মাহমুদ আহমদ
প্রাণঘাতী মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে সমগ্র বিশ্ব এখন আতঙ্কিত। এ বিষয়ে আমাদেরকে আতঙ্কিত না হয়ে সচতেনতা অবলম্বন করতে হবে আর আল্লাহর কাছে নতজানু হয়ে সবিনয় প্রার্থনা অব্যাহত রাখতে হবে।
যদিও বিশ্বময় এ মহামারির কারণে স্বাভাবিক জীবন যাপন কিছুটা কঠিন, তারপরও আমাদেরকে ধৈর্যধারণ করতে হবে। সবে মাত্র আমরা পবিত্র রমজান মাস শেষ করে শাওয়াল মাস অতিবাহিত করছি। অনেকে শাওয়াল মাসের রোজা রাখছেন।
বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতে স্বাভাবিক জীবনযাপন যদিও কষ্টকর তারপরও একজন মুমিন কখনও তার ইবাদত-বন্দেগিতে কমতি করেন না। সে পুরো রমজানে যেভাবে ইবাদত-বন্দেগিতে রত থেকে কাটিয়েছেন ঠিক সেভাবেই বছরের অন্যান্য দিনগুলো অতিবাহিত করার চেষ্টা করেন।
সব ক্ষেত্রে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করেন তাদের বিষয়ে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاء مَرْضَاتِ اللّهِ وَاللّهُ رَؤُوفٌ بِالْعِبَادِ
‘আর মানুষের মাঝে এক শ্রেণির লোক রয়েছে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিকল্পে নিজেদের জান বাজি রাখে। আল্লাহ হলেন তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত মেহেরবান।‘ (সুরা বাকারা : আয়াত ২০৭)
মহামারির এ দিনগুলোতে মুসলিম উম্মাহর একটি বড় শ্রেণি এমন আছেন যারা বিশেষ ইবাদত-বন্দেগিতে সময় অতিবাহিত করছেন। আবার এমনও অনেক রয়েছেন যারা এখনও ইবাদতের দিকে মনোযোগ দেননি। যারা ইবাদত-বন্দেগিতে গাফেল তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, এখনও যদি আপনাদের হুশ না হয় তাহলে আর কবে হবে? এখনও কি আল্লাহর দিকে ফেরে আসার সময় হয়নি?
বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিকে আমরা কি অনেক কষ্টকর মনে করছি? আমরা কি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ের দুঃখ-কষ্টকে ভুলে গেছি? তারা ধর্মের জন্য কতই না কষ্ট করেছেন, সব প্রকার ত্যাগ স্বীকার করেছেন, দিনের পর দিন অনাহারে থেকেছেন, তারপরও তারা নামাজ, রোজা ও অন্যান্য পুণ্যকাজ পরিত্যাগ করেননি।
ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের ওপর আক্রমণকারীরা কতই না জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন করেছে, যা বর্ণনাতীত। আর অপর দিকে আমরা কি দেখতে পাই, মুসলমানদের ক্ষুদ্র দলটি হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি পরম শ্রদ্ধায় অনুপ্রাণিত হয়ে অতুলনীয় বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন।
ওহুদের ময়দানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র শরীর আঘাতে জর্জরিত হয়েছিল, তার পবিত্র দাঁতও এতে শহিদ হয়। তারপরও তিনি তাদের জন্য পরম দয়াময় আল্লাহর কাছে হেদায়াত কামনা করেছেন। ওহুদের ময়দানে তার পবিত্র সাহাবাদেরকে এমন নির্দয়ভাবে আঘাত করে শহিদ করা হয়েছে যে, তাদের মৃতদেহ পর্যন্ত সনাক্ত করা যায়নি।
তা সত্বেও কোনো সাহাবা ইসলাম এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ত্যাগ করে চলে যাননি বরং তাদের মনোবল আরো দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছিল। তারা এটা বলেন নি যে, আমরা এই দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে পারছি না, তাই ইসলাম ত্যাগ করছি।
বরং তাদের মনোবল এমন পাহাড়ের ন্যায় ছিল যে, এ পথে নিজ প্রাণ কুরবান করতে সদা প্রস্তুত ছিল। এত কষ্ট সহ্য করা সত্বেও তারা ঠিকমত নামাজ আদায় করেছেন, রমজানের রোজা রেখেছেন। আবার নফল নামাজেও অতিবাহিত করেছেন রাত।
এরপর শিবে আবু তালিব উপত্যকায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার সাহাবায়ে কেরামের বন্দী জীবনের দুর্বিসহ দিনগুলোর ইতিহাসও আমাদের সামনে রয়েছে। সেই দিনগুলোতে তাদের কাছে না ছিল মাল-সামান আর মজুদ খাদ্য সামগ্রী। অবরুদ্ধ অবস্থায় কী যে নিদারুন দুঃখ-কষ্টের মধ্যে তারা কালাতিপাত করেছিলেন তা কেবল ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কারো পক্ষে কল্পনা করাও দুঃসাধ্য।
এই দুঃসহ অবস্থা চলেছিল প্রায় তিন বছর। খাদ্য-সামগ্রী সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেয়া হলে গাছের পাতা আর চামড়া খেয়েই সাহাবাদের জীবনধারণ করতে হয়। নারী শিশুদের কান্নার আওয়াজে বাতাস ভারি হয়ে যেত আবু তালিবের উপত্যকায়। এমন ভয়াবহ সময়ে কেমন কেটেছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার সাহাবায়ে কেরামের দিনগুলো?
কেমন ছিল সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তগুলো? তা রাসলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবাদের বর্ণনা থেকেই তা জানা যায়-
হজরত সাআদ বিন আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘কোনো এক রাতে একটি শুষ্ক চামড়া পেয়ে তা ভালোমতো ধুয়ে নিলাম। তারপর আগুনে তা গুঁড়া করে নিলাম। পানিতে মিশিয়ে তৃপ্তি নিয়ে খেলাম।’
এ তো শুধু এক সাহাবার অবস্থা ছিল না বরং সবার অবস্থাই ছিল অকুণ্ঠ শোচনীয়। এ কষ্টের পরিণতিতে মৃত্যুবরণ করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশ্বস্ত সহধর্মিণী হজরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা এবং চাচা আবু তালিব।
হায়! আমার দয়াল রাসুল কত কষ্টই না সহ্য করেছেন তারপরও তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে তার প্রভুর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। শিবে আবু তালেবের এ কঠিন পরিস্থিতিতেও সাহাবায়েকেরাম একবারের জন্যও বলেননি, বর্তমান বৈরি অবস্থায় আমাদের জন্য নামাজ ও রোজাকে মাফ করে দেয়া হোক।
একটু ভেবে দেখুন! ইসলামের জন্য, আল্লাহর একত্ববাদের জন্য আমাদের প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সাহাবারা কতই না কষ্ট সহ্য করেছেন। সেই তুলনায় আমরা কি এর সামান্য পরিমাণও কষ্ট সহ্য করছি?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই সাহাবাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
‘হে শান্তিপ্রাপ্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রতিপালকের কাছে ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।’ (সুরা ফাজর : আয়াত ২৭-৩০)
বিপদাপদ যাই হোক না কেন একজন মুমিন তার ইবাদতে কখনই কমতি করে না বরং কঠিন পরিস্থিতিতে ইবাদত-বন্দেগিতে আরো গতি সৃষ্টি করে।
আসুন, সকাতরে আল্লাহর দরবারে দোয়া করি, হে দয়াময় প্রভু! সব বিপদাপদ থেকে আমাদের রক্ষা করুন আর আমাদের তাওবা কবুল করে তোমার দয়ার চাদরে আবৃত করে নিন। আমিন।
লেখক-ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
Discussion about this post