বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের প্রথম পর্ব নির্মাণ করেন পাদ্রি আর সংস্কৃত পন্ডিতরা। তাঁদের গদ্যরচনার মধ্য দিয়ে প্রারম্ভিক স্তরটি নির্মিত হয়। দ্বিতীয় পর্বে আগমন ঘটে চিন্তাশীল ও সৃষ্টিশীল বাঙালি সাহিত্যিকদের। তৃতীয় পর্বের ব্যাপ্তি কম হলেও এর রচনাসম্ভার উৎকৃষ্ট ও প্রাচুর্যময় এবং গোটা সময়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) প্রাধান্য বিস্তার করে আছেন। চতুর্থ পর্বের শুরু রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালেই, যার স্থায়িত্ব ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাগ পর্যন্ত; একে তিরিশোত্তর বা রবীন্দ্রোত্তর পর্বও বলা হয়। এরপর রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে সাহিত্যিক ভাবধারারও পরিবর্তন ঘটে; ফলে বাংলা সাহিত্য পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষত কলকাতাএবং সদ্যোজাত পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ভিত্তিক দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। তাই সবশেষে যে পর্বের সূচনা হয় তাকে এক কথায় বাংলাদেশ পর্ব (১৯৪৭-) বলা চলে।
প্রস্ত্ততিপর্ব সাহিত্যে নতুন যুগের সূচনা সাধারণত সুনির্দিষ্ট কোনো সন-তারিখ মেনে হয় না, কিন্তু বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের শুরু প্রায় সুনিশ্চিতভাবেই ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ধরা হয়। এ যুগ নানা দিক থেকে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ, সমৃদ্ধি ও বেগবান হওয়ার যুগ; বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সুবিখ্যাত ও সমাদৃত হওয়ার যুগ।
প্রাচীন ও মধ্য যুগীয় বাংলা সাহিত্য শুধু পদ্যেই রচিত হতো। তখন সাহিত্যের বিষয়বস্ত্ত ছিল সীমাবদ্ধ এবং তাতে বাঙালি জীবনের প্রতিফলন ঘটত কম। প্রাচীন কবিদের জীবনী সম্পর্কেও নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব ছিল। সাহিত্যচর্চা হতো প্রধানত রাজপৃষ্ঠপোষকতায়। আঠারো শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের মূল লক্ষণগুলি হলো অনুকরণপ্রিয়তা, বৈচিত্র্যহীনতা, ধর্মমত প্রচারের প্রবণতা (প্রণয়কাব্য ও লোকগাথা ব্যতিক্রম) এবং হূদয়াবেগ ও ভাবোচ্ছ্বাসের আধিক্য।
উনিশ শতক হচ্ছে বাঙালির নবজাগরণের যুগ। এ সময় বাঙালি-প্রতিভার সর্বতোমুখী বিকাশ ঘটে এবং জাতি হিসেবে বাঙালির অভ্যুদয়ের সর্ববিধ প্রচেষ্টারও সূত্রপাত ঘটে। এ যুগেই একটি শক্তিশালী সাহিত্যেরও সৃষ্টি হয়। এ সময়ের বাংলা সাহিত্যের প্রধান কয়েকটি বিশেষত্ব হচ্ছে: ক. শক্তিশালী গদ্য-সাহিত্যের সৃষ্টি ও তার অসাধারণ বিকাশ; খ. উনিশ শতকের প্রথম পঞ্চাশ বছরের গদ্য-সাহিত্যে সংস্কৃত পন্ডিতদের প্রভাব; গ. বিশ্বসাহিত্য ও বিশ্বের আধুনিক চিন্তাধারার সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের নিবিড় সংযোগ; ঘ. জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক সাহিত্য সৃষ্টি; ঙ. সাময়িক সাহিত্য সৃষ্টি; চ. মান-বাংলা হিসেবে চলিত ভাষার সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ ও পরবর্তী ধারায় এর ক্রমবর্ধিষ্ণু প্রভাব; ছ. কাব্য-সাহিত্যের অসামান্য উন্নতি; জ. সর্বদেশীয়, সর্বকালীয় ও সর্বজাতীয় সার্বভৌম সাহিত্য সৃষ্টির আদর্শ এবং ঝ. জাতীয় জীবনে সাহিত্যের প্রভাব সর্বাধিক অনুভূত হওয়া এবং সাহিত্যই যে জাতীয় চরিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানদন্ড এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া।
উপর্যুক্ত সংঘটনগুলির প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, ১৭৫৭ সালে বঙ্গদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা ইংরেজদের হস্তগত হলেও সাংস্কৃতিক জীবনে উনিশ শতকের পূর্বে ইংরেজি তথা পাশ্চাত্য প্রভাব অনুভূত হয়নি। প্রধানত ইংরেজদের শিক্ষা ও সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটার মধ্য দিয়েই আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয় এবং বাঙালি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ইউরোপীয় সংস্কৃতির নিকটবর্তী হয়। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তন ঘটে, তাকে ঐতিহাসিকগণ ‘নবজাগৃতি’ বা ‘রেনেসাঁ’ নামে আখ্যায়িত করেন। এর ফলস্বরূপ উনিশ শতকের সাহিত্যে মানব-প্রাধান্য, গদ্য-সাহিত্যের উদ্ভব, সাময়িক পত্রের আবির্ভাব ইত্যাদি বৈচিত্র্যের সূত্রপাত হয়। এ সময় উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি বিচিত্র ধরনের গদ্য-সাহিত্য এবং ইংরেজির আদর্শে নাটক ও কাব্যসাহিত্য (মহাকাব্য-আখ্যায়িকা, সনেট, গীতিকবিতা) রচিত হতে থাকে; এমনকি ইউরোপীয় ধাঁচে নতুন নতুন রঙ্গমঞ্চও নির্মিত হতে থাকে।
গদ্যরচনার যুগ উনিশ শতকের পূর্বে বাংলায় যেসব গদ্য রচিত হয়েছিল তা সাহিত্যপদবাচ্য নয়। সতেরো শতকের শেষভাগে দোম আন্তোনিও ছিলেন প্রথম বাঙালি লেখক এবং তাঁর রচিত ব্রাহ্মণ-রোমান-ক্যাথলিক-সংবাদ প্রথম মুদ্রিত বাংলা গ্রন্থ। পরে পর্তুগিজ পাদ্রি মানোএল-দ্য আস্সুম্পসাঁও সংকলিত কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ এবং বাঙ্গলা ব্যাকরণ ও বাঙ্গলা-পর্তুগীজ শব্দকোষ ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগালের লিসবন শহর থেকে রোমান অক্ষরে মুদ্রিত হয়। রাষ্ট্রক্ষমতা লাভের পর ইংরেজ শাসকবর্গ দেশীয় ভাষা রপ্তকরণের আবশ্যকতা উপলব্ধি করেন। ইতোমধ্যে এদেশে মুদ্রণব্যবস্থা প্রচলিত হলে ইংরেজদের বাংলা শেখাবার উদ্দেশ্যে নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন A Grammar of the Bengal Language। গ্রন্থটি ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হুগলি প্রেস থেকে মুদ্রিত হয় এবং এতে দৃষ্টান্তস্বরূপ উদাহরণ ও উদ্ধৃতিতে বাংলা হরফ ব্যবহূত হয়। এর কাছাকাছি সময়ে খ্রিস্টান পাদ্রিগণ বাংলা গদ্যে আরও কিছু পুস্তক রচনা করেন, যার সবগুলিরই উদ্দেশ্য ছিল ধর্মপ্রচার। এক কথায় বলা যায় যে, শাসনকার্য পরিচালনা ও ধর্মপ্রচারের প্রয়োজনেই আঠারো শতকে বাংলা গদ্যচর্চার প্রসার ঘটে; তাই তাতে সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি। রাজকার্য পরিচালনায় আইনগ্রন্থের বাংলা অনুবাদই প্রথম প্রয়োজন হয়, তাই এ সময়ে কিছু আইন গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশিত হয়। এ ক্ষেত্রে ১৭৭৮ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হ্যালহেডের পরে উল্লেখযোগ্য হলেন ফরস্টার। তিনি কর্নওয়ালীসী কোড (১৭৯৩) ও শব্দকোষ (১৭৯৯) বাংলায় অনুবাদ করেন। এ দুটি মৌলিক রচনা না হলেও এ থেকে বাংলা গদ্যের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা জন্মে। উনিশ শতকে এই গদ্য-প্রচেষ্টা আরও বেগবান ও সমৃদ্ধ হতে থাকে।
ইংরেজ সিভিলিয়ানদের ভারতীয় ভাষা ও বিভিন্ন বিষয়াদি শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ। এখান থেকেই ধারাবাহিকভাবে বাংলা গদ্য রচনা ও চর্চার সূত্রপাত হয়। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা গদ্যের ক্ষেত্রে এই কলেজের অবদান ইতিহাস খ্যাত। শেষ দিকে বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তিত্ব এখানে বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন।
বাংলা গদ্যচর্চায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন উইলিয়ম কেরী (১৭৬১-১৮৩৪) নামে একজন ইংরেজ কর্মকর্তা। তিনি বাংলা গদ্যচর্চাকে ধর্মপ্রচারের অনুরূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন থেকে বাইবেলের বঙ্গানুবাদ মথী রচিত মঙ্গল সমাচার প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। পরে তিনি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে গিয়ে গদ্যে পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশের কাজ আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর নেতৃত্বে একদল বাঙালি পন্ডিত বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনা ও বাংলা ভাষা শিক্ষার কাজ শুরু করেন। এভাবে কেরী এবং ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষার একটা পরিকল্পিত ধারার প্রবর্তন ঘটে। কলেজের বাংলা বিভাগের পন্ডিত রামরাম বসু (১৭৫৭-১৮১৩) ও মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার (১৭৬২-১৮১৯) সর্বপ্রথম বাংলায় যথাক্রমে ফারসি ও সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য কেরীর অবদানই বেশি। বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধনে কেরী যে অবদান রাখেন, তার জন্য তিনি বঙ্গদেশ ও বাংলা ভাষার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
ফোর্ট উইলিয়ম পর্বের বাংলা গদ্যের আটজন পন্ডিতের উল্লেখযোগ্য কর্ম হলো: উইলিয়ম কেরী কথোপকথন (১৮০১), বাংলা ভাষার ব্যাকরণ (১৮০১), ইতিহাসমালা (১৮১২), বাংলা-ইংরেজি অভিধান; রামরাম বসু রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র (১৮০২), লিপিমালা (১৮০২); গোলকনাথ শর্মা হিতোপদেশ (১৮০২); মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার বত্রিশ সিংহাসন (১৮০২), হিতোপদেশ (১৮০৮), রাজাবলি (১৮০৮), প্রবোধচন্দ্রিকা (১৮৩৩); তারিণীচরণ মিত্র (১৭৭২-১৮৩৭) ওরিয়েন্টাল ফেবুলিস্ট (১৮০৩); রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং (১৮০৫); চন্ডীচরণ মুন্সী তোতা ইতিহাস (১৮০৫) এবং হরপ্রসাদ রায় পুরুষ পরীক্ষা (১৮১৫)।
পাঠ্যপুস্তক প্রসঙ্গ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পরে পাঠ্যপুস্তক রচনার উদ্যোগ নেয় কলিকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি (১৮১৭)। এর প্রধান কয়েকজন লেখক ছিলেন: রামকমল সেন (১৭৮৩-১৮৪৪), রাধাকান্ত দেব (১৭৮৪-১৮৬৭), তারিণীচরণ মিত্র প্রমুখ। এঁদের গ্রন্থগুলি মূলত উপকথা-নীতিকথা ভিত্তিক। প্রকৃত পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন শ্রীরামপুর কলেজের শিক্ষকগণ। পাঠ্যপুস্তকগুলিতে বিষয়গত প্রয়োজনই প্রাধান্য পায়, ফলে সেগুলির সাহিত্যমূল্য বিচার্য নয়; বরং উল্লেখ্য যে, বাংলা ভাষার পাঠকের কাছে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা বলার যে আবশ্যকতা ছিল এবং তার জন্য যে ভাষা নির্মাণের প্রয়োজন ছিল তা এগুলিদ্বারা সম্পন্ন হয়েছে। এজন্য বিভাষা থেকে বিষয় ও শব্দ গ্রহণ করাও জরুরি ছিল।
রামমোহন পর্ব বাংলা গদ্যসাহিত্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হলো সন্দর্ভ জাতীয় রচনা। এ ধারার প্রবর্তক রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩)। তিনি বেদান্তের অনুবাদ এবং কিছু মৌলিক গ্রন্থও রচনা করেন। ব্রাহ্মধর্মের প্রচারক হিসেবে হিন্দু ধর্মবেত্তাদের সঙ্গে ধর্ম ও তত্ত্ববিষয়ক এবং সহমরণবিষয়ক সমাজসংস্কার আলোচনা তাঁর মৌলিক রচনার প্রধান বিষয়। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত গৌড়ীয় ব্যাকরণের জন্যই তিনি সমধিক খ্যাত। এটি বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক বাংলা ব্যাকরণ।
বাংলা গদ্যে রামমোহনের বিশিষ্টতা এই যে, তিনি পাঠ্যপুস্তকের বাইরে গদ্য ব্যবহারের পথ উন্মুক্ত করেন। এ সময় তাঁর প্রতিপক্ষ ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন, কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৭৮৭-১৮৪৮) প্রমুখ এবং প্রধানত শ্রীরামপুরের মিশনারি পাদ্রিরা। ভবানীচরণের গদ্যরচনায় বাংলা কথ্যরীতির প্রথম সূচনা হয় এবং তাঁর সামাজিক নকশা জাতীয় রচনা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করে। রামমোহনের স্বপক্ষে ছিলেন রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ, দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬), প্রসন্নকুমার ঠাকুর, তারাচাঁদ চক্রবর্তী (১৮০৬-১৮৫৭), চন্দ্রশেখর দেব, গৌরীকান্ত ভট্টাচার্য (জ্ঞানাঞ্জন), গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার (স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক), কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮১৩-১৮৮৫) প্রমুখ। এ সময় বাংলা গদ্য ব্যবহারের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল সাময়িক পত্র ও সংবাদপত্র। এছাড়া পক্ষ-প্রতিপক্ষের প্রচারণামূলক এক ধরনের রচনার প্রচলন হয়েছিল, যা পরবর্তীকালে ‘দ্বৈরথ দ্বন্দ্ব’ (Polemics) নামে পরিচিত হয়।
ওই সময়কার অন্যান্য গদ্য রচয়িতার মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩)। তিনি প্রথম বাংলা উপন্যাস এবং কথ্য ভাষার ব্যবহারে গদ্য রচনার জন্য বিখ্যাত হলেও নানা বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করেও খ্যাতি অর্জন করেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮১৭-১৯০৫) গদ্য কবিত্বময়, স্নিগ্ধ ও অন্তরঙ্গ। অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬) বাংলা গদ্যকে যুক্তি ও বিজ্ঞানচর্চার উপযোগী করে তোলেন। তাঁর রচনায় বাহ্য প্রকৃতির সঙ্গে মানব প্রকৃতির সম্বন্ধবিচার স্থান পেয়েছে। তাঁর সর্বাধিক পরিচিত গ্রন্থ হচ্ছে কিশোর শিক্ষার্থীদের জন্য রচিত চারুপাঠ।
বাংলায় সাময়িক পত্রপত্রিকা এবং সংবাদপত্রের সূচনা বাংলা গদ্যের ইতিহাসকে বিনির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশে উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে বিবিধ সাময়িক পত্র-পত্রিকা নানাভাবে সাহায্য করেছে, যার ধারা একাল পর্যন্ত অব্যাহত। শ্রীরামপুরের পাদ্রিরা প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশের কৃতিত্ব অর্জন করেন মাসিক দিগ্দর্শনের (এপ্রিল ১৮১৮) মাধ্যমে। ১৮১৮ থেকে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত নিয়মিত-অনিয়মিত পত্র-পত্রিকার মধ্যে প্রধান কয়েকটি এবং সংশ্লিলষ্ট ব্যক্তিবর্গ হলেন: সমাচারদর্পণ (১৮১৮) জন ক্লার্ক মার্শম্যান; সম্বাদকৌমুদী (১৮২১) তারাচাঁদ দত্ত ও ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়; সমাচার চন্দ্রিকা (১৮২২) ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বঙ্গদূত (১৮২৯) নীলমণি হালদার। পরে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত এ পত্রিকায় অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১), দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৯), দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬) প্রমুখ এ যুগের শ্রেষ্ঠ গদ্যলেখক নিয়মিত লিখে বাংলা সাহিত্যে একটা যুগের সৃষ্টি করেন। জ্ঞানবিজ্ঞান ও দর্শনসংক্রান্ত রচনায় এ পত্রিকাটিকে যাঁরা সমৃদ্ধ করেন তাঁরা ছিলেন সংস্কারপন্থী এবং এটিকে কেন্দ্র করেই সে সময়ের সাহিত্য-সাধনায় বাঙালি জাতির কল্যাণ সাধিত হয়েছিল। এর লেখকগোষ্ঠীর মধ্যে অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন নানা কারণে উল্লেলখযোগ্য। তিনি দীর্ঘ বারো বছর এর সম্পাদক ছিলেন।
ইয়ং বেঙ্গল প্রসঙ্গ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশিষ্ট ধারা প্রবর্তনে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলেন ইয়ং বেঙ্গল সদস্যরা। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে তাঁরা ছিলেন প্রচলিত ধর্মীয় সংস্কারের বিরোধী। তাঁরা নির্বিচারে কোন কিছু গ্রহণ করতেন না। তাঁদের চিন্তা ও কর্ম তখনকার (১৮৩১-১৮৫৭) বাঙালি সমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। প্যারীচাঁদ মিত্রের নাম এ ক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য। ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ ছদ্মনামে রচিত তাঁর আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮) বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস। এতে তিনি আরবি-ফারসি-হিন্দুস্থানি মিশ্রিত সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ব্যবহার করেন। ভাষাগত কারণেও উপন্যাসটি সমকালে এবং পরবর্তীকালে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করে। তাঁর অন্যান্য রচনায়ও ভাষা ব্যবহারের এই স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান, যে কারণে বাংলা গদ্যের প্রথম যুগে ‘আলালি গদ্য’ নামে তাঁর ভাষাকে পৃথক মর্যাদা দেওয়া হয়।
প্যারীচাঁদের অনুসরণে বাংলা ভাষাকে আরও গণমুখী করেন কালীপ্রসন্ন সিংহ (১৮৪০-১৮৭০)। কলকাতা এবং তৎসংলগ্ন এলাকার মৌখিক ভাষাকে তিনি সার্থকভাবে তাঁর রচনায় প্রয়োগ করেন। তাঁর হুতোম প্যাঁচার নকশা (১৮৬২) উপন্যাসে ব্যবহূত ভাষারীতি প্যারীচাঁদের ভাষার চেয়ে মার্জিততর। এ গ্রন্থে চলিত ভাষায় সরস ব্যঙ্গবিদ্রূপের মাধ্যমে কলকাতার সমাজজীবন চিত্রিত হয়েছে। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে তাঁর ভাষা ‘হুতোমি ভাষা’ নামে পরিচিত, যা পরবর্তী শতকের গদ্যরচনায় বিশেষ প্রভাব ফেলে।
আধুনিক বাংলা গদ্যের প্রধান রূপকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নানাভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। শিক্ষাবিস্তারের প্রয়োজনে তিনি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন এবং পরবর্তীকালে সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে নিজস্ব রীতিতে গদ্যচর্চা করেন। উনিশ শতকের মানবতাবাদে যেমন, বাংলা গদ্যের সার্থক শিল্পরূপ নির্মাণের ক্ষেত্রেও তেমনি তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। রামমোহন বাংলা গদ্যের কাঠামো তৈরি করেন, আর বিদ্যাসাগর তাতে প্রাণসঞ্চার ও সৌন্দর্য সংযোজন করেন। বিদ্যাসাগরের রচনাকে চারটি ধারায় ভাগ করা যায়: সমাজবিষয়ক রচনা, রম্যরচনা, পাঠ্যপুস্তক ও সাহিত্যধর্মী রচনা। তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য বাংলা গদ্যে সাবলীল গতিভঙ্গি তথা অন্তর্নিহিত ছন্দ আবিষ্কার এবং বিরামচিহ্নের যথাযথ ব্যবহার। উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের প্রধান পরিকল্পনাকারী ও নিয়ন্ত্রক ছিলেন বিদ্যাসাগর। তিনি বাংলা সাধুগদ্যের একটা আদর্শ রূপ দেন, যার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালের লেখকগণ অনুপম সাহিত্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হন।
প্রবন্ধের সুসংবদ্ধ বক্তব্যের জন্য উপযুক্ত গদ্য রচনা করেন ভূদেব মুখোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৯৪)। তাঁর রচনার বিষয় সমাজ, শিক্ষা, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ধর্ম ইত্যাদি; আর এ কারণেই রচনার শিথিল ভঙ্গি তাতে গ্রাহ্য হয়নি। এ সময়ের অন্যতম প্রধান পন্ডিত রাজেন্দ্রলাল মিত্রের (১৮২২-১৮৯১) অধিকাংশ রচনা ইংরেজিতে হলেও বাংলায় তিনি খ্যাত মাসিক পত্রিকা বিবিধার্থ সংগ্রহ (১৮৫১), রহস্যসন্দর্ভ (১৮৫১) ও বিবিধার্থ সংগ্রহ সন্দর্ভ-এর (১৮৬৩) জন্য। প্রথমটিতে সূচনা হয় গ্রন্থ সমালোচনার। এ ধারায় রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৮৭) ১৮৫২ সালে প্রকাশ করেন বাংলার প্রথম সাহিত্য সমালোচনামূলক একটি গ্রন্থ। রাজনারায়ণ বসুর সেকাল আর একাল (১৮৭৪), হিন্দু কলেজ অথবা প্রেসিডেন্সি কলেজের বৃত্তান্ত (১৮৭৬), বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা (১৮৭৮) এবং আত্মচরিত-এ (১৯০১) পাওয়া যায় মননশীলতার গভীর পরিচয়। রামগতি ন্যায়রত্ন (১৮৩১-১৮৯৪) বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিস্তৃত ইতিহাস বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৭২, ১৮৭৩) রচনা করেন। পাঠ্যপুস্তকের লেখক মদনমোহন তর্কালঙ্কার (১৮১৭-১৮৫৮) বিদ্যাসাগর পর্বের একজন উল্লেখলযোগ্য লেখক ছিলেন।
বিকাশের যুগ এ পর্বের শ্রেষ্ঠ লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪)। তিনি বাংলা গদ্যকে সর্বপ্রকার ভাব প্রকাশের উপযোগী করে তোলেন। বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি জীবনে অসামান্য প্রভাব বিস্তার করেন। তিনি তাঁর অসাধারণ প্রতিভাগুণে পন্ডিতি ও আলালি-হুতোমি রীতির মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করে সরল ও সরস গদ্যের সৃষ্টি করেন। বঙ্গদর্শন (১৮৭২) নামক সাহিত্য-বিষয়ক মাসিক পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে তিনি সাহিত্যের ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করেন। সাহিত্য-সমালোচনা, ঐতিহাসিক গবেষণা, ধর্ম ও দার্শনিক আলোচনা, রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক সাহিত্য, ব্যঙ্গ-সাহিত্য এর সবই তিনি প্রবর্তন করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভাবলে যে সাহিত্যিক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে, তাঁরাই দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর যাবৎ বাংলা সাহিত্যে আধিপত্য করেন। বাংলায় তুলনামূলক সাহিত্যসমালোচনারও তিনিই পথিকৃৎ। তবে তাঁর প্রধান পরিচয় ঔপন্যাসিক হিসেবে এবং এজন্য তিনি ‘সাহিত্যসম্রাট’ উপাধিতে ভূষিত হন। তাঁর রচিত বিখ্যাত উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুন্ডলা, কৃষ্ণকান্তের উইল, বিষবৃক্ষ, আনন্দমঠ ইত্যাদি।
এ সময়ের অন্যান্য বিশিষ্ট লেখকের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য বঙ্কিমচন্দ্রের অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৪-১৮৮৯)। তাঁর সার্থক সৃষ্টি পালামৌ চমৎকার এক ভ্রমণকাহিনী। তিনি উপন্যাস রচনায়ও খ্যাতি অর্জন করেন। আরেকজন গুণী লেখক হলেন রমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯)। বাংলা সাহিত্যে তাঁর পরিচয় ঐতিহাসিক উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে। উপন্যাসে তিনি বাংলার ইতিহাস ও সমাজকে তুলে ধরেন। রবীন্দ্রনাথের অগ্রজা স্বর্ণকুমারী দেবীর (১৮৫৫-১৯৩২) ছিল বিচিত্র ধরনের সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষমতা। কবিতা ও নাট্যরচনায় দক্ষতার পরিচয় দিলেও উপন্যাস রচনায়ই তাঁর সর্বাধিক কৃতিত্ব। সমকালীন সমাজ-জীবনের আদর্শ-সংঘাতের ছায়া স্বর্ণকুমারীর সামাজিক উপন্যাসে গভীরভাবে পড়েছে। তাঁর সম্পাদিত ভারতী পত্রিকা সমকালে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৪৭-১৯১৯) ছোট-বড় সকলের অবসর বিনোদনের জন্য বিচিত্র কাহিনী সৃষ্টি করেন। তিনি চারটি উপন্যাস ও চারটি গল্পগ্রন্থ রচনা করেন; তবে উপন্যাসের তুলনায় গল্প রচনায় তাঁর সফলতা বেশি। তাঁর সমসাময়িক ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৪৯-১৯২২) ব্যঙ্গাত্মক নকশা ও উপন্যাস রচনায় সমকালীন কথাসাহিত্যে হাস্যরসের ধারা প্রবর্তন করেন। এ সময়ের আরও কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত গদ্যলেখক হচ্ছেন প্রতাপচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৫-১৯২১), শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৯), চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় (১৮৪৯-১৯১১), হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১), দামোদর মুখোপাধ্যায় (১৮৫৩-১৯০৭), শ্রীশচন্দ্র মজুমদার (১৮৬০-১৯০৮), নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত (১৮৬১-১৯৪০) প্রমুখ।
প্রবন্ধ রচনার ধারা এ ধারার সূত্রপাত হয় ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের হাতে, কিন্তু পরিণতি লাভ হয় বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে। ভাষা, সাহিত্য, সমাজ, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে গভীর মননশীল প্রবন্ধ রচনা করে বঙ্কিমচন্দ্র এ ধারাকে সমৃদ্ধ করেন। বিজ্ঞান রহস্য (১৮৭৫), বিবিধ সমালোচনা (১৮৭৬), কৃষ্ণচরিত্র (১৮৮৬) প্রভৃতি তাঁর এ জাতীয় রচনা। এ ধারায় পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন আরো অনেকে। বঙ্কিমের অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র লেখেন যাত্রা-সমালোচনা (১৮৭৫), বাল্যবিবাহ (১৮৮২) ইত্যাদি। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর মননশীল প্রাবন্ধিক হিসেবে ছিলেন অনন্য, এমনকি তাঁর ভাষাতাত্ত্বিক প্রবন্ধও ছিল সে সময়ের জন্য অভাবিত। উনিশ শতকের শেষ দশকে বাংলা ভাষা বিশ্লেষণে যে একটি নতুন ধারার সূত্রপাত হয়, তিনি ছিলেন তার সূচনাকারী। অন্যান্য প্রাবন্ধিকের মধ্যে ছিলেন ধর্মীয় প্রবন্ধের লেখক ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল (১৮৪০-১৯১৬), বান্ধব পত্রিকার (১৮৭৪) সম্পাদক কালীপ্রসন্ন ঘোষ (১৮৪৩-১৯১০), রক্ষণশীল চন্দ্রনাথ বসু (১৮৪৪-১৯১০), বাংলা ভাষায় প্রত্নতত্ত্ব আলোচনার সূচনাকারী রামদাস সেন (১৮৪৫-১৮৮৭), ধর্মতাত্ত্বিক ও সমাজ-ঐতিহাসিক শিবনাথ শাস্ত্রী যিনি রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ (১৮৯৭) গ্রন্থের জন্য স্মরণীয়, সুলেখক পূর্ণচন্দ্র বসু, উদ্ভ্রান্ত প্রেমের লেখক চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় (১৮৪৯-১৯২২), পুরাতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক রজনীকান্ত গুপ্ত (১৮৪৯-১৯০০), স্বর্ণকুমারী দেবী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ।
অন্যান্য প্রবন্ধ প্রণেতার মধ্যে হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) -এর জীবনী লেখক শেখ আবদুর রহিম (১৮৫৯-১৯৩১), রেয়াজউদ্দীন আহমদ মাশহাদী (১৮৫৯-১৯১৮), মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক (১৮৬০-১৯৩৩), সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ের লেখক ত্রৈলোক্যনাথ ভট্টাচার্য (১৮৬০-১৯০৩), ঐতিহাসিক প্রবন্ধ রচয়িতা অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় (১৮৬১-১৯৩০) প্রমুখ বিখ্যাত। বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের ক্ষেত্রে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নতুন ধারার প্রবর্তন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আধুনিক সাহিত্যে বাঙালি মুসলমান কবি মধ্যযুগের পর দীর্ঘকাল যাবৎ বাঙালি মুসলমান কবিদের উল্লেখযোগ্য কোনো সাহিত্যিক অবদান দেখা যায় না। মুসলমানদের নিকট থেকে ইংরেজ রাজশক্তির ক্ষমতা দখলের কারণে মুসলমানদের মধ্যে এক গ্লানিময় অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়। ইংরেজের কোম্পানি শাসন এবং আধুনিক সভ্যতা কোনটাই তারা মেনে নেয়নি। হিন্দুসমাজে যখন ইয়ং বেঙ্গলদের আধুনিকতার চর্চা চলছিল, সে সময়ে তিতুমীরের নেতৃত্বে মুসলমানদের অভ্যুত্থান (১৮৩১) এবং পরবর্তী পর্যায়ে তাদের রাজনৈতিক-সামাজিক পর্যায়ে ইংরেজবিরোধ ছিল সুস্পষ্ট। এর ফলে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি মুসলমানরা দীর্ঘকাল উদাসীন থাকে। এসব কারণে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তাদের আগমন ঘটে অনেক বিলম্বে।
বটতলার পুথি সিপাহি বিপ্লবের (১৮৫৭-৫৮) পরে যখন মুসলমানরা আধুনিক বাংলা সাহিত্য-চর্চায় এগিয়ে আসেন তখনও তাঁদের মধ্যে বিশুদ্ধ বাংলায় সাহিত্যচর্চার পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। আধুনিক শিক্ষা ও জ্ঞানের বাইরে থেকে অতীত গৌরবের কথা নিয়ে তাঁরা পুরো শতাব্দী ধরেই রচনা করেন দোভাষী পুথি। উর্দু, ফারসি ও হিন্দি শব্দবহুল এসব পুথির ভাষা ছিল সাধু শ্রেণির। যুগপ্রভাবে স্বভাবতই এ ভাষা ওহাবী বা ফরায়েজী আন্দোলন-প্রেরণায় পুষ্ট ছিল এবং তাতে ধর্মীয় প্রভাবও ছিল পর্যাপ্ত পরিমাণে। পরবর্তী পর্যায়ে ছাপাখানা ও পুস্তক ব্যবসার প্রসারের ফলে উনিশ শতকে এগুলি পরিচিত হয় বটতলার পুথি নামে। এ ধারার সাহিত্য তখন বিরাট জনগোষ্ঠীর সাহিত্য-পিপাসা মিটিয়েছে। সমগ্র বঙ্গদেশের মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ স্থাপনের জন্য যেভাবে এ সাহিত্য রচিত ও চর্চিত হয়েছে, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের সাহিত্যের ইতিহাসে তার নজির পাওয়া যায় না।
প্রধান বাঙালি মুসলমান লেখক উনিশ শতকে রাজনীতি সম্পর্কে বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির মুসলমানদের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটার পর থেকে বাংলা সাহিত্যে বেশ কিছু প্রতিভাবান সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন: মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২), মৌলবি মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন (১৮৩২-১৯০৭), দাদ আলী (১৮৫২-১৯৩৬), কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫১), শেখ আবদুর রহিম, রেয়াজউদ্দীন মাশহাদী, মোজাম্মেল হক, মুনশি মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দীন আহমদ (১৮৬২-১৯৩৩), মৌলবি মেয়রাজউদ্দীন আহমদ (১৮৫২-১৯২৯), মুনশি মোহাম্মদ জমিরউদ্দীন (১৮৭০-১৯৩০), আবদুল হামিদ খান ইউসুফজয়ী (১৮৪৫-১৯১৫), আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৮৭১-১৯৫৩), নওশের আলী খান ইউসুফজয়ী (১৮৬৪-১৯২৪), মওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০) প্রমুখ। মীর মশাররফ হোসেন ছিলেন আধুনিক যুগের মুসলমান বাংলা সাহিত্যিকদের অগ্রগণ্য। সমগ্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেও তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক। উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, কাব্য, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ-সাহিত্য, সমাজচিত্র প্রভৃতি বিষয়ে তিনি প্রায় ৩০টি গ্রন্থ রচনা করেন; তবে উপন্যাস ও কাহিনী জাতীয় রচনাতেই তাঁর অবদান সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর রচনার ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্য পরবর্তী যুগের বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনা জুগিয়েছে। বিষাদ-সিন্ধু তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা।
মশাররফের পরে অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হলেন মোজাম্মেল হক। গদ্য ও পদ্য রচনায় অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারী মোজাম্মেল হক প্রধানত মুসলমান সমাজের জাগরণমূলক কাব্য রচনা করলেও তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটে মূলত গদ্যে। তিনি জীবনচরিত ও উপন্যাস রচনায় এবং ফারসি থেকে অনুবাদে কৃতিত্ব অর্জন করেন। মুসলমানদের জন্য সর্বপ্রথম পাঠ্যপুস্তক রচনাও তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব। মূল ফারসি থেকে শাহনামা কাব্যের প্রথমাংশের অনুবাদ তাঁর অমর কীর্তি। শেখ আবদুর রহিমের কৃতিত্ব হজরত মোহাম্মদের (দ.) জীবন-চরিত ও ধর্মনীতি নামে বাঙালিদের মধ্যে প্রথম হযরত (স.)-এর জীবনী রচনা। পন্ডিত রেয়াজউদ্দীন আহমদ মাশহাদী সমাজ সংস্কারক গ্রন্থের জন্য সমধিক খ্যাত। মুসলমান সমাজকে সংঘবদ্ধ করা এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে জামালুদ্দীন আফগানীর বৈপ্লবিক চিন্তাধারা প্রচারের কারণে প্রকাশের অল্প পরেই এ গ্রন্থটি সরকার বাজেয়াপ্ত করে।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কাব্যের ঋদ্ধ ও বেগবান ধারা উনিশ শতকের প্রথমার্ধে এসে প্রায় শুষ্ক অবস্থায় পতিত হয়। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য কবি ছিলেন কেবল ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯)। তাঁকে বলা হয় যুগসন্ধির কবি। নিজের সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকরে তিনি নিজের এবং অন্যদের কবিতাও প্রকাশ করতেন। তাঁর মহান কীর্তি হলো প্রাচীন কবিদের জীবনী ও কাব্য সংগ্রহ করে প্রকাশ করা।
ঈশ্বরগুপ্তের কবিতায় সে সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনা প্রকাশ পায়। উনিশ শতকের নতুন সাহিত্য ছিল নাগরিকজনদের জন্য লেখা এবং সাহিত্যিকরা ছিলেন নাগরিক সংস্কৃতিপুষ্ট; তাই তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল প্রসারিত। ঈশ্বরগুপ্তের মধ্যে প্রথম সেই লক্ষণ দেখা যায় ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রকাশিত তাঁর সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায়। তখনকার কলকাতায় নতুন সাহিত্য ও জীবনধারা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এর অবদান ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এক সময় তা বাংলা সাহিত্যের দিকনির্দেশ ও নীতিনির্ধারণ করেছে। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, মনোমোহন বসু, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখকরা ঈশ্বরগুপ্তের নিকট বিশেষভাবে ঋণী ছিলেন।
১৮৫৮ সাল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। এ সময় যুগসন্ধির কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মৃত্যু হয়, প্রথম বাংলা উপন্যাস আলালের ঘরের দুলাল প্রকাশিত হয় এবং বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-১৮৭৩) আত্মপ্রকাশ ঘটে। মধুসূদন শর্মিষ্ঠা নাটক রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হন। একই সঙ্গে বাংলা কাব্যেও তিনি বিপ্লব ঘটান। বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন তাঁর অক্ষয় কীর্তি। এ ছন্দে রচিত তাঁর মেঘনাদবধ কাব্য (১৮৬১) বাংলা সাহিত্যে এক অনুপম সৃষ্টি এবং মধুসূদনেরও শ্রেষ্ঠ রচনা। এর বিষয় ও ভাষা প্রাচ্যদেশীয় হলেও ভাব ও রচনারীতি পাশ্চাত্যের। মধুসূদনে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সার্থক মিলন ঘটেছে।
মধুসূদন মেঘনাদবধ রচনার কিছুকাল পরে ইউরোপ চলে যান এবং প্রবাসে বসে সনেট লিখতে শুরু করেন, যা চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী নামে ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয়। কিছু গীতিকবিতা ও কিশোরতোষ নীতিমূলক কবিতাও তিনি রচনা করেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দ ও সনেটের মতো বাংলা সাহিত্যে প্রথম বিয়োগান্ত নাটক রচনার কৃতিত্বও মধুসূদনের। বস্ত্তত মধুসূদনের দ্বারাই বাংলা কাব্যে আধুনিকতার সূত্রপাত হয় এবং বাংলা সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদা লাভ করে।
মধুসূদনের পরে বাংলা কাব্যের ইতিহাসে উল্লিলখিত হন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৯০৩) ও নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯)। হেমচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ কীর্তি মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে রচিত সুবৃহৎ মহাকাব্য বৃত্রসংহার (১৮৭৫)। এতে সাধনার জয় ও স্বাজাত্যবোধ তুলে ধরা হয়েছে। উনিশ শতকের হিন্দুধর্মীয় বিশ্বাস ও আচারনিষ্ঠাকে কবি পূর্ণ মর্যাদা দেন এবং কাব্যের বিভিন্ন আঙ্গিক নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। নবীনচন্দ্র আখ্যানকাব্য, খন্ডকবিতা এবং মহাকাব্য রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি মধুসূদনের দ্বারা প্রভাবিত হলেও তাঁর রচনাভঙ্গি ততটা অনুসরণ করেননি। কাব্যক্ষেত্রে তাঁর খ্যাতি প্রধানত দুটি কারণে জাতীয়তাবাদের পোষণ ও সনাতন ধর্মবিশ্বাস। তাঁর প্রধান কাব্যগ্রন্থ পলাশীর যুদ্ধ (১৮৭৫) প্রকাশে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়।
গীতিকাব্য ধারা বাংলা সাহিত্যের এ ধারার প্রথম প্রকাশ ঘটে মধ্যযুগের বৈষ্ণবকবিতায়। পরবর্তীকালে এর নবরূপ প্রকাশ পায় প্রধানত কবিগান ও যাত্রার মাধ্য দিয়ে। কবিগান, যাত্রা, লোকগাথা, পাঁচালি, আখড়াই,টপ্পা প্রভৃতি ছিল মধ্যযুগ ও উনিশ শতকের সন্ধিক্ষণের বাংলা কাব্যের অমূল্য সম্পদ। বিশেষত ভাগীরথী অঞ্চলে এসব কবিতার অসামান্য প্রভাব ছিল এবং কলকাতার ধনিক-বণিকরা ছিলেন এসবের প্রধান সমঝদার। এ সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি নিধিরাম গুপ্তের (নিধুবাবু) প্রণয়-কবিতার সঙ্গে আধুনিক গীতিকাব্যের একটা আন্তর সাদৃশ্য রয়েছে। তাছাড়া যাত্রা, পাঁচালি ও কবিগানের সঙ্গেও পরবর্তীকালের গীতিকাব্যের একটা সম্বন্ধ রয়েছে। এসব গান কেবল লোকমনোরঞ্জনের জন্যই রচিত ও পরিবেশিত হতো, তাই সাহিত্য হিসেবে এগুলি উঁচু মানের নয়। তবে এগুলিকে অনেকটা মার্জিত করেন গোঁজলা গুঁই ও অন্যরা। এক সময় তরজা-পাঁচালি-প্রিয় শহরবাসীদের মধ্যে কবিগানের সমাদর বাড়ে। আর এ পর্বের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন ভোলা ময়রা, এন্টনি ফিরিঙ্গি, ঠাকুর সিংহ প্রমুখ।
আধুনিক গীতিকবিতা এ ধারার জনক বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪) সারদামঙ্গল (১৮৭৯) কাব্যের জন্য বিখ্যাত। তাঁর বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এজন্য যে, এ্রতেই প্রথম রোম্যান্টিকতার বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। বিহারীলালের কাব্যের ভাষা সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত, কিন্তু ভাবের প্রগাঢ়তা এতে ক্ষুণ্ণ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনাদ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। এ সময়ের অন্যান্য কবির মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার (১৮৩৮-১৮৭৮) মহিলা কাব্য লিখে যশস্বী হন। দীনেশচরণ বসু প্রাঞ্জল ও সুমিষ্ট গীতিকবিতার জন্য খ্যাত। যোগীন্দ্রনাথ বসু স্বদেশপ্রীতিমূলক কাব্য রচনা করেন। দেবেন্দ্রনাথ সেনের কবিতায় ছিল ভাবুকতার উচ্ছ্বাস; তাঁর ভাষা সরল ও সুললিত এবং রচনার একটা প্রধান অংশ ফুল সম্পর্কীয়। অক্ষয়কুমার বড়ালের (১৮৬০-১৯১৯) কাব্য স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। তাঁর বিখ্যাত কাব্য এষা। রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০) ছিলেন সরল ও সরস গীতিকবিতা এবং ব্যঙ্গকবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত। গোবিন্দদাস (১৮৫৪-১৯১৮) এ যুগের একজন প্রসিদ্ধ স্বভাবকবি। গিরীন্দ্রমোহিনী দাস (১৮৫৭-১৯২৪) ভাবগূঢ় গীতিকবিতা রচনা করেন। কামিনী রায় (১৮৬৪-১৯৩৩) ছিলেন উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি; তাঁর কবিতায় আন্তরিকতা ও বিষাদের সুর ধ্বনিত। মধুসূদনের ভ্রাতুষ্পুত্রী মানকুমারী বসুর কবিতায় ভগবদ্ভক্তি ও করুণরস পরিস্ফুট। এছাড়া এ যুগে আরও বহু কবি কাব্য-সাধনায় খ্যাতি অর্জন করেন, যেমন: আনন্দচন্দ্র মিত্র, গোবিন্দচন্দ্র রায়, বরদাচরণ মিত্র, নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) প্রমুখ।
এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন কায়কোবাদ। হেমচন্দ্র-নবীনচন্দ্রের কাব্যধারায় মহাশ্মশান মহাকাব্য রচনা করে তিনি বিখ্যাত হন। মুসলমানদের তৎকালীন দুরবস্থা কবিকে বেদনার্ত করেছে, তাই তিনি তাদের সমৃদ্ধ অতীত অবলম্বনে কাব্য রচনা করেন। মহাশ্মশান পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে রচিত ৮৭০ পৃষ্ঠার বিপুলায়তন কাব্যগ্রন্থ। এখানে কবি ভারতের হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের একটি চরম সংকটপূর্ণ অবস্থা আবেগপূর্ণ ভাষায় বর্ণনা করেন। গীতিকাব্য রচনায়ও কায়কোবাদের কৃতিত্ব রয়েছে; অশ্রুমালা তাঁর একটি বিখ্যাত গীতিকাব্য।
আধুনিক নাট্যসাহিত্য বাংলায় আধুনিক নাট্যসাহিত্য সৃষ্টি হয় পাশ্চাত্যের প্রভাবে। প্রথমে কেবল ধনিকসমাজের চিত্তবিনোদনের জন্যই নাটক রচিত ও অভিনীত হতো। তখন রামনারায়ণ তর্করত্নের (১৮২২-১৮৮৬) কুলীন-কুলসবর্বস্ব জাতীয় কৌতুকনাট্য বাংলার রঙ্গমঞ্চকে মুখরিত করত। পরে আবির্ভাব ঘটে আধুনিক নাট্যকার মধুসূদন দত্তের। বাংলা কাব্যে আধুনিকতার দ্বারোদ্ঘাটনের মতো বাংলা নাটকেও তিনি আধুনিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বেলগাছিয়া থিয়েটারে মঞ্চস্থ রত্নাবলী নাটকে নাট্যগুণগত দুর্বলতা ও বাংলা ভাষায় নাটকের অভাব অনুভব করে তিনি নাটক লিখতে শুরু করেন। মহাভারতের শর্মিষ্ঠা-দেবযানী-যযাতির কাহিনী অবলম্বনে তিনি প্রথম রচনা করেন শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯) নাটক। তাঁর দ্বিতীয় নাটক পদ্মাবতী রচিত হয় এর অব্যবহিত পরেই (১৮৬০)। এতে গ্রীক পুরাণের কাহিনীকে তিনি দেশীয় ধারায় রূপদান করেন। পদ্মাবতী নাটক নানা কারণে উল্লেখলযোগ্য; শর্মিষ্ঠার তুলনায় এটি নাট্যগুণে অনেক সমৃদ্ধ এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রথম প্রয়োগও হয় এ নাটকে।
মধুসূদনের একেই কি বলে সভ্যতা এবং বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০) সমকালীন বাংলা সাহিত্যের দুখানি শ্রেষ্ঠ প্রহসন। এ দুটির অনন্যতা শুধু রচনাভঙ্গির জন্যই নয়, সমাজচেতনার বিশিষ্টতা ও ব্যাপকতার জন্যও। সংলাপ রচনায় চলিত ভাষাও গ্রাম্য ভাষার সার্থক ব্যবহার এবং ইংরেজি-ফারসিমিশ্রিত সংলাপে তিনি চরিত্রগুলিকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তবে মধুসূদনের শ্রেষ্ঠ নাটক কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১) বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি। প্রাচ্য নাট্যরীতি অগ্রাহ্য করে পাশ্চাত্য অলঙ্কারের নির্দেশ অনুযায়ী কবি কৃষ্ণকুমারীকে বিয়োগান্ত করেন। এ নাটকে স্বাদেশিকতার সুর বেজেছে। নাটকের ঘটনাসংস্থান, চরিত্রচিত্রণ ও সংলাপ রচনায় নাট্যকারের নৈপুণ্য প্রকাশ পেয়েছে।
মধুসূদনের অব্যবহিত পরেই নাট্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন দীনবন্ধু মিত্র। প্রধানত এই দুজনের সাধনার ফলেই বাংলা নাটক প্রাথমিক পর্বের বিভিন্ন রকম দুর্বলতা ও অসঙ্গতি কাটিয়ে ওঠে। তাই বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে মধুসূদন ও দীনবন্ধু অনন্য। দীনবন্ধুর শ্রেষ্ঠ নাটক নীলদর্পণ (১৮৬০)। এর ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। ইংরেজ নীলকররা অতিরিক্ত মুনাফার লোভে কীভাবে বাংলার কৃষকদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছিল, তার মর্মন্তুদ চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এই নাটকে। সেকালের সমাজজীবনে এই নাটকটি গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। নীলচাষ বন্ধে নীলদর্পণের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সমাজসচেতনতা দীনবন্ধু মিত্রের নাটকের বিশিষ্টতা।
অন্যান্য নাট্যকার মধুসূদন-দীনবন্ধুর পরে বাংলা নাটকে যাঁরা বিশেষ অবদান রাখেন তাঁরা হলেন মনোমোহন বসু (১৮৩১-১৯১২), গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১২), রাজকৃষ্ণ রায় (১৮৪৯-১৮৯৪), জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫), দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, গোলাম হোসেন প্রমুখ। মনোমোহন বসুর খ্যাতি অপেরা বা গীতাভিনয় রচনায়। তিনি পৌরাণিক উপাখ্যান অবলম্বনে সঙ্গীতপ্রধান দৃশ্যকাব্য রচনা করেন। এছাড়া তিনি কয়েকটি সামাজিক নাটকও লিখেছেন। রাজকৃষ্ণ রায় ছত্রিশটির মতো ছোট-বড় নাটক রচনা করেন; কিন্তু তাঁর প্রধান কৃতিত্ব মনোমোহন বসুর নাট্যধারাকে পরবর্তী নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত করা। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাংলা নাট্যসাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখেন। তাঁর প্রধান চেষ্টা ছিল ফরাসি ও সংস্কৃত-মারাঠি ভাষার নাটক বাংলায় অনুবাদ করে বাংলা নাটককে সমৃদ্ধ করা। তাই তিনি কোনো বিশিষ্ট ধারা সৃষ্টি করতে না পারলেও তাঁর অনুবাদমূলক নাটকগুলি উল্লেখযোগ্য। তাঁর ইতিহাসাশ্রিত নাটকগুলিও উল্লেখ করার মতো।
প্রথম মুসলমান নাট্যকার গোলাম হোসেনের নাটক হাড়জ্বালানী মুদ্রিত হয় ১৮৬৪ সালে। এটি পূর্ণাঙ্গ নাটক নয়, নাট্যরীতিতে সংলাপের মাধ্যমে অঙ্কিত কয়েকটি সমাজচিত্র। মুসলমান রচিত গদ্য পুস্তকের প্রথম নিদর্শন হিসেবেই প্রধানত এর মূল্যায়ন করা হয়। প্রায় একই সময়ে রচিত আজিমদ্দীর কড়ির মাথায় বুড়োর বিয়ে একটি প্রহসন (২য় সংস্করণ ১৮৬৮)। গদ্যপদ্য মিশ্রিত ভাষায় রচিত প্রহসনটির তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। বাংলার খ্যাতিমান এবং প্রতিষ্ঠিত গদ্যশিল্পী মীর মশাররফ হোসেন একাধিক নাটক রচনা করেন। তাঁর প্রথম নাটক বসন্তকুমারী (১৮৭৩) সংস্কৃত নাটকের আঙ্গিকে রচিত। এ নাটকের সংলাপে কথ্য ভঙ্গির প্রয়োগ চরিত্রগুলিকে বাস্তবানুগ করেছে। তাঁর দ্বিতীয় নাটক জমিদারদর্পণে (১৮৭৩) সে সময়ের জমিদারদের অত্যাচারের কাহিনী চিত্রিত হয়েছে।
এ সময়ে বঙ্গদেশে যে নাট্যান্দোলন ঘটে, নানা কারণে তার শীর্ষে স্থান দেওয়া হয় গিরিশচন্দ্র ঘোষকে। তিনি ছিলেন তখনকার সর্বাপেক্ষা খ্যাতিমান নাট্যব্যক্তিত্ব। অসাধারণ অভিনয় ও নাট্য-পরিচালনার মাধ্যমে তিনি বাংলা নাটকে একটা ঐতিহ্য সৃষ্টি করেন। একের পর এক নাটক পরিবেশনের মাধ্যমে তিনি রঙ্গমঞ্চে প্রাণ সঞ্চার করেন। তিনি এ সত্য আবিষ্কার করেন যে, নাটক শুধু পাঠের জন্য নয়, বরং মঞ্চে অভিনীত হলেই তার সত্য প্রকাশিত হয়। গিরিশ ঘোষ সামাজিক, ঐতিহাসিক এবং পৌরাণিক বিষয় নিয়ে অনেক নাটক রচনা করেন। রঙ্গমঞ্চের প্রয়োজনেই তিনি বাংলা উপন্যাস ও আখ্যানকাব্যের নাট্যরূপ দিতে শুরু করেন। তিনি অনেক মৌলিক নাটকও রচনা করেন।
আধুনিক বাংলা নাটক যাত্রার ঢঙ পরিহার করেছিল, কিন্তু মনোমোহন বসু ও রাজকৃষ্ণ রায়ের চেষ্টায় তা আবার নাটকে স্থান লাভ করে এবং গিরিশচন্দ্র ঘোষ তা নিজের নাটকে গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবহার করেন। তিনি প্রাচীন যাত্রারীতির সঙ্গে ইউরোপীয় নাটকের বহিরঙ্গের সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন। তাঁর সে প্রচেষ্টা সফল না হলেও বাংলা নাটকে এক নতুনত্বের সৃষ্টি করে, যা তখনকার দর্শকচিত্ত আকর্ষণে সমর্থ হয়। গিরিশচন্দ্র পৌরাণিক নাটকের জন্যই সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর নাটকের সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি এবং সমকালে ও পরবর্তী জনমানসে প্রভাব বিস্তারের দিক থেকে সেগুলি গুরুত্বপূর্ণ। গিরিশ ঘোষের সামাজিক নাটকে সমকালীন কলকাতার মধ্যবিত্ত জীবনের ছবি অঙ্কিত হয়েছে।
বাংলায় যথার্থ ঐতিহাসিক নাটক রচনার ধারা প্রবর্তন করেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তিনি সামাজিক ও পরিহাসমূলক নাটক রচনায়ও দক্ষতা দেখিয়েছেন। এর মূলে ছিল তাঁর ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এবং ইউরোপীয় নাট্যসাহিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়। দ্বিজেন্দ্রলাল পৌরাণিক নাটকে আধুনিক মনোভাব নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলালের শ্রেষ্ঠ কীর্তি তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলি। এগুলিতে ইতিহাসের সত্যতা প্রায়ই রক্ষিত হয়েছে। তাঁর মেবার পতন নাটকে জাতীয়তাবাদের ওপরে মানবমৈত্রীর আদর্শ স্থাপিত হয়েছে; আবার মুগল-জীবনের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তাঁর নূরজাহান (১৯০৮) এবং সাজাহান (১৯০৯) নাটকে। দ্বিজেন্দ্রলালের শ্রেষ্ঠ নাটক সাজাহান। এতে সাজাহান চরিত্রে পিতৃত্ব ও সম্রাটত্বের মধ্যে যে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বের চিত্র তিনি এঁকেছেন তা বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ। মঞ্চসাফল্যের দিক থেকেও সাজাহান বাংলা নাট্যমঞ্চের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
এ সময়ের আরও একজন উল্লেখযোগ্য নাট্যকার হলেন ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ (১৮৬৩-১৯২৭)। তিনি প্রায় অর্ধশত নাটক রচনা করে সমকালীন রঙ্গমঞ্চের চাহিদা মেটান। উন্নত নাট্যকলার অভাব সত্ত্বেও তাঁর নাটক যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাঁর নাটকের বিষয়বস্ত্ত ঐতিহাসিক, প্রণয়মূলক ও পৌরাণিক। আরবি-পারসিক লঘুরস ও রোমাঞ্চকর উপাখ্যান অবলম্বনে তিনি যেসব নাটক রচনা করেন, সেসব আনন্দ উপভোগের অকৃত্রিমতায় উত্তরকালেও ছিল প্রীতিপদ। যেমন, তাঁর অন্যতম বিখ্যাত রচনা আলিবাবা (১৮৯৭) সর্বসময়ের জন্য সমাদৃত বিনোদনমূলক একটি গীতিনাট্য। ক্ষীরোদপ্রসাদের কয়েকটি ঐতিহাসিক নাটক মঞ্চে যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছে।
১৮৬০-৭০ দশকে ইংরেজ রাজশক্তি ফরায়েজী, ওহাবী প্রভৃতি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করলে পরবর্তী ২০-২৫ বছর বঙ্গদেশে অনুরূপ আন্দোলন আর দেখা যায় নি। এক সময় খ্রিস্টধর্ম মুসলমানদের ধর্ম ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে। শতাব্দী শেষে এর প্রতিকারে অবতীর্ণ হন মুনশি মেহেরুল্ললাহ (১৮৬১-১৯০৭) এবং তাঁর শিষ্য মুনশি মোহাম্মদ জমিরউদ্দীন (১৮৭০-১৯৩০)। আর এঁদেরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সে যুগের মুসলমান বাঙালিকে সাহিত্যিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে স্বজাতি-অভিমুখী করে তোলে একটি বিশেষ দল ‘সুধাকর’, যার প্রধান ছিলেন মৌলবি মেয়রাজউদ্দীন আহম্মদ, পন্ডিত রেয়াজুদ্দীন আহমদ মাশহাদী, মুনশি শেখ আবদুর রহিম (১৮৫৯-১৯৩১) এবং মুনশি মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ। এঁরা ইসলামি ঐতিহ্য এবং জাতীয় ইতিহাস সম্বন্ধে মুসলমানদের সচেতন করে তোলার জন্য মাতৃভাষা বাংলায় সাহিত্য সৃষ্টি করেন এবং সংবাদপত্রাদির মাধ্যমে ধর্ম ও কৃষ্টিমূলক বিষয়বস্ত্তর প্রচার-প্রসারের জন্য কিছু বইয়ের অনুবাদ প্রকাশ করে সাহিত্যক্ষেত্রে এক পৃথক ধারার সূত্রপাত করেন। তাঁদের প্রথম প্রকাশনা হচ্ছে এসলাম তত্ত্ব। পরে শেখ আবদুর রহিম ও মুনশি মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ সুধাকরনামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন (১৮৮৯)। যদিও সুধাকর-দলের আগেও বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির পথে মুসলমান বাঙালিদের কেউ কেউ অগ্রসর হয়েছিলেন, কিন্তু বাংলায় মুসলমানদের জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা এঁদের আগে আর কেউ করেননি; স্বজাতীয়তাবোধও এমনভাবে বাংলা সাহিত্যে ফুটে ওঠেনি। এক কথায় সুধাকর-দলই মুসলমানদের জাতীয় সাহিত্যের ভিত্তি রচনা করে। এঁদের রচিত সাহিত্যের মূল্য যেমনই হোক, পরিপ্রেক্ষিত বিচারে বাংলা সাহিত্যে তার গুরুত্ব অপরিসীম।
মুনশি মোহাম্মদ মেহেরুল্ললাহর সুপ্ত প্রতিভার জাগরণ ঘটে খ্রিস্টান ধর্মের সঙ্গে প্রবল সংঘর্ষের ফলে। তাঁর নয়টি গ্রন্থের মধ্যে সাহিত্যিক বিচারে মেহেরুল এসলাম উল্লেখ্য এ কারণে যে, পুথির আদর্শে লিখিত এর গোড়াতে রসুলে করিম (স.)-এর নাত (স্ত্ততি) আছে, যা পরবর্তী বহুকাল যাবৎ দরুদশরিফের মতো আবৃত্ত হতো। এর ভাষা অত্যন্ত সহজ ও লালিত্যময়। মুনশি মোহাম্মদ জমিরউদ্দীন প্রথমে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে পাদ্রি জন জমিরউদ্দীন নামে পরিচিত হন। পরে ধর্মবিষয়ক বাদানুবাদে পরাজিত হয়ে তিনি পুনরায় মেহেরুল্ললাহর নিকট ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মুনশি জমিরউদ্দীন নাম নিয়ে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। মূলত ইসলাম প্রচার ও তার সেবাতেই তাঁর লেখনী সক্রিয় ছিল এবং এতেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। শেখ আবদুর রহিম বাংলা ভাষার মাধ্যমে যেভাবে বাঙালি মুসলমানদের ঐতিহ্য সন্ধান এবং মানব সভ্যতায় ইসলামের অবদান তুলে ধরার চেষ্টা করেন, তেমনিভাবে আর কেউ করেননি। তাঁর প্রথম গ্রন্থ হজরত মহাম্মদের জীবনচরিত ও ধর্মনীতি (১৮৮৭) তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তিনি সুধাকর, মিহির, হাফেজ, মোসলেম প্রতিভা, মোসলেম হিতৈষী প্রভৃতি পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। মোহাম্মদী পত্রিকায় তিনি যেসব প্রবন্ধ লেখেন তা থেকে সেকালের মুসলিম বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ছিলেন একাধারে রাজনৈতিক কর্মী, সমাজসেবক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সুবক্তা। তিনি প্রধানত ইতিহাসমূলক রচনার জন্যই খ্যাতি লাভ করেন। ভারতে মুসলমান সভ্যতা তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি। তিনি মিহির ও সুধাকরে লিখে সাহিত্যিক খ্যাতি অর্জন করেন এবং পরে সোলতান ও আমীর পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। মুসলিম জাতির হূতগৌরব ফিরে পাওয়ার চিন্তাই ছিল তাঁর সাহিত্যসাধনার মূল প্রেরণা।
আরো কয়েকজন বিশিষ্ট মুসলমান লেখক হচ্ছেন: দীন মোহাম্মদ গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৫৩-১৯১৬), মুনশি আবদুল লতিফ (১৮৭০-১৯৩৬), শেখ আব্দুল জববার (১৮৮১-১৯১৮), এয়াকুব আলী চৌধুরী (১৮৮৮-১৯৪০), কাজী আকরম হোসেন (১৮৯৬-১৯৬৩) প্রমুখ। বিভাগপূর্ব বাংলার একজন কংগ্রেসভক্ত জাতীয়তাবাদী নেতা হয়েও ইসলাম ও মুসলমানদের সেবায় সাহিত্যচর্চা করে আবদুল লতিফ খ্যাতি অর্জন করেন। ইসলামের ইতিহাস (১৯২৪) গ্রন্থটি রচনা করে সুবিখ্যাত হলেও কাজী আকরম হোসেন সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অবদান রাখেন। এয়াকুব আলী চৌধুরীর মতো পন্ডিত সাহিত্যিক ওই সময়ে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে কমই ছিল। তাঁর দার্শনিক চিন্তাশীলতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মানব মুকুট। এ গ্রন্থে নবী মুহাম্মাদ (সঃ)-এর জীবনী ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাঁর ভাষা হয়ে উঠেছে অপূর্ব ধ্বনিব্যঞ্জনাময়।
রবীন্দ্রপর্ব বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রেই অনন্যসাধারণ অবদান রেখেছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তিনিই বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদায় ভূষিত করেন। তাঁর পরিচয় যদিও ‘বিশ্বকবি’ হিসেবেই, তথাপি এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখকের কৃতিত্ব তাঁরই। তাঁর সৃষ্টিকাল উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে আমৃত্যু (৭ আগস্ট ১৯৪১) বিস্তৃত। বিশ শতকের একটা বড় অংশ জুড়ে তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একচ্ছত্র অধিপতি।
রবীন্দ্রনাথের ভাবানুভূতি ও শিল্পচেতনা বিবর্তনধর্মী। সৃজনশীলতা, নব নব ভাবকল্পনা ও রূপচেতনার দ্বারা তিনি একটি স্বতন্ত্র ধারার সৃষ্টি করেন। তিনি অভূতপূর্ব শিল্পসমৃদ্ধ ও নতুন রূপাঙ্গিকের কাব্য, নাটক, উপন্যাস, ছোটগ্রল্প, প্রবন্ধ এবং দুহাজারেরও অধিক গান রচনা করেছেন। তবে এগুলিই সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁকে মূল্যায়িত করার জন্য যথেষ্ট নয়। সাহিত্য, সমাজ, ধর্ম ও রাজনীতিবিষয়ক তাঁর বিবিধ প্রবন্ধ, সামাজিক ও ধর্মীয় বিশ্লেষক হিসেবে তাঁর অবদান, বিভিন্ন রচনার স্বকৃত ইংরেজি অনুবাদ সব মিলিয়ে প্রাচুর্যে ও বৈচিত্র্যে রবীন্দ্রনাথ একটি পূর্ণ প্রতিষ্ঠানস্বরূপ। তাঁর রচনা পৃথিবীর প্রধান প্রধান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কবি হিসেবে তিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে। রবীন্দ্রযুগ বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধির সেরা যুগ। এ পর্বের সাহিত্যের প্রধান বিশেষত্ব কাব্য-সাহিত্যের নতুন ভাব-ভঙ্গি ও আদর্শ, কথা-সাহিত্যের অসামান্য বিকাশ ও উন্নতি, নাট্যসাহিত্যে আধুনিক ব্যক্তিচৈতন্য, সমাজবোধ ও অধ্যাত্মবোধের প্রকাশ, পাশ্চাত্য সাহিত্যের আদর্শ স্বীকরণ, চলিত ভাষার প্রভাব, সাময়িকপত্রের প্রকাশ ও তার মাধ্যমে সাহিত্যের দ্রুত উন্নতি এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলার পঠন-পাঠন ও বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনার প্রসার।
এ পর্বের দুজন উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক হচ্ছেন জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭) ও রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪-১৯১৯)। বাংলার খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র Response of the living and the non-living নামে যে গ্রন্থটি লিখে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন, তারই বাংলা রূপ তাঁর অব্যক্ত গ্রন্থ। জড় জগতের মধ্যে যে চেতন সত্তার আবিষ্কার তিনি করেছিলেন, তার বর্ণনায় জগদীশচন্দ্রের কবিদৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ছিল সর্ববিষয়ে অনুসন্ধিৎসু মন। তবে বিজ্ঞানবিষয়ক রচনায়ই তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। বেদ, মহাভারত ও মহাজনচরিতকথাসহ বাংলার মেয়েলি ছড়া পর্যন্ত সকল বিষয়েই তাঁর মনীষার পরিচয় পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রযুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮)। কথাসাহিত্যিক হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। তাঁর সামাজিক উপন্যাসের জনপ্রিয়তা সে যুগের মতো এ যুগেও এমনভাবে বহমান যে, ভারতীয় প্রায় সব ভাষায় সেগুলি অনূদিত, এমনকি চলচ্চিত্র ও মঞ্চনাটকেও রূপান্তরিত হয়েছে। তাঁর রচনায় বাঙালির নিত্যদিনের সুখদুঃখময় জীবনযাত্রা, বাংলার পল্লিলসমাজ এবং সর্বোপরি বাংলার নারীচরিত্র অপরূপ মাধুর্যে ফুটে উঠেছে। সমাজের অন্যায়, অবিচার ও দুর্বলতা তিনি তীক্ষ্ণ ও যুক্তিপূর্ণ ভাষায় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। ভাষায় আবেগ সঞ্চারে এবং বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশে শরৎচন্দ্রের অবদান নজিরবিহীন। সামাজিক সংস্কার ও নীতিবোধের প্রশ্নকেই তিনি তাঁর উপন্যাসের উপজীব্যরূপে তুলে ধরেছেন।
প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬) রবীন্দ্রনাথের বয়ঃকনিষ্ঠ হয়েও গদ্য রচনারীতিতে তাঁকে প্রভাবিত করেন। তাঁর প্রবন্ধ এবং ভাষাভঙ্গি পরবর্তী একটি গোষ্ঠীর ওপর বিশেষ ক্রিয়াশীল ছিল। তাই রবীন্দ্রযুগের লেখক হয়েও বাংলা গদ্যের একটা স্বতন্ত্র ধারা প্রতিষ্ঠার দাবিদার হিসেবে প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষভাবে খ্যাত। বাংলায় কথ্যরীতি তাঁরই হাতে সাহিত্যিক স্বীকৃতি লাভ করে এবং রবীন্দ্রনাথের সমর্থন ও চর্চায় তা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলায় ফরাসি ছোটগল্পের আঙ্গিকরীতিকে তিনিই প্রথম পরিচিত করেন।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৭৩-১৯৩২) অনেকগুলি উপন্যাস লিখলেও তাঁর আসল পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর শতাধিক ছোটগল্পে। তাঁর ছোটগল্পের আঙ্গিকনৈপুণ্য উল্লেখ করার মতো। গল্পের শেষে একটি আকস্মিক চমক তাঁর রচনাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বাংলা গদ্যের কথ্যরীতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে। তাঁর এ রীতির পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনায় এবং শিল্পের সৌন্দর্যতত্ত্বের বর্ণনায়। এ পর্বের আরও উল্লেখযোগ্যরা হলেন নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (হাস্যরসিক), খগেন্দ্রনাথ মিত্র, জগদীশচন্দ্র গুপ্ত, জলধর সেন, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, নিরুপমা দেবী, প্রভাবতী দেবী, সীতা দেবী, শান্তা দেবী, হেমেন্দ্রকুমার রায় প্রমুখ।
রবীন্দ্রবলয়ে বাংলা কবিতা অর্ধশতাব্দীরও অধিককাল যাবৎ রবীন্দ্রযুগের কবিগণ রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তবে কয়েকজন কবি এ প্রভাব অতিক্রম করে স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টিতে সফল হয়েছেন। এমন চারজন প্রধান কবি হলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২), মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) এবং জসীমউদ্দীন (১৯০২-১৯৭৬)। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নতুন নতুন ছন্দ নির্মাণের ক্ষেত্রে অসাধারণ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন; তাই তাঁকে বলা হয় ‘ছন্দের জাদুকর’। শব্দের চমৎকার ব্যবহার এবং ধ্বনির অনুরণন দিয়ে তিনি এক মায়াজাল বিস্তার করতেন। সত্যেন্দ্রনাথ কবিতার অনুবাদের ক্ষেত্রেও প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন।
মোহিতলাল মজুমদার ভাবকল্পনা ও প্রেম সম্পর্কে নবতাৎপর্য আবিষ্কারে এবং রবীন্দ্রোত্তর কাব্যে আধুনিকতার দ্বারোদ্ঘাটনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর দেহবাদী চেতনা অশরীরী প্রেমানুভূতিকে অস্বীকার করেছে। তবে বাগ্ভঙ্গি ও কবিতার দেহগঠনে তাঁর আদর্শ ক্লাসিক। নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথের শান্তস্নিগ্ধ কাব্যপরিমন্ডলে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন। সাহিত্য ও সমাজে তিনি নিয়ে আসেন বিদ্রোহ। যে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মাধ্যমে নজরুলের বাংলা কাব্যক্ষেত্রে আগমন, সে কবিতাই তাঁর স্থায়ী প্রতিষ্ঠার কারণ। বাংলা সাহিত্যে বীররসের কবিতা প্রবর্তনের কৃতিত্ব একা নজরুলের। তাঁর কাব্যের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য সমসাময়িকতা। সাময়িক ঘটনা এবং জীবন বা আবেগকে অবলম্বন করে তাঁর মতো এত প্রচুর আর কেউ লেখেননি। তিনি একই সঙ্গে কবিতা লিখেছেন, প্রচারমূলক প্রবন্ধ লিখেছেন এবং সংবাদপত্রও পরিচালনা করেছেন। তাঁর অগ্নি-বীণা ও বিষের বাঁশি গ্রন্থদুটিতে দুস্থ মানবতার জয় ঘোষণা করতে গিয়ে ইংরেজ রাজশক্তির বিরুদ্ধে যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে, তা তখন এ দেশ ও সমাজ কামনা করেছিল। ১৯৩০-এর পর থেকে নজরুল খ্যাত হয়ে ওঠেন গীতিরচয়িতা ও সুরকার হিসেবে। তাঁর গজল গানগুলি কবিতা হিসেবেও যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। বাংলা গানের জগতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি নজরুলসঙ্গীতও স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত ও বাঙালি সংস্কৃতির শাশ্বত সম্পদ।
জসীমউদ্দীন রবীন্দ্রযুগের হয়েও ভিন্নতর কাব্যচেতনার কারণে স্বাতন্ত্র্য অর্জন করেন। তাঁর কবিতায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্য প্রাধান্য পাওয়ায় তিনি ‘পল্লিকবি’ উপাধিতে ভূষিত হন। অত্যন্ত সফলভাবে তিনি গ্রামজীবন ও গ্রামবাংলার পরিবেশকে কাব্য ও নাটকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেন। বিষয় গ্রামীণ হলেও কাব্যের রূপশিল্পে জসীমউদ্দীন সম্পূর্ণ আধুনিক। রবীন্দ্রযুগের অন্যান্য উল্লেলখযোগ্য কবি হলেন করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন দাশ, অতুলপ্রসাদ সেন, কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, নরেন্দ্র দেব, প্রথমনাথ রায়চৌধুরী, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, মানকুমারী বসু, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, রাধারাণী দেবী, উমাদেবী প্রমুখ।
রবীন্দ্রপর্বের প্রবন্ধসাহিত্য এ পর্বের প্রাবন্ধিকগণ রবীন্দ্রনাথের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। এ সময়ে বিষয়ের গভীরতা এবং ভাষা ও বাচনভঙ্গির সৌকর্যে বেশ কয়েকজন প্রাবন্ধিক সাফল্যের পরিচয় দেন। ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক আলোচনায় প্রবন্ধের ভান্ডার এ সময়ে পূর্ণ হয়ে ওঠে, তবে বিজ্ঞান ও রাজনীতিবিষয়ক প্রবন্ধ-সাহিত্যের অভাব ছিল।
এ পর্বের প্রাবন্ধিকদের মধ্যে প্রথমেই উল্লেলখযোগ্য প্রমথ চৌধুরী। সবুজপত্রকে কেন্দ্র করে তিনি বাংলা গদ্যে নবরীতি প্রবর্তন করেন এবং তাঁর প্রবন্ধাবলিতে প্রমাণ করেন যে, চলিত ভাষায় লঘুগুরু সকল প্রকার ভাব প্রকাশ করা সম্ভব। দর্শন, রাজনীতি, ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে তিনি যে প্রবন্ধগুলি রচনা করেন, সেগুলির সর্বত্রই তাঁর পান্ডিত্যের প্রকাশ ঘটেছে। সাহিত্যসমালোচক হিসেবেও তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রধানত বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ রচনায় খ্যাতি লাভ করলেও শব্দতত্ত্ব ও ব্যাকরণ, সমাজ ও রাজনীতি এবং দর্শনবিষয়ক প্রবন্ধ রচনায়ও তাঁর খ্যাতি আছে। তাঁর দার্শনিক প্রবন্ধগুলি চিন্তার গভীরতায়, যুক্তি, পদ্ধতি ও সিদ্ধান্তের মৌলিকতায় এবং সর্বোপরি ভাষার সরলতায় বাংলা সাহিত্যে অতুলনীয়।
বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭০-১৯০০) সাহিত্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধ রচনায় দক্ষতা দেখিয়েছেন। এ ব্যাপারে তিনি রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রভাবিত হলেও তাঁর মৌলিক অবদানও অনস্বীকার্য। তিনি সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন বৈষ্ণব কবিতার বিচারে। আধ্যাত্মিক তাৎপর্যকে গুরুত্ব না দিয়ে তিনি কেবল সেগুলির সাহিত্যসৌন্দর্যকেই আলোচনার বিষয়ীভূত করেছেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিল্প সম্পর্কে উন্নত মানের তাত্ত্বিক আলোচনায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি তাঁর বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী এবং বাংলার ব্রত গ্রন্থে যে গদ্য ব্যবহার করেছেন তা চলিত ভাষারীতি, চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি এবং কাব্যধর্মের এক বিচিত্র মিশ্রণ হয়ে উঠেছে। বাংলা গদ্যরীতি তাঁর হাতে এক ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে। মোহিতলাল মজুমদার ছিলেন বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের এক উল্লেললখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। মননে ও সাহিত্যে তিনি উচ্চতর আদর্শের পরিচয় দেন। তাই তাঁর বাক্রীতিতে উনিশ শতকীয় গাম্ভীর্য এবং শব্দাড়ম্বর প্রাধান্য পায়। সমালোচনা রীতিতে তিনি কিছুটা বঙ্কিমী হলেও রবীন্দ্রযুগের সৌন্দর্যরুচি তাঁর মধ্যে ছিল। এ যুগের উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকজন প্রাবন্ধিক হলেন দীনেশচন্দ্র সেন, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, শশাঙ্কমোহন সেন প্রমুখ।
রবীন্দ্রপর্বের নাট্যধারা বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য ধারায় রবীন্দ্রপ্রভাব যতটা গভীরতর হয়েছিল, নাটকের ক্ষেত্রে ততটা নয়। সমকালীন এবং অনুজ নাট্যকাররা তাঁর দ্বারা ততটা প্রভাবিত হননি, বরং গিরিশ-দ্বিজেন্দ্রের মঞ্চানুগ ধারাই তখন অধিক প্রচলিত ছিল। রবীন্দ্রনাটক কোন বিদেশী ধারার ব্যর্থ অনুকরণমাত্র না হয়ে এক স্বতন্ত্র সৃষ্টি হয়ে উঠেছিল, কিন্তু যোগ্য উত্তরসূরির অভাবে সে ধারার পরিপুষ্টি হয়নি।
রবীন্দ্রোত্তর পর্ব বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে সংঘটিত প্রথম মহাযুদ্ধ এবং সমাজতান্ত্রিক রুশ বিপ্ললবের প্রভাবে বঙ্গদেশে যে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, তার ফলে বাংলা সাহিত্যের ধারা নতুন দিকে মোড় নেয়। ১৯৩০-এর কাছাকাছি সময় থেকে বাংলা সাহিত্য নবপর্বে প্রবেশ করতে থাকে। এ সময় গল্প, উপন্যাস এবং কবিতার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকজন বড় সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটে। কলকাতায় প্রকাশিত হয় কল্লোল (১৯২৩) নামে একটি পত্রিকা। এর শাখা-পত্রিকা হিসেবে কলকাতায় প্রকাশিত হয় কালিকলম (১৯২৬) এবং ঢাকায় প্রকাশিত হয় প্রগতি (১৯২৭)। এসব পত্রিকার মাধ্যমে উপর্যুক্ত গোষ্ঠীর সাহিত্যচর্চা চলতে থাকে। শনিবারের চিঠিও প্রকারান্তরে তাঁদের উৎসাহ যোগায়। কল্লোল-কালিকলম-প্রগতি গোষ্ঠী মূলত রবীন্দ্র-ঐতিহ্যের সৃষ্টি হলেও পরের দিকে তাঁরা এ প্রভাব অতিক্রম করায় সচেষ্ট হন এবং শরৎচন্দ্র ও নজরুল তাঁদের নিকট প্রাধান্য পান। রবীন্দ্রসাহিত্য ধারার এই ব্যতিক্রমকাল বলা চলে ১৯১৮ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত নজরুলও এ সময়েরই কবি। কল্লোল যুগের ব্যতিক্রমধর্মী লেখকদের মধ্যে আরও খ্যাতিমান ছিলেন বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত প্রমুখ। এঁদের লেখায় বাংলা সাহিত্যে নতুন প্রত্যাশার সঞ্চার হয়।
তিরিশের সাহিত্যধারা উপন্যাস ও ছোটগল্প এ সময় কয়েকজন বড় সাহিত্যিকের আবির্ভাবে বাংলা উপন্যাস ও ছোটগল্প বিচিত্রমুখী হয়ে ওঠে। শ্রমজীবী মানুষের জীবনকাহিনী, সমস্যাসঙ্কুল মানবজীবন, ভারতবর্ষের রাজনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতিকে বিষয় হিসেবে নিয়ে এ পর্বের লেখকরা ছোটগল্পে বৈচিত্র্য আনয়ন করেন। রাজশেখর বসু (১৮৮০-১৯৬০) ছিলেন তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তিনি বাংলা ব্যঙ্গ গল্পধারার প্রধান শিল্পী। তাঁর প্রথম দিকের গল্পগুলি রঙ্গ-ব্যঙ্গ ও সাময়িকের সঙ্গে শাশ্বত জীবনচেতনার সংমিশ্রণে উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছে।
তিরিশের কালে বাংলা উপন্যাসে যাঁরা খ্যাতি অর্জন করেন তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যদের একজন হলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০)। পল্লিপ্রধান বাংলার গার্হস্থ্য জীবন ও পল্লিপ্রকৃতির অপূর্ব কাব্যিক বর্ণনা তাঁর রচনার বিশেষত্ব। প্রকৃতির শান্তস্নিগ্ধ ও মমতাভরা রূপ বর্ণনার মাধ্যমে মানবপ্রকৃতির বিশ্লেষণ তাঁর রচনায় প্রধান হয়ে উঠেছে। তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা পথের পাঁচালী (১৯২৯)।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) তৎকালীন উপন্যাস-সাহিত্যে এক শক্তিধর প্রতিভা। বাংলার পল্লী অঞ্চলের সহজ-সরল কৃষক, মাঝি ও গায়েনের প্রাণের মূল্য তিনি অপরিসীম দরদের সঙ্গে উপলব্ধি করেন। রাঢ়ের রুক্ষভূমির স্পর্শ, শ্রমজীবী মানুষের কাহিনী বর্ণন এবং সুতীব্র আত্মানুসন্ধান তাঁর উপন্যাসকে দুর্লভ শিল্পোৎকর্ষ দিয়েছে। তাঁর গণদেবতা (১৯৪২) ও পঞ্চগ্রাম (১৯৪৪) উপন্যাস দুটিতে পল্লিজীবনের বৈচিত্র্যমন্ডিত কাহিনী মূর্ত হয়ে উঠেছে। তাই বৈচিত্র্য, বিশালতা এবং সামগ্রিকতায় এ দুটিকে বলা হয় পল্লিজীবনের মহাকাব্য। তাঁর গল্পের বিষয়বস্ত্তও পল্লিপ্রধান।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬) বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অন্যতম প্রধান ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর মানবজীবনকে দেখার রীতি একান্ত নিজস্ব। মনোবিশ্লেষণের মাধ্যমে মানবজীবন ও মানবপ্রকৃতির গোপন রহস্য আবিষ্কার তাঁর রচনার আদর্শ। পুতুল নাচের ইতিকথা (১৯৩৬) ও পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬) তাঁর সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য দুটি রচনা। এতে তাঁর মানসবৈশিষ্ট্য সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তাঁর উত্তরজীবনের রচনায় মার্কসবাদী মতাদর্শ এবং দলীয় মতের তীব্র সমর্থন দেখা যায়। প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৮) প্রথম শ্রেণির ছোটগল্পকার ছিলেন। মিতভাষণ, বক্তব্যের সূক্ষ্মতা এবং চরিত্র সৃষ্টিতে তিনি পারদর্শী ছিলেন। মানুষের জীবনসংগ্রাম থেকে শুরু করে রাজনীতি, সমাজনীতি সবই তাঁর সাহিত্যে স্থান পেয়েছে।
এ যুগের শক্তিমান কথা-সাহিত্যিকদের আরও কয়েকজন হলেন জগদীশ গুপ্ত, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৬-১৯৮৭), বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭৯), প্রমথনাথ বিশী (১৯০১-৮৫), মনোজ বসু (১৯০১-১৯৮৭), গোপাল হালদার (জ. ১৯০২), অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৩-১৯৭৬), অন্নদাশঙ্কর রায় (জ. ১৯০৪), প্রবোধকুমার সান্যাল (১৯০৫-১৯৮৩), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), সুবোধ ঘোষ (১৯০৯-১৯৮০), গজেন্দ্রকুমার মিত্র (জ. ১৯০৯), বিমল মিত্র (জ. ১৯১২), নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (১৯১৮-১৯৭০), মতি নন্দী (জ. ১৯৩১), শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় (১৯৩৩-২০০১), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (জ. ১৯৩৪), শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় (জ. ১৯৩৫) প্রমুখ।
কাব্যসাহিত্য প্রথম মহাযুদ্ধের পর ইউরোপীয় সমাজজীবনে যে ভাঙন ধরেছিল, ইংরেজি সাহিত্যের মাধ্যমে তার সর্বব্যাপী প্রভাব পড়েছিল বাঙালি কবিদের ওপরও। তাঁরা তখন বাংলা কবিতায় সৌন্দর্য, প্রেম ও আনন্দ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রভাবনাকে অস্বীকার করে পল্লিজীবনের চেয়ে নাগরিক জীবনকে বেশি প্রাধান্য দেন। এ সময়ের কাব্যসাহিত্যে অতি আধুনিকতা প্রবর্তনের প্রয়াসে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সে সঙ্গে জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০), বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২) এবং সমর সেনের (জ. ১৯১৬) নামও উল্লেখযোগ্য। জীবনানন্দ দাশ এ পর্বের সবচেয়ে শক্তিমান কবি। কবিতার প্রকাশভঙ্গিতে তিনি বুদ্ধি ও বোধের দ্বারা তাড়িত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাই তাঁর কবিতায় হূদয়ের সামগ্রিক আবেদন চিরকালীন। তাঁর কবিতাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘চিত্ররূপময়’, কারণ তা পাঠকদৃষ্টিতে ছবির মতো ভেসে ওঠে। তিনি প্রধানত প্রকৃতির কবি; উপমা প্রয়োগের অভিনবত্ব তাঁর কাব্যের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন একজন প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, দর্শনমনস্ক ও বুদ্ধিনির্ভর কবি। তাঁর বাক্রীতির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। ভাবে ও ভাষায় তাঁর কবিতা দুরূহ। অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহার তাঁর ভাষাকে করেছে জটিল। কিন্তু এই জটিলতা বাইরে থেকে আরোপিত একটা ফ্যাশনমাত্র নয়, কবির জীবনদৃষ্টিতেই নিহিত এই জটিলতার মূল। একদিকে ব্যক্তিগত প্রেমানুভূতি, অন্যদিকে বিশ্ববোধ, ইতিহাস ও সমাজচেতনা তাঁকে বিষণ্ণ-বেদনায় আহত করেছে প্রতিনিয়ত। এই যন্ত্রণাক্ষুব্ধ চিত্তই জটিল ভাষা ও দুরূহ শব্দে আত্মপ্রকাশ করেছে তাঁর কবিতায়। মার্কসীয় সমাজাদর্শ-ভাবুক বিষ্ণু দের কবিতা শব্দবিন্যাস, মিথ প্রযুক্তি ও ছন্দকৌশলের নতুনত্বের কারণে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। সমর সেন নগরজীবনের পরিবেশকে কবিতার উপজীব্য করেছেন; তবে তাঁর কাব্যে মার্কসীয় ভাবধারার পাশাপাশি রোম্যান্টিক চেতনা ও সাঁওতাল পরগনার শান্ত পরিবেশের মাধুর্যও রয়েছে।
বুদ্ধদেব বসু ছিলেন রবীন্দ্রধারার ব্যতিক্রমী কবিদের প্রথম সারির একজন। আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি সচেতন ছিলেন। তাঁর কবিতার দেহ অতিমার্জিত এবং দুর্বোধ্যতা ও বাচনবক্রতা থেকে অনেকটাই মুক্ত। দেহকামনার রক্তরাগ সঞ্চারিত হয়েছে তাঁর প্রেমের কবিতায়। তাঁর বেশি বয়সের কবিতা থেকে বোঝা যায় যে, অন্তরের গভীরে তিনি ছিলেন মূলত রোম্যান্টিক কবি।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা ভাবের দিক থেকে বিদ্রোহের এবং নিপীড়িত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য এক নতুন উপলব্ধি। তাতে যতটা আছে উচ্চকণ্ঠ আত্মঘোষণা, ততটা নেই জীবনজিজ্ঞাসার তীব্রতা ও গভীর আকুতি। তবে তাঁর কবিতায় মানবের আদি ও অকৃত্রিম জীবনপ্রবৃত্তির স্বীকৃতি রয়েছে। গভীর মানবতাবোধ প্রকাশের জন্য তাঁর কবিতা হয়েছে আবেদনময়ী। অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৬), সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬-১৯৪৭), অজিত দত্ত, অরুণ মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ এ যুগের আরও কয়েকজন উল্লেখযোগ্য কবি।
নাট্যসাহিত্য কাব্য ও কথাসাহিত্যের মতো এ পর্বের নাট্যসাহিত্যে আধুনিকতার প্রকাশ ততটা উল্লেখযোগ্য নয়। তখনও পর্যন্ত মোটামুটিভাবে গিরিশ-দ্বিজেন্দ্রলালের ধারাই অনুসৃত হয়েছে। তবে মঞ্চব্যবস্থার আধুনিকায়ন, নাট্যাঙ্গিকের পরিবর্তন, শিক্ষিত অপেশাদার নাট্যশিল্পীদের আগমন, নতুন ধরনের নাটক রচনা ইত্যাদি কারণে নাট্যসাহিত্যে রুচির পরিবর্তন ঘটেছে। এ পর্যায়ে যোগেশচন্দ্র চৌধুরী (১৮৮৬-১৯৪১), শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত (১৮৯২-১৯৬১), তুলসী লাহিড়ী (১৮৯৭-১৯৫৯), মন্মথ রায় (১৮৯৯-১৯৮৮), প্রথমনাথ বিশী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
প্রবন্ধসাহিত্য এ পর্বে বিষয়সমৃদ্ধ প্রবন্ধে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৮৯০-১৯৭৭), সুশীলকুমার দে (১৮৯০-১৯৬৮), রাজশেখর বসু, নীহাররঞ্জন রায় (১৯০৩-১৯৮১), সুকুমার সেন; সমালোচনায় শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯২-১৯৭০), শশিভূষণ দাশগুপ্ত (১৯১১-১৯৬৪), প্রথমনাথ বিশী এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অতুলচন্দ্র গুপ্ত (১৮৮৪-১৯৬১), অন্নদাশঙ্কর রায়, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৬১) প্রমুখ উল্লেলখযোগ্য। সৃজনধর্মী প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৪-১৯৭৪), হুমায়ুন কবির (১৯০৬-১৯৬৯), আবু সয়ীদ আইয়ুব (১৯০৬-১৯৮২) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের অধিকারী।
মুসলিম মানস উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত মুসলমান বাঙালিদের সাহিত্য-সাধনায় সমাজসংস্কারের চিন্তা-ভাবনা, জাতীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাই প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয়। মুসলিম মানসের এই আকাঙ্ক্ষা পরবর্তী পর্যায়ের মুসলিম সাহিত্যসেবীদের স্বতন্ত্র ও নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। এ পর্যায়ের কাব্য ও কথাসাহিত্যে সমাজ ও জীবনের পরিচয় ফুটে ওঠে; আর চিন্তা-চেতনা ও যুক্তিনির্ভর অভিব্যক্তি ঘটে প্রবন্ধসাহিত্যে। মুসলিম মানসে যুক্তিবাদী মননচর্চার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা তিরিশের কালে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজএর প্রতিষ্ঠা। এই সমাজের মুখপত্র শিখা পত্রিকার নামে পরিচিত ‘শিখাগোষ্ঠী’ বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন করে সাহিত্য-ভাবনার সম্পূর্ণ নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি করে। শিখাগোষ্ঠীর প্রাণপুরুষ ছিলেন আবুল হুসেন (১৮৯৬-১৯৩৮) এবং প্রধান লেখক কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০)।
ভারত বিভাগের পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এবং তারও অনেক পরে স্বাধীন বাংলাদেশে যে স্বতন্ত্র সাহিত্যধারা গড়ে ওঠে, তার প্রাক্প্রস্ত্ততি হিসেবে যাঁদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তাঁদের একজন হলেন মোহাম্মদ নজিবর রহমান (১৮৬০-১৯২৩)। তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস আনোয়ারায় (১৯১২) তৎকালীন মুসলিম বাঙালি পরিবারের আদর্শ চিত্রায়িত হয়েছে। এটি বহুকাল বাংলার মুসলমানদের ঘরে-ঘরে পঠিত হয়েছে। তাঁর অন্যান্য রচনাও জীবনঘনিষ্ঠ। সাহিত্যে অবদানের জন্য নজিবর রহমান ‘সাহিত্যরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত হন। একরামুদ্দীন আহমদ (১৮৭২-১৯৪০) ছিলেন এ যুগের শক্তিমান লেখকদের অন্যতম। সমালোচক, ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার হলেও তিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন তাঁর রবীন্দ্র-প্রতিভা গন্থের (১৯২৬) জন্য। এর মাধ্যমে তিনি সর্বপ্রথম রবীন্দ্রনাথকে মুসলমান সমাজে পরিচিত করান। বাংলার মুসলমান নারীদের শিক্ষা ও প্রগতির অগ্রদূত এবং সমাজ সংস্কারকরূপে খ্যাত বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২) ছিলেন একজন প্রথম শ্রেণির সাহিত্যিক। তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ ও কবিতা রচনায় অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন। নারীর দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে প্রাঞ্জল ও মর্মস্পর্শী ভাষায় রচিত তাঁর অবরোধবাসিনী (১৯২৮) এক অসাধারণ রচনা। কাজী ইমদাদুল হক (১৮৮২-১৯২৬) প্রসিদ্ধি অর্জন করেন তাঁর আবদুল্লাহ (১৯৩২) উপন্যাসের জন্য। পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে যে নবজীবন সঞ্চারিত হয় তা এতে চিত্রিত হয়েছে। শাহাদাৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫৩) একজন নিরহঙ্কার সাহিত্যসাধক ও কবি হিসেবে খ্যাত। রূপছন্দা (১৯৪৩) তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্য। গোলাম মোস্তফার (১৮৯৭-১৯৬৪) সাহিত্যচর্চার ব্যাপ্তি বিভাগপূর্ব কাল থেকে পূর্ব পাকিস্তান পর্যায়েও বিস্তৃত। বাংলা সাহিত্যে ইসলামি ভাবধারার রূপায়ণ ছিল তাঁর সাহিত্যসাধনার প্রধান লক্ষ্য। রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ এবং পরবর্তীকালে নজরুলের দ্বারা প্রভাবিত হয়েও তিনি তাঁর মৌলিকত্ব বজায় রাখেন। গোলাম মোস্তফার সেরা রচনা বিশ্বনবী (১৯৪২) রসুলুল্লাহ্ (সঃ)-র শ্রেষ্ঠ জীবনী গ্রন্থগুলির অন্যতম। এ গ্রন্থে তাঁর গদ্যবৈশিষ্ট্য চূড়ান্তরূপ লাভ করেছে।
এ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকজন হলেন মোহাম্মদ আকরাম খাঁ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (১৮৮৫-১৯৬৯), মোহাম্মদ লুৎফর রহমান (১৮৮৯-১৯৩৬), এস ওয়াজেদ আলী (১৮৯০-১৯৫১), ইব্রাহীম খাঁ (১৮৯৪-১৯৭৮), নুরুন্নিসা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী (১৮৯৪-১৯৭৫), শেখ মুহম্মদ ইদরিস আলী (১৮৯৫-১৯৪৫), আকবরউদ্দীন (১৮৯৫-১৯৭৯), আবুল কালাম শামসুদ্দীন (১৮৯৭-১৯৭৮), কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১), মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ্ (১৮৯৮-১৯৭৪), আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯), বেনজীর আহমদ (১৯০৩-১৯৮৩), আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩), মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯০৩-১৯৫৬), মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন (১৯০৪-১৯৮৭), আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪), বন্দে আলী মিয়া (১৯০৬-১৯৭৯), মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা (১৯০৬-১৯৭৭), হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী (১৯০৬-১৯৬৬), মাহবুবউল আলম (১৯০৬-১৯৮২), মুহম্মদ এনামুল হক (১৯০৬-১৯৮২), সুফী মোতাহার হোসেন (১৯০৭-১৯৭৫), বেগম সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯), রওশন ইজদানী (১৯১৭-১৯৬৭) প্রমুখ।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং পাশাপাশি পাকিস্তান আন্দোলন বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীকে দুটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রভাবিত করে। পুরানো ঐতিহ্য ও প্রথায় বিশ্বস্ত থেকেও এ পর্বের কবি-সাহিত্যিকগণ নতুন রাষ্ট্রের (১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের ফলে) পরিবর্তিত সমাজ ও জীবন-ভাবনায় উজ্জীবিত হন। তাই হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের প্রাচীন ও নবীন সাহিত্যিকদের মধ্যে জীবন ও জগৎ এবং সমাজ ও পরিবেশের নব মূল্যায়নের প্রয়াস লক্ষ করা যায়। সাহিত্যিকগণ নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি, তার নতুন সমাজব্যবস্থা এবং জীবনের নবচেতনায় উদ্দীপিত হন। এর ফলে বাংলা সাহিত্যও দুটি ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়। [মহাম্মদ দানীউল হক]
Discussion about this post