আতিক আকবর
জীবনে বেঁচে থাকা মানেই কতগুলো গল্প। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, মিলন-বিরহ নিয়েই চলে জীবনের নৌকা। কেউ হোঁচট খায়, কেউ পড়তে পড়তে দাঁড়িয়ে যায়। দুটো মানুষের মন, আবেগ, ভালো লাগা যখন একটা বিন্দুতে স্পর্শ করে, শুরু হয় ভালোবাসা, স্বপ্ন দেখার অভিযাত্রা। কখনোবা দুজনের মাঝে প্রবেশ করে তৃতীয় কেউ। ভুল বোঝাবুঝি, সন্দেহ, সম্পর্কের টানাপড়েন দুর্বিষহ করে দেয় জীবনকে। তবু জীবন চলে। চলতে হয়। মানুষের স্বপ্ন থেমে থাকে না। আশায় থাকে কাঙ্খিত সকালের।
কবি ও কথাসাহিত্যিক আলমগীর খোরশেদ তার গল্পগ্রন্থ ‘ভালোবাসায় চোরাকাঁটা’য় মানুষের যাপিত জীবনে একজন নর ও একজন নারীর সম্পর্কের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দশটি জীবনধর্মী গল্পের ক্যানভাস এঁকেছেন। লেখক তার ‘ভালোবাসায় চোরাকাঁটা’ গল্পে গ্রামীণ জীবনের চিত্র, রনজু ও মিতু নামের দুটি ছেলেমেয়ের প্রেম, সহজ-সরল ভালোবাসার রূপ বোঝাতে মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। রনজুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মিতুর স্বপ্নের যবনিকা পাঠকের দুচোখের কোণ চিকচিক করে উঠবে বৈকি।
‘হাওর পাড়ের কাব্য’ গল্পে হাওরবাসীর সুখণ্ডদুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিয়ে, তাদের জীবনধারা তুলে ধরেছেন লেখক আলমগীর খোরশেদ। মোতালেব ভালোবাসে তার পাশের আডির মেয়ে দোলনকে। অভিভাবক পর্যায়ে বিয়ের কথাবার্তা ও তারিখ নির্ধারণ হয়, ধান মাড়াইয়ের পর। তা আর হয়ে ওঠেনি, অতিবৃষ্টিতে বন্যায় হাওরের একমাত্র ফসল ধান পানিতে তলিয়ে যায়। অভাব, অপারগতা ভালোবাসার মাঝে দেয়াল করে দেয়। দোলন অপেক্ষায় থাকে শহরে আসা মোতালেব কবে ফিরে আসবে, সেইদিনের।
‘তবুও জীবন চলে’ গল্পটিতে আলমগীর খোরশেদ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি, যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রীর অপেক্ষা, ছোট্ট সন্তানের ভবিষ্যৎ, অসুস্থতা, একাকিত্ব তুলে ধরেছেন। এত কিছুর পরও জীবন চলে। চলতে হয়। নতুনত্ব নিয়ে।
‘পলাতকা মন’- মানুষের সুখ টাকা, দামি ফ্ল্যাট, গহনা দিয়ে নয়, মন ও তার মূল্যায়ন থেকে হয়। সবাই তার প্রথম প্রেম, ভালোবাসাই হৃদয়জুড়ে লেপ্টে থাকে আমৃত্যু। পলাতকা মনের সাধ্য থাকে না সেখান থেকে বেরিয়ে আসে।
‘একজন বাবার গল্প’- বাবারা চিরকালই বাবা। শত কষ্ট, দুঃখ সয়েও সন্তানের জন্য বিলিয়ে দেন নিজেকে, তেমনি একটি গল্পের ক্যানভাস সামনে তুলে ধরেছেন লেখক আলমগীর খোরশেদ এই গল্পে।
‘অন্যরকম একটি ভ্যালেন্টাইন্স ডে’- ফেসবুকে পরিচয় হওয়া অতসীকে না দেখেই ভালোবাসে সোহাস। ভালোবাসা দিবসে দেখা হয় পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী। অতসীর বর বিদেশ গিয়ে বিনা কারণে তালাকনামা পাঠায়। নিকটাত্মীয় দ্বারা অতসী সন্তান ধারণ করে। সেটা এবোরশন করানোর জন্য সোহাসকে অনুরোধ জানায়। যা ছিল সোহাসের কাছে সবার থেকে ভিন্ন একটি ভ্যালেন্টাইন দিবস।
‘আজও অপেক্ষায়’ গল্পটি পুরোটা যেন একটা গ্রামের ছবি। লেখক তার ছেলেবেলায় গ্রামে থাকাকালীন জীবনলিপি, ভালো লাগা, সবকিছু ফুটে উঠেছে শৈল্পিক বর্ণনায়। আজও প্রিয় মানুষটির অপেক্ষায় আছেন তিনি।
‘পাগল’ ও ‘ঝানুমামা’ দুটো গল্পই মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তীকালের আবহ নিয়ে লেখা। একমাত্র সন্তান পাগল হয় কীভাবে, ভেবে পান না বাবা মুক্তিযোদ্ধা আফজাল সরকার। যুদ্ধে গিয়ে স্ত্রী দিলুকে হারান ঝানুমামা। যুদ্ধে জিতে এলেও তারা হেরে গেছেন, হার মেনেছেন সমাজ, বাস্তবতা আর অপারগতার কাছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে।
‘দূরত্ব’- সম্পর্কের দূরত্ব মাইল কিলোমিটারে মাপা যায় না, যা হৃদয়ে দেয়াল তুলে মনের কষ্টকে উসকে দেয় মানবজীবনে, তেমনি প্রেক্ষাপট নিয়ে রচিত গল্প ‘দূরত্ব’। সম্পর্কে বৈষয়িকতা থেকে মায়া বেশি জরুরি। টান, আবেগ, ভালোবাসাহীন সম্পর্ক নামেমাত্র, আসলে তা জীবন্ত মমি যেন। কবি ও কথাসাহিত্যিক আলমগীর খোরশেদ তার তৃতীয় গল্পগ্রন্থ ও তার উনিশতম বই ‘ভালোবাসায় চোরাকাঁটা’ পাঠক মহলে সমাদৃত হোক, এই কামনা। প্রকাশিত হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২-এ, জাগৃতি প্রকাশনী থেকে।
Discussion about this post