অনলাইন ডেস্ক
মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের গল্প, মুক্তিবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধের তথ্যসহ নানা ঘটনাবলী জায়গা করে নিয়েছে বাংলা সাহিত্যে। গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও গবেষণামূলক প্রবন্ধে স্থান পেয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা। প্রতিবছর বইমেলায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে উপজীব্য করে অসংখ্য গ্রন্থ বের হয়। ব্যতিক্রম নয় এবারো। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত বেশকিছু গ্রন্থ ইতোমধ্যে সাড়া ফেলেছে।
নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম মাঠে চলছে বইমেলা। মেলায় আসা পাঠকের আগ্রহে থাকা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ‘জাদুমানিক স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প’, করিম আবদুল্লাহর ‘চট্টগ্রাম শহরে গেরিলা যুদ্ধ’, সুশীল বড়ুয়ার ‘একাত্তরের স্মৃতি মুক্তিযুদ্ধে গহিরা অংকুরঘোনা ও রাউজান’, কালাম আজাদের ‘মুক্তিযুদ্ধে আরাকানে বাঙালি শরণার্থী’, শাহিন আকতার সম্পাদিত ‘৭১ এর স্মৃতিকথা’, শুকলাল দাশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিশোর উপন্যাস ‘তুহিনের স্বাধীন দেশ’, সরোজ আহমেদের ‘ওরা মুক্তিযুদ্ধের লড়াকু কিশোর’ এবং জাকির হাসানের ‘ছোটদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’।
স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম শহরে মুক্তিকামী জনগণ যেসব গেরিলা অভিযান চালিয়েছেন তার ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে করিম আবদুল্লাহর ‘চট্টগ্রাম শহরে গেরিলা যুদ্ধ’ গ্রন্থে। যেমন আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক অপারেশন, জাতিসংঘ প্রতিনিধিদলের উদ্দেশে আগ্রাবাদ হোটেলের ট্রান্সফর্মার ধ্বংস, আইস ফ্যাক্টরি রোড অপারেশন, পাঠানটুলী ফায়ার ব্রিগেড কেন্দ্র আক্রমণ, চট্টগ্রাম শহরে একই দিনে একই সময়ে- ভোর পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটায় পঁচাশিটি স্পটে বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো, আসকারাবাদে দালাল মোহাম্মদ আলী মিঞার বাড়ি আক্রমণসহ। এছাড়া অমল মিত্র মুক্তাঞ্চল এলাকায় এক নৌ বাহিনী সদস্যের হত্যাকাণ্ডে একাই অংশগ্রহণ, চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশন জ্যাকপট, সামারিক আইন উপ-প্রশাসকের সদর দপ্তর (সার্কিট হাউজ) এলাকায় রক্ষিত জাতিসংঘের জিপ ধ্বংস, হোটেল ময়কং রেস্টুরেন্ট অপারেশন, ইপিআরটিসি বাস অপারেশন, লাফার্জ পেট্রোল পাম অপারেশন, ফজলুল কাদের চৌধুরীর কুখ্যাত চেলা বাকলিয়ার বাঙ্গুমিঞা চেয়ারম্যান, মুসলিম লীগের কুখ্যাত গুণ্ডা বাকলিয়ার কানাইয়া সেকান্দর, চট্টগ্রাম বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক আবদুল কাহহার হত্যা অপারেশনের তথ্য জানা যাবে এ গ্রন্থ থেকে।
ভূমিকায় লেখা হয়েছে, তৃণমূলের একজন সাধারণ যাদ্েধা হিসেবে ভারতে প্রশিক্ষণকালীন অভিজ্ঞতা এবং ভেতরে অবস্থানকালে যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান থেকে দেখা অভিজ্ঞতাগুলোই বইতে প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এ অভিজ্ঞতা শুধু যুদ্ধের অভিজ্ঞতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, আমার দেখা যুদ্ধপূর্ব আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার রূপচিত্রের সাথেও যথাসম্ভব সম্পর্কিত করে বলার চেষ্টা করা হয়েছে। যে অভিজ্ঞতা অবশ্যই খণ্ডিত, কিন্তু প্রতিনিধিত্বমূলক।
সুশীল বড়ুয়ার ‘একাত্তরের স্মৃতি মুক্তিযুদ্ধে গহিরা অংকুরঘোনা ও রাউজান’ গ্রন্থটি অনেক তথ্যবহুল। মুক্তিযুদ্ধে অংকুরঘোনা, মুক্তিযুদ্ধে রাউজান এবং মুক্তিযুদ্ধে বাম ধারা, শিরোনামে দৈনিক আজাদীতে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছিল বইটির অনেকটুকু অংশ। ভূমিকায় সুশীল বড়ুয়া লিখেছেন, চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা অংকুরঘোনা-দুই বর্গকিলোমিটারের একটি ছোট্ট দ্বীপগ্রাম। চারদিকে হালদা নদী। মোট জনসংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের মতো। সবাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। পেশায় কৃষক, ক্ষেতমজুর এবং হালদা নদীর উপর নির্ভরশীল। তার মধ্যে একমাত্র ব্যবসায়ী চন্দ্র মোহন বড়ুয়া। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কীভাবে গ্রামবাসীদের পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসরদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন তার বর্ণনা আছে এই বইয়ে। আছে ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন ও আমার মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ইতিহাস।
সাংবাদিক শুকলাল দাশের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস ‘তুহিনের স্বাধীন দেশ’। তবে এখানে লেখক কেবল গল্প বলেননি। বরং গল্পের আবহে তুলে ধরেছেন এক নিরেট সত্য, বাঙালির বিজয় এসেছে তুহিনের মত লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে। গল্পের ঢংয়ে লেখক একটা সময়কে তুলে এনেছেন সমকালের সামনে। যে সময়টা ছিল বাঙালি জাতির জন্য অনেক অর্থবহ। ৫০ বছর পার হলেও নিখুঁত বর্ণনায় সে সময়টা স্বচ্ছ আয়নার মত ধরা দিবে পাঠকের কাছে। যে আয়নায় ভেসে উঠেবে বাঙালির গৌরব মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ।
বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ‘জাদুমানিক স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ মূলত কিশোর-তরুণদের উপযুক্ত গ্রন্থ। ফ্ল্যাপে লেখা আছে, বাঙালির জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এ অধ্যায়ের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষের রক্ত ও অশ্রু। সেইসব রক্ত ও অশ্রুমাখা ঘটনাধারা একদিকে যেমন বুকভাঙা বেদনাময় অন্যদিকে তেমনি আকাশ ছোঁয়া গৌরবের। এর পটভূমি এত বিশাল যে, অনেক কিছুই এখনো ঐতিহাসিকদের অজানা, গবেষকদের অনুসন্ধানী দৃষ্টির আড়ালে। আমাদের সৃজনশীল সাহিত্য স্রষ্টারা তাঁদের অনন্য কুশলতা দিয়ে তুলে আনছেন সেইসব অকথিত আখ্যান। ‘জাদুমানিক স্বাধীনতা সেরকমই একটি চমকপ্রদ আখ্যান।
কালাম আজাদের ‘মুক্তিযুদ্ধে আরাকানে বাঙালি শরণার্থী’ গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আরাকানে আশ্রয় নেওয়া বাঙালি শরণার্থীদের কর্মকাণ্ড, জীবন যাপন এবং শরণার্থী সম্পর্কে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিমাতাসূলভ আচরণ ইত্যাদির সামগ্রিক চিত্র তথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী দেশের অবস্থান ও ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
সরোজ আহমেদের ‘ওরা মুক্তিযুদ্ধের লড়াকু কিশোর’ গ্রন্থে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দেশমাতৃকার জন্য লড়াই করা ১৮ জন দূরন্ত এবং কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের গল্প তুলে ধরা হয়েছে। সরোজ আহমেদ আজাদীকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে বড়দের মতো লড়াই করেছে অগণিত শিশু-কিশোরও। তারা কখনও সরাসরি যুদ্ধ করেছে, কখনও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। কেউ কেউ জীবনবাজি রেখে গ্রেনেড হাতে ছুটে গেছে পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে। পলকেই উড়িয়ে দিয়েছে শত্রুদের আস্তানা। মুক্তিযুদ্ধে শিশু-কিশোরদের অবদান কিছুতেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
আলোচনা সভা :
গতকাল বইমেলা মঞ্চে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান। তিনি বলেন, পাকিস্তান আমলে প্রথম আঘাত আসে আমাদের সংস্কৃতি ও ভাষার উপর। সেই ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষার সংগ্রাম শুরু করে ১৯৫২ সালে এদেশের তরুণ ছাত্রসমাজ বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। জাতির পিতার ঐতিহাসিক ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ সে এক অমর কবিতা, এই কবিতাই মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে।
কবি ও সাংবাদিক নাজিমুদ্দীন শ্যামলের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেন, চসিক প্রধান শিক্ষা কর্মকতা লুৎফুন নাহার। প্রধান আলোচক ছিলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা কবি ফাউজুল কবির। বক্তব্য দেন, বইমেলা কমিটির আহ্বায়ক কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু, সলিম উল্লাহ বাচ্চু।
Discussion about this post