নিয়ান নামটি এসেছে ‘নিয়ান্ডার্থাল’ শব্দ থেকে। নিয়ান্ডার্থালরা মানুষের মতোই একটি বিশেষ প্রজাতি ছিল। আজ থেকে প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে এরা পৃথিবীতে বসবাস করতো। নানাবিধ কারণে তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়। তারা যদি বিলুপ্ত না হতো তাহলে আজকে আধুনিক মানুষের পাশাপাশি বাস করতো আরো একটি প্রজাতি। তারা কীভাবে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে তা নিয়ে মতভেদ আছে। কয়েকটি মতের মাঝে একটি হলো আমাদের পূবপুরুষ মানুষরা তাদেরকে মেরে মেরে নিঃশেষ করে দিয়েছে।
কালের আবর্তনে মানুষ আধুনিক হয়েছে। তার মাঝে নৈতিকতা ও আদর্শের চিন্তা চেতনা বিকশিত হয়েছে। আর সাথে সাথে হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিক থেকে উন্নত। আজকের মানুষ জানতে পেরেছে তাদের সম্পর্কে। খুঁজে খুঁজে বের করেছে তাদের ফসিল। ফসিল থেকে বের করেছে তাদের বিচরণকাল। তাদের ফসিল হয়ে যাওয়া কংকাল হয়ে উঠেছে মানুষের বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয়বস্তু।
এরকমই একজন ফসিল বিজ্ঞানী হলেন ড. রিয়াজ। ফসিল গবেষণায় বিশ্বজোড়া খ্যাতি তার। তিনি বাংলাদেশি, কাজ করেন যুক্তরাষ্ট্রে। তার একটা মেয়ে আছে নাম মনিকা। মনিকার মা মনিকাকে ছোট রেখে মারা যান। তাই মনিকাকে ড. রিয়াজ কখনো কষ্ট দেন না। মনিকার কোনো ইচ্ছাতে না করেন না। যখন যেটা করতে চায় সেটা করতে দেন। এর ফলাফল খুব একটা মন্দ নয়। মেয়ে হয়েছে প্রকৃতিপ্রেমী। পাহাড়ে পর্বতে ঘোরে বেড়ানো তার শখ। বরফের উপর স্কি করে বেড়ানোয় তার প্রবল আগ্রহ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোনো স্থানে গেলে সেগুলোকে পেছনে রেখে নিজের ছবি তুলতে ব্যস্ততা নেই তার, বরঞ্চ নিজেকে বাদ দিয়ে প্রকৃতির ছবি তোলাতেই সকল মনোযোগ।
পাশাপাশি মনিকা হয়েছেও ডানপিটে। ষোল বছর বয়সের আগেই অর্জন করেছে ফোর্থ ডিগ্রি কারাটে ব্ল্যাক বেল্ট। স্কুলে লাগিয়ে রাখে একটার পর একটা গণ্ডগোল। একদিন এক সংসদ সদস্যের ছেলেকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ফেলেছিল। নাক ফাটিয়ে রক্ত বের করে ফেলেছিল, পরে তাকে হাসপাতালে নিতে হয়েছিল। এই ঘটনার জেরে তাকে স্কুল ছেড়ে দেবার প্রস্তুতি নিতে বলেছিল স্কুল প্রধান।
এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয়ে চলে যাই। সায়েন্স ফিকশনে অনেক সময় ক্রায়োজেনিক লাইফ সাপোর্টের কথা শুনেছি। বিশেষভাবে তৈরি ক্যাপস্যুলে মানুষের দেহ হিমায়িত করে রাখা হয়। সেখানে মানুষ শত শত বছর এমনকি হাজার হাজার বছর অবিকৃত অবস্থায় জীবিত থাকে। প্রয়োজনে যেকোনো সময় হিমকক্ষ থেকে তাদের ঘুম ভাঙিয়ে জাগিয়ে তোলা যায়।
ব্যাপারটি একদমই ফেলে দেবার মতো নয়। কারণ প্রকৃতিতে অল্প হলেও এরকম উদাহরণ পাওয়া যায়। কাঠ ব্যাঙ (Wood Frog) নামে একধরনের ব্যাঙ আছে। এদের বসবাস আমেরিকা-কানাডা-আলাস্কা অঞ্চলে। শীতকালে সে অঞ্চলে প্রবল ঠাণ্ডা পড়ে। শীতের সময়টায় এই ব্যাঙ বরফের মাঝে বরফশীতল হয়ে নিশ্চল হয়ে থাকে। অনেকটা বরফের মতোই জড় বস্তু হয়ে যায় যেন। শীত কিছুটা কমলে আবারো প্রাণ ফিরে আসে তাদের শরীরে। স্বাভাবিকভাবে চলাচল শুরু করে তখন।
কাঠ ব্যাঙ। বৈজ্ঞানিক নাম Rana sylvatica; Image: Wikimedia Commons
এখানে তো অল্প কিছু সময় শীতনিদ্রায় থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। কিন্তু এমনটা কি সম্ভব যে শত শত কিংবা হাজার হাজার বছরও এভাবে বরফে থেকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে? আর ব্যাঙ তো শীতল রক্তের প্রাণী, পরিবেশের সাথে তাদের দেহের তাপমাত্রার হেরফের হলে খুব বেশি সমস্যা হয় না। কিন্তু যেসব প্রাণী উষ্ণ রক্তের, পরিবেশের তাপমাত্রা কমলেও যাদের দেহের তাপমাত্রা কমে না সাধারণত, তাদের বেলাতেও কি এরকমটা সম্ভব হবে? তারাও কি বরফশীতল থেকে হাজার বছর পর আবার স্বাভাবিক হতে পারবে?
এই প্রশ্নের সোজা কোনো উত্তর নেই। একেবারেই অসম্ভব এমনটা বলা যায় না কখনোই। তবে বর্তমান সময়ের বাস্তবতার কথা বিবেচনা করলে বলা যায় এমনটা সম্ভব নয়। তবে বিজ্ঞান অনেক নাটকীয়। একদিক থেকে দেখলে যে জিনিসটা অসম্ভব সেই জিনিসটিকেও অন্য কোনো দিক থেকে জলের মতো সোজা করে ফেলতে পারে বিজ্ঞান। আর এরকম বিষয় নিয়েই তো রচিত হয় বিজ্ঞান কল্পকাহিনী। মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘নিয়ান’ উপন্যাসটিও সেরকমই এক প্লটের উপর গড়ে উঠেছে। উপন্যাসের চরিত্র মনিকা এবং রিয়াজ ঘটনাক্রমে একটি নিয়ান্ডার্থাল বাচ্চা খুঁজে পায় যেটি বরফে আটকা পড়ে রয়েছিল দীর্ঘদিন।
পুরো উপন্যাসটিকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। উত্তরভাগ ও শেষভাগ। উত্তরভাগে একটু একটু করে মূল গল্পের পটভূমি তৈরি করেছেন। মূল গল্পে ঢুকার জন্য এবং মূল গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য যা যা করা দরকার তা সেখানে করার চেষ্টা করেছেন লেখক। শেষভাগে বলেছেন মূল গল্প। তবে যত প্রস্তুতি নিয়ে প্রাক-কাহিনী বলে মূল গল্পে ঢুকেছেন সেই তুলনায় মূল গল্প বলা হয়নি তেমন। শুরু হয়েই যেন শেষ। মূল গল্পে উপন্যাস হবার মতো কাহিনী হতে গিয়েও হয়নি।
তবে উত্তরভাগ, মানে পটভূমির অংশটি খুবই দারুণ হয়েছে। ভ্রমণপিপাসু এবং প্রকৃতির সৌন্দর্যপিপাসু এক মন সেখানে ফুটে উঠেছে। সেখানের পরতে পরতে যেন বোঝাতে চেয়েছেন সমাজের প্রচলিত জীবনের বাইরে খুব চমৎকার একটি জীবন আছে আমাদের, যেটিকে অনুসন্ধান করা হয় না অনেকের। বাবা-মেয়ের টুকরো টুকরো খুনসুটি যেন বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে সেখানে। বিশেষ করে কয়েকটি হালকা হাস্যরস যেন একদম জীবন্ত।
…মনিকা তার ছোট নোটবইটা বের করে সেখানে প্রথম কার্যতালিকায় টিক চিহ্ন দিল। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “প্রথম দিনটা ঠিক ঠিকভাবে শেষ হয়েছে।”
রিয়াজ হাসিমুখে বলল, “গুড।”
“যেভাবে প্ল্যান করেছিলাম ঠিক সেরকম হয়েছে।”
“শুনে খুশি হলাম। আমি এখন পর্যন্ত আমার জীবনে প্ল্যানমতন কিছু করতে পারি নাই।”
“আমার সাথে থাকো শিখিয়ে দেব।”
রিয়াজ হাসল, বলল, “মনে হয় শেখার জন্যে দেরি হয়ে গেছে।”
মনিকা গম্ভীর মুখে বলল, “না আব্বু শেখার জন্যে কখনো দেরি হয় না। তুমি করতে চাও না সেটা ভিন্ন কথা।”
“কে বলেছে করতে চাই না? তোর আম্মুকে আমি কত প্ল্যান করে বিয়ে করেছিলাম জানিস?”
মনিকার চোখ চকচক করে ওঠে, “কীভাবে বিয়ে করেছিলে বলবে আব্বু?”
“অনেক কায়দা করে। আমার তখন চাল–চুলো কিছু নেই, কে আমার সাথে তার মেয়ে বিয়ে দেবে?”
কিংবা
…সোনালি চুলের মহিলা তার কথা শুনে সন্তুষ্টির ভাব প্রকাশ করে বলল, “এই পুরো ব্যাপারটা থেকে তোমার কি কিছু চাইবার আছে?”
মনিকা মাথা নাড়ল, বলল, “আছে।”
“সেটি কী?”
“আমি চাই নিয়ান জেগে উঠুক এবং আমি তার সাথে কথা বলি।”
সাংবাদিক মহিলা চমকে উঠে বলল, “নিয়ান? জেগে উঠুক?”
“হ্যাঁ। এই ছেলেটি যেহেতু নিয়ানডারথাল তাই আমি তার নাম দিয়েছি নিয়ান। আর যেহেতু তার পুরো শরীরটি বরফের ভেতর অবিকৃত আমি আশা করছি সে আসলে জীবন্ত। সে হিমঘরে ঘুমিয়ে আছে। বিজ্ঞানীরা তাকে জাগিয়ে তুলতে পারবেন।”
সাংবাদিক মহিলা রিয়াজের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তোমার মেয়ে যেটি আশা করছে সেটি কি সম্ভব?”
রিয়াজ দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করল। বলল, “নামকরণের ব্যাপারটি হয়তো সম্ভব। আমরা তাকে নিয়ান ডাকতেই পারি।”
“আর জীবন্ত থাকার ব্যাপারটি?”
“তার সম্ভাবনা খুবই কম। পৃথিবীর ইতিহাসে অল্প সময়ের জন্যে এরকম ঘটনা ঘটেছে কিন্তু সুদীর্ঘ চল্লিশ হাজার বছর প্রাণ সংরক্ষিত থাকার উদাহরণ নেই। হবে বলে মনে হয় না।”
মনিকা রিয়াজের দিকে তাকিয়ে বাংলায় বলল, “আব্বু তুমি আমার সাথে একশ ডলার বাজি ধরতে চাও?”
রিয়াজ বলল, “না মা। আমি তোর সাথে বাজি ধরতে চাই না। যদি বাজিতে হেরে যাস তার টাকাটা তো আমাকেই দিতে হবে!”
পূর্ববর্তী বছরগুলোতে প্রকাশিত জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশন নিয়ে পাঠকদের আক্ষেপ থাকতো। তার সাম্প্রতিক সায়েন্স ফিকশন উপন্যাসগুলোতে প্রতিবারই এমন সব গল্প বলছেন যে গল্প আগের কোনো সায়েন্স ফিকশনে বলে রেখেছিলেন। ‘নতুন বোতলে পুরাতন মদ’ নামক তকমাই লেগে গিয়েছিল তার উপর। এবার ‘নিয়ান’-এর মাধ্যমে এই তকমা কিছুটা ঘুচবে। কারণ এর কাহিনী আগে প্রকাশিত তার সায়েন্স ফিকশনের সাথে খুব বেশি মিল নেই। বছরের পর বছর জাফর ইকবালের এই ব্যাপারটা নিয়ে পাঠক এতটাই হতাশ যে তার এই সায়েন্স ফিকশনটি যে ইউনিক সেটি বিশ্বাসই করতে পারছে না অনেকে।
Discussion about this post