মনি হায়দার
‘আবদুল করিম মুহূর্তকাল চিন্তা করে। হঠাৎ পঙ্গু রুগী তুলে দাঁড় করানোর মতো রেবুর বগলের তলায় দুই হাত দিয়ে এক ঝটকায় টেনে তুলেই ঘরের মধ্যে ছুঁড়ে দেয়, কোক করে একটা শব্দ হয় রেবুর, হুমড়ি খেয়ে পড়ে খাটের পায়ার কাছে। ততক্ষণে নুরুননেসা আবার এসেছে, হাতে শাদা ধবধবে কাপড়ে বাঁধা কোরান শরীফ, স্বামীর দিকে এগিয়ে দেয়। কোরান শরীফটা হাতে নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে আবদুল করিম ফয়েজুর রহমানের গায়ের কাছে এগিয়ে আসে, তীক্ষ্ণ ও সরাসরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হিসহিসিয়ে বলে, এই আমার মেয়ে আর এই আল্লার কালাম। আল্লার কালামের উপর কিছু নেই, এইটে ছুঁয়ে আপনাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে।
ধীরে, খুব ধীরে ফয়েজুর রহমানের ডান হাতটা উঠে আসে, যেন অবশ হাত কেউ তুলে দিচ্ছে, কোরান শরীফ স্পর্শ করে ধর্মান্তরিত হবার মতো অনুচ্চারিতভাবে বলে, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, রেবুকে বিয়ে করবো।
আলহামুল্লিলহা! গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে আবদুল করিম ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে।… আকাশ থেকে চোখ ফিরিয়ে আনে মেঝেয়, ধীর ধীরে সেজদার ভঙ্গীতে রেবুর কাছে বসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আবদুল করিম সমস্ত স্নেহ উজাড় করে দিয়ে বললো, ওঠ মা, ওঠ। দ্যাখ, এইতো আমি। তুই তো নিজের কানে শুনলি উনি কোরান ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন যে বিয়ে করবেন। বল কোনো বাপ মা চায় মেয়েকে গরীবের হাতে তুলে দিতে? মেয়ে একটু সুখে থাকবে, টাকা পয়সার মুখ দেখবে, নইলে সারা জীবন দুঃখে কষ্টের বোঝা বয়ে বেড়ানো বল কোনো বাপ মা চায়?’
অস্ট্রিক পাবলিশার্স থেকে ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘অসম বৃক্ষ’র প্রায় মাঝামাঝি থেকে বড় উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করতে হলো কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দারের বন্দনা। এবং রশীদ হায়দারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা। ক্ষমার কারণ, এই লেখাটা লিখছি রশীদ হায়দারের প্রয়াণের পর, শোক থমথমে মন নিয়ে।
রশীদ হায়দারের উপন্যাস ‘অসম বৃক্ষ’। উপন্যাসের নাম ‘অসম বৃক্ষ’, বুঝতেই পারা যায়, বড় গাছের নিচে ছোটোগাছ জন্মায় না, জন্ম নিতে পারে না। কিন্তু মানুষ এক অদ্ভুত প্রাণি। মানুষকে অন্ধকারে কিংবা পাথরের নিচে চাপা রাখলেও, সাপের বিষাক্ত জিহ্বার মতো লিকলিকে জিভে বের হয়ে আসে, নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। এই উপন্যাসের পিতা আবদুল করিম, মফস্বলের মানুষ। সংসারে বেশ কয়েকটা ছেলে-মেয়ে। কোনোভাবে দিন চলে। বড় মেয়ে সাজুর জামাই আশরাফ আলী এক বিকেলে বাড়িতে খুবই বিখ্যাত টাকাওয়ালা ফয়েজুর রহমনাকে নিয়ে আসে। আবদুল করিম খুবই আনন্দিত। পথ যখন রচনা হয়ে গেছে, ফয়েজুর আরও কয়েবার আসে মিষ্টি নিয়ে। এবং পরিণতি পিতা ও মাতার যৌথ প্রযোজনায় এই দৃশ্য : রেবুকে তুলে দেয় ফয়েজুরের হাতে, নিজের ঘরে, পবিত্র ধর্মগ্রন্থে শপথ নিয়ে। কারণ, ফয়েজুর সংসারের কারণে এখন বিয়ে করতে পারবে না, বিয়ে করবে কয়েকদিন পর। কিন্তু ভোগের তর সইছে না। বিয়ে কলমা কাজীর অফিসের রেজিষ্ট্রি ছাড়াই, ধনবান ফয়েজুর স্ত্রী [!] উপর উপগত হয়। হওয়ার সুযোগ করে দেয়, পিতা, মা। একটাই বাসনা, ‘মেয়ে টাকা পয়সার মুখ দেখবে’। হায় সুখ, হায় টাকা-পয়সা! কন্যার পবিত্র ইজ্জতের চেয়ে বিয়ে ছাড়া, স্বাক্ষী ছাড়া নিজের কন্যাকে একটা বয়স্ক পুরুষের হাতে নিজের ঘরে তুলে দেয়া…। না, অসম্ভব নয়। কারণ মানুষের পক্ষে করা যায় না, এমন কাজ সংসারে নেই—যখন প্রসঙ্গ টাকা-পয়সা—টাকা পয়সার টংকারে আবদুল করিম …
পিতা আবদুল করিম তো মেয়েকে তুলে দিলেন, পরের উপাখ্যানে রশীদ হায়দার আমাদের কোথায় নিয়ে যান? এই উপাখ্যান গত শতকের ষাটের দশকের এবং মফস্বলের। সেই সময়ে মানুষ টেকনিক্যালি অগ্রসর ছিলো না। ফলে খুব শীঘ্রই রশীদ হায়দার জানান, রেবুর পেটে বাচ্চা। এখন কী করবেন আবদুল করিম?
মানুষ যখন নিজেকে হারায়, তখন সবই হারায়। কিন্তু বুঝতে পারে না কী হারায়! সে কেবলই হারাতে থাকে নিজেকে। যেমন ‘অসম বৃক্ষ’ রেবুর পিতা আবদুল করিম। কতোটা ফাঁদে আটকে গেলে পিতাকে ফিরে যেতে হয় পাষণ্ডের কাছে। ফয়েজুর রহমান সব শুনে আবদুর করিমকে বলে—‘দেখুন, আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করতাম ঠিকই। আপনাদের বাড়িতে যেদিন আমি গেছি, রেবুর কথা শুনেছি, রেবুকে দেখেছি, সেদিনই মনে মনে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু আপনাদের দু’জনের লোভ দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি। একটা বার ভাবলেন না, যে লোকটির ঘরে জোর করে মেয়ে ঠেলে দিচ্ছি, সে জামাই এখনো হয়নি?
কিন্ত কোরান শরীফ?
হেসে ফেলে ফয়েজুর রহমান, কোনো জবাবই দেয় না।’
সমাজের কতোটা গভীরের পাপের উপর হাত রেখে মানুষ্য চরিত্রের উপর বাজনা বাজিয়েছেন রশীদ হায়দার? রেবুর তো কিছু করার ছিল না, রেবু এই ঘটনার শিকার। কিন্তু অনাগত সন্তানের কী হবে? মানুষ যখন ডুবে যায় অতলে, মানুষ সব করতে পারে, করেও।
রেবুর সন্তান হলে, হাঁড়িতে রেখে মুখে নুন দিয়ে হত্যার চক্রান্ত করে রেবুর মা নুরুননেসা। সব জোগাড়ও হয়ে যায় কিন্ত বাড়ির নিরীহ ছেলেটা শফি প্রতিরোধের ভূমিকা নেয়। না, কোনো মানুষ হত্যা করা যাবে না। অপরাধী পিতা ও মা মৌন হতে বাধ্য। পৃথিবীতে আসে রেবুর ছেলে। এলাকা ছেড়ে চলে যায়, যেতে বাধ্য হয় আবদুল করিম। কারণ, বাড়ির পাশের আফজাল ডাক্তারের মাধ্যমে ফয়েজুর রহমানের কাছ থেকে একটা তালাকনামা আর দশ হাজার টাকায় আদায় করতে পেরেছেন আবদুল করিম। আগেই লিখেছিলাম, ডুবে যাওয়া মানুষদের কাছে এক টুকরো গু-ও পরম অবলম্বন। সেই অবলম্বনের সূত্র, তালাকনামা। বিনিময়ে ডাক্তার আফজালকে লিখে দিতে হয়েছে ছোটো বাড়িটা।
ঘটনার পরে ঘটনা সাজিয়ে কথাশিল্পী রশীদ হায়দার দেখান, মানুষ কতো বিচিত্র।মানুষ কতো আত্মকেন্দ্রিক, ইতর। আমরা মানুষেরা কত মানুষের আকারে কত ইতরের মধ্যে ইতরের সঙ্গে বাস করি, শেষ নেই। দূরে চলে গেছে আবদুল করিমের পরিবার। অনেক ঘটনাও ঘটেছে। আবদুল করিম আর নুরুননেসা মারা গেছেন। সংসারের ভার ভাই শফির উপর।
শফি বিয়ে করেছে । সংসারে ভাবী এসেছে। রেবু জানতে চায়, স্বামী স্ত্রী কীভাবে সংলাপ রচনা করে, কিংবা শরীরের মৈথুনে…। ভাইয়ের দরজার সামনে রাতে অপেক্ষা করে, কান পাতে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। শফির স্ত্রীর কাছে ধরা পড়ে। শফি ভাগ্নে মিন্টুকে আগলে রাখলেও এখন বাসায় নিজের স্ত্রী। টানাপোড়েন তৈরী হয়। কোথায় যাবে রেবু? কোথায় হবে রেবুর ঠিকানা? কী করে বাঁচবে রেবু?
জীবনবাদী কথাশিল্পী রশীদ হায়দার জীবনের অগ্রগতি চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। মানুষ যখন লড়াই করতে করতে মাঠের শেষ প্রান্তে চলে আসে, যখন দেখে আর নেই কোনো পথ, ঠিক তখনই বিকল্প পথ আবিষ্কার করে। মিন্টুর বন্ধু মানিকের এই বাড়িতে আসা পছন্দ করে না শফি। কিন্তু সময় পাল্টে গেছে, সেই মানিক কলেজে পড়ে।
রশীদ হায়দার ‘অসম বৃক্ষ’ উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠায় জানান—‘মানিকের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। মানিক এখন কলেজে পড়ে, শরীর স্বাস্থ্য আরও তেজী, যুদ্ধে ছিল, হাতে গুলির আঘাত আছে। মিন্টুর সমস্ত বন্ধুর মধ্যে ও-ই এখন নিয়মিত আসে, আগের মতো অপ্রতিভ হয়ে কথা বলে না, যুদ্ধ ওকে নতুন প্রাণ দিয়েছে।’
আত্মগত চির বঞ্চিত জীবনের রোদে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রেবু ঠিক করে, মিন্টুর বন্ধু মানিকের সঙ্গে একটা বোঝপাড়া করবে। জীবনের কোনো সাধ বা স্বাদ পাওয়ার অধিকার নেই আমার? আত্মগত অন্ধকার থেকে মুক্তি পাওয়ার বা চাওয়ার কোনো অধিকার কি আমার নেই? এই শরীর, শরীরের মধ্যে শরীরের খিদে, অফুরান প্রাণ শক্তি নিয়ে আমি মৃত্যুর প্রহর গুনবো কেবল? নাকি…
জীবনের মধ্যে জীবনের সুখ দেখা বা দেখোনো একজন মহৎ ঔপন্যাসিকের শিল্পচেতনার পরম প্রকাশ। মহৎ শিল্পপথিক রশীদ হায়দার প্রবল সাহসে সঙ্গে গেঁথে দিয়েছেন জীবনের সঙ্গে জীবনের গ্রন্থি। অসম, অবৈধ পুত্রের বন্ধু মানিকের সঙ্গে নিবিড়ে গভীরে জীবনের আবাদের পথে চলে যাওয়ার পথ রচনার মধ্যেই কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দার প্রমাণ রাখেন, জীবন অসম হতে পারে কিন্তু বৃক্ষ তো…
রশীদ হায়দার প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু সত্যি তিনি প্রয়াত? মনে করি, রশীদ হায়দার প্রচুর সৃষ্টিসম্ভারের মধ্যে দিয়ে প্রতিদিন আমাদের মধ্যে ফিরে আসবেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় রচনার মধ্যে দিয়ে বলে যাচ্ছেন, এই বাংলাদেশ আমার, আমি এই বাংলার মাটিতে ‘স্মৃতি একাত্তরে’র বৃক্ষ রোপন করেছি। যতদিন বাংলাদেশ, ততদিন আমার সম্পাদিত ‘স্মৃতি একাত্তর’, আমারই নাম বলবে…
Discussion about this post