ধর্ম ডেস্ক
হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পর তাঁর বড় সন্তান ইমাম হাসান (আ.) মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব ও ইমামতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.) ও নবীকন্যা ফাতিমা জাহরা সালামুল্লাহি আলাইহার প্রথম সন্তান হাসান তৃতীয় হিজরি সালের ১৫ রমজান মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর হযরত ফাতিমা সন্তানের জন্য একটি নাম রাখার জন্য আলী (আ.)কে অনুরোধ জানান। হযরত আলী বলেন, আমাদের সন্তানের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চেয়ে ভালো নাম আর কেউ রাখতে পারবে না। বিশ্বনবী (সা.) নিজের দৌহিত্রের জন্মগ্রহণের খবর শুনেই তাকে দেখতে আসেন। তিনি নবজাতকের ডান কানে আজান এবং বাম কানে ইকামত দেয়ার পর তার নাম রাখেন হাসান। আইয়্যামে জাহিলিয়াতের যুগে আরবে এই নামের প্রচলন ছিল না। প্রথমবারের মতো নবীজীর বংশে তাঁর পক্ষ থেকে এই নাম রাখা হয়।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর দৌহিত্র ইমাম হাসানকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তিনি বলতেন, হে আল্লাহ! আমি তাকে ভালোবাসি কাজেই তুমিও তাকে ভালোবাসো। সহিহ বুখারি গ্রন্থে ইবনে আব্বাসের বরাত দিয়ে বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে: একদিন রাসূলে আকরাম (সা.) হাসানকে কোলে নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। এক ব্যক্তি এ দৃশ্য দেখে বলেন, হে বালক! খুব ভালো বাহনের কাঁধে চড়েছ। একথা শুনে বিশ্বনবী (সা.) বলে ওঠেন: সেও খুব ভালো সওয়ারি।
একজন সাহাবী বলেন : একদিন রাসূলুল্লাহর সঙ্গে এক মুমিনের ঘরে দাওয়াত খেতে যাচ্ছিলাম। পথে আমরা হাসানকে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে দেখি। বিশ্বনবী এ দৃশ্য দেখে দৌড়ি হাসানের দিকে ছুটে যান, তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং চুমু খান। এরপর বলেন, হাসান আমার এবং আমিও হাসানের। হে আল্লাহ! যে হাসানকে ভালোবাসে তুমিও তাকে ভালোবেসো। এ ছাড়া, বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, নবীজী বহুবার ইমাম হাসানকে উদ্দেশ করে বলেছেন: চারিত্রিক গুণাবলীর দিক দিয়ে তুমি আমারই মতো।
একজন সাহাবী বর্ণনা করেন: বিশ্বনবী (সা.) যখন সিজদায় যেতেন তখন কখনো কখনো দেখতাম হাসান নবীজীর পিঠে চেপে বসেছেন। এ অবস্থায় শিশু হাসান নেমে না যাওয়া পর্যন্ত বিশ্বনবী সিজদা লম্বা করতেন। এ সম্পর্কে এমন প্রচুর বর্ণনা পাওয়া যায় যেখানে বলা হয়েছে, নবীজী সব সময় নিজের আহলে বাইতের উচ্চ মর্যাদা জনগণের সামনে তুলে ধরতেন যাতে তারা তাঁর অনুপস্থিতিতে নিজেদের নেতা ও ইমাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভুল না করে। তবে ইমাম হাসান (আ.) প্রিয় নানাজীর সঙ্গ বেশিদিন পাননি। তাঁর বয়স যখন মাত্র ৭ বছর তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) ওফাত লাভ করেন এবং এর কিছুদিনের মধ্যে জন্মদায়িনী মা’কেও হারান।
দুই দু’জন প্রাণপ্রিয় মানুষকে হারানোর পর ইমাম হাসানের একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়ায় পিতা ইমাম আলী (আ.)। পিতার কাছে ধর্মীয় শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে বুৎপত্তি অর্জন করেন ইমাম হাসান। ইমাম আলী (আ.) যখন রাত জেগে ইবাদত করতেন তখন তাঁর অশ্রুসজল নয়ন এবং কম্পিত দেহ মুবারক দেখে বিস্মিত হতেন ইমাম হাসান। একবার তিনি পিতাকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে আমিরুল মুমিনিন বলেন, আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করে তাঁর ইবাদত করলে এমনই হওয়া উচিত। তিনি জীবনে ২৫ বার মক্কায় আল্লাহর ঘর জিয়ারত করতে যান এবং বেশিরভাগ সময় খালি পায়ে হেঁটে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেন।
নবী পরিবারের সদস্য ইমাম হাসান (আ.) নিঃস্ব ব্যক্তিদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ছিলেন সবার চেয়ে অগ্রগামী। কারণ, পবিত্র কুরআনে নামাজ আদায় অর্থাৎ আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পরপরই গরীব দুঃখীকে যাকাত প্রধান অর্থাৎ আল্লাহর বান্দাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনের নির্দেশনা হচ্ছে, দরিদ্র ব্যক্তিকে এমনভাবে দান করতে হবে যাতে দান করার সময় ওই ব্যক্তি মনে কষ্ট না পায়। দান করার সময় অহংকারী ভাব নিয়ে পাওনাদারের মতো আচরণ করা যাবে না বরং দরিদ্র ও অসহায় ব্যক্তির মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হবে।
একদিন ইমাম হাসান (আ.) মসজিদে প্রবেশ করে দেখেন এক ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে দু’হাত উঠিয়ে দোয়া করছে: হে আল্লাহ! আমার প্রয়োজন মিটিয়ে দেয়ার জন্য আমাকে ১০ হাজার দিরহাম দাও। ইমাম হাসান এ দৃশ্য দেখে তাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে যান এবং অন্য এক ব্যক্তির মাধ্যমে তার কাছে ১০ হাজার দেরহাম পাঠিয়ে দেন। দান করার সময় ওই ব্যক্তি ইমামের দিকে অসহায় মুখে তাকাবে- এটা তিনি চাননি। ইমাম হাসান (আ.) জীবনে তিনবার নিজের সব সম্পদকে দুই ভাগ করে এক ভাগ গরীব-দুঃখীর মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি এ কাজ করেছেন শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে।
ইমাম হাসান (আ.)-এর আরেকটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল মানুষের সঙ্গে উত্তম আচরণ। একদিন নবীবংশের বিরুদ্ধে উমাইয়াদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত শামের এক অধিবাসী ইমাম হাসানকে সামনে পেয়ে প্রচণ্ড গালিগালাজ করে। ইমাম হাসান (আ.) অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে এসব কথা শোনার পর বলেন, আমার মনে হয় আমাদের শহরে আপনি অপরিচিত।
কোনো প্রয়োজন থাকলে আমাকে বলুন আমি তা মেটানোর চেষ্টা করব। যদি পথ ভুল করে থাকেন তাহলে পথ চিনিয়ে দেব, যদি অভুক্ত থাকেন খাবারের ব্যবস্থা করব, যদি থাকার জায়গা না থাকে তাহলে থাকার ব্যবস্থা করব, যদি বাহন না থাকে তাহলে বাহন জোগাড় করে দেব। ইমামের এই ব্যবহার দেখে ওই ব্যক্তি প্রচণ্ড রকম অনুতপ্ত হয় এবং কান্না শুরু করে দেয়। সে ইমামকে বলে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনিই পৃথিবীর বুকে আল্লাহর খলিফা। এতদিন আপনি এবং আপনার পিতা ছিলেন আমার কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি কিন্তু আজ এই মুহূর্ত থেকে আপনাদের চেয়ে প্রিয় কোনো মানুষ আমার কাছে নেই।
Discussion about this post