ফাহমিদা ইয়াছমিন
আজ ১৩ মে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ৭৩তম মৃত্যুবার্ষিকী।
কিশোর বয়সেই এই কবি তাঁর অসাধারণ কাব্যশক্তি ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ এবং ‘শাবাশ বাংলাদেশ/এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/জ্বলেপুড়ে ছারখার/তবু মাথা নোয়াবার নয়’—এই অমর পঙিক্ত রচনার মাধ্যমে বাংলা কবিতায় চির অমর হয়ে আছেন। ক্ষণজন্মা এ কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরা হলো।
“দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে লিখি কথা,
আমি যে বেকার পেয়েছি লেখার স্বাধীনতা…”
যেকোনো কলমসৈনিকের কলম ছুটিয়ে চলার অনুপ্রেরণা হিসেবে এ দু’টি কথা অনেক ইন্ধন জোগায়। ক্ষণজীবীতা যে কেবল ক্ষণজীবী প্রভাই ছড়ায় না, তার অনবদ্য দৃষ্টান্ত কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। তার কর্ম তার বয়সকে, এমনকি তার জীবনকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে এবং তার এই অতিক্রান্ত প্রতিভা আজো দেদীপ্যমান বাংলা সাহিত্যে।
সুকান্তের পিতা নিবারন ভট্টাচার্য ও মা সুনীতি দেবী। তিনি জন্মেছিলেন ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট তার মাতামহের বাড়িতে- ৪৩, মহিম হালদার স্ট্রীট, কালীঘাট, কলকাতায়। তার পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার উনশিয়া গ্রামে। সুকান্তের পিতা ছিলেন সারস্বত লাইব্রেরীর স্বত্বাধিকারী, যেটি ছিল একাধারে বইয়ের প্রকাশনা ও বিক্রয়কেন্দ্র। বিত্তের দিক দিয়ে সচ্ছলতা তাদের গৃহে কখনো আসেনি। সুকান্ত তার ভাইদের মধ্যে ছিলেন দ্বিতীয়; অন্যরা হলেন মনমোহন, সুশীল, প্রশান্ত, বিভাস, অশোক ও অমিয়। সুকান্ত তার বড় ভাই মনমোহন ভট্টাচার্য ও বৌদি সরযূ দেবীর সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
সুকান্তের জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি ছিলেন তার রাণীদি, সেসময়ের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মণীন্দ্রলাল বসুর ‘সুকান্ত’ গল্পটি পড়ে রাণীদিই তার নাম রেখেছিলেন ‘সুকান্ত’। সুকান্তের সবচেয়ে কাছের নারী ছিলেন তার এই জেঠতুতো বোন। ছোট্ট সুকান্তকে গল্প-কবিতা শুনিয়ে তাকে সাহিত্যের প্রথম ছোঁইয়া তিনি দেন। হঠাৎ করে েকদিন রাণীদি মারা গেলে সুকান্ত প্রচন্ড ধাক্কা খান, এর কিছুদিন পর তার মাও চিরবিদায় নেন। একের পর এক মৃত্যুশোক যেন সুকান্তকে করে তুলেছিলো নিঃসঙ্গ থেকে নিঃসঙ্গতর…কবিতাই ছিল তার একাকীত্বের সঙ্গী।
শৈশব কাটিয়েছেন বাগবাজারের তাদের নিবেদিতা লেনের বাড়িটিতে এবং সেখানকারই কমলা বিদ্যামন্দিরে তাকে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ভর্তি করা হয়। কমলা বিদ্যামন্দিরেই সুকান্তের সাহিত্যেও হাতেখড়ি হয়। বলা হয়ে থাকে, ‘উঠন্তি মূলো পত্তনেই চেনা যায়’…সুকান্তের ক্ষেত্রেও এর ব্যাত্যয় ঘটেনি। শৈশবেই তার সাহিত্যানুরাগ স্পষ্ট হতে থাকে, তার প্রথম ছোটগল্প ছাপা হয় বিদ্যালয়েরই একটি পত্রিকা- ‘সঞ্চয়’ এ। এরপর ‘বিবেকানন্দ জীবনী’-আরো একটি গদ্য শিখা পত্রিকায় ছাপা হয়। শিখা পত্রিকায় সেসময় প্রায়ই সুকান্তের লেখা ছাপা হতো।
কমলা বিদ্যামন্দিরে লেখাপড়ার পা্ট চুকবার পর সুকান্ত ভর্তি হন বেলেঘাটা দেশবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়ে। সুকান্ত সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন এবং ১৯৪৪ সাল থেকে তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগদান করেন ভারতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের মাধ্যমে। ১৯৪৪ সালেই ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’ এর প্রকাশনায় তিনি ‘আকাল’ নামে একটি সাহিত্য সংকলন সম্পাদনা করেন। ১৯৪৫ সালে সুকান্ত প্রবেশিকা পরিক্ষায় অংশ নেন এবং উত্তীর্ন হতে পারেননি।
ছোটবেলা থেকেই বিদ্যালয়ের বাঁধাধরা নিয়ম-কানুন তার একদম পছন্দ ছিলো না। জীবনের প্রতিটি অংশেই সুকান্ত যেন অনিয়মকে তার নিয়ম করে নিয়েছিলেন। একদিকে পার্টির কাজ, অন্যদিকে কলমযুদ্ধ, অভাব অনটন…সব মিলিয়ে অনিয়মের স্রোত তার রুগ্ন শরীর মেনে নিতে পারেনি; যক্ষ্মারোগ বাসা বাঁধে এই অনিয়মের ফাঁকে ফাঁকে। সুকান্ত সূর্যের কাছে ‘রাস্তার ধারের উলঙ্গ ছেলেটিকে’ উত্তাপ দেবার জন্য পরম আকুতি জানিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু কখনো নিজেকে রক্ষার জন্য কারো কাছে হাত পাততে পারেননি। যে নিজেকেই মানবতার, আর্তের রক্ষক নিযুক্ত করেছে তাকে রক্ষা করবে কে? কেউ পারেনি, তাই সুকান্ত তার জীবনাঙ্কের সবটুকু বেঁচে যেতে পারেননি। তার রাজনৈতিক জীবন, তার সাহিত্য জীবন এমনভাবে ‘ব্যক্তি সুকান্ত’কে গ্রাস করে নিয়েছিলো যে তার ব্যক্তিজীবনকে থেমে যেতে হয় অকাল মৃত্যুতে।
সুকান্তের লেখনী গভীরভাবে প্রভাবিত হতো তার সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গী ও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির অভিজ্ঞতা থেকে। চারপাশের মানুষকে নিয়ে সুকান্তের যে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি ছিলো, তাই তিনি ঢেলে দিতেন কলমে-কাগজে। তার অনুভূতিগুলো এতই প্রখর ছিলো যে তা প্রকাশ করতে গিয়ে কলম হয়ে উঠতো তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর। ‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থের ‘হে মহাজীবন’ কবিতাটিতে সুকান্ত পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটির সাথে তুলনা করেছেন, এ যেন আপামর জনতার ক্ষুধারই আক্ষরিক রূপ। পদ্য কী করে গদ্যের চেয়েও বেশি সত্য হয়ে ওঠে, সুকান্ত তো তা বারবারই দেখিয়ে দিয়েছেন তার মূর্তমান কবিতায়। কবিতা যে শুধু অদেখা, অছোঁয়া বা বিমূর্তই নয়- সুকান্তের কবিতার মূর্ততা আপনি আপনার পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়েও অনুভব করতে পারবেন।
“…পোষমানাকে অস্বীকার করো,
অস্বীকার কর বশ্যতাকে।
চলো শুকনো হাড়ের বদলে সন্ধান করি তাজা রক্তের,
তৈরী হোক লাল আগুনে ঝলসানো আমাদের খাদ্য।
শিকলের দাগ ঢেকে গজিয়ে উঠুক সিংহের কেশর, প্রত্যেকের ঘাড়ে”
আমি যেন সেই বাতিওয়ালা..
একজন লেখক অবশ্যই একজন ভালো পাঠক, এই বৈশিষ্ট্যটিও ছিল কবি সুকান্তের। অনেক বই পড়তেন তিনি। সুকান্তের প্রিয় বইয়ের তালিকায় বিভূতিভুষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ বইটির স্থান ছিল অনেক উঁচুতে। বইটি সম্পর্কে সুকান্ত বলেছিলেন, “ধর্মগ্রন্থের সঙ্গে সমান আদরে এই বই সকলের ঘরে রাখা উচিত”। সুকান্তের মনে সবসময়ই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি গভীর অনুরাগ কাজ করতো। একবার তো তিনি কলকাতায় মহাজাতি সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানে চলে গিয়েছিলেন শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথকে দেখবার জন্য!
কলকাতা রেডিওতে প্রচারিত ‘গল্পদাদুর আসর’ অনুষ্ঠানটিতে সুকান্ত ছিলেন একজন নিয়মিত সভ্য, আনন্দবাজার পত্রিকার সভ্যতালিকাতেও ছিল সুকান্তের নাম। তার বাল্যকালের সকল কাহিনীতেই দেখা মেলে তার বন্ধু অরুণাচল বসুর, যিনি নিজেও একজন কবি। এও বলা যায় যে তাদের প্রথম সাহিত্যচর্চা ঘটেছিলো একসাথেই। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় তাদের যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় একটি হাতে লেখা পত্রিকা-‘সপ্তমিকা’। শিক্ষক নবদ্বীপচন্দ্রের স্মৃতিকথন থেকে সুকান্ত ও অরুণাচল বসুর ‘শতাব্দী’ নামে একটি যৌথ কবিতার কথাও জানা যায়। অরুণাচলের মা সরলা দেবীর অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন সুকান্ত।
সুকান্ত ভট্টাচার্য কানে একটু কম শুনতেন ঠিকই, কিন্তু সর্বহারার আর্তচিৎকার শুনতে একদম ভুল করেননি! সুকান্তের কবিতার সহজ সরলতা অনেককে আশ্চর্য ও মুগ্ধ করেছে, সেই সরলতার সমগ্র তাৎপর্য সকলের কাছে ধরা পড়েনি; কারণ আমরা শুধু প্রকাশভঙ্গিটাই বুঝতে চাই-বার্তাটি নয়!
সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু সুকান্তের বর্ণনা দিয়েছেন এমন করে-“গর্কীর মতো, তার চেহারাই যেন চিরাচরিতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কানে একটু কম শোনে, কথা বেশি বলেনা, দেখামাত্র প্রেমে পড়ার মতো কিছু নয়, কিন্তু হাসিটি মধুর, ঠোঁট দু’টি সরল”। বুদ্ধদেব বসু সুকান্তের কথা আরো বলেছেন, “যে চিলকে সে ব্যঙ্গ করেছিলো, সে জানতো না সে নিজেই সেই চিল; লোভী নয়, দস্যু নয়, গর্বিত নিঃসঙ্গ আকাশচারী, স্খলিত হয়ে পড়লো ফুটপাতের ভিড়ে, আর উড়তে পারলো না, অথবা সময় পেলো না। কবি হবার জন্যই জন্মেছিলো সুকান্ত, কবি হতে পারার আগে তার মৃত্যু হলো”।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মগুলো দেখে নিই একনজরেঃ
- ছাড়পত্র (১৯৪৮)
- ঘুম নেই (১৯৫০)
- পূর্বাভাস (১৯৫০)
- মিঠে-কড়া (১৯৫১)
- অভিযান (১৯৫৩)
- গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫)
কবিতার পৃষ্ঠায় সুকান্তই সূর্যকে বলতে পেরেছিলেন,“হে সূর্য তুমি ত জানো আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব!”, সিগারেটকে আহবান জানাতে পেরেছিলেন ‘হঠাৎ জ্বলে উঠে বাড়িসুদ্ধ পুড়িয়ে’ মারতে, ‘যেমন করে তোমরা আমাদের পুড়িয়ে মেরেছ এতকাল’; সুকান্ত কেঁদেছেন ডাকঘরের রানারের দুঃখে-‘পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া!’
কলকাতা শহরকে নিয়ে এক অদ্ভূত আতিশয্য কাজ করতো সুকান্তের মাঝে, কলকাতাকে এক রহস্যময়ী নারী ভেবে ভালবেসেছেন তিনি। কলকাতা তার প্রেয়সী, কলকাতা তার হারিয়ে যাওয়া মা। তার বাইরের কোনো জগত ছিলো না, যা ছিল তা এই কলকাতাতেই। সুকান্তের জগত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো কলকাতার অলিতে গলিতে। তিনি বাঁচতে চাইতেন কলকাতাকে নিয়ে, কলকাতার মৃত্যু তার জীবনেরও ইতি টানবে এই বিশ্বাস ছিলো সুকান্তের…।
সুকান্তের জীবন ও কাব্য ছিলো একই সুরে গ্রথিত ও একই মন্ত্রে অনুরণিত। তাই কোন এক অংশকে আলাদা করে বলা যায় না…বলতে হলে সমান্তরালভাবে, একসাথেই বলতে হয়। সুকান্ত ভট্টাচার্য তার কোন বইই প্রকাশিত হবার পর দেখে যেতে পারেননি। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘ছাড়পত্র’, এবং এরপর অন্যগুলোও; ১৯৪৭ সালের ১৩ই মে সুকান্ত ভট্টাচার্য কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
Discussion about this post