অনলাইন ডেস্ক
ওস্তাদ শাহ আবদুল করিম একজন বাংলাদেশি কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার ও সংগীত শিক্ষক। তিনি বাউল সংগীতকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। কর্মজীবনে তিনি পাঁচশো-এর ওপরে সংগীত রচনা করেছেন। বাংলা সংগীতে তাকে ‘বাউল সম্রাট’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়। বাংলার হাওর অঞ্চলের গানকে বিশ্ব দরবারে নিয়ে গেছেন কিংবদন্তি শাহ আবদুল করিম।
২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। তবে এই বাউল সম্রাটের জীবদ্দশা থেকেই তার গান গেয়ে ও রিমেক করে দেশ-বিদেশে নাম-অর্থ কুড়িয়েছেন অসংখ্য সাধারণ ও অসাধারণ মানুষ। সেই ধারাবাহিকতা চলছে এখনও। ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তার গান কথা বলে সকল অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তিনি তার গানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন প্রখ্যাত বাউলসম্রাট ফকির লালন শাহ, পুঞ্জু শাহ এবং দুদ্দু শাহের দর্শন থেকে।
যদিও দারিদ্র্য তাকে বাধ্য করে কৃষিকাজে তার শ্রম ব্যয় করতে কিন্তু কোনো কিছু তাকে গান সৃষ্টি করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তার পরিবার এখনও পড়ে আছে হাওর অঞ্চলের নিভৃতে। গত ১৩ বছর ধরেই তার একমাত্র ছেলে বাউল শাহ নূর জালাল এ নিয়ে করছেন হাহাকার। অবশেষে শাহ আবদুল করিমের লেখা-সুর করা ৪৭২টি গানের একটা বিহিত হলো।
জানা গেছে, সম্প্রতি বাংলাদেশ কপিরাইট বোর্ডে গানগুলোর মালিকানা ও কপিরাইট ইস্যুর বিষয়টি সংরক্ষিত কতা হয়েছে। কপিরাইট রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরীর আগ্রহ আর সংগীতশিল্পী জুয়েল মোর্শেদ জু ও সারোয়ার শুভর উদ্যোগে এই জটিল কাজটি সম্পন্ন হলো বলে জানান শাহ আবদুল করিমের ছেলে শাহ নূর জালাল। এর মধ্য দিয়ে শাহ আবদুল করিমের সৃষ্টিগুলো প্রচার ও প্রকাশের ক্ষেত্রে একটা শৃঙ্খলা ফিরবে বলে সবার বিশ্বাস।
এরমধ্যে কপিরাইট অফিসের মাধ্যমে গানগুলোর সঠিক সংরক্ষণ ও রয়্যালটি সংগ্রহের বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে। আগে যারা উনার গান প্রকাশ করেছেন, তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হচ্ছে। ’শাহ আবদুল করিম ইব্রাহিম আলী ও নাইওরজানের ঘরে ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি খুব ছোটবেলায় তার গুরু বাউল শাহ ইব্রাহিম মাস্তান বকশ থেকে সঙ্গীতের প্রাথমিক শিক্ষা নেন। তিনি আফতাব-উন-নেসা কে বিয়ে করেন, যাকে তিনি সরলা নামে ডাকতেন। তিনি ১৯৫৭ সাল থেকে তার জন্মগ্রামের পাশে উজানধল গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।
২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর পর উজানধল গ্রামের নিজ বাড়িতে স্ত্রী সরলা খাতুনের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হন তিনি। স্বশিক্ষিত বাউল শাহ আব্দুল করিম এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ শতাধিক গান লিখেছেন এবং সুরারোপ করেছেন। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে তার ১০টি গান ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। কিশোর বয়স থেকে গান লিখলেও কয়েক বছর আগেও এসব গান শুধুমাত্র ভাটি অঞ্চলের মানুষের কাছেই জনপ্রিয় ছিল।
তার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে বেশ কয়েকজন শিল্পী বাউল শাহ আব্দুল করিমের গানগুলো নতুন করে গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করলে তিনি দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন। বাউলসাধক শাহ আবদুল জীবনের একটি বড় অংশ লড়াই করেছেন দরিদ্রতার সাথে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময় তার সাহায্যার্থে এগিয়ে এলেও তা তিনি কখনোই গ্রহণ করেননি।
মাত্র আট দিন নাইটস্কুলে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন আব্দুল করিম। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও, তিনি ছিলেন স্ব শিক্ষিত। জীবদ্দশায় কালনী নদীর তীরে বসে তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য বাউল গান। ভাটিবাংলার অপার সৌন্দর্য তিনি ধারণ করেছিলেন তার হৃদয় সত্তায়। সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা তাকে তিলেতিলে পীড়ন করতো। তার গানে গ্রামবাংলার জীবনচিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন সুনিপুণভাবে। গানে গানে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মানুষের আত্মার আত্মীয়, অকৃত্রিম দেশপ্রেমিক ও গণ মানুষের শিল্পী।
Discussion about this post