গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ)। এর গুরুত্ব এই যে, মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ মুক্তিদাতা ১২ রবিউল আউয়াল, ২৯ আগস্ট ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে শুভাগমন করেন। তাকে প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল মানবগোষ্ঠীকে এ পৃথিবীতে অত্যাচার, দুর্নীতি, সকল প্রকার জুলুম-নির্যাতন ও অন্যায় থেকে মুক্তিদানে সুখ-শান্তি ও সৎপথে পরিচালনা এবং মৃত্যুর পরপারে জাহান্নামের অগ্নি থেকে পরিত্রাণের মাধ্যমে চিরসুখময় জান্নাতের যোগ্য করে গড়া। এভাবে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) দুনিয়াতে ইসলাম ধর্মের মিশন শান্তির বাণী নিয়ে আগমন করেন।
গোটা মানব জাতির সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বাধিক সম্মানিত এবং সব নবী-রাসূলের নবী পরিশেষে আগমন করেন। সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কোনো একটি বিশেষ দল বা সম্প্রদায়ভুক্ত নবী ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য। কারণ তারপর দুনিয়াতে আর কোনো নবীর আবির্ভাব হবে না। এই মর্মে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বাণী প্রদান করেছেন যে,“অন্য নবীগণ তাদের স্ব স্ব সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন আর আমি বিশ্বের সমগ্র মানুষের জন্য প্রেরিত হয়েছি।” নবী করিম (সাঃ) । আরো ঘোষণা করেছেন,‘ আমি সর্বশেষ নবী, আমার পরে আর কোনো নবী নেই ।(সহিহ আল-বুখারি)।
মক্কায় কুরাইশ সম্প্রদায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে আল্লাহর পরিচয় জানতে চাইলে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) নবুওয়্যাত প্রাপ্তির পর সর্বপ্রথম পবিত্র কোরআনের আয়াত দ্বারা বিশ্বের মানুষকে তাওহিদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি আহŸান জানালেন, ‘বলুন (হে মুহাম্মদ!) আল্লাহ এক। আল্লাহ মুখাপেক্ষীহীন, তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কারো হতে জন্মও নেননি, আর কেউ তার সমকক্ষ নয়।’ (সূরা আল-ইখলাস, আয়াত:১-৪)।
এখানে আমরা পবিত্র ঈদের মিলাদুন্নবী (সাঃ) এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করছি যে, মহানবী (সাঃ) মানবগোষ্ঠীর প্রতি সত্য প্রচারে নিবিষ্ট হন এবং তাদের সরল-সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করেন, যাতে তারা জীবনের সফলতা অর্জনে একে ফলপ্রসূ করতে পারে আর ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে শান্তি ও সৌভাগ্য লাভ করতে সক্ষম হয়। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) প্রথমত আল্লাহর একত্ববাদ ও ধর্মের মৌলিক আইন-কানুন শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল।’
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এমন এক সমাজে আবির্ভূত হন, যেখানে লোকেরা তাদের মানবিক গুনাবলি ও চারিত্রিক আদর্শ হারিয়ে ফেলেছিল। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাদের নিজের সুন্দর আচরণ, উত্তম চরিত্র-মাধুর্যের দ্বারা মানবিক গুনাবলি ও সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেন এবং আল্লাহ একত্ববাদের স্বীকৃতি ও তার আনুগত্যের মাধ্যমে মানবজীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের পথ নির্দেশনা প্রদান করেন। আত্মভোলা ও পথভ্রষ্ট মানুষকে মানব মর্যাদা, ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির সর্ম্পক মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য শিক্ষা দেন। জীবন-মরণের এই জাগৃতি ও উপলদ্ধি সৃষ্টির দ্বারা রাসূল (সাঃ) আরব সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা, অধিকার,সাম্য,মৈত্রী ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় মানব ইতিহাসে অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
এ জন্য প্রতিবছর পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) উদযাপনের মাধ্যমে মুসলিম জাতি রাসূলল্লাহ (সাঃ) এর শিক্ষা ও জীবন ব্যবস্থাকে নিজেদের কর্মজীবনে বাস্তবায়নের এবং নিজেদের সুন্দর করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে নতুন করে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ হয়। এমনিভাবে নবচেতনার দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে দ্বীন ইসলামের পূণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা অনুসরণের মাধ্যমে ঈমানের বলিষ্ঠতা, আমলের পরিপূর্ণতা ও সার্বিক সৌভাগ্য এবং কল্যাণ লাভের পথ সুগম হয়। কারণ, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর শিক্ষা ও তার সুন্নাতের অনুসরণ মানবজীবনের উৎকর্ষ সাধন ও সাফল্যমন্ডিত হওয়ার চাবিকাঠি।
এখানে বিশেষ লক্ষ্যনীয় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর পবিত্র সিরাত ও তাঁর অমূল্য শিক্ষাবলি আলোচনার মধ্যেই যেন পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) সীমিত না থাকে। স্মরণ রাখতে হবে, শুধু আনুষ্ঠানিক মিলাদ ও মাহফিল তবারক বিতরণের মধ্যে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) এর প্রকৃত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হাসিলের কাজ সমাপ্ত হয় না: বরং পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, এ মহতি উপলক্ষ্যে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা , ভক্তি ও ভালবাসা নিজের হৃদয়ে সুদৃঢ় করা, তার রেখে যাওয়া বিধি-বিধান ও সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরার মতো ঈমানী শক্তি সঞ্চয় করা, যাবতীয় কর্মকান্ডে তার নীতি, আদর্শ ও শিক্ষা বাস্তবায়ন করা, জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর আনুগত্য ও তাকে অনুসরণ করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন আয়াতে তার আনুগত্য ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। এই মর্মে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,‘ আপনি বলুন( হে রাসূল!) তোমরা আল্লাহর ও তার রাসূলের আনুগত্য করো।’ (সূরা আল ইমরান, আয়াত-৩২) অন্য আয়াতে নির্দেশ করা হয়েছে , ‘ওহে, যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো’ এবং রাসূলের আনুগত্য করো।’ (সূরা আল-নিসা, আয়াত-৫৯)। আল্লাহর তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর শিক্ষা ও আদর্শ অনুসরণ ব্যতিত সম্ভব নয়। কারণ, রাসূল (সাঃ) যা কিছু বলেছেন যা নির্দেশ করেছেন তার ওহি বা প্রত্যাদেশের দ্বারাই করেছেন। পবিত্র কোরআনে এই মর্মে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি (রাসূল) মনগড়া কিছুই বলেন না,(তিনি যা বলেছেন তা প্রত্যাদেশকৃত ঐশীবাণী ব্যতীত আর কিছু নয়।
এ জন্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের রাসূলুল্লাহ((সাঃ) এর আদর্শবানী অনুসরণ ও তার শিক্ষা মেনে চলার নির্দেশ প্রদান করেছেন, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে সুন্দরতম আর্দশ।’ (সূরা আল-আহযাব,আয়াত-২১)।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন বলে বিরোধী কাফিরাও তাকে ‘ আল-আমিন’ তথা ‘বিশ্বাসী’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন এবং তার এই সৎ চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে দলে দলে লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করেছিল। আল্লাহ তায়ালা নবীকুল শিরোমণির উত্তম চরিত্র সম্পর্কে আল কোরআনে ঘোষণা করেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সূরা আল-কালাম,আয়াত-৪)
উল্লেখ্য, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর ঐতিহাসিক বিদায় হজ্জের ভাষণে বিশাল জনসমুদ্রে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের সংবিধান মেনে চলার জন্য বলেছিলেন, ‘ আমি তোমাদের মাঝে দুটি নির্দেশ (বস্তু) রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা এর অনুশাসন মেনে চলবে ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। তা (বস্তুদ্বয়) হলো: আল্লাহর কিতাব (আল কোরআন) এবং তার প্রেরিত রাসূলের চরিত্রাদর্শ (আল-হাদিস)। (মিশকাত)।
বস্তুত বর্তমান সমস্যা সংকুল বিশ্বে যেখানে মানুষ মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যেখানে সন্ত্রাস ব্যাপক আকার ধারন করেছে, দেশে দেশে হানাহানি ও যুদ্ধ বিগ্রহ চলছে, নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরছে, যেখানে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বিনষ্ট হচ্ছে, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মত পার্থক্য ও আচার-আচরণের বিভিন্নতা সহ্য করা হচ্ছে না, সেখানে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর অনুপম আদর্শ গ্রহণ করে বহু প্রত্যাশিত শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ)। আমাদের সবার মনে সহনশীলতা, সংযম,হৃদ্যতা, সম্প্রীতি,পারস্পরিক ভালবাসা ও শ্রদ্ধা সৃষ্টিতে সহায়ক হোক। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম, সুন্দরতম, মহোত্তম, রাহমাতুল্লিল আল-আমিন, পেয়ারা নবী মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ)। তিনি আর আসবেন না, তবে তিনি আছেন, থাকবেন, তিনি অমর, তিনি চিরঞ্জিব।
পবিএ ঈদ-এ মিলাদুন্নবী (সাঃ) পালনের দলিল সমূহ..!
ঈদ অর্থ হচ্ছে খুশি বা আনন্দ প্রকাশ করা।
আর মিলাদ ও নবী দুটি শব্দ একত্রে মিলিয়ে মিলাদুন্নবী বলা হয়। আর নবী শব্দ দ্বারা রাহমাতুলি্লল আলামিন হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) কে বোঝানো হয়েছে। এককথায়, ঈদে মিলাদুন্নবী অর্থ হুজুর পাক (সা.) এর পবিত্র ‘বেলাদত শরিফ’ উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করা।
আর পরিভাষায় বললে, হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর শুভাগমন স্মরণে খুশি প্রকাশ করে মিলাদ শরিফ মাহফিলের ব্যবস্থা করা, শান-মান, মর্যাদা-মর্তবা আলোচনা করা, কোরআন তেলাওয়াত, দরুদ শরিফ পাঠ, তাওয়াল্লুদ বা জন্মকালীন ঘটনা মজলিস করে আলোচনা করা, দাঁড়িয়ে সালাম, কাসিদা বা প্রশংসামূলক কবিতা, ওয়াজ-নসিহত, দোয়া-মোনাজাত, সম্ভব মতো মেহমান নেওয়াজির সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান করা।
হাদিস শরিফে মহানবী (সা.) এর জন্মকাল সম্পর্কে জানা যায়। হজরত আবু কাতাদা আল আনসারি (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) কে সোমবার দিন রোজা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘এ দিনে (সোমবারে) আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এ দিনেই আমি নবুয়ত পেয়েছি।’ (মুসলিম)।
★পবিত্র কুরআনুল কারীমের সুরা আলে ইমরানের ১০৩ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেন,
” ﺍﺫﻛﺮﻭﺍ ﻧﻌﻤﺔ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻜﻢ ” অর্থাৎ তোমাদেরকে যে নিয়ামত দেওয়া হয়েছে তার জিকির কর এবং খুশি কর|
★আল্লাহ পাক পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফের সুরা ইউনুসের ৫৮ নং আয়াতে এরশাদ করেন,
” ﻗﺎﻝ ﺑﻔﻀﻞ ﺍﻟﻠﻪ ﻭ ﺑﺮﺣﻤﺘﻪ ﻓﺒﺬﺍﻟﻚ
ﻓﻠﻴﻔﺮﺣﻮﺍ ﻫﻮ ﺧﻴﺮﻣﻤﺎ ﻳﺠﻤﻌﻮﻥ
অর্থাৎ হে রাসুল আপনি বলুন আল্লাহর দয়া ও রহমতকে কেন্দ্র করে তারা যেন আনন্দ করে এবং এটা হবে তাদের অর্জিত সকল কর্মফলের চেয়েও অধিক শ্রেষ্ঠ |
এ পৃথিবীতে যত নেয়ামত রয়েছে বা এসেছে এর চেয়ে সবচেয়ে বড় নেয়ামত হচ্ছে হাবিবুল্লাহ হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম | আল্লাহর এই নেয়ামত ও অনুগ্রহকে কেন্দ্র করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ও আনন্দ উদযাপন করার নির্দেশ স্বয়ং রাব্বুল আলামিন
দিয়েছেন যার প্রমান উপরোক্ত পবিত্র কোরআনের আয়াত |
★তাছাড়া সুরা আজহাবের ৫৬ নং আয়াতে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন ,
“তোমরা আমার হাবিবের প্রতি দুরুদ সালাম প্রেরণ কর” |
অর্থাৎ আল্লাহ আমাদেরকে স্পষ্ট এখানে নির্দেশ করেছেন উনার হাবিবের প্রতি দুরুদ সালাম
জানানোর জন্য |আল্লাহর নির্দেশ বিবেচনায় যা প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের জন্য ফরজ ( অর্থাৎ নবীজিকে তাজিম করা , সম্মান করা , নবীজিকে দিয়ে ভালো মনোভাব পোষণ করা ) |
Discussion about this post