জর্জরিত পতিতাপল্লীর জীবন চিত্রিত হতে দেখা যায়। তাঁর একটি ফুলের জন্য (১৯৮৬) উপন্যাসে পাওয়া যায় একজন মুক্তিযোদ্ধার পরাজয়ক্লিষ্ট মুখচ্ছবি। এ জাতীয় আরও রচনা শওকত আলীর অপেক্ষা (১৯৮৫), বশীর আল হেলালের কালো ইলিশ (১৯৭৯), হাসনাত আবদুল হাই-এর আমার আততায়ী (১৯৮০), সেলিনা হোসেনের মগ্নচৈতন্যে শিস (১৯৭৯) ইত্যাদি। অন্যদিকে বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যের অপর একজন শক্তিমান লেখিকা রাজিয়া খানের হে মহাজীবন (১৯৮৩) উপন্যাসে দেখা যায় মুক্তিকামী এক নারীর জীবনচিত্র। একই ধরনের চেতনা নিয়ে তিনি রচনা করেন চিত্রকাব্য (২ খন্ড ১৯৮০, ১৯৮৭) উপন্যাস।
শামসুর রাহমানের অক্টোপাশ (১৯৮৩) ও মন্তাজ (১৯৮৫) উপন্যাস বাইরের ও ভেতরের চাপে ব্যক্তির অন্তর্গত রক্তক্ষরণের লেখ্যরূপ। এ ধরনের উপন্যাসের মধ্যে আবু জাফর শামসুদ্দীনের পদ্মা মেঘনা যমুনা (১৯৭৪), সংকর সংকীর্তন (১৯৮০) এবং স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী রচনা ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান মিলে একটি ট্রিলজি সৃষ্টি হয়েছে। একইভাবে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ কালপর্বের ঘটনা-প্রবাহকে নিরাসক্তভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে সরদার জয়েনউদ্দীনের বিধ্বস্ত রোদের ঢেউ (১৯৭৫) উপন্যাসে। ভাষা আন্দোলনের মৌল আবেগের শব্দরূপ হিসেবে গড়ে উঠেছে শওকত ওসমানের আর্তনাদ (১৯৮৫) ও সেলিনা হোসেনের যাপিত জীবন (১৯৮১) উপন্যাসের কাহিনী। একই সঙ্গে এতে উঠে এসেছে দেশবিভাগজনিত উদ্বাস্ত্তসমস্যা এবং সাংস্কৃতিক সংকটও। ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে আশ্রয় করে রচিত শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন (১৯৮৪) এক অনন্য সংযোজন। বাঙালির নৃতাত্ত্বিক-ভৌগোলিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের দীর্ঘ পরিসরে গড়ে উঠেছে রিজিয়া রহমানের বং থেকে বাংলা (১৯৭৮), একাল চিরকাল (১৯৮৪) এবং সেলিনা হোসেনের নীল ময়ূরের যৌবন (১৯৮৩) ও চাঁদ বেনে (১৯৮৪) উপন্যাস।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে রাজনীতি-সচেতনতা, সেনাতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র এবং যুদ্ধাপরাধী পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে যে জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল, তার মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে একাধিক উপন্যাস। সেগুলির মধ্যে শওকত ওসমানের পতঙ্গ পিঞ্জর (১৯৮৩) এবং সেলিনা হোসেনের নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি (১৯৮৭) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর ষাটের দশকের ব্যক্তি ও সমষ্টির স্বপ্নকল্পনা ও রাজনীতিক অভীপ্সা নিয়ে রচিত হয়েছে শওকত আলীর ত্রয়ী উপন্যাস দক্ষিণায়নের দিন (১৯৮৫), কুলায় কালস্রোত (১৯৮৬) ও পূর্বরাত্রি পূর্বদিন (১৯৮৬)। ষাটের দশকেরই আরেক প্রভাববিস্তারী ঘটনা অর্থাৎ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকে অবলম্বন করে রচিত হয়েছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৬) উপন্যাসটি।
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে রচিত উপন্যাসের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য আনোয়ার পাশার আত্মজৈবনিক রীতিতে রচিত রাইফেল রোটি আওরাত (১৯৭৩)। একই বিষয় অবলম্বনে শওকত ওসমান রচনা করেন চারটি উপন্যাস: জাহান্নম হইতে বিদায় (১৯৭১), দুই সৈনিক (১৯৭৩), নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩) এবং জলাংগী (১৯৭৬)।
কবিতা স্বাধীনতা-উত্তর কবিতাকে এক কথায় মুক্তিযুদ্ধের কবিতা বলা চলে, কারণ এ সময়ের কবিতায় বিশেষভাবে মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধের আবেগ ও অভিজ্ঞতা ধরা পড়েছে। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে রচনা শুরু করেও যাঁরা স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের কবিতায় সক্রিয় ছিলেন তাঁদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবদুল্লাহ আবু সাঈদ, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, জিনাত আরা রফিক, আলতাফ হোসেন, আসাদ চৌধুরী প্রমুখ প্রধান। এঁদের পরে যাঁরা তীব্র আবেগ, দ্রোহ আর প্রেমের কবিতা রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, হুমায়ুন আজাদ, দাউদ হায়দার, হুমায়ুন কবীর প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এঁদের কবিতা অনেক বেশি জীবনঘনিষ্ঠ এবং মাটি ও মানুষের কাছাকাছি। এ সময়ের কবিতা ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ বা বেদনাবোধের পরিবর্তে সমষ্টির চেতনাকে অধিক রূপায়িত করেছে। কবিতার চিরচেনা ভাব ও ভাষাকে বাদ দিয়ে এঁরা অনমনীয় ও বিষয়নির্ভর কবিতা রচনার প্রতি মনোযোগী হয়েছেন।
স্বাধীন দেশের মুক্ত পরিবেশে সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় কবিতাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখা। কিন্তু স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যা প্রত্যাশা করেছিল, তা বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনা না দেখে আশাহত ও বঞ্চনার বেদনায় মুষড়ে পড়েন এদেশের সাধারণ মানুষের মতো কবিরাও। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে দাউদ হায়দারের ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’, রফিক আজাদের ‘ভাত দে হারামজাদা তা না হলে মানচিত্র খাবো’ ইত্যাদি কবিতায়। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং দুর্ভিক্ষ জর্জরিত জীবন নিয়ে রচিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রফিক আজাদের ভাত দে হারামজাদা, দাউদ হায়দারের জন্মই আমার আজন্ম পাপ এবং রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বাতাসে লাশের গন্ধ উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীনতা উত্তর কবিতার আরেকটি প্রধান বিষয় প্রেম। রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার পাশাপাশি কবিদের রচনায় চিত্তের বৈভবটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নবীন কবিদের পাশাপাশি প্রবীণ কবিদেরও অনেকেই প্রেমবিষয়ক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রেম ও বিপ্লবকে তাঁরা সমার্থক বিবেচনা করে তাঁদের কাঙ্ক্ষিত ভুবনকে পাওয়ার জন্য আকুল হয়েছেন। এ কারণে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বিপ্লবী কবিতার পাশাপাশি অজস্র প্রেমের কবিতাও রচিত হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশের কবি ও কবিতা কখনোই প্রেমসর্বস্ব হয়ে থাকেনি। দেশের শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে যখন সামরিক স্বৈরাচার ক্ষমতাসীন, তখনও কবিরা নিজেদের হতাশা, ক্ষোভ ও প্রতিবাদ ব্যক্ত করতে দ্বিধাগ্রস্ত হননি। তবে এক্ষেত্রে তাঁরা হয় পুরান নয়তো রূপকের আশ্রয়ে তাঁদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। এ ধরনের রূপকধর্মী কাব্য হিসেবে শামসুর রাহমানের উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কবিতা রচনার পাশাপাশি স্বাধীনতা পরবর্তীকালে একদল কবি কবিতাকে নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তাঁরা রচনা করেছেন পরাবাস্তব কবিতা। এ প্রসঙ্গে আবদুল মান্নান সৈয়দের পরাবাস্তব কবিতা গ্রন্থটির নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। তবে কবিতা রচনার এ ধারা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। এর পাশাপাশি আবার কেউ কেউ কবিতার ছন্দ ভেঙ্গে এর আঙ্গিকের ক্ষেত্রে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। অবশ্য এরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা সব সময়ই ছিল এবং বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে।
আশির দশকের কবিতা মূলত প্রতিবাদী চেতনায় পূর্ণ। তখন বাংলাদেশে চলছিল সামরিক স্বৈরাচার ও ক্ষমতালোভীদের শাষণ-শোষণ; তাই সরাসরি দ্রোহের প্রকাশ ঘটেছে সে সময়ের কবিতায়। আশির দশকের কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন খন্দকার আশরাফ হোসেন, মোহন রায়হান, মারুফ হোসেন, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ প্রমুখ।
নববইয়ের দশকে নতুন একটি চেতনা বাংলাদেশের কবিতাজগতকে আন্দোলিত করে। এ দশকের কবিরা সচেতনভাবে উত্তর-আধুনিকতার চর্চা শুরু করেন। মূলত লিটল ম্যাগাজিনগুলিকে কেন্দ্র করে দেশীয় ঐতিহ্যের নানা বিষয় নিয়ে তাঁরা ফিরে তাকান আদি ও প্রকৃত বাংলাদেশের দিকে। তিরিশের কবিরা বাংলা কবিতায় যে আধুনিকতার সূত্রপাত করেছিলেন, আবহমান বাংলা কবিতার সঙ্গে তার কোন যোগসূত্র ছিল না; কারণ তা ছিল একটি আরোপিত বিষয়। ওই আরোপিত আধুনিকতার খোলস থেকে বাংলা কবিতাকে বের করে যথার্থ বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের কবিতা করে তোলাই উত্তরআধুনিক কবিদের প্রচেষ্টা।
ছোটগল্প স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ছোটগল্পে আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবু রুশদ, শওকত ওসমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রমুখ খ্যাতি অর্জন করেন। আবু জাফর শামসুদ্দীনের রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা (১৯৭৭) বিবৃতিমূলক ছোটগল্পের সঙ্কলন। আবু রুশদের মহেন্দ্র মিষ্টান্ন ভান্ডার (১৯৮৬) গ্রন্থে কয়েকটি দুঃসাহসী এবং চমৎকার গল্প সন্নিবেশিত হয়েছে। স্বাধীনতা উত্তরকালে সৈয়দ শামসুল হক উপন্যাস ও নাটক রচনায় অধিকতর মনোযোগী হলেও তাঁর একটি উৎকৃষ্ট গল্পগ্রন্থ প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান বাংলাদেশের গল্পের ধারায় বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দীন এবং নাজমুল আলম স্বাধীনতা পরবর্তীকালে লোকজ জীবনবৃত্তের আলেখ্য নিয়ে গল্প রচনা করেন। অন্যদিকে সাঙ্কেতিক গল্প রচনা করেন সাইয়িদ আতীকুল্লাহ্ তাঁর বুধবার রাতে (১৯৭৩) গ্রন্থে।
এ সময়ের ছোটগল্প স্বাধীনতা পূর্বযুগের তুলনায় অনেক বেশি গণমুখী ও রাজনীতি সংলগ্ন। মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিপুল সংখ্যক মধ্যবিত্তের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের ভাঙ্গন, পারিবারিক জীবনে সুস্থিরতার অভাব ইত্যাদি বার বার ওঠে এসেছে এ সময়ের গল্পে। স্বাধীনতা-পরবর্তী ছোটগল্পে সক্রিয় লেখকদের অনেকেই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, ফলে যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় তাঁরা অনেকেই ছিলেন সমৃদ্ধ। হানাদার বাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়ন ও গণহত্যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের সশস্ত্র প্রতিরোধ ও যুদ্ধ গল্পকারদের অনুপ্রেরণার উৎস। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম গল্প সংকলন আবদুল গাফফার চৌধুরীর বাংলাদেশ কথা কয় (১৯৭১) প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে। সংকলনে অন্তর্ভুক্ত গল্পগুলির মধ্যে ধরা পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। পরে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় বশীর আল হেলালের প্রথম কৃষ্ণচূড়া (১৯৭২), আবুল হাসনাত সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের গল্প (১৯৭৩) এবং হারুন হাবীব সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত গল্প (১৯৮৫)।
মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের সামাজিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, যুবসমাজের নৈতিক অবনতি এবং সামগ্রিকভাবে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়কে বিষয়বস্ত্ত করে একাধিক গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ ধরনের গল্পগ্রন্থের মধ্যে শওকত ওসমানের জন্ম যদি তব বঙ্গে (১৯৭৫), আলাউদ্দিন আল আজাদের আমার রক্ত, স্বপ্ন আমার (১৯৭৫), আবদুল মান্নান সৈয়দের মৃত্যুর অধিক লাল ক্ষুধা (১৯৭৭) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ছোটগল্পে একটি বড় পরিবর্তন হচ্ছে জীবনদৃষ্টির পরিবর্তন। সমাজের উঁচু তলার মানুষের পাশাপাশি নিচুতলার মানুষও গল্পের বিষয়বস্ত্ত হিসেবে স্থান লাভ করে। এ প্রসঙ্গে আল মাহমুদের পানকৌড়ির রক্ত (১৯৭৩) উল্লেখযোগ্য। এটি সাধারণ মানুষের কামনা-বাসনার উন্মুখ চিত্রসম্বলিত একটি অনিন্দ্যসুন্দর গল্পগ্রন্থ। বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে এমন লালসাসিক্ত গল্প খুব কম লেখকই লিখেছেন। তাঁর গল্পের পরিবেশও আমাদের এতকালের চেনাজানা পরিবেশ থেকে অনেক দূরের; জেলে-নৌকায়, বেদের বহরে, বিল কিংবা হাওরের পটভূমিতে এসব গল্প রচিত। আল মাহমুদের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ গল্পগ্রন্থ হচ্ছে সৌরভের কাছে পরাজিত।
বাংলাদেশের নগর-সংস্কৃতি নিয়ে ছোটগল্পে গড়ে উঠেছে এক ভিন্ন ধারা। এই সংস্কৃতির দুটি প্রান্ত, যার একদিকে বিত্ত-বৈভব, অন্যদিকে নিঃস্বতা। বিত্তবানদের চিত্তদৈন্য আর নিঃস্বদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এই বিপরীতমুখী বিষয়কে অবলম্বন করে অনেকেই সৃষ্টি করেছেন তাঁদের গল্পের ভুবন। এরূপ প্রসঙ্গ নিয়ে রচিত রাহাত খানের অনিশ্চিত লোকালয় (১৯৭২), অন্তহীন যাত্রা (১৯৭৫) ও ভালমন্দের টাকা (১৯৮১); আবদুশ শাকুরের ক্রাইসিস (১৯৭৬), সরস গল্প (১৯৮২); রশীদ হায়দারের অন্তরে ভিন্ন পুরুষ, মেঘেদের ঘরবাড়ি; হাসনাত আবদুল হাইয়ের একা এবং এ প্রসঙ্গে, যখন বসন্ত; মাফরুহা চৌধুরীর অরণ্য গাথা ও অন্যান্য গল্প, বশীর আল হেলালের বিপরীত মানুষ, মাহবুব তালুকদারের অরূপ তোমার বাণী, আবুল হাসানাতের পরকীয়া, কবোষ্ণ, বাজ; সুব্রত বড়ুয়ার কাচপোকা, নাজমা জেসমিন চৌধুরীর অন্য নায়ক, হুমায়ুন আহমদের নিশিকাব্য, শীত ও অন্যান্য গল্প; ইমদাদুল হক মিলনের লাভ স্টোরি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীনতা উত্তরকালের ছোটগল্পে সামাজিক দায়বদ্ধতা অধিক পরিমাণে প্রকাশিত হয়, কারণ সমাজে তখন নানামুখী পরিবর্তন সূচিত হচ্ছিল; রাজনৈতিক ভাঙ্গাগড়া এবং শোষণ-বঞ্চনা বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি তেমন ঘটেনি। তবে এর মধ্য দিয়েই গজিয়ে ওঠে একটি উচ্চবিত্ত শ্রেণি। তাদের জীবনও ছোটগল্পে ঠাঁই পেয়েছে নানাভাবে। এ ধরনের গল্পগ্রন্থের মধ্যে আবু বকর সিদ্দিকের মরে বাঁচার স্বাধীনতা (১৯৭৭) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া মঞ্জু সরকারের অবিনাশী আয়োজন (১৯৮২), হরিপদ দত্তের সূর্যের ঘ্রাণে ফেরা (১৯৮৫), সৈয়দ ইকবালের ফিরে পাওয়া (১৯৮২) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
দারিদ্র্যক্লিষ্ট ভূমিহীন কৃষক, জোতদার ও মহাজনের শোষণ-পীড়ন, রাজনৈতিক ফড়িয়া, দালাল ও ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা বিভ্রান্ত- বিপর্যস্ত গ্রামবাংলার লোকদের কথা ছোটগল্পে এসেছে চল্লিশ-পঞ্চাশ দশক থেকেই। স্বাধীনতা পরবর্তী ছোটগল্পেও এদের কথা অনেকে সহানুভূতির সঙ্গে বর্ণনা করেছেন। হাসান আজিজুল হকের গল্পে উত্তর বাংলার জনজীবনের এরূপ একটি চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। স্বাধীনতা পূর্বকালে তিনি লিখেছিলেন সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য (১৯৬৪) এবং আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৯); স্বাধীনতার পরে লেখেন জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩), নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), পাতালে হাসপাতালে (১৯৮১) প্রভৃতি। শওকত আলীর লেলিহান সাধ (১৯৭৩) ও শুন হে লখিন্দর (১৯৮৬) গ্রন্থদুটিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সকল গল্পগ্রন্থই প্রকাশিত হয়েছে স্বাধীনতার পরে। তাঁর অন্য ঘরে অন্য স্বর (১৯৭৬), খোয়ারি (১৯৮২) ও দুধভাতে উৎপাত (১৯৮৫) উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ। তিনি পুরনো ঢাকার জীবনকে নিখুঁতভাবে তাঁর গল্পে রূপায়িত করেছেন। হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের ছোটগল্পের যে সামাজিক ব্যবস্থা ও সমাজ-রাজনীতির চিত্র উন্মোচিত হয়েছে, তার একদিকে প্রতিষ্ঠিত শোষিত গ্রামীণ জীবন, অন্যদিকে ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ।
সাম্প্রতিক কালে যাঁরা উল্লেখযোগ্য গল্প রচনা করছেন তাঁদের মধ্যে মঈনুল আহসান সাবের (পরাস্ত সহিস), কায়েস আহমদ (অন্ধ তীরন্দাজ), বিপ্রদাশ বড়ুয়া (গাঙচিল, যুদ্ধজয়ের গল্প), বুলবুল চৌধুরী (টুকা কাহিনী), হারুন হাবীব (বিদ্রোহী ও আপন পদাবলী), ভাস্কর চৌধুরী (রক্তপাতের ব্যাকরণ), আহমেদ বশীর প্রমুখ প্রধান।
নাটক ১৯৭১ সালে বিভাষী শাসকদের হাত থেকে মুক্তি লাভের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মুক্তসংস্কৃতিচর্চার এক অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং সেই সুবাদে নাট্যচর্চা একটি নিয়মিত শিল্পমাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কবিতার পরে নাটকেই তখন সমাজের চিত্র অধিক মাত্রায় প্রতিফলিত হয়। তাছাড়া নাট্যকারদের উদ্ভাবনী শক্তি, রাজনীতি-সচেতনতা, কৌশলগত আঙ্গিক ও পরিশীলিত ভাষা স্বাধীনতা পরবর্তী নাটকে এক প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এ সময়ের নাটকে দেখা যায় গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের চিত্র এবং স্বাধীনতা উত্তর সমাজজীবনে মূল্যবোধের অবক্ষয়, মানুষের হতাশা-বঞ্চনা ইত্যাদি। রূপক, প্রতীক ও লোকজ ঐতিহ্যের ব্যবহারেও এ সময় বিভিন্ন নাটক রচিত হয় এবং অনেক বিদেশী নাটক বাংলায় রূপান্তরিত হয়। স্বাধীনতার পর যাঁদের রচনায় বাংলাদেশের নাট্যআন্দোলন বেগবান হয় তাঁদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ ও সেলিম আল দীন প্রধান। এঁরা সকলেই মঞ্চাভিনয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত।
সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাব্যনাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৬) বাংলাদেশের নাট্যক্ষেত্রে একটি মূল্যবান সংযোজন। এছাড়াও তাঁর নূরলদীনের সারা জীবন (১৯৮২), এখানে এখনও যুদ্ধ এবং যুদ্ধ ফর্মের দিক দিয়ে নাটকের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সুবচন নির্বাসনে নাটকের মধ্য দিয়ে আবদুল্লাহ আল মামুন প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। এছাড়া ১৯৭৪ সালে দেশে বিরাজমান মূল্যবোধের অবক্ষয়, হতাশা, অস্থিরতা ইত্যাদি নিয়ে তিনি রচনা করেন এখন দুঃসময়, চারিদিকে যুদ্ধ, এবার ধরা দাও, সেনাপতি, এখনও ক্রীতদাস (১৯৮৪) ইত্যাদি মঞ্চসফল একাধিক নাটক।
সমসাময়িক নাট্যকারদের মধ্যে মামুনুর রশীদ সবচেয়ে বেশি সমাজসচেতন। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি: ওরা কদম আলী (১৯৭৯), ওরা আছে বলেই (১৯৮১), ইবলিস (১৯৮৩), এখানে নোঙর (১৯৮৪), গিনিপিগ ইত্যাদি। সেলিম আল দীন নাটকের ফর্ম ও ভাষা নিয়ে নানারকম পরীক্ষা করেছেন। সংবাদ কার্টুন ও মুনতাসির ফ্যান্টাসিতে ব্যঙ্গধর্মী নাটক রচনায় তাঁর নাট্যপ্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। এছাড়া তাঁর কিত্তনখোলা (১৯৮৫), শকুন্তলা, কেরামতমঙ্গল নাটকও উল্লেখযোগ্য।
মমতাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতার আগে থেকেই নাটক রচনা করলেও স্বাধীনতার পরেই তাঁর নাটকের প্রসার ঘটে। একাঙ্কধর্মী নাটক রচনায় এবং নাটকের সংলাপে ব্যঙ্গাত্মক ভাষা ব্যবহারে তাঁর একটি বিশিষ্টতা রয়েছে। স্বাধীনতার পরে রচিত তাঁর সাত ঘাটের কানাকড়ি, কী চাহ শঙ্খচিল (১৯৮৫) দুটি মঞ্চসফল নাটক।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের নাটক হয়ে ওঠে নাট্য আন্দোলনের একটি প্রধান হাতিয়ার; গড়ে ওঠে নানা নাট্যগোষ্ঠী। গোষ্ঠীগুলি নিয়মিত নাট্য মঞ্চায়নের মাধ্যমে নাটককে ক্রমশ একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যেসকল নাট্যগোষ্ঠী নাট্য-আন্দোলনে বিশেষভাবে সক্রিয় সেগুলি হলো: নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, থিয়েটার, ঢাকা থিয়েটার, আরণ্যক, ঢাকা পদাতিক, নাট্যচক্র ইত্যাদি। এগুলি ব্রেখট্, মলিয়র, চেখভ, শেকসপীয়র, ইবসেন প্রমুখ বিশ্বখ্যাত নাট্যকারদের নাটক অনূদিত ও রূপান্তরিত করে মঞ্চস্থ করছে।
প্রবন্ধ স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে গবেষণার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হলেও মৌলিক প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে তার বিকাশ আশানুরূপ নয়। এ সময়ের প্রবন্ধ-সাহিত্যকে প্রধানত নয়টি ধারায় ভাগ করা যায়: প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সাহিত্য, আধুনিক সাহিত্য, রবীন্দ্র-সাহিত্য, নজরুল-সাহিত্য, লোকসাহিত্য, ভাষাচর্চা, ভাষা আন্দোলনবিষয়ক সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাহিত্য এবং সম্পাদনা। এ পর্বে যাঁরা গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন তাঁরা হলেন সন্জীদা খাতুন, রফিকুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, আবদুল হাফিজ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সৈয়দ আকরম হোসেন প্রমুখ। সন্জীদা খাতুন ও সৈয়দ আকরম হোসেনের গবেষণার বিষয় যথাক্রমে রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ও ছোটগল্প। রফিকুল ইসলামের গবেষণার বিষয় নজরুল-সাহিত্য ও নজরুলসঙ্গীত। আবু হেনা মোস্তফা কামালের গ্রন্থের নাম Bengali Press and Literary Writing (১৯৭৭)। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান নানাবিধ বিষয় অবলম্বনে গবেষণা করেছেন, তবে সেগুলির মধ্যে সাময়িকপত্রে সাহিত্যচিন্তা: সওগাত (১৯৮১) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মোহাম্মদ মনিরুজ্জমান, আনিসুজ্জামান এবং মুস্তাফা নূরউল ইসলামের রচনার মধ্য দিয়ে বংলা ভাষার সাময়িক পত্রগুলির একটি চরিত্র পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন গোলাম মুরশিদ। তাঁর গবেষণার বিষয় সমাজ সংস্কার আন্দোলন ও বাংলা নাটক; রশীদ আল ফারুকি কাজ করেছেন বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঔপন্যাসিকদের নিয়ে। আবুল কাশেম চৌধুরী সামাজিক নকশার পটভূমি ও প্রতিষ্ঠা, নাজমা জেসমিন চৌধুরী বাংলা উপন্যাসে রাজনীতি এবং ওয়াকিল আহমদ উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমানের চিন্তাচেতনার ধারা বিষয়ে গবেষণা করেছেন। এ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে গবেষণার ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যের ছোঁয়া লেগেছে।
লোকসাহিত্য ও ভাষাতত্ত্ব নিয়েও বাংলাদেশে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। লোকসাহিত্য বিষয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেছেন আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়া, আশরাফ সিদ্দিকী, মযহারুল ইসলাম, আবদুস সাত্তার, আবদুল হাফিজ, আনোয়ারুল করীম, খোন্দকার রিয়াজুল হক, এস.এম লুৎফর রহমান, আবুল আহসান চৌধুরী প্রমুখ। আর ভাষাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছেন মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম, রফিকুল ইসলাম, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, মনসুর মুসা, হুমায়ুন আজাদ, দানীউল হক, মনিরুজ্জামান প্রমুখ।
রাজনৈতিক, সমাজতাত্ত্বিক ও মননশীল রচনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছেন বদরুদ্দীন ওমর, আবদুল হক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবুল কাশেম ফজলুল হক, আহমদ রফিক প্রমুখ। মৌলিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ-সাহিত্যে রণেশ দাশগুপ্ত, সৈয়দ আলী আহসান, কবির চৌধুরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সৈয়দ আকরম হোসেনের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। এঁদের মধ্যে রণেশ দাশগুপ্ত মার্কসবাদী প্রাবন্ধিক হিসেবে খ্যাত। সৈয়দ আলী আহসান অতীত ও বর্তমান বাংলা কবিতা এবং শিল্পকলা সম্পর্কে প্রচুর প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর সতত স্বাগত, শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্য গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন প্রবন্ধ গ্রন্থ। কবির চৌধুরী মূলত বিদেশী লেখক ও তাদের রচনাকর্মের সঙ্গে বাঙালি পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেই বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন। [আমীনুর রহমান]
গ্রন্থপঞ্জি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, বাংলা সাহিত্যের কথা (১ম-২য় খন্ড), ঢাকা, ১৯৬৭, ১৯৭৬; মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, চট্টগ্রাম, ১৯৬৮; সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (১ম-৪র্থ খন্ড), ইস্টার্ন পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৭০-৭৬; অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (১ম-৫ম খন্ড), ৪র্থ সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৮২-৮৫; আহমদ শরীফ, বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য (১ম-২য় খন্ড), ঢাকা, ১৯৭৮, ১৯৮৩; দীনেশচন্দ্র সেন, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য (অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত), কলকাতা, ১৯৮৬।
Discussion about this post