দেবাশীষ বল
সর্ষে দেওয়া ব্যঞ্জন উপাদেয় হয় জানি, কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে থাকলেও যে উপাদেয় কিছু তৈরি হতে পারে তার আরেকটা প্রমাণ পেলাম বাবর আলীর ‘পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা’ বইটি পড়া শেষ করে। বইটির বিষয়বস্তু পদব্রজে বঙ্গদেশের সবকটি জেলা পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা।
লেখকের ৬৪ জেলা ভ্রমণের ধারাবাহিক গল্প পত্রপত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে বহুল চর্চিত হয়েছে – পরিণত হয়েছে অনেকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। তারই ফলশ্রুতিতে চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন এবার বাবর আলীর ভ্রমণের গল্পটিকে দুই মলাটের ভেতরে নিয়ে এসেছে।
তরুণ লেখক বাবর আলী পেশায় ডাক্তার, নেশায় পাহাড়ি। প্রথম প্রেম পাহাড় হলেও ভ্রমণের পোকা যে তাকে প্রতিনিয়ত দংশন করে যাচ্ছে তা তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতার বহর দেখলেই বোঝা যায়।
বইয়ের ভূমিকা থেকেই আমরা জানতে পারি বাবর আলীর ভ্রমণ পরিকল্পনার আঁতুড় ঘরের কথা।
লেখক কিন্তু এর আগে সাইকেলে পুরো দেশ ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু দ্রুতগতির সাইকেলে চেপে কি আর ৬৪টি জেলাকে আঁশ মিটিয়ে দেখা যায়! তাই শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার মোটা বেতনের নিশ্চিত চাকরি ছেড়ে লেখক পায়ে হেঁটে পুরো দেশটা ঘুরে দেখার “ওয়ানস ইন আ লাইফটাইম” অভিজ্ঞতা লাভের সিদ্ধান্ত নেন। তবে মূল যাত্রায় বেরোনোর আগে ওয়ার্ম-আপ হিসেবে প্রায়ই বেরিয়ে পড়তেন লম্বা দৈর্ঘ্যের হাঁটায়। তার মধ্যে একদিন চট্টগ্রাম থেকে কাপ্তাই পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটারের হন্টন পর্ব অন্যতম।
পদব্রজে পুরো দেশটাকে ছয়টি ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগ করা, বাংলার হরেক চরিত্রের মানুষের সাথে মিথস্ক্রিয়ার পাশাপাশি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য তার ছিল। হিমালয়ে পর্বত অভিযানে গিয়ে লেখকের সঙ্গে একবার এক বিদেশির সঙ্গে পরিচয় হয়। বিদেশি বন্ধুটির কাছ থেকেই তিনি “সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক”-এর ব্যবহার কমানোর জন্য সচেতনতা তৈরিতে উৎসাহিত হন, আর তাই সচেতনতার সেই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন দেশভ্রমণের উদ্যোগটিকে। জানতেন প্লাস্টিকসৃষ্ট বিশাল এই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে তার এই উদ্যোগের ভূমিকা হয়তো অতি ক্ষুদ্র, তবু একজন মানুষও যদি তার মাধ্যমে সচেতন হয় তাতেই তার এই উদ্যোগের সার্থকতা বলে তিনি মনে করেন।
অতঃপর ২০১৯ সালের ২৫ শে অক্টোবর শুরু হয় তার আনুমানিক ৮০ দিন ও প্রায় ৩০০০ কিলোমিটারের এই যাত্রা।
জানতেন সবকটা জেলা ছুঁলেও সবকয়টার হয়তো জেলা সদর যাওয়া হবে না – কিছু ক্ষেত্রে উপজেলা সদরেও থাকতে হতে পারে। আর দিনশেষে থাকা-খাওয়ার সংস্থান হবে কোনো না কোনো শুভাকাঙ্ক্ষির বাড়িতে।
পুরো অভিযানে বাংলার রূপ-রস-গন্ধে লেখক বিমোহিত হয়েছেন – চলতিপথে মহাসড়কের পাশাপাশি পথ হেঁটেছেন শহরতলীর কাঁকর বিছানো সড়কে, পা ফেলেছেন খেতের মাঝখানের কাদামাখা আইলে। তবে অতি ব্যস্ত রাস্তায় দ্রুতগামী যানবাহনের হর্ন শুনে হাঁটার চেয়ে ছায়া-সুনিবিড় রাস্তায় হাঁটাটা অধিক উপভোগ্য ছিল তার কাছে৷ রাস্তার পাশে অবিরত ধানখেত দেখে জুড়িয়েছেন দুচোখ – আকাশমণি, কড়ই কিংবা ইপিল ইপিল গাছে ছাওয়া রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে খুঁজে ফিরেছেন কৈশোরের দিনগুলো – তুলসীমালা ধানের সূক্ষ্ম গন্ধভরা বাতাসে নিয়েছেন নিঃশ্বাস। পুরো মৌসুম বর্ষার পানিতে গা ডুবিয়ে রেখে সদ্যই হাওড়ের বুক থেকে মাথা তোলা সুনামগঞ্জের রাস্তা তাকে দিয়েছে প্রশান্তির ছোঁয়া। তার লেখায় বারবার উঠে এসেছে এ দেশের মানচিত্রে শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নদ নদী এবং তাদের মোহনীয় নাম নিয়ে তার মুগ্ধতার কথা। দক্ষিণবঙ্গের খরস্রোতা নদীগুলো দেখে মন যেমন নেচে উঠেছে তেমনি উত্তরবঙ্গের মরা নদীগুলো দেখে হয়েছেন মর্মাহত।
চলতি পথের ধারে অযত্নে পড়ে থাকা শিউলি ফুল কিংবা তারাকান্দা উপজেলার শত শত শাপলা ফুল থেকেও লেখক খুঁজে নিয়েছেন আনন্দ। বিলের পর বিল জুড়ে ফুটে থাকা পদ্ম তার চলার পথের গতিকে করেছে শ্নথ – রাস্তার পাশাপাশি সমান্তরালে এগোনো রেলগাড়ি, সবুজ ঘাসের চাদরের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া এক ফালি পায়ে চলার রাস্তা কিংবা নরম ঘাসে পা ডুবিয়ে হাঁটার বর্ণনায় ফুটে ওঠে প্রকৃতির প্রেমমগ্ন এক সত্তার স্বরূপ। তার সরস বর্ণনায় আমরাও যেন কল্পনার চোখে তার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে উপভোগ করি ঈশ্বরদীর ঈদে মিলাদুন্নবি পালনের আড়ম্বর, সৈয়দপুরের আকাশে দীপাবলির আতসবাজির রোশনাই কিংবা সুবিশাল মধুমতী নদীর রূপ।
৩২০ পৃষ্ঠার পুরো বইটি জুড়ে লেখকের অনুসন্ধিৎসু কৌতূহলী দৃষ্টি আমাদের সন্ধান দেয় চেনা বাংলার অচেনা হাজারো রূপের। তাই আকর্ষণীয় লাল মলাট আর ঘিয়ে রঙের কাগজের কারাগারে বন্দি ভ্রমণের এই রোজনামচা যে পাঠকের কাছে দারুণ উপভোগ্য এক অভিজ্ঞতা হবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আগ্রহী পাঠকগণ বইটি সংগ্রহ করতে পারবেন চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন, বাতিঘর, রকমারি এবং প্রথমাসহ আরো বেশকিছু প্ল্যাটফর্ম থেকে।
Discussion about this post