মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
আল্লাহ তাআলা আদম (আ.) থেকে শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত বহু শক্তিশালী জাতি পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। যেমন—নুহ (আ.)-এর জাতি, ইবরাহিম (আ.)-এর জাতি, মুসা (আ.)-এর জাতি। এ ছাড়া আদ, সামুদ, আমালেকা প্রমুখ জাতি। ইউনুস (আ.), লুত (আ.), জাকারিয়া (আ.), দাউদ (আ.), সুলাইমান (আ.)-এর জাতি ও মুহাম্মদ (সা.)-এর জাতি। প্রত্যেক জাতি নিজেদের যুগের শ্রেষ্ঠ ও শক্তিশালী জাতি বলে দাবি করেছে। তবে সবচেয়ে মারাত্মক ও দাম্ভিক জাতি ছিল আদ জাতি। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর আদ জাতি, তারা পৃথিবীতে অযথা অহংকার করেছে এবং বলেছে, আমাদের চেয়ে শক্তিধর কে আছে? তারা কি লক্ষ করেনি যে, যে আল্লাহ তাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের চেয়ে অধিক শক্তিধর? আসলে তারা আমার নিদর্শনাবলি অস্বীকার করেছে।’ (সুরা হামিম সাজদা, আয়াত : ১৫)
আদ জাতির পরিচয়
আদ জাতি নুহ (আ.)-এর পুত্র সামের বংশধর। সামের পঞ্চম পুরুষদের একজনের নাম ছিল আদ। তাঁর নামেই এ বংশের নাম হয়েছে আদ বংশ। কোরআনের সুরা আন নাজমে ‘আদে উলা’ এবং সুরা আল-ফজরে ‘ইরামা যাতিল ইমাদ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয়, আদ সম্প্রদায়কে ‘ইরাম’ও বলা হয়। তা ছাড়া প্রথম আদের বিপরীতে দ্বিতীয় আদও রয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রসিদ্ধ কথা হলো, আদের দাদার নাম ইরাম। তাঁর এক পুত্র আউসের বংশধররাই আদ। তাদের বলা হয় ‘প্রথম আদ’। অন্য পুত্র জাসুর। তাঁর পুত্র হলো সামুদ। তাঁর বংশকে দ্বিতীয় আদ বলা হয়। সারকথা হলো, আদ ও সামুদ উভয়ই ইরামের দুটি শাখা। এক শাখাকে ‘প্রথম আদ’ আর দ্বিতীয় শাখাকে ‘দ্বিতীয় আদ’ বলা হয়। কোনো কোনো তাফসিরবিদ বলেন, আদ জাতির ওপর যখন আজাব নাজিল হয়, তখন তাদের একটি প্রতিনিধিদল মক্কা গমন করেছিল। ফলে তারা আজাব থেকে রক্ষা পেয়ে যায়। তাদের বলা হয় দ্বিতীয় আদ। (বয়ানুল কোরআন)
আদ গোত্রের ১৩ পরিবার ছিল। আম্মান থেকে শুরু করে হাজরামাউত ও ইয়েমেন পর্যন্ত তাদের বসতি ছিল। তাদের ক্ষেত-খামার অত্যন্ত সজীব ও শস্যশ্যামল ছিল। সব ধরনের বাগ-বাগিচা ছিল তাদের। তারা দৈহিক গঠন ও শক্তি-সাহসে ছিল অন্য সব জাতি থেকে স্বতন্ত্র। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘আল্লাতি লাম ইউখলাক মিসলুহা ফিল বিলাদ—এমন দীর্ঘকায় ও শক্তিশালী জাতি ইতিপূর্বে পৃথিবীতে সৃজিত হয়নি।’ (সুরা ফজর, আয়াত : ৮)
ইবনে আব্বাস (রা.) ও মুকাতিল (রহ.) থেকে একটি (ইসরায়েলি) বর্ণনায় রয়েছে, তাদের উচ্চতা ছিল ১৮ ফুট (১২ হাত)। তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘যাদাহুম ফিল খালকে বাসতাতান—তিনি তাদের দেহের বিস্তৃতি করেছেন অধিক পরিমাণ।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৬৯)
আদ জাতির নবী
আল্লাহ তাআলা আদ জাতির কাছে হুদ (আ.)-কে নবী হিসেবে প্রেরণ করেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর আদ জাতির কাছে প্রেরণ করেছি, তাদের ভাই হুদকে।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৬৫)
হুদ (আ.) নুহ (আ.)-এর পুত্র সামের বংশের পঞ্চম পুরুষ। আদ সম্প্রদায় এবং হুদ (আ.)-এর বংশ তালিকা চতুর্থ পুরুষে সাম পর্যন্ত পৌঁছে এক হয়ে যায়। এ হিসেবে হুদ (আ.) তাদের বংশগত ভাই।
দাওয়াত
আদ জাতি ছিল মূর্তিপূজারি। তারা আরো নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিল। হুদ (আ.) তাদের মূর্তিপূজা ছেড়ে একত্ববাদের অনুসরণ করতে এবং সর্বপ্রকার অত্যাচার-উত্পীড়ন বর্জন করে ন্যায় ও সুবিচারের পথ ধরতে বলেন। কিন্তু তারা নিজেদের ধনৈশ্বর্যের মোহে মত্ত হয়ে তাঁর আদেশ অমান্য করে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি আজাব নাজিল করেন। বর্তমানে হাজরামাউতে হুদ (আ.)-এর কবর রয়েছে।
আদ জাতির পরিণতি
নবীর কথা অমান্য করে পাপাচারে লিপ্ত থাকার কারণে আল্লাহ তাআলা আদ জাতিকে ধ্বংস করে দেন। তাদের প্রতি প্রথম আজাব ছিল অনাবৃষ্টি। তিন বছর তাদের এলাকায় বৃষ্টি বন্ধ ছিল। এতে তাদের ফসল জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। ফলে দেশে অভাব দেখা দেয়। এর পরও তারা শিরক ও মূর্তিপূজা ত্যাগ করেনি। অতঃপর আট দিন সাত রাত তাদের ওপর দিয়ে বয়ে যায় প্রবল ঘূর্ণিঝড়। এতে তাদের বাড়িঘর, বাগ-বাগিচা, জীবজন্তু সব ধ্বংস হয়ে যায়। তারা নিজেরাও শূন্যে উড়তে থাকে। রাতে তারা মরে উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে। আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর সেরা শক্তিধর আদ জাতিকে এভাবে ধ্বংস করেন। আল্লাহ তাআলা হুদ (আ.) ও তাঁর অনুসারী মুমিনদের এ আজাব থেকে রক্ষা করেন। বর্তমানে আদ জাতির এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী।
Discussion about this post