দুধ’ মার দুগ্ধ পান : আরবদের প্রথা ছিল যে তাঁরা তাদের শিশুদেরকে বেদুঈন অধ্যুষিত মরু অঞ্চলে লালন-পালন করার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিত। সেখানে তাদের দৈহিক সুস্থতার অনুকুল পরিবেশ ছিল। রাসূলের পবিত্র জন্ম লাভের পর বনী সা‘দ গোত্রের কিছু বেদুঈন লোক মক্কায় আসে। তাদের মহিলারা মক্কার ঘরে ঘরে শিশুর অনুসন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু রাসূলের পিতৃহীনতা ও দারিদ্রের কারণে কেউ তাকে নেয়নি। হালিমা সা‘দিয়াও ছিল তাদের মধ্যে একজন। সবার মত সেও ছিল বিমুখ। শিশু পালনের পারিশ্রমিক দিয়ে জীবনের অভাব অনটন বিমোচন করার লক্ষ্যে মক্কার অধিকাংশ ঘরে শিশুর অনুসন্ধান করেও সফল হয়নি সে। অধিকন্তু সে বছরে ছিল অনাবৃষ্টি ও খরা। তাই স্বল্প পরিশ্রমিকে এতিম সন্তানকে নেয়ার উদ্দেশ্যে আমেনার ঘরে আবার ফিরে আসে সে। হালিমা আপন স্বামীর সাথে মক্কায় মন্থর গতিতে চলে এমন একটি দূর্বল গাধিনী নিয়ে এসেছিল। কিন্তু প্রত্যাবর্তনের পথে রাসূলকে কুলে নেয়ার পর গাধিনী অত্যন্ত দ্রুত গতিতে চলতেছিল এবং অন্যান্য সব জানোয়ারকে পিছনে ফেলে আসছিল। ফলে সফর সঙ্গীরা অত্যন্ত আশ্চর্যাম্বিত হয়। হালিমা আরো বর্ণনা করেন যে, তাঁর স্তনে কোন দুধ ছিল না, তাঁর ছেলে ক্ষুধায় সর্বদা কাঁদতো। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পবিত্র মুখ স্তনে রাখার পর প্রচুর পরিমাণে দুধ তাঁর স্তনে আসতে লাগলো। বনী সা‘দ গোত্রের অধ্যুষিত অঞ্চলের অনাবৃষ্টি সম্পর্কে বলে যে, এ শিশু (মহাম্মদ) দুধ পান করার বদৌলতে জামিতে উৎপন্ন হতে লাগলো ফল মুল এবং ছাগল ও অন্যান্য পশু দিতে লাগলো বাচ্চা। অবস্থা সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। দারিদ্র ও অভাব-অনটনের পরিবর্তে সুখ ও সমৃদ্ধি সর্বত্র রিাজমান। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হালিমার পরিচর্যায় দুবছর পালিত হয়।হালিমা তাঁকে দারুণ ভাবে চাইতো। হালিমা নিজেই হৃদয়ের গভীরে এ শিশুকে ঘিরে রাখা অস্বাভাবিক কিছু জিনিস পুরো অনুভব করতো। দু’বছর শেষ হবার পর হালিমা তাকে মক্কায় মাতা ও দাদার কাছে নিয়ে আসলো। কিন্তু হালিমা রাসূলের বরকত অবলোকন করে যে, বরকত তাঁর অবস্থায় পরিবর্তন ঘটায় আমেনার কাছে রাসূলকে দ্বিতীয় বার দেয়ার জন্য আবেদন করলো। আমেনা তাতে সম্মত হয়। হালিমা এতিম শিশুকে নিয়ে নিজ এলাকায় আনন্দ ও সন্তোষ সহকারে ফিরে আসে।
বক্ষ বিদারণ : এক দিন শিশু মুহাম্মাদ হালিমার ছেলেরে সাথে তাবু থেকে দূরে খেলা-ধুলা করতেছিল। এ সময় তাঁর বয়স ছিল চার বছরের কাছাকাছি, এমতাবস্থায় হালিমার ছেলে ভীত সন্ত্রস্ত ও আতংকগ্রস্ত হয়ে মায়ের কাছে দৌড়ে এসে তাকে কুরাইশী ভায়ের সাহায্যে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানালো। ঘটনা কি জিজ্ঞেস করা হলে সে উত্তর দেয় যে, দু’জন সাদা পোষাক পরিহিত লোককে আমাদরে কাছ থেকে মুহাম্মাদকে নিয়ে মাটিতে চিৎকরে তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করতে দেখেছি। তাঁর বর্ণনা শেষ না করতেই হালিমা ঘটনা স্থলের দিকে দৌড়ে যান। গিয়ে দেখেন মুহাম্মদ নিজ স্থানে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর মুখমন্ডল হলুদ বর্ণ, দেহ ফ্যাকাশে। তাঁকে ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে অত্যন্ত শান্ত ভাবে জবাব দেন যে তিনি ভাল আছেন। তিনি আরো বলেন: সাদা পোষাক পরিহিত দু’ব্যিক্তি এসে তাঁর বক্ষবিদীর্ণ করে হৃদয় বের করে কাল জমাট বাধা রক্ত বের করে ফেলে দেয়, এবং হৃদয়কে ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে আবার যথাস্থানে রেখে দেয়। বক্ষ মুছিয়ে দৃষ্টির অন্তরালে চলে যায়। হালিমা বক্ষের সে স্থানটি স্থির করার চেষ্টা করেও কোন চিহ্ন দেখতে পেলেন না। এরপর মুহাম্মদকে নিয়ে তাবুতে ফিরে আসেন। পরের দিন ভোর হতেই হালিমা মুহাম্মাদকে তাঁর মায়ের কাছে মক্কায় নিয়ে আসে। আমেনা অনির্ধারিত সময়ে হালিমাকে ছেলে নিয়ে আসতে দেখে আশ্চর্যাম্বিত হন, অথচ তিনি ছেলেকে অন্তর থেকে দেখতে চাচ্ছিলেন। কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে হালিমা বক্ষ বিদারণের ঘটনার পুরো বিবরণ দেন।
আমেনার মৃত্যু : আমেনা নিজের এতিম শিশু মুহা্ম্মাদকে নিয়ে ইয়াসরাবে বনী নাজ্জার গোত্রে মামাদের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য যাত্রা করে। সেখনে কিছু দিন অবস্থান করে ফেরার পথে “আবওয়া” নামক স্থানে মৃত্যু বরণ করে এবং সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। ফলে মুহাম্মাদ চার বছর বয়সে মাতৃ-স্নেহ ও আদরের ছায়া থেকে বঞ্চিত হন। দাদা আব্দুল মুত্তালিবকে এ অপূরণীয় ক্ষতির কিছু লাঘব করতে হবে। তাই তিনি তাঁর দেখা-শুনা ও পরিচর্যার দায়িত্ব নেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ছয় বছর বয়সে পা রাখেন তখন তাঁর দাদা ইহকাল ত্যাগ করেন। অতঃপর চাচা আবু তালিব আর্থিক অভাব-অনটন ও পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশী থাকা সত্বেও তাঁর দেখা-শুনার দায়িত্ব নেন। রাসূলের চাচা আবূ তালেব ও তাঁর স্ত্রী রাসূলের সাথে আপন ছেলের ন্যায় আচরণ করেন। এতিম ছেলের সম্পর্কে আপন চাচার সাথে অনকটা গভীর হয়ে যায়। এ পরিবেশে তিনি বড় হয়ে উঠেন।
Discussion about this post