যার রঙ-তুলির ছোঁয়াতে বিশ্বের কাছে পরিচিতি পেয়েছে বাংলার শিল্প, যার হাত ধরেই ঘটে বাংলার চিত্রশিল্পের জাগরণ, বাঙালির রুচির দুর্ভিক্ষ দূর করে জাগ্রত করেন জাতির শিল্পবোধ। তাঁরই মেধা-মননের গুণে শিল্পী থেকে শিল্পাচার্য তিনি। তিনি অন্য কেউ নন আমাদেরই জয়নুল আবেদিন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।
ছেলেবেলা থেকেই শিল্পকলার প্রতি ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ। মাত্র ষোল বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে বন্ধুদের সাথে অনেক দূরের শহর কলকাতায় গিয়েছিলেন কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টস দেখার জন্য। সেখান থেকে ঘুরে আসার পর সাধারণ পড়াশুনায় মন বসাতে পারেননি কোনভাবেই। তাই ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই স্কুলের সাধারণ পড়ালেখার পাট চুকিয়ে কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টস-এ ভর্তি হন। তাঁর মা ছেলের এই আগ্রহ দেখে নিজের গলার হার বিক্রি করে ছেলেকে কলকাতার এই আর্ট স্কুলে পড়তে যেতে সাহায্য করেছেন। আর ছেলেও মায়ের এই ঋণ শোধ করেছেন দেশের সুনামধন্য শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
১৯১৪ সালের ২৯শে ডিসেম্বর বর্তমান বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন জয়নুল আবেদিন। বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ এবং মা জয়নাবুন্নেছা। বাবা ছিলেন পুলিশের সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর। জয়নুল আবেদিন ছিলেন নয় ভাইবোনের মধ্যে পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান এবং জ্যেষ্ঠ পুত্র। ব্রহ্মপুত্র নদের প্লাবন অববাহিকার অত্যন্ত শান্ত, সুনিবিড় ও রোমান্টিক পরিবেশে তিনি বেড়ে উঠেছেন। তাঁর শৈশব এবং তারুণ্যের প্রধানতম অর্জন ছিল এই প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের অভিজ্ঞতা। পড়াশোনার হাতেখড়ি পরিবারের কাছ থেকেই। খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি ছবি আঁকাতেন। পাখির বাসা, পাখি, মাছ, গরু-ছাগল, ফুল-ফলসহ আরও কত কি এঁকে মা-বাবাকে দেখাতেন। তাঁর শৈল্পিক মানসিকতা নির্মাণে প্রকৃতির প্রভাব ছিল অসামান্য ও সুদূরপ্রসারী।
জয়নুল আবেদিন ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে পড়েন। ১৯৩৮ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৩৮ সালেই নিখিল ভারত চিত্র প্রদর্শনীতে গভর্নরের স্বর্ণপদক লাভ করেন তিনি। এ পুরস্কার ছিল ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদ নিয়ে আঁকা তাঁর একগুচ্ছ জলরং ছবির জন্যে।
কর্মজীবন
১৯৩৮ সালে শেষ বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টসের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলে জয়নুল পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন। তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে তাঁর চাকরিটি ছেড়ে ঢাকার আরমানিটোলায় অবস্থিত নর্মাল স্কুলে আর্ট শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু তখন থেকেই তিনি এদেশে শিল্প আন্দোলন শুরুর গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকাতে প্রদেশের প্রথম আর্ট স্কুল, গভর্নমেন্ট ইন্সটিটিউট অফ আর্টস প্রতিষ্ঠার যাবতীয় পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন তিনি। তখনকার সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাঁর এই উদ্যোগটি ছিল রীতিমতো বিপ্লবাক্তক ঘটনা। পুরান ঢাকার জনসন রোডের ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের একটি জীর্ণ বাড়িতে মাত্র ১৮ জন ছাত্র নিয়ে গভর্নমেন্ট ইন্সটিটিউট অফ আর্টস এর যাত্রা শুরু হয়।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ছিলেন এ প্রতিষ্ঠান এর প্রথম শিক্ষক। ১৯৫১ সালে এটি সেগুনবাগিচার একটি বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫৬ সালে গভর্নমেন্ট ইন্সটিটিউট অফ আর্টস শাহবাগে স্থানান্তর করার পর ১৯৬৩ সালে এটি একটি প্রথম শ্রেণীর সরকারী কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তখন এর নামকরণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় নামে এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় নামে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ১৯৪৯-১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালের ১লা সেপ্টেম্বর এই সরকারী কলেজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তরভুক্ত হয়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সোনার গাঁয়ে লোকশিল্প যাদুঘর ও মায়মনসিংহ জয়নুল সংগ্রহশালাও গড়ে তোলেন।
দুর্ভিক্ষ ও জয়নুল
১৯৪৩-এর বাংলার দুর্ভিক্ষ জয়নুল আবেদিনকে একেবারে বদলে দেয়। গ্রাম-বাংলার রোমান্টিক নিসর্গ শিল্পীকে রূপান্তরিত করে ফেলে এক দুর্দান্ত বিদ্রোহী ব্যক্তিত্বে। তারপর থেকে সারাটি জীবনই বিক্ষুব্ধ থেকে গেছেন তিনি। দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়ার পরপরই জয়নুল তাঁদের ময়মনসিংহের বাড়িতে ফিরে যান। সেখানেও দুর্ভিক্ষের যে মর্মান্তিক দৃশ্যাবলি দেখতে পান তাতে তিনি ভীষণভাবে ব্যথিত হন। আবার ফিরে আসেন কলকাতায়। কিন্তু দুর্ভিক্ষপীড়িত দুস্থ মানবতা যেন সে যাত্রায় তাঁর সঙ্গী হয়ে আসে। তেতাল্লিশের কলকাতা মহানগরে ঘটেছে মানবতার চরম অবমাননা। ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট থেকে খাদ্যান্বেষণে তীব্র প্রতিযোগিতা চলেছে মানুষ আর কুকুরের মধ্যে। ঊনত্রিশ বছর বয়স্ক জয়নুল এ রকম অমানবিক দৃশ্যে প্রচণ্ডভাবে মর্মাহত হন, আতঙ্কে শিউরে ওঠেন, আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। কিন্তু সে আবেগকে তিনি কাজে লাগান সেসব দৃশ্যাবলির শিল্পরূপ দিতে। অন্যভাবে বলা যায় সেই আবেগই তাঁকে তাড়িত করে, বাধ্য করে অমানবিক পরিস্থিতির এক মানবিক নির্মাণে। তিনি রাতদিন শুধু কলকাতার দুর্ভিক্ষের সেসব নারকীয় দৃশ্যাবলির স্কেচ করতে থাকেন।
দুর্ভিক্ষের বাজারে উন্নতমানের শিল্পসামগ্রী তখন যেমন ছিল দুর্লভ তেমনি দুর্মূল্য। তিনি তখন আর্ট স্কুলের একজন শিক্ষক,আয়ও সামান্য। সে কারণে তিনি বেছে নেন শুধু কালো কালি আর তুলি। শুকনো তুলিতে কালো চীনা কালির টানে স্কেচ করতে থাকেন অতি সাধারণ সস্তা কাগজের ওপর। ব্যবহার করেছেন কার্টিজ পেপার। এসব কাগজ ছিল ঈষত্ পীত বর্ণের। এমনকি তিনি প্যাকেজিং কাগজও ব্যবহার করেছেন। সাধারণ স্বল্পমূল্যের এসব অঙ্কন সামগ্রী ব্যবহার করে তিনি যে শিল্প সৃষ্টি করলেন তাই পরিণত হলো অমূল্য সম্পদে। এমন এক অসাধারণ শক্তিশালী অঙ্কন শৈলীর মাধ্যমে তিনি দুর্ভিক্ষের করুণ বাস্তব দৃশ্যাবলি চিত্রায়িত করলেন, যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত উপমহাদেশের চিত্র ঐতিহ্যে ছিল না। জয়নুলের দুর্ভিক্ষের স্কেচগুলো দেখার পর ‘ভারতের নাইটিঙ্গেল’ শ্রীমতি সরোজিনি নাইডু মন্তব্য করেছিলেন, “সব চাইতে মর্মস্পর্শী ও আবেগময় বর্ণনার চাইতেও তাঁর এসব ছবির আবেদন অধিকতর।” ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে সে বছরই কলকাতায় যে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল তাতে জয়নুল তাঁর দুর্ভিক্ষ নিয়ে অংশগ্রহণ করেন।
স্থানীয় শিল্প-ঐতিহ্যের সাথে পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন
১৯৫১-৫২তে জয়নুল আবেদিন সরকারি বৃত্তি নিয়ে এক বছরের জন্যে ইংল্যান্ডে যান। সেখানে অবস্থানকালে তিনি বিভিন্ন চারুকলা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। তিনি সেখানে তাঁর নিজের শিল্পকর্মের প্রদর্শনীও করেন। তাঁর কাজ ইংল্যান্ডের বিদগ্ধজনের অকুন্ঠ প্রশংসা অর্জন করে। তাঁর এই ইংল্যান্ড ভ্রমণটি শুধুমাত্র যে তাঁকে পাশ্চাত্য জগতে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তাই নয়, এতে করে তাঁর দৃষ্টি আরো প্রসারিত হয় এবং সম্ভবত এর মাধ্যমেই বাংলাদেশের চারুকলা চর্চা শুরু থেকেই এক প্রাণবন্ত আধুনিকতার চরিত্র গ্রহণ করতে পেরেছিল। আবেদিনের এই ইউরোপ ভ্রমণ তাঁকে বাংলার সমৃদ্ধ লোকশিল্পের মর্যাদা ও গুরুত্ব সম্পর্কেও বিশেষভাবে সচেতন করে তোলে।
১৯৫২ সালে ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এসে তিনি এদেশের স্থানীয় শিল্প-ঐতিহ্যের সাথে পাশ্চাত্যের আধুনিক শিল্প-আন্দোলন ও কৌশলাদির সমন্বয় সাধনে কাজ শুরু করেন। ইতিমধ্যে তিনি নানান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। তিনি তখন থেকেই চিত্রকলায় এক ধরনের আধুনিক বাঙালিত্ব ফুটিয়ে তোলার পক্ষে সুস্পষ্ট ও জোরালো মত ব্যক্ত করতে থাকেন। তাঁর এই মানসিকতা তাঁর নিজের কাজের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৫১ সালে এবং এর অব্যবহিত পরে আঁকা তাঁর ছবিতে একটি অসাধারণ আঙ্গিকের পরিচয় পাওয়া যায়। এই আঙ্গিকের প্রাথমিক পর্যায়ে দেখা যায়, জয়নুল গ্রাম বাংলার অতি সাধারণ প্রাত্যহিক অথচ অত্যন্ত প্রতীকী গুরুত্বসম্পন্ন দৃশ্যাবলি এঁকেছেন। ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার সেই তুলির বলিষ্ঠতা ও সাবলীলতা আবার প্রাণ পেয়েছে এ সময়ের কাজে। অধিকাংশ কাজ জলরঙ বা সোয়াশে করা। ব্যবহৃত জলরঙের বৈশিষ্ট্য হালকা এবং অনুজ্জ্বল, তুলির টান এবং কম্পোজিশন বা স্পেস ব্যবহার অত্যন্ত প্রাচ্যধর্মী। অন্যদিকে বিষয় উপস্থাপনা ও ড্রইং পাশ্চাত্য-বাস্তবধর্মী। এভাবে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের এক অপরূপ সমন্বয় ঘটেছে তাঁর শিল্পকর্মে।
‘৫২-৫৩-তে জয়নুল গড়ে তোলেন এক চমত্কার নতুন ঢঙ, যাকে আধুনিক বাঙালি ঢঙ বলা চলে। এই ঢঙের কাজের সাথে যামিনী রায়ের ছবির ঢঙের সামঞ্জস্য দেখা যায়। জয়নুলের এই ঢঙের কাজে বাংলার লোকশিল্পের নানা মটিভ এবং রং বিন্যাসের প্রভাবও লক্ষণীয়। তাঁর এ সময়ের কাজগুলোকে রোমান্টিক মেজাজের বলে চিহ্নিত করা যায়। অধিকাংশ ছবি মহিলাদের জীবনযাপন নিয়ে, এসব ছবিতে পল্লী-রমণীগণ নদীর ঘাটে যাচ্ছে জল আনতে বা স্নান করতে। অনাবিল প্রশান্তিতে প্রসাধানে নিযুক্ত, একক, যুগল কিংবা ত্রয়ী মহিলার চিত্র। মা ও শিশুও রয়েছে। গ্রামীণ কর্মী পুরুষের জীবনও ধরা পড়েছে এই সময়কার কাজে। একটি গোটা সিরিজ গড়ে উঠেছে এসব ছবি নিয়ে। এগুলোর মধ্যে কিছু স্মরণীয় কাজ হলো ‘নৌকোর গুণটানা’, ‘পল্লী-রমণী’, ‘আয়না নিয়ে বধূ’, ‘একাকী বনে’, ‘পাইন্যার মা’, ‘মা ও শিশু’, ‘তিন পল্লী রমণী’, ‘মুখ চতুষ্টয়’ ইত্যাদি।
মুক্তিকামী জয়নুল
জয়নুল আবেদিন ছিলেন মুক্তিকামী মানুষ। স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্যে যাঁরা সংগ্রাম করেন তাঁদের সবার সাথেই একাত্মতা জানাতে উত্সাহী ছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালে যখন তাঁর বয়স প্রায় ৫৬, তিনি আরব লীগের আমন্ত্রণে ছুটে যান মধ্যপ্রাচ্যের সমর ক্ষেত্রে। আল-ফাতাহ গেরিলাদের সাথে চলে যান যুদ্ধফ্রন্টে। সেখানে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি আঁকেন, তাঁর সেসব ছবির প্রদর্শনী হয় একাধিক আরব দেশে। মুক্তিযোদ্ধারা তাতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। সেখান থেকে দেশে ফিরতে না ফিরতে এক প্রলয়ঙ্করী ঝড় আঘাত হানে জয়নুলের নিজের দেশের উপকূলীয় এলাকায়। তিন লক্ষাধিক মানুষ এই ঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারায়। প্রচণ্ড মানসিক ধাক্কা খান জয়নুল আবেদিন। কিন্তু বসে না থেকে একটি রিলিফ টিমের সাথে ছুটে যান দুর্যোগাক্রান্ত এলাকায়। দুঃখী জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। পরে তিনি সেখানকার মর্মস্পর্শী দৃশ্যাবলির কিছু কিছু তুলে ধরেন তাঁর তুলিতে, কালিতে।
সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত সেরে উঠতে না উঠতেই শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। নিজ দেশে বন্দি জীবন কাটাতে বাধ্য হলেন জয়নুল। পালিয়ে পালিয়ে বেড়ালেন কিন্তু সর্বক্ষণই তাঁর দুর্ভিক্ষের সময় আঁকা চিত্রমালা আঁকড়ে ধরে রাখলেন। মুক্তিযুদ্ধ জয়নুলের মনে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিজয় অর্জনের পর পরই তিনি পূর্ণোদ্যমে লেগে যান শিল্পচর্চা সংগঠনের কাজে। এবারে লোকশিল্প তাঁর কাছে প্রাধান্য পেতে থাকে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমানের সরকার জয়নুল আবেদিনকে দায়িত্ব দেন বাংলাদেশের সংবিধানটির অঙ্গসজ্জার জন্যে। তিনি প্রবল উত্সাহের সাথে কাজটি সমাধা করেন। তাঁকে সাহায্য সহযোগিতা করেন আরো কয়েকজন শিল্পী।
ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা
বাংলাদেশের সংবিধানটির অঙ্গসজ্জার পর তিনি ছুটলেন তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্ন ‘লোকশিল্প জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠার কাজে। জয়নুল আবেদিনের ঐকান্তিক প্রচেস্টায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে লোকশিল্প জাদুঘর স্থাপিত হয়। তাঁর ইচ্ছে ছিল এই জাদুঘরে সংরক্ষিত হবে দেশের মূল্যবান লোকশিল্প। ভবিষ্যত্ প্রজন্ম এখান থেকেই প্রেরণা পাবে।
জয়নুল তাঁর নিজের ছবি সংগ্রহের জন্য একটি সংগ্রহশালা নির্মাণের পরিকল্পনা করেন এবং এই সংগ্রহশালাটির জন্য স্থান নির্বাচন করেন ময়মনসিংহে তাঁর অতি প্রিয় ব্রহ্মপুত্র নদের তীরের একটি পুরাতন ভবনে। ১৯৭৫ সালে ময়মনসিংহে জয়নুল আবেদিন এই সংগ্রহশালাটি প্রতিষ্ঠা করেন।
পরিবার
জয়নুল আবেদিন তার পরিবারের ঋণের কথা ভোলেননি কখনও। তিনি যখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তখন থেকেই তিনি পত্র-পত্রিকার অঙ্গসজ্জা করে যে সামান্য আয় করতেন তা দিয়েই তাঁর পিতার অস্বচ্ছল পরিবারে আর্থিক অবদান রেখেছেন। তাঁর মাকে দিয়েছেন ভালোবাসা। তাঁর জন্মস্থান ময়মনসিংহকে উপহার দিয়েছেন একটি আর্ট গ্যালারি আর বাংলাদেশের জনগণকে দিয়েছেন তাঁর সারা জীবনের শিল্পকর্মের বৃহত্ সম্ভার।
১৯৪৬ সালে জয়নুল আবেদিন জাহানারা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জয়নুল আবেদিন তিন পুত্রের জনক। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র সাইফুল আবেদিন (টুটুল) স্থপতি। দ্বিতীয় পুত্র খায়রুল আবেদিন (টুকুন), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল বিষয়ে এম.এ এবং কনিষ্ঠ পুত্র মঈনুল আবেদিন (মিতু) প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পানি-সম্পদ প্রকৌশল বিদ্যায় স্নাতক।
স্বীকৃতি
জয়নুল আবেদিন অসাধারণ শিল্প-প্রতিভা এবং তাঁর মহত্ মানবিক গুণাবলির জন্যে তিনি দেশে ও বিদেশে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, সরকার এবং জনগণের কাছ থেকে পেয়েছেন সম্মান। রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে তিনি অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। বাংলাদেশে চারুকলার উন্নয়নে জয়নুল আবেদিন তাঁর অবদানের যথার্থ স্বীকৃতি পেয়েছেন ‘শিল্পাচার্য’ সম্বোধনে। এ শিরোপা তাঁকে উপহার দিয়েছে তাঁরই দেশের গুণমুগ্ধ ও কৃতজ্ঞ জনগণ।
মৃত্যু
দীর্ঘ ছ’মাস ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগে ১৯৭৬ সালের ২৮ মে তিনি মাত্র ৬২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি আঁকার কাজ অব্যাহত রাখেন। তাঁর মৃত্যুর মাত্র ক’দিন আগে হাসপাতালে শুয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব ঢঙে শেষ ছবিটি আঁকেন- দুটো মুখ। বলিষ্ঠ মোটা রেখায়, কালো কালি আর মোম ব্যবহার করে।
জয়নুল আবেদিনের জন্ম হয়েছিল সাধারণ পরিবারে। তিনি জীবনযাপনও করেছেন সাধারণ বাঙালির মতোই। সরল কিন্তু আত্মবিশ্বাসী জয়নুল সমাজের শক্তিধর ব্যক্তিত্ব এবং দরিদ্র চাষী সবার সাথেই অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দে মেলামেশা করতে পারতেন। তাঁরাও তাঁকে আপন মানুষ মনে করতেন। তিনি ছিলেন এক অসাধারণ মজলিশি মানুষ, অক্লান্ত আড্ডা দিতে পারতেন। ময়মনসিংহের আঞ্চলিকতার টান ছিল তাঁর ভাষায়। তিনি ছিলেন যেমন আমুদে, তেমনি রসিক। তিনি ভালোবাসতেন শিশুদের, ভালোবাসতেন ভালো খাবার, বিশেষ করে গ্রামবাংলার খাবার। তিনি ছিলেন চা প্রেমিক এবং ধূমপানে আসক্ত। নিরবচ্ছিন্নভাবে সিগারেট খেতেন। তিনি প্রকৃতির সবকিছুই ভালোবাসতেন, শুধু কাক পছন্দ করতেন না। অথচ কাকের ছবিই বার বার তাঁর হাতের তুলির পরশে কী জীবন্ত রূপ পেয়েছে। তাঁর কাছে কাক ছিল সুযোগ সন্ধানী চালাকদের প্রতীক।
তথ্যসূত্রঃ
১. বাংলা উইকিপিডিয়া।
২. গুণীজন।
Discussion about this post