ফাহমিদা ইয়াসমিন
মানুষটা ছিলেন ফকির, কিন্তু কারো কাছ থেকে কিছু নেয়া মানুষটার স্বভাবে ছিল না। হাদীসে নবীয়ে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গেছেন, ওপরের হাত নিচের হাতের চাইতে উত্তম। তাই তিনি কারো কাছে কিছু চাইতেন না, কঠিন পরিশ্রম করে নিজের রুযি রোজগার করতেন, বাকি সময় কাটাতেন আল্লাহর ইবাদতে। কেউ তার কাছে কিছু চাইলে ফিরিয়ে দিতেন না, কাছে যা থাকতো দিয়ে দিতেন।
তার আসল নাম ছিল মাওলানা মুহাম্মাদ আবু তালিব। জন্ম মেওয়াটে, সেখান থেকে মাদারিয়া তরিকায় বাইয়াত নিয়ে চলে এলেন কানপুরে। তিনি নিজের মুরশিদ ই আলা হিসেবে মানতেন ইমাম যাইনুল আবেদীন ইবন হুসাইন ইবন আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে। তাই সদকা দেয়া ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ এবং সদকা নেয়া ছিল অপ্রিয় কাজ। সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ ছিল তার সমস্ত কাজের মূলনীতি। আর এই করতে করতেই তিনি শেষমেশ লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়লেন ব্রিটিশ রাজের সাথে।
এভাবেই, মাওলানা মুহাম্মাদ আবু তালিব হয়ে গেলেন ইমামে মালাং ফকির মজনু শাহ বুরহানা। মধ্য ভারত থেকে পূর্বে বাঙ্গালাহ, আর দক্ষিণে মহীশুর পর্যন্ত ছিল তার হাজার হাজার মুরীদ। ফকির মজনু শাহের মতে, ব্রিটিশরা ছিল জালেম, আর জালেম মানেই সে ইয়াজিদের দলের লোক, তাই যারা নিজেদের ইমাম হুসাইনের অনুসারী মনে করে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করা তাদের জন্য ফরজ। পলাশীর প্রহসনের পর মীরজাফরকে পুতুল নবাব বানিয়ে যে তলে তলে ব্রিটিশরাই বাঙ্গালাহর দখল নিয়েছে তা অনেক অভিজাত মুসলিম আমীরেরা না বুঝলেও ফকির মজনু শাহ ঠিকই বুঝেছিলেন।
মুরিদদের নিয়ে বসলেন মজনু শাহ, আলাপ হল চেরাগ আলী শাহ, মুসা শাহ, সোবহান শাহ, পরাগল শাহ, করিম শাহদের সাথে। কানপুর, বিহার, মীরাট, মুর্শিদাবাদ, কুচবিহার, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, গাজীপুর, বাকেরগঞ্জ, খুলনাতে তৈরি হল একের পর এক সুফী মুজাহিদ বাহিনী। আলোচনা হল সন্ন্যাসী দস্যুদের নেতা ভবানী পাঠক আর দেবী চৌধুরানীর সাথেও। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তারা হলেন ঐক্যবদ্ধ। শুরু হল একের পর এক অভিযান।
মজনু শাহের ফকিরেরা মূলত ঢাল-তলোয়ার-লাঠি-সড়কি আর বর্শা নিয়ে আচমকা গেরিলা হামলা চালাতো ব্রিটিশ বাণিজ্যকুঠি বা ব্রিটিশদের দালাল জমিদার কাছারীতে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এসব অপারেশনে প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবকে ফকির বাহিনী টেকনিক্যালি পিছিয়ে থাকলেও সেটা তারা কাভার করতেন ট্যাকটিক্সে।তারা অস্ত্রশস্ত্র বয়ে নিয়ে যেতেন উটের পিঠে করে, আর হামলা চালাতেন লক্ষ্যবস্তুর একেবারে কাছ থেকে ঘোড়ার পিঠ থেকে। প্রথম হামলার পর পেছন থেকে এসে যোগ দিতেন পদাতিক সৈনিকেরা।
১৭৬৩ সালে বাকেরগঞ্জের কেলি, এবং পরের বছর র্যালফ লেস্টারের ঢাকা কুঠিতে হামলা চালান ফকিরেরা। কেলি ধরা পড়লেও র্যালফ প্রান নিয়ে সটকে পড়তে সক্ষম হয় সেবার। এর কয়েক মাস পরেই ফকিরেরা হামলা চালান রাজশাহীর বোয়ালিয়ার বেনেটের কুঠিতে। বেনেটকে জীবিত বন্দী করে পাটনায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে তাকে ফাসিতে ঝোলানো হল। বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসিমের বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে যোগ দেন মজনু শাহের ফকিরেরা। বক্সারের যুদ্ধে হিন্দুস্তানের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হলে ফকিরেরা আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হন।
কিন্তু থেমে থাকেনি তাদের কাজ।
রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, কুচবিহার, জলপাইগুড়ি ও কুমিল্লায় তাদের প্রচন্ড আক্রমনে নাজেহাল হতে থাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য কাফেলাগুলি। তাদের থামাতে পাঠানো হল লেফটেন্যান্ট মার্টেলকে, মার্টেল এক গেরিলা হামলায় নিহত হল তাদের হাতে। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফকিরদের থামাতে পাঠালো ক্যাপ্টেন ডি ম্যাকেঞ্জিকে।
তাতে কাজের কাজ কিছুই হল না। ফকিররা সারা উত্তর ও পশ্চিম বাংলায় আধিপত্য বিস্তার করে বসলো। এমনকি, চট্টগ্রামে পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নৌকায় ফকিররা হামলা করতে লাগলো। অবশেষে ম্যাকেঞ্জির বাহিনীর সাথে মুখোমুখি লড়াইয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তারা নেপালের দিকে সরে যেতে বাধ্য হলেন। ১৭৭১ সালে লেফটেন্যান্ট ফেলথামের আক্রমনের শিকার হয়ে রংপুর থেকে ফকিরদের একটা বাহিনী বগুড়ার মহাস্থানগড়ের আস্তানায় পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। আহত হন প্রায় একশো ফকির। কিন্তু ফকিরদের আস্তানায় এসে সরাসরি আক্রমনের সাহস পেলেন না ফেলথাম। ফলে বিশ্রাম নিয়ে পরের বছর কোম্পানীর রাজশাহী রেভিনিউ অফিসে হামলা চালিয়ে খাজনার টাকা কেড়ে নেন ফকিরেরা। এই টাকা দিয়ে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেন মজনু শাহ।
সত্তরের দশকজুড়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ওপর ফকির মজনু শাহের আক্রমন আরো বেড়ে যায়। মজনু শাহের বাহিনী প্রায় হাওয়ার থেকে উদয় হয়ে অভিযন চালিয়ে হারিয়ে যেত জঙ্গলে, তাই তাদের দমন করা কনভেনশনাল সেনাবাহিনীর জন্য ছিল খুব কঠিন। এসময় মজনু শাহ মহীশুরের সুলতান হায়দার আলীর কাছ থেকে যোগাড় করেন হাতে চালানোর উপযোগী কামান, গ্রেনেড এবং রকেট। এতে ফকির বাহিনীর হামলা আরো বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। কিন্তু গেরিলাযুদ্ধের বাইরে মুখোমুখি লড়াইয়ে প্রশিক্ষিত জনবল কম থাকায় জমিদারদের সাথে জিতলেও ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে সংখ্যায় অনেক বেশি হয়েও বারবার মার খেতে হত ফকির মজনু শাহের বাহিনীকে।
১৭৮৬ সালের ৮ই ডিসেম্বর ময়মনসিংহের কালেশ্বরে ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট ব্রেন্যানের বাহিনীর সঙ্গে ফকির মজনু শাহের বাহিনীর এক ভয়ানক সংঘর্ষ হয়। মজনু শাহের বাহিনীর এক বিরাট অংশ যুদ্ধক্ষেত্রেই শহীদ হন। বাকিদের অনেককে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কানপুর ও বিহার অঞ্চলে। মজনু শাহ নিজেও মারাত্মকভাবে আহত হয়ে কানপুর চলে যেতে বাধ্য হন।কানপুর তখনো ছিল স্বাধীন।
প্রায় পঞ্চাশদিন পর, স্বাধীন কানপুরের মকানপুরে শাহ মাদারের দরগায় ১৭৮৭ সালের ২৬শে জানুয়ারী দুর্ধর্ষ সুফী মুজাহিদ ফকির মজনু শাহ শহীদ হন, তার প্রিয় ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতই। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অনেক বীরকে ইতিহাসে লুটেরা-দস্যু-সন্ত্রাসী হিসেবে চিত্রায়ন করা হয়েছে গত দুশো বছর যাবত। কাউকে আবার গায়েব করে দেয়া হয়েছে ইতিহাসের ক্যানভাস থেকে।
Discussion about this post