আমিনুল ইসলাম
সাহিত্য বিষয়ে প্রধানত দুটি মতবাদ জেঁকে বসে আছে। কলকৈবল্যবাদীদের মতে শিল্পের জন্য শিল্প হচ্ছে কবিতাসহ সকল নান্দনিক শিল্পের মূল সূত্র। এই মতের অনুসারীরা মনে করেন, কবিতার কোনো কেন্দ্রীয় বিষয় থাকার প্রয়োজন নেই এবং কবির কোনো সামাজিক দায়বোধ থাকার দাবি শিল্পবিরোধী। তাদের যুক্তি হচ্ছে, পাখি যেমন তার ইচ্ছানুসারে গান করে, কবিও তেমনি তার মনের আবেগ অনুভূতি নিয়ে নিজের ভালো লাগার জন্য কবিতা রচনা করবেন। অন্যদিকে সমাজবাদীরা মনে করেন, জীবনের জন্য শিল্প। তারা মনে করেন, যে কবিতা জীবন বাঁচাতে পারে না, তার কোনো মূল্য নেই, প্রয়োজন নেই। তো কোন্ দিকে জোর বেশি? যখন বলা হয় কবিতার ইতিহাস হচ্ছে তার টেকনিকের ইতিহাস, তখন শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বটিই প্রাধ্যান্য লাভ করে। কিন্তু আসলে কি তাই? কবিতার গঠনে বা অঙ্গসৌষ্ঠবে পরিবর্তন এনেও কি সমাজের কথা, মানবিকতার কথা, ভালোবাসার কথা বলা যায় না? কবিতায় শিল্পগুণ অক্ষুণ্ন রেখে কি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, প্রকৃতিবৈরিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা সম্ভব হয় না? উত্তর হচ্ছে : যায়। শক্তিমান শিল্পীর হাতে বিষয়বৈভব ও শিল্পসৌন্দর্য—দুটো মিলেমিশে উপভোগ্য ও কালজয়ী শিল্প তৈরি হতে পারে। তাজমহলে বিষয় আছে; আবার নান্দনিক শিল্পশৈলি আছে। ফলে তা চিরন্তন সৃষ্টিতে উন্নীত হয়েছে। এমন অজস্র গজল আছে যেখানে বাণীর সমুদ্র ও সুরের হাওয়া মিলে রচনা করেছে অনিঃশেষ উপভোগ্যতার পৃথিবী। রবীন্দ্র-নজরুলের গানের ভুবনেও অমন সৃষ্টির অজস্রতা বিরাজমান। জীবনানন্দ দাশের ‘অবসরের গান’, ‘আকাশলীনা’, ‘অন্ধকার’, ‘ভিখিরি’ ‘আট বছর আগের একদিন’, আবুজাফর ওবায়দুল্লাহর ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ আল মাহমুদের ‘তুমি আমার প্রথম উচ্চারণ’, ‘সম্রাটের স্বর্ণমুদ্রা’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’, ‘অন্যায় বৃষ্টি’ আবুল হাসানের ‘উদিত দুঃখের দেশ’ প্রভৃতি কবিতা বিষয়বৈভব ও শিল্পসৌন্দর্যকে ধারণ করে আছে কালজয়ী মহিমায়। আমরা কামাল চৌধুরীর কবিতার মাঝেও শিল্প ও সামাজিক দায়বোধের চমৎকার মেলবন্ধন দেখতে পাই। উদাহরণস্বরূপ তাঁর ‘আজ আমি ফিরে পেতে এসেছি অধিকার’ কবিতাটির কথা বলা যায়। কবিতাটি কোনো বিষয়রিক্ত আত্মরতির শৈল্পিক অনুশীলন নয়। কবিতাটির মাঝে অন্তরঙ্গ ক্ষোভ, অন্তঃসলিলা জেদ, হারানো অধিকার ফিরে পাওয়ার অনুদ্ধত প্রতিজ্ঞা, রাজনীতি, প্রেম সবকিছুর সংশ্লেষ আছে কিন্তু কোনোটাই নগ্ন প্রাধান্য প্রকাশ করেনি। পাঠক বারবার পড়বেন এ-কবিতা; পাঠকভেদে রুচিভেদে, পাঠকের কল্পনার গভীরতা ও গ্রহণক্ষমতার মাত্রা ভেদে কবিতাটি বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হবে। ফলে কবিতাটির আবেদন পাঠান্তে ফুরিয়ে যাবে না। অন্যদিকে কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ, উপমা, চিত্রকল্প, কল্পচিত্র, উপস্থাপনার নাটকীয় ভঙ্গি, মুখোমুখি কথোপকথনের বেঠকি ঢং শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বপ্রেমিকদেরও সমানভাবে আকৃষ্ট করবে, আনন্দ দিবে। কবিতাটি একটা অংশ পাঠ করা যাক :
‘প্রবেশাধিকার চেয়ে একদিন বাইরে এসেছি
খোলা মাঠে
হর্ষ চাঁদের নিচে
একদিন আশ্রয় চেয়েছি, একদিন খোলস ভেঙে
বেরিয়ে এসেছি পথে
বদ্ধ জলাশয়কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি রাজপথে
বলেছি—হে নগর আমি উদ্বাস্তু লাভাস্রাতে
আমাকে বাসিয়ে নাও হে দ্রোহ, হে ক্ষোভ
হে স্খলন, হে পবিত্র পতন
আমি এই যমুনার তীরে সেতুবন্ধ বানাতে এসেছি।’
[আজ ফিরে পেতে এসেছি অধিকার/ এই মেঘ বিদ্যুতে ভরা]
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কামাল চৌধুরী যাপিত জীবনের আনাচেকানাচে অলক্ষ্যে পড়ে থাকা ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে সুন্দর কবিতা রচনা করেন। আবার সমাজের জাতির, রাষ্ট্রের, পৃথিবীর বড়বড় ঘটনার কোনো কোনোটাও তাঁর কবিতার বিষয় হয়ে উঠেছে। অনুদ্ধত অপ্রগলভ মৃদুভাষা তাঁর কবিতার ঐশ্বর্য। সেকারণে খুব গভীর মনোনিবশেসহ তাঁর কবিতা পাঠ করতে হয়। তাঁর কবিতার ভুবনে একটা মিষ্টি গন্ধ থাকে তাঁর কবিতার প্রাণজুড়ে। কিন্তু সেই খোশবুর উৎসের সন্ধান সহজে ধরা পড়তে চায় না। তিনি প্রতিবাদের কবিতা লিখেছেন, প্রেমের কবিতা লিখেছেন, মানবিক অসঙ্গতি নিয়ে কবিতা লিখেছেন, বন্যাভাসী মানুষের দুর্দশার চিত্রকে কবিতা করে তুলেছেন। কবিতাভেদে কাব্যভাষায়-ছন্দে-আকৃতিতে পরিবর্তন ঘটেছে। সেই পরিবর্তন পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। কিন্তু যা দৃষ্টি এড়িয়ে যায় সেটাই হচ্ছে তাঁর কবিতার সবচেয়ে বড় প্রসাদগুণ। সেটা হচ্ছে কবিতার প্রাণে মিশে থাকা হালকা মিষ্টি সৌরভ। সেই সৌরভের নাম দেওয়া যায় না, ব্যাখ্যা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। সেই সৌরভ উপভোগ করতে হয় যেভাবে প্রেমিক স্বাদ নেয় নকিট হাওয়ায় ভেসে আসা প্রেমিকার চুলের গন্ধে নাক ভিড়িয়ে। সেই ঘ্রাণ কোন্ দোকানের কিংবা কোন্ ব্রান্ডের প্রেমিকরে মনে সেই প্রশ্ন ওঠার সুযোগ থাকে না; অনুরূপভাবে এধরনের কবিতায় মন ভেড়ালে মুগ্ধমনের কাছে কবিতার বিষয় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে চায়। তখন কোনো ব্যক্তি নয়, ঘটনা নয়, সমুদ্র নয়, আকাশ নয়, সনতারিখহীন সময় হয়ে ওঠে কবিতার বাগান। এধরনের কবিতা রচনার জন্য মোগলদের মালির মতো দক্ষতা, শিল্পজ্ঞান ও মন লাগে। কামাল চৌধুরীর অনেক কবিতায় তেমন মনের এমবোস ছাপ রয়েছে।
‘আমরা দু’জন ধুলোর ভেতর হেঁটে
পা ধুতে যাই সুদূর অতীকালে
অতীত তখন শুভ্রডানায় মেঘ
ঠোঁট এঁকে দেয় অগ্নিনদীর গালে।
অতীত আলোর আগুনভরা ভোর
পেরিয়ে আসি দূর আগামীর দিনে
প্রাণসজনী সাঁঝবেলাকার পাখি
বললে, আজো চিনতে পারলি নে!’
[দিনকাল / টানাপড়েনের দিন]
প্রচারণা মনে নিলে স্বীকার করতেই হয়, এখন ছোট কবিতা লেখার যুগ চলছে। বড় কবিতা পড়ার ধৈর্য নেই পাঠকের। গান থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সঞ্চারী অংশ। মহাকাব্য রচনা এখন কল্পনারও বাইরে। চিঠি নেই। আছে এসএমএস। প্রেমে পড়ে এখন কেউ কারো জন্য বছরের পর অপেক্ষা করতে চায় না। করে না। আজকালকার জীবনে সবকিছু মুদিখানার মতো নগদ, এককালীন এবং স্বল্পসময়কেন্দ্রিক। ফলে কবিতা রচিত হচ্ছে অনুর্ধ্ব দশলাইনের। কামাল চৌধুরী কালের যাত্রার ধ্বনি শোনেন এবং তার সাথে পাল্লারা দিয়ে পথ চলেন কিন্তু তার অন্ধ অনুসারী হতে চান না। ফলে তাঁর ক্ষুদ্রায়বের কবিতাগুলোতেও গভীর ভাবনার প্রাতিস্বিক ছাপ অংকিত হয়ে যায়। এসময়ের অধিকাংশ ছোট কবিতা বিষয়রিক্ত বলে সেসব একবার পাঠের পর পাঠহীনতার রিসাইকেল বিনের ঝুড়িতে ঠায় লাভ করে। কামাল চৌধুরীর কোনো কবিতাই অর্থহীন নয়, শৈল্পিক সৌন্দর্যরিক্ত নয়। সেজন্য তাঁর কবিতার আসন দীর্ঘস্থায়িত্বে এবং অটুট ব্যঞ্জনায়। সাম্প্রতিকতার সুতোয় তিনি রচনা করেন যে ক্ষুদ্রাকৃতির মালা তাতে গাঁথা পড়ে অতীত ও বর্তমান, পুরাতন ও নতুন, কৈশোরিক আকুলতা ও প্রাপ্তবয়স্ক পরিমিতি। তাঁর ‘হে মাটি পৃথিবীপুত্র’, ‘পান্থশালার ঘোড়া’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে এধরনের কবিতার সমৃদ্ধি ঈর্ষণীয় মাত্রা লাভ করেছে।
‘ভুলো না আমায়’ দুপুরের সুঁই-সুতো
দূর প্রান্তরে ভ্রমরের ছবি আঁকে
একা কিশোরীর ভুল বানানের চিঠি
পাখি হয়ে যায় হারানো পথের বাঁকে।’
[চিত্রকল্প/ পান্থশালার ঘোড়া]
কামাল চৌধুরীর অনন্য কবিমানস ও কবিতার অনন্যতা ফটে উঠেছে বিষয় নির্বাচন এবং গঠনশৈলি উভয় ক্ষেত্রেই। তাঁর কবিতাভাবনার ভুবন সারাবিশ্ব। তিনি যা দেখেন, যা শোনেন, যা অনুভব করেন, যা এসে টোকা দেয় তাঁর কল্পনার রাডারে, প্রায় সবকিছুকে নিয়েই কবিতা লেখেন তিনি। তাঁর কাছে জগতের কোনোকিছুই ‘অকাব্যিক’ নয়। দেশ ভাসানো বন্য, জগতের বিস্ময় জাগানো পিরামিড ও তাজমহল, পিতার শবযাত্রা, রোদপোড়া মুক্তিযোদ্ধার চোখের ভাষা, অনিবন্ধিত নারীর প্রেম, পুরুষ প্রযোজিত নারীস্বাধীনতার পরিহাসমাখা চারিত্র্য, কাব্যপ্রকরণ নিয়ে অকবি-আধাকবিদের উৎপাত, জগন্নাথ হলের দুর্ঘটনা, মেঘ ও ধূলির অসংজ্ঞায়িত সম্পর্ক, হাসনুহেনার অলৌকিক ঘ্রাণ এবং বিচিত্র ধরনের অনির্বচনীয় অনুভূতি এ-সবকিছুই কবিতা হয়ে উঠেছে কামাল চৌধুরীর কলমে। প্রসঙ্গত স্মরণ্য, কবিতার বিষয় নিয়ে সর্বভুক হতে গেলে সেখানে প্রকরণশৈথিল্য জেঁকে বসার সমূহ আশঙ্কা থাকে। কিন্তু কামাল চৌধুরী তাঁর ব্যক্তিজীবনের মতোই কবিতায় ধরে রাখেন বিস্ময়কর পরিমিতিবোধ ও পরিশীলিত আনন্দ। কবিতাপাঠের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা বলে, হাতে এতটা কন্ট্রোল নিয়ে তিনি হয়ে যেতে পারতেন অনেকখানি যান্ত্রিক, অনেকখানি কৃত্রিম, অনেকখানি বৃত্তাবদ্ধ। কিন্তু না। পাঠকের সৌভাগ্যের অনুকূলে তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে নদীর মতো প্রবহমান, বাগানের মতে সুরভিত, সমুদ্রের মতো গভীর প্রাণ। তাঁর দীর্ঘকবিতাগুলো এক একটি বাগান; তাঁর ছোট কবিতাগুলো আকৃতিতে ছোটো কিন্তু প্রাণপ্রাচুর্যে এক একটি পূর্ণবৃক্ষ। আজকাল অধিকাংশ কবি কবিতার অবয়ব ছোটো,তাদের ভাষায় স্মার্ট করতে গিয়ে তাকে ইটের উঠোন কিংবা বড়জোর বনসাই বানিয়ে তোলেন। সেখানে পাখির গান, ঢেউয়ের কলতান, হাওয়ার মাতলামি স্থান, দ্বাদশীর জোছনা প্রবেশাধিকার পায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কবিতার নামে সেসব হয় শব্দের খোয়াড়। আর কামাল চৌধুরী ক্ষুদ্র অবয়বের কবিতায় সঞ্চার করেন অনিঃশেষ প্রাণ। সেই প্রাণের মাঝে অশেষ সুধা; অফুরন্ত মাধুর্য, অনেকখানি রহস্যময়তা। সেই প্রাণ, সেই সুধা, সেই মাধুরী, সেই রহস্যের সন্ধান পেতে হলে যোগ্য পাঠক হতে হয়। চেনার মাঝে অচেনাকে দেখার, জানার মাঝে না-জানাকে বোঝার, ইঙ্গিতের মাঝে আড়ালকে পাঠের মেধা ও মন নিয়ে পাঠ করলে কামাল চৌধুরীর কবিতা থেকে প্রাপ্তিযোগ ঘটতে পারে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি।
‘প্রথম চুম্বনের পরে অর্ধেক জোয়ার দেখে সাগরে নেমেছি
সৈকতে যখন হই হই মধুচন্দ্রিমা
তখন লবণের ভাগ নিয়ে অভ্যাসবশত আমরা ঝগড়া করেছি
দ্বিতীয় চুম্বনের পরে তুমি আমাকে সূর্যাস্ত দেখাতে নিয়ে গেলে
অথচ আমাদের ভোরে উঠবার কথা ছিল
রাতে ভালো ঘুম হয়নি, আসল কথা আমরাই ঘুমাইনি
আমাদের কৈফিয়ত আছে
সকালের সব গল্প বিকেলে মানিয়ে যাচ্ছে বেশ
মাঝখানে একটা দিন রেখে দিয়েছি ঝিনুক বিক্রেতার জন্য।’
[মধুচন্দ্রিমা/ পান্থশালার ঘোড়া]
‘প্রকৃতপক্ষে কবিমাত্রই প্রেমের কবিতার কবি। ক্রিকেটারদের প্রধান পরীক্ষা যেমন টেস্ট খেলায়, কবিদেরও মূল পরীক্ষা প্রেমের কবিতা রচনায়। রবীন্দ্রনাথ তো বিশ্বপ্রেমিক; নজরুল ইসলামকে বিদ্রোহী কবি, সাম্যবাদী কবি প্রভৃতি নানা অভিধায় অভিষিক্ত করা হলেও তিনি ছিলেন মূলত এবং প্রধানত প্রেমের কবি; জীবনানন্দ দাশকে হতাশার বা নির্জনতার কবি বলার পেছনে যতই যুক্তি থাক, তিনি প্রধানত প্রেমের কবি; আল মাহমুদকে বিপ্লবী বা প্রতিবিপ্লবী যে যাই বলুক, তাঁর কাব্যনদীর মূলধারাই প্রেম; আর মহাদেব সাহা তো অক্লান্তভাবে প্রেমের অফুরন্ত কাব্যসম্ভার উপহার দিয়ে চলেছেন।’ কামাল চৌধুরী একজন শক্তিমান কবি। প্রত্যাশিতভাবেই তাঁর হাতে রচিত হয়েছে প্রেমের কবিতা। তাঁর প্রেমের কবিতা সংখ্যায় কম তবে প্রকাশরীতিতে অনেকখানিই ভিন্ন ধরনের। তিনি তাঁর ব্যক্তিজীবনের প্রেমকে সহজে শনাক্তযোগ্য লাইমলাইটে আনেননি কবি। তাঁর প্রেমের কবিতায় মিষ্টি লুকোচুরির খেলা আমাদের আনন্দ দেয় তবে তারও বেশি রেখে দেয় উদ্বেলিত কৌতূহল। যারা তাঁর কৈশোর-যৌবনের নিবিড় বন্ধু-সাথি, তাদের পক্ষে সম্ভব কবিতায় নামছাপানো সেই অথবা সেইসব প্রেমিকা অথবা অনুরাগের নারীদের কথা। তিনি জীবনানন্দ দাশের তরিকা অনুসরণ করে কোনো শেফালিকা বোস, সুজাতা, বনলতা সেন, সুরঞ্জনা ধরনের ছদ্মনামও ব্যবহার করেননি। তিনি কোনো নারীর চেহারার বর্ণনা অথবা শারীরিক আকর্ষণের কথা বলেননি। তাঁর প্রেমের কবিতায় আছে কতগুলো অচিহ্নিত মুগ্ধ সময়, কয়েকটি অসংজ্ঞায়িত ঘটনার ইঙ্গিৎ, কিছু মিষ্টি আনন্দের স্মৃতি-সংকেত। এমন কিছু কবিতার নাম ‘একটি অতৃপ্ত কবিতা’, ‘দুপরের চিত্রনাট্য’, ‘সন্দেহ’, ‘মধুচন্দ্রিমা’, ‘দৃষ্টি’, ‘যুগলবন্দি’, ‘দহনসন্ধ্যা’, ‘গৃহশিক্ষক’ প্রভৃতি।
‘তখন সিনেমার পোকা। মুনলাইটে শাবানা-নাদিমের ছবি
অ্যাটিনি দেখব
স্যারকে বলেছি পেটে খুব ব্যথা
প্রথম ক্লাসের শেষে ছুটি পেয়ে পালালাম
তোমারও ইশকুল ছিল, তোমারও অসুখ
দুপরের চিত্রনাট্যে এভাবেই কাহিনির শুরু…’
[দুপরের চিত্রনাট্যে/ পান্থশালার ঘোড়া]
কামাল চৌধুরীর কবিতাপাঠে এবং তাঁর কবিতাবিষয়ক আলোচনা ও সাক্ষাৎকারসমূহ পড়ে বোঝা যায় তিনি বিশ্বকবিতার নিরন্তর পাঠক। মেধাবী পাঠক। বাংলাকবিতার এবং বিশ্বকবিতার বিবর্তন ও পরিবর্তনসমূহ তাঁর চোখ এড়িয়ে যায় না কখনো। কবিতার প্রয়োজন কি, কবিতার পক্ষে বিপক্ষে যুক্তিসমূহ, কবিতার আঙ্গিকের ক্রমপরিবর্তনশীলতা প্রভৃতি বিষয় তিনি গভীর মনোনিবেশসহ পাঠ ও পর্যবেক্ষণ করেন। সেসব পাঠ ও পর্যবেক্ষণলব্ধ অভিজ্ঞান তাঁকে সহায়তা দেয়। তবে তিনি কোনো ইজমের স্রোতে ভেসে যান না। কবিতার বিশ্বে বেজে ওঠা কালের যাত্রার ধ্বনি তিনি কান পেতে শোনেন, তার রথের উধাও গতির দিকে চোখে মেলে দেখেন চেয়ে চেয়ে কিন্তু সবার সাথে দলবদ্ধ হয়ে সেই রথে ওঠেন না। ঝাঁকের কই হওয়া তাঁর নয়। তিনি তাঁর নিজস্ব পথ ধরে হাঁটা অব্যাহত রাখেন এবং যেখানে যতটুকু সংযোজন বিয়োজনের অপরিহার্যতা সিগন্যাল দেয়, সেখানে ততটকু যোগ বিয়োগ করে নেন কাঁধে ঝুলে থাকা কাব্যালংকারের ঝোলায়। কামাল চৌধুরী একটি বিরলপ্রায় গুণ হচ্ছে রসবোধ বা পরিহাসজ্ঞান। রসবোধের অভাবে আজকালকার সিংহভাগ কবিতাই নীরস, নিষ্প্রাণ ও উপভোগ্যতারিক্ত। একথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে বাঙালির রসবোধ বা সেন্স অব হিউমার সবচেয়ে কম। এটা তার আদি দৈন্য; চিরকালের রিক্ততা। অথচ নির্মম সত্য এই যে, রসবোধ ছাড়া কবিতার নামে যা লেখা হয় তা শেষ পর্যন্ত শব্দের বিফল খেলায় পর্যবসিত হয়। আবার রসবোধ কেবল থাকলেই হয় না, তার সঙ্গে মাত্রাজ্ঞান এবং ক্ষেত্রজ্ঞান থাকা লাগে। অন্যথায় মাত্রাজ্ঞানহীন ক্ষেত্রজ্ঞানহীন রসের প্রয়োগ কবিতাকে নিম্নমানের চটুল সৃষ্টিতে নামিয়ে দেয়। কামাল চৌধুরী পরিমিতিবোধ ও পরিহাসকে ব্যবহার করেন সুদক্ষ সুচারুতায় যাকে সোনায় সোহাগা—এই বাগধারার সঙ্গে তুলনা করা যায়। তাঁর ‘ছাত্রী নিবাস’ কবিতাটি যারা পড়েছেন, তারা দেখেছেন পরিহাস ও পরিমিতিবোধের পরিশীলিত সংশ্লেষ যা কবিতাটিকে সৃষ্টি হিসেবে অনন্যতায় উত্তীর্ণ হতে সহায়তা করেছে। তাঁর এই গুণটি আরও বহু কবিতায় সুখকরভাবে লক্ষযোগ্য। আজকাল একটু বড় আকৃতির কবিতা লিখলেই তার মাঝে বিবৃতিধর্মিতা, আতিশয্য, তারল্য ইত্যাদি আবিস্কারের মূর্খ আস্ফালন কোলাহল করে ওঠে। বনসাই দেখেই যার সবখানি তৃপ্তি, তার পক্ষে বাগান তো দূরের কথা, একটি বটবৃক্ষের সৌন্দর্য ও মহিমা উপভোগ করাও সম্ভব নয়। বেশকিছুদিন যাবত কবিতার রাজ্যে বনসাইপ্রেমীদের যূথবদ্ধ কোলাহল চলছে। সেই যূথবদ্ধ কোলাহলে যুক্তির চেয়ে অর্থহীন হইচই ও অক্ষমতার ঔদ্ধত্য অনেক বেশি। কামাল চৌধুরীর কানেও এসব প্রবেশ করে তাঁর চারপাশ থেকে। তিনি সেসব শোনেন হাসিমুখে কিন্তু পাত্তা দেন না। আবার কোলাহলের জবাব কোলাহলের ভাষায় দেন না। পরিমিতিবোধ আর পরিহাসসহ সৃষ্ট সাম্প্রতিকতম আঙ্গিকের পরিশীলিত কবিতায় তাঁর জবাব ফুটে ওঠে দৃঢ় অনুদ্ধততায়। আসুন পড়া যাক তেমনি একটি হীরকখ-তুল্য কবিতা :
‘এতদিন যা লিখেছি, দেখছি আাজ তার দাড়ি-গোঁফ গজিয়ে গেছে
বন্ধুরা বলছে, কাটো, কাটো
আমাদের নাপিত-সমাজে একদিন সিজার্স ব্রান্ডের
সিগারেট ফোঁকা ছাড়া
অন্য কিছুর সঙ্গে বিরোধ ছিল না
তবু এই অসম দ্বৈরথে ছোটবেলার মতো পাছায় ইট বিছিয়ে
বসে যাচ্ছি
যেকোনো গাছের তলায়
বাহ্বা দিচ্ছে কাঁচি, অভয় দিচ্ছে ক্ষুর
কাটো, কাটো, হে কবিতা তোমারও রক্তপাত চাই।
(নাপিত-সমাজ/পান্থশালার ঘোড়া)
আর দশটা প্রাণী ও প্রাণের মতোই মানুষ প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির সঙ্গে তার সম্পর্ক মানে নাড়ির সম্পর্ক। এ সম্পর্ক ছিন্ন করে বড় কবি হওয়া যায় না। কালজয়ী শিল্পী হওয়া যায় না। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর এক কবিতায় বলেছেন, ‘‘সিক্ত যাদের সারাদেহ মন মাটির মমতারসে/ এই ধরণীর তরণীর হাল রবে তাহাদেরই বশে।’’ এটা মানুষের সামাজিক রাজনৈতিক জীবনে যেমন সত্য, তেমনি সত্য তার সৃজনশীল জীবনে। প্রকৃতির চিরসচ্ছল ভান্ডার থেকেই কবিদের নিতে হয় রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ। কবিনামধারী যে-ব্যক্তি নদীর কলতান শোনে না, বৃক্ষের ফিসফিসানিতে কান পাতে না, বাতাসের সেতারে যার হৃদয় মুগ্ধ হয় না, সমুদ্র যাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে না, তার পক্ষে প্রকৃত কবি হওয়া শক্তিমান কবি হওয়া সম্ভব নয়। প্রকৃতি ছাড়া আরও কারও ভান্ডারে প্রাণের অনিঃশেষ মজুদ নেই। প্রাণ সঞ্চারণ ছাড়া কবিতা হয় না; যা হয় তা হলো শব্দের গুটি খেলা। কামাল চৌধুরী একথা খুব ভালো করেই জানেন; কেবল জানেন তাই নয়, মানেন এবং কবিতালেখার সময় উজ্জ্বল অব্যর্থতায় মেনে চলেন। তাঁর অবস্থান ছোটকাল থেকেই ইটপাথরের শহরে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে রাজধানীতে। মাঝখানে কিছুদিন কাজ করেছেন রাজধানীর বাইরে। কিন্তু তিনি সবসময়ই সকল অবস্থানেই মাটির মমতারসে সিক্ত থাকতে চেয়েছেন, থেকেছেন আপন দেহ-মনে-মননে-ভাবনায়-ভালোবসায়। তাঁর অবস্থান অট্টালিকায়, তাঁর চেয়ারটি দামি ধাতুতে মোড়ানো, তাঁর টেবিলটি বেলজিয়াম গ্লাসে ঝলমল কিন্তু কবিতা লেখার হাতখানি মাটিমাখা। যিনি বিশ্বাস করেন, ‘সবুজ পুস্তিকা ছাড়া মহাকালে কেউ কবি নয়।’, তাঁর বারবার প্রকৃতির কাছে—মাটির কোলের কাছাকাছি যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না :
‘দাঁড়িয়ে দেখছি, ভিখিরির মতো মেঘ
এক ফোঁটা জল নামিয়ে দিচ্ছে গাছে
সেখানে পাখিরা ভেজা পালকের ওমে
পুকুরে ঝাঁপানো কবিতাটি লেখা আছে।’
তো কামাল চৌধুরী ন্যায্যভাবেই নিজের কবিতা সম্পর্কে বলতে পারেন, ‘এই কবিতা মাটির হাতে লেখা।’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে—আধুনিকতা-উত্তর-উপনিবেশিকতা-উত্তরাধুনিকতা এতসব ইজমের ডামাডোলে বসে তিনি যখন নাগরিক জীবনের ছবি আঁকেন কবিতায়, তখনও তাঁর কবিতায় মাটির হাতের নরম উর্বর ছোঁয়া থাকে। প্রকৃতির ক্যানভাসে নাগরিক জীবনের ছবি আঁকতে পারেন তিনি শৈল্পিক সুচারুতায় যা অনেকখানি ঈর্ষণীয় কাব্যযশপ্রার্থীদের কাছে। তিনি সময়ের পরিবর্তন, রুচির পরিবর্তন, বিশ্বকবিতায় বহমান পরিবর্তনের হাওয়া সবকিছুকে আত্মীকরণ করে নগরে বসে নগরজীবনের কবিতা লিখেন; তাঁর কবিতার পাঠকগণও বলা যায় নগরের অধিবাসী—কেউ স্থায়ী, কেউ-বা লক্ষ্যান্বেষণে অভ্যন্তরীণ অভিবাসী। নগরজীবনকে সেই কালেই জীবনানন্দ দাশ তুলনা করেছিলেন লিবিয়ার জঙ্গলের সাথে; এতদিনে তা যে আরও বেশি জটিল-কুটিল হয়ে গেছে, এতে কারও কোনো সন্দেহ নেই। নগরের মানুষ এখন বৈষয়িকভাবে ভয়ংকর লোভী এবং আত্মবিনাশী অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কবি কামাল চৌধুরী এমন দূষিত পরিবেশে নিজের সবুজ সত্তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এবং বাঁচিয়ে রেখেছেন অটুট প্রাণবন্ততায়। বিপুল জনপ্রিয়তা কারণে এবং কিছুটা প্রভাববিস্তারী উচ্চ অবস্থানের কারণেও তাঁর চারপাশে লোকজনের ভিড় লেগেই থাকে। কিন্তু তিনি তাদের মতো নন; তাদের মতো হয়ে চাননি। তিনি ভিড়ের মাঝে নিজস্বতা ধরে রেখেছেন, তিনি কোলাহলের মাঝে কোলাহলের সাথে নিজ কণ্ঠস্বর মেলাননি। ফলে রাজধানীর নাগরিক উঠোনে বসবাস করেও তিনি রয়ে গেছেন রমনা পার্কের মতো সবুজতায় সচ্ছল। এই সবুজ প্রাণময়তার, এই বিরল শক্তিমত্তার অনুদান যোগ হয়েছে তাঁর নগরভাষিক কবিতাতেও। নগরের ভাষা আর প্রকৃতির সুর একসাথে বাঁধা পড়েছে তাঁর কবিতায়। তিনি বিশ্বকবিতার ধারক বাহক হয়েও রয়ে গেছেন সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা বাংলা ভূগোলের কবি যেভাবে ম্যারাডোনা-মেসিরা ইউরোপের বুট-জার্সি পরেও যান আর্জেন্টিনীয়ান।
‘ধাতব মুদ্রার মতো বেজে যাচ্ছে তোমার শহর
এ শহরে অনেক পিঁপড়ের ভিড়ে আমি বাস করি।
আমরা সুরের আগে পতনের শব্দ শুনি
হেভি মেটালের শব্দে মৃত রবীন্দ্রনাথের পাশে ঘুমিয়ে পড়ে
আমাদের সব নদী
লৌহকপাটের পাশে রক্তাক্ত নজরুলকে দেখে
ট্রামলাইনে কাটা পড়েন জীবনানন্দ দাশ।
এইসব ধাতব জীবন-যাপনের ফাঁকে
সঞ্চয় ছাড়াই
আমরা আরেকটি শীতকালের দিকে চলে যাচ্ছি।’
(শীতকাল/ কামাল চৌধুরী)
আমার আারেকটি ঝুঁকিপূর্ণ শীতকালের দিকে যাচ্ছি হয়তো-বা; সেই শীতকাল এলে আমাদের মানবিক বৃক্ষের পাতাগুলো ঝরে যাবে আরো বেশি বেশি। সেই শীতকাল এলে আমরা উষ্ণতার খোঁজে আত্মকোটরে ঢুকে যাব আরো বেশি বেশি। সেই শীতকাল এলে আমাদের পক্ষপুটের মৌরসি সঞ্চয় থেকে আরো বেশি বেশি কমে যাবে সম্পর্কের উষ্ণতা। আমরা নিশ্চয়ই তেমন আরেকটি শীতকালকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে চাইব না। চাইব তাকে তাকে ফিরিয়ে দিতে। আর যদি সেই শীতকাল অনিবার্য হয়ে ওঠে তবে তাকে মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হবে আমাদের। আমাদের প্রয়োজন হবে সক্রিয় সচেতনতায় প্রাণে ও প্রণয়ে সবুজ ও উষ্ণ থাকা। কামাল চৌধুরীর কবিতায় রয়েছে অনুরূপ সবুজ প্রাণ, মাটির মমতারসে উর্বর রোদচেতনার সচ্ছল সঞ্চয়।
Discussion about this post