শাহীনুর রেজা
নজরুলসংগীতের তিন প্রজন্মের শিল্পীর সাথে গান করে যিনি নজরুলের গানকে চরম উত্কর্ষতায় নিয়ে গেছেন, তিনি হলেন বরেণ্য সংগীতজ্ঞ প্রবীণ সংগীতব্যক্তিত্ব জনাব খালিদ হোসেন। সংগীতের জন্য নিবেদিত, প্রাণবন্ত, সৃজনশীল এই সংগীতব্যক্তিত্বকে নিয়ে আমাদের এবারের পথিকৃত্
প্রখ্যাত নজরুল-সংগীতশিল্পী, নজরুল-সান্নিধ্যধন্য ও আশীর্বাদপুষ্ট আব্বাসউদ্দীন আহমদ যাঁর গান শুনে মন্তব্য করেছিলেন, ‘তুমি একদিন অনেক বড় শিল্পী হবে’। তিনি হলেন খালিদ হোসেন। নজরুলসংগীতের একজন অভিভাবক শিল্পী হিসেবে লক্ষ কোটি নজরুল-ভক্তের হূদয়ে তিনি সু-আসীন। নজরুলের গানের একজন প্রবীণ শিল্পী হিসেবে তিনি সুপরিচিত। গত ছয় দশক ধরে বাংলা গানের বিভিন্ন ধারার সাথে সম্পর্ক থাকলেও নজরুলের গানে তিনি সর্বাসীন। বিশেষ করে নজরুলের ইসলামি গানে অদ্বিতীয় শিল্পী হলেন সকলের শ্রদ্ধাভাজন খলিদ হোসেন।
খালিদ হোসেনের পিতা নাম মরহুম মুন্সী মুহাম্মদ শামসুজ্জোহা এবং মাতার নাম মরহুম রাহিমা খাতুন। তিনি ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা ছিলেন ৬ ভাই ৩ বোন । খালিদ হোসেন ভাইবোনদের মধ্যে দ্বিতীয়। অন্যরা হলেন হামিদা খাতুন, নাজনিন বেগম, হাফিজা বেগম, মাহমুদ হোসেন, সাজ্জাদ হোসেন, মুহাম্মদ হোসেন, মাহমুদা নাসির ও খালেদা সেলিম। অন্য ভাইবোনদের তুলনায় তিনি পিতামাতার স্নেহ একটু বেশি পেয়েছেন। দেশ বিভাগের পর ১৯৫১ সালে তাঁরা সপরিবারে কুষ্টিয়ায় চলে আসেন। এসময় তাঁর লেখাপড়ায় ভাটা পড়ে। সংসারে সচ্ছলতা আনার জন্য নিজেদের প্রতিষ্ঠিত ‘খালিদ মেডিকেল হল’ ঔষধ ক্রয়-বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানে পিতার সাথে নিজেও মনোযোগ সহকারে কাজ শুরু করেন।
১৯৬৩ সাল থেকে তাঁরা ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এখানকার ২০/১৪, ব্লক-সি তাজমহল রোড, মোহাম্মদপুরের বাসায় যখন আমরা পৌঁছাই তখন সন্ধ্যে হয় হয়। চারপাশে আলো জ্বলতে শুরু করেছে। খালিদ হোসেনের বসার ঘরের চারপাশে মূল্যবান ঐতিহ্যপূর্ণ আলোকচিত্র আর বিভিন্ন পুরস্কার-পদকে ভরা। অনেকগুলো ছবির মধ্যে একটিতে গিয়ে চোখ আটকে যায়। সেটা হলো নজরুলের সাখে খালিদ হোসেনের ছবি। আত্মিক ছবিটা অনেক আগের।
কৃষ্ণনগর, পুতুল খেলার কৃষ্ণনগর, খালিদ হোসেনের এই পাড়াতেই নজরুল ইসলাম ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে বসবাস শুরু করেন। পেছনেই দরিদ্র খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষদের বসবাস ছিল। যাদের জীবন-যাপনের কাহিনি নিয়ে নজরুল তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’ লিখেছেন। এছাড়াও কৃষ্ণনগরে ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার’সহ অনেক বিখ্যাত গান তিনি লিখেছিলেন। নজরুলের দ্বিতীয় পুত্র অরিন্দম খালেদ বুলবুলের জন্ম এখানেই হয়েছিল। কৃষ্ণনগরের চাঁদসড়কে কবি যে বাড়িতে থাকতেন তার নাম ‘গ্রেস কটেজ’।
শৈশবের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খালিদ হোসেন বলেন—কৃষ্ণনগরে চাঁদসড়কের সামনের দিকে কৃষ্ণনগরের কলেজের কাছে সি.এম.এস সেন্ট জন্স স্কুলে পড়তাম। মিস মাক্যাথি ছিলেন আমাদের প্রিন্সিপাল। তিনি আইরিশ মহিলা ছিলেন। আমাদের ইংরেজি ক্লাস তিনিই নিতেন। অত্যন্ত নিয়মানুবর্তী ও ভারী মেজাজের এই মানুষটি শিক্ষক হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। আমরা সবাই তাঁকে খুব ভয় করতাম। এই স্কুলে নকশা তৈরি করাও শেখানো হতো। স্কুলের কাছেই রোমান ক্যাথলিক গির্জা থেকে নির্দিষ্ট দিনে আমরা ব্রাদারের কাছে থেকে বিভিন্ন দেশের স্ট্যাম্প আনতে যেতাম। আমাদের চাঁদসড়কের বাড়ির সামনেই ফুটবল মাঠ। এটি পার হলেই পরিচ্ছন্ন একটি পুকুর, নাম মংলা। মাঝে মাঝে কবিতা লেখার জন্য একটি খাতা আর কলম নিয়ে সেই পুকরের পাড়ে যেয়ে পা ঝুলিয়ে বসতাম। সাথে থাকত আমার এক কিশোরী সঙ্গিনী, যে আমার সঙ্গ নেবার জন্য আমার একটু ইশারার অপেক্ষায় থাকত। সে এসে সুশ্রী নায়িকাদের মতো আমার কাছেই একটি গাছে হেলান দিয়ে বসতো সোজা করে মেলে দেয়া দুই পায়ের ওপর ফ্রকের কুঁচিতে এক ললিত ভঙ্গি তুলে। তার বেশির ভাগ সময়ই থাকত নির্নিমেষ আমার নয়নের পানে, যেন জানত কবিতাগুলো তার জন্যেই সৃষ্টি হচ্ছে। তারপর একসময় গোধূলির আলো ম্লান হয়ে এলে ধীরপায়ে দুজনে ফিরে আসতাম। আজ সে নেই, সেই কবিতাও নেই।
আমাদের আর একটি বাড়ি ছিল, পালদের বিখ্যাত মৃিশল্পের তথা মাটির পুতুলের পাড়া ঘূর্ণির পাশেই রাধানগরে। সেখানে আমাদের বাড়ির দরজায় শিলালিপিতে আমার ডাক নামের সাথে মেলানো নাম ‘কানন কুটির’ আজো দাঁড়িয়ে আছে।
তিনি অত্যন্ত স্পষ্টভাষী। তাঁর গানের মধ্যেও বিষয়টি প্রকটভাবে ধরা পড়ে। শব্দের প্রক্ষেপণ দিয়ে স্পষ্ট উচ্চারণের বিষয়ে এখানকার অধিকাংশ শিল্পীরাই বলতে গেলে আনকোরা। খালিদ হোসেন এদিক থেকে ব্যতিক্রম। কৈশোরে মিত্র ইনস্টিটিউশনে তিনি গান করতেন। পাশাপাশি পছন্দের বিষয় ছিল কবিতা আবৃত্তি। সু্কলের বাংলা শিক্ষক্ষ কবি কৃষ্ণদয়াল বসুও ভূদেব ভট্টাচার্য অত্যন্ত যত্ন করে তাঁকে আবৃত্তি শিক্ষা দিতেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নেওয়ার জন্য। যা তাঁকে পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, বুদ্ধদেব বসু, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বিষ্ণুদে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অজিদ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমর সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য; পরে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফররুখ আহমদ, ফজল শাহবুদ্দীন, আসাফ উদ্দৌলা এঁদের কবিতা পাঠে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
সংগীত শিক্ষার শুরুতেই তিনি ধনঞ্জয় ভট্টচার্যের অনুরাগী ছিলেন। রেডিওতে, রেকর্ডে তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হতেন, তাঁকে দেখার জন্য মন আনচান করত। কোথায় গেলে কার কাছে গেলে তাঁর দেখা পাওয়া যাবে। এ ভাবনায় মন ব্যকুল থাকত। তখনকার দিনে রেডিওতে বড় শিল্পীদের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তিন-চারটা সিটিং-এ গান করতে হতো। একদিন খবরের কাগজে বেতারের সূচিতে নিজের প্রিয় শিল্পীর নাম দেখে এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে ১নং গারস্টিন প্লেস, আকাশবাণী ভবনে যেয়ে হাজির হলেন। খালিদ হোসেনের বর্ণনায়—বিশাল গেইটে বিশাল ভোজপুরী দারোয়ান বসে আছে। আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করল, কী খোকাবাবুরা, কী দরকার? গম্ভীর হয়ে উত্তর দিলাম, ধনঞ্জয় বাবুর সঙ্গে দরকার আছে। হাফপ্যান্ট পরা দুটি বালকের দিকে চেয়ে সে সস্নেহে হেসে উঠল। বলল, যাও যাও, ভিতরে যাও।
লন পার হয়ে দেখি, অভ্যর্থনায় ডেস্কের পিছনে এক সুদর্শন যুবক বসে আছেন। আমাদের দেখে কৌতুকভরে জিজ্ঞেস করলেন, কী খোকারা, এত রাতে কী মনে করে? আমাদের সেই একই উত্তর। ওঁর মুখে মৃদু হাসি দেখলাম, ইঙ্গিতে বসতে বললেন। ততক্ষণে ধনজয় বাবুর সেই সিটিং-এর গান শুরু হয়ে গেছে, কেননা লাউড স্পিকারে দূরাগত আওয়াজে তাঁর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। কিছুক্ষণ পর গান শেষ হলো। একটু পরেই কাঙ্ক্ষিত শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকে আরো কয়েকজনের সঙ্গে করিডোর ধরে বেরিয়ে আসতে দেখলাম। তপ্ত কাঞ্চন বর্ণের বলিষ্ঠ অবয়ব, শার্টের আস্তিন কনুইয়ের অনেক ওপর পর্যন্ত গোটোনো। ধুতির কোঁচা পকেটে ঢোকানো, ডান হাতে ঘড়ি, গালে পান, অত্যন্ত প্রিয়দর্শন মানুষটি এগিয়ে আসতেই, রিসেপসনিস্ট বলে উঠলেন, এই যে ধনঞ্জয় দা, আপনার ভিজিটর। আমরা টুকটুক করে লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে নেমে দাঁড়ালাম। তাঁর চোখে স্নেহভরা দৃষ্টি, বললেন, কী খোকারা, এত রাতে এখানে কেন এসেছ? বললাম, আপনাকে দেখতে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে এসেছ? বললাম, কলেজ স্ট্রিট থেকে। এত দূর থেকে এসেছ? হ্যাঁ সেজন্যে আমার বন্ধুও সাথে এসেছে। তারপরে তিনি আমার হাত ধরে সদলবলে রাস্তার ওপারে গেলেন। দোকানিকে চা দিতে বললেন। কিন্তু আমি খেলাম না। কারণ আমার চা খাওয়ার অভ্যাস ছিল না। কিছুক্ষণ কথা বলার পর তাঁর একটু ব্যস্ততা দেখলাম, কারণ তখনো তাঁর আর একটি সিটিং বাকি ছিল। তিনি আমাকে আদর করে বললেন, শোনো, আমি তোমার বাসার খুব কাছেই থাকি, হোটেল সিসিলে। তোমার যখনই আমাকে দেখার ইচ্ছা হবে, তুমি আমার বাসায় চলে এসো। এত রাতে আর এখানে এসো না। তারপর থেকে প্রায়ই তাঁর কাছে যেতাম। মাঝে মাঝে তিনি আমাকে তার সংগীতানুষ্ঠানে যেতে বলতেন। এমনিভাবে তিনি আমাকে এমন একটি স্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন যে, যেখান থেকে আমার জীবনে সংগীতের স্বর্ণদুয়ার খুলে গিয়েছিল।
শ্যামবাজারের নলিনী সরকার স্ট্রিটে হিজ মাস্টার্স ভয়েস ও কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানীর পাশাপাশি দুটি তিনতলা বাড়িতে রিহার্সেল হাউস। খালিদ হোসেন সেখানে প্রায়ই একা যেতেন। সেই সময়ের সব বিখ্যাত শিল্পীদের রিহার্সেল, কথাবার্তা, আচার-আচরণ সবকিছু দেখার ও শোনার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। সেখানে হাফপ্যান্ট পরা ছেলের কোনো ভূমিকা ছিল না, ধনঞ্জয় বাবুর সাথে যাতায়াত করায় কেউ কিছু বলত না।
সংগীতে শিক্ষা নেবার প্রারম্ভে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের কল্যাণে খালিদ হোসেন সুবিনয় রায়, দ্বিজেন চৌধুরী, কমলদাশ গুপ্ত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, সত্য চৌধুরী, অখিল বন্ধু ঘোষ, পান্নালাল ভট্টাচার্য, সুবিনয় রায়, সুবলদাশ গুপ্ত, জগন্ময় মিত্র, সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ, বেচু দত্ত, ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্র, দূর্গা সেন, সনত্ সিংহ, গাত্রী বসু, কান্দী ঘোষাল, সমরেখা রায়, হীরণ দাস, গিরীন চক্রবর্তী, শচীন গুপ্ত, বিমল ভূষণ, গৌরীকেদার ভট্টাচার্য, মৃনালাকান্তি ঘোষ, সন্তোষ সেনগুপ্ত, দেবব্রত বিশ্বাস, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, অপারেশ লাহিড়ী ও বাঁশরী লাহিড়ী (সংগীতপরিচালক বাপ্পী লাহিড়ীর বাবা-মা), বেলা মুখোপাধ্যায় (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী), সুকৃতি সেন, কল্যাণী মজুমদার, সুধীরলাল চক্রবর্তী, কুমার প্রদ্যোত্ নারায়ণ, জ্ঞান প্রকাশ ঘোষ, পঙ্কজ মল্লিক, তারা ভট্টাচার্য, সনত্ বন্দ্যোপাধ্যায়, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ চক্রবর্তী, শ্রীমতি আঙ্গুরবালা, দীপালি নাগ, পান্না কাওয়াল, ধীরেন বসু, নির্মলা মিশ্র, আরতি মুখোপাধ্যায়, সুপ্রভা সরকার, সুপ্রীতি ঘোষ, নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্য গোপাল নন্দী, সৌরেন রায়, হৈমন্তী শুক্লা প্রমুখ প্রথিতযশা সংগীত-সাধকদের সঙ্গ লাভ করেছিলেন।
শিল্পীজীবনের গল্প, প্রতিষ্ঠা, খ্যাতি এ গল্পগুলো জানতে চাইলে খালিদ হোসেন বারবার কলকাতায় কিশোরবেলার স্মৃতিতে ফিরে যান। সেখানকার সাংগীতিক পরিবেশ ও অনুকূল সংগীত আবহাওয়া তাঁকে খ্যাতিমান শিল্পী হয়ে উঠতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। ছোটবেলায় সংগীত অ্যাকাডেমিতে যাওয়া, ওস্তাদের কাছে গান শেখা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে গান পরিবেশন করা এসবের চেয়ে খাত্যিমান শিল্পীদের সাথে মেলামেশা, সঙ্গলাভ, তাঁদের রিহার্সেল, অনুষ্ঠানের প্রতি খালিদ হোসেনের আগ্রহ ছিল প্রবল। এমন এক কাহিনি তিনি আমাদের শোনালেন—মনে আছে, খবরের কাগজে দেখলাম, আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের আজ বিকেলেই একটা জরুরি সভা ডাকা হয়েছে। অতএব আমারও সেখানে যাওয়াটা খুবই জরুরি হয়ে দাঁড়াল। স্কুল থেকে ফিরেই যেয়ে উপস্থিত হলাম বৌবাজার স্ট্রিট মোড়ের একটু আগেই ডানদিকে কংগ্রেস সাহিত্য সংঘের অফিসে। বিশাল কাঠের দরজা, ভেতরে ঢুকলাম, দেখি কাছেই এক বিশাল ঘরে একদল শিক্ষার্থীকে দরাজ গলায় একটি দেশত্ববোধক গান শেখাচ্ছেন মাথায় গান্ধী টুপি, গায়ে জহর কোট পরা বিখ্যাত শিল্পী সুকৃতি সেন, যিনি দেশত্বাবোধক গানে একটা নতুন মাত্রা এনেছেন।
একসময় তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বসবাসের জন্য কলকাতার একটি স্থায়ী বাসস্থান দেখে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে দ্রুতপায়ে সেখানে উপস্থিত হলেন হাতে শান্তিনিকেতনি হাতব্যাগ, পায়ে শান্তিনিকেতনি চপ্পল, চোখে চশমা উজ্জ্বল গৌরবর্ণা আমার প্রিয় শিল্পী কিংবদন্তীতুল্য সুচিত্রা মিত্র। তাঁর আর একটি পরিচয় সুসাহিত্যিক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের কন্যা তিনি। আগেকার অনেক রেকর্ডে তাঁর নাম সুচিত্রা মুখোপাধ্যায় লেখা হতো। এসে ঘরে না উঠেই তিনি জানতে চাইলেন, সুকৃতিদা, এখানে অ্যাসোসিয়েশনের মিটিং হবার কথা ছিল না? উনি বললেন, মিটিং-এর ভেন্যুটা চেঞ্জ হয়ে মিনার্ভা থিয়েটারে হচ্ছে। সুচিত্রা দ্রুতপায়ে অদৃশ্য হলেন। আমিও তক্ষুনি একটা ট্রামে চড়ে শ্যামবাজার মিনার্ভা থিয়েটারে উপস্থিত হলাম। গিয়ে দেখি হলের সামনে যেন মহোত্সব শুরু হয়েছে। লনে গিয়ে দাঁড়ালাম, দেখলাম অভিনেতা ছবি বিশ্বাস, অহিন্দ চৌধুরী, রবি রায়, নীতিশ মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা রানী, বিকাশ রায়, অজিত চট্টোপাধ্যায়, কম্বল মিত্র, তবলাবিদ গায়ক-অভিনেতা অসিতবরণ মুখোপাধ্যায়, গায়ক-অভিনেতা রবীন মজুমদার, মিহির ভট্টাচার্য, গায়ক-অভিনেতা পরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভারতী দেবী, ছায়া দেবী, চন্দ্রাবতী দেবী, জহর গাঙ্গুলী, রেণুকা রায়, পদ্মা দেবী, প্রভা দেবী, সুপ্রভা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ নাট্য ও সংগীতশিল্পীরা ঢুকে যাচ্ছেন।
ইতোমধ্যে এক ভদ্রলোক ভিড় ঠেলে হলের বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালেন। আমার দিকে চোখ পড়তেই জিজ্ঞেস করলেন—কী খোকা, এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমি বললাম, আমি ধনঞ্জয় বাবুর কাছে এসেছি। তিনি বললেন, ধনঞ্জয় দা তো এসে গেছেন। তুমি সোজা চলে যাও। আমি বললাম, কী করে যাব? আমার তো কার্ড নেই। তিনি হেসে উঠেলেন, তোমার কার্ড লাগবে না। আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি আমার কার্ড নিয়ে যাও। দেখলাম কার্ডের ওপর তাঁর নাম লেখা বীরেশ্বর চক্রবর্তী। তার চেয়েও বড় কথা, নিচে সভার আহ্বায়ক হিসেবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্বাক্ষর। একটি দুর্লভ রত্ন হাতে পেয়েছিলাম বলে সেদিন মনে হয়েছিল। হলে ঢুকলাম, দেখি গ্যালাক্সি অব স্টারস। অভিনয়শিল্পী, সংগীতশিল্পী কে নেই সেখানে…।
কুষ্টিয়া খালিদ হোসেনের দ্বিতীয় নিবাসভূমি ও সংগীতভূমি। পরিবারের কেউ সংগীত ও সংস্কৃতিবিমুখ ছিলেন না। বাড়িতে রেডিও, রেকর্ড, গ্রামোফোন সবই ছিল, কিন্তু সেকালে রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারের কোনো সন্তান সাধারণত বাড়িতে হারমোনিয়াম-তবলা নিয়ে চর্চা করবে সেটা ভাবা যেত না। কিন্তু খালিদ হোসেনের গুরু ওস্তাদ ওসমান গণি, যিনি কুষ্টিয়ার মোহিনী মিলসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আর মোহিনী মিলসের অডিটোরিয়ামের ড্রেসিং রুমের চাবি তাঁর আয়ত্তে ছিল। তিনি তাঁর একটি চাবি খালিদ হোসেনকে দিয়েছিলেন, সেখানে হারমোনিয়াম রাখা ছিল। খালিদ হোসেন নিজের কোটপাড়া থেকে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, বসন্ত ভোরবেলা সাইকেলে চেপে সেই মিলপাড়ার ড্রেসিং রুমে নিয়মিত রেওয়াজ করতে যেতেন। বহুদিন তিনি একনাগাড়ে একাজ করেছেন। এরপর বেতারে তালিকাভুক্ত হলে বাড়িতে যন্ত্রপাতি আনার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর খালিদ হোসেন মোদিনিপুর থেকে আগত আধুনিক গানের কিংবদন্তীতুল্য শিল্পী অকাল প্রয়াত জনাব আবুবকর খানের কাছে তালিম গ্রহণ করেন। ‘সেই চম্পানদীর তীরে’, ‘কথা দিলাম আজকে রাতে’ ইত্যাদি বহু অবিনাশী আধুনিক গানের তিনি স্রষ্টা ছিলেন।
১৯৫৭ সালে খালিদ হোসেন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন শাহানা হোসেনের সঙ্গে। খালিদ হোসেন শাহানা হোসেন দম্পতির একমাত্র সন্তান আসিফ হোসেন। পরিবারে অন্য কেউ সংগীতের সাথে সম্পৃক্ত নন। ঢাকা বেতারে গান গাওয়ার সময় খালিদ হোসেন কুষ্টিয়া থেকে যাতায়াত করতেন। পরে ব্যস্ততা বেড়ে গেলে ১৯৬৩ সালে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বেতারে আধুনিক, নজরুল সংগীত, রবীন্দ্র সংগীত প্রভৃতি গান গাইতেন। একসময় শুধুই নজরুলের গান।
বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে ছয় দশক ধরে নজরুলসংগীত-শিল্পী ও পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এছাড়া দীর্ঘদিন যাবত্ নজরুল একাডেমি, হিন্দোল সংগীত একাডেমিসহ বিভিন্ন সংগীত-প্রতিষ্ঠানে তিনি প্রশিক্ষকের দায়িত্বে আছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ও মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক টেক্সট বুক বোর্ডের সংগীত বিষয়ক দায়িত্ব পালন খালিদ হোসেনের জীবনের বড় পাওয়া। নজরুল ইনস্টিটিউটে নজরুল স্বরলিপি প্রমাণীকরণ পরিষদের একজন সম্মানিত সদস্য ছাড়াও তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন অডিশন বোর্ডের একজন সম্মানিত বিচারক।
তিন প্রজন্মের শিল্পীর সাথে সংগীত পরিবেশন করা খালিদ হোসেনের অনেকগুলো সিডি/ক্যাসেট প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে সেই চম্পা নদীর তীরে, সাহারাতে ফুটল রে, বক্ষে আমার কাবার ছবি, শাওন রাতে যদি, ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ ইত্যাদি উল্লেখ্যযোগ্য।
নজরুলসংগীত পুনরুদ্ধার, সংগ্রহ, চর্চা, প্রশিক্ষণ ও এর অবিকৃত রূপ প্রচারের সাধনায় খালিদ হোসেন একুশে পদক, নজরুল ইনস্টিটিউট পদক, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় পদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদক ছাড়াও বহু সম্মাননা পেয়েছেন।
সরকারি সংগীত কলেজে একনাগাড়ে ত্রিশ বছর উপাধ্যক্ষ ও নজরুলসংগীত বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নজরুলসংগীতের সেমিনার ও পরিবেশন উপলক্ষে খালিদ হোসেন কলকাতা, যুক্তরাজ্য, করাচিসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন।
Discussion about this post