সেরাতুল মুস্তাকীম ডেস্ক
সব আসমান পেরিয়ে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে যাওয়া রাতের সফরই ‘মেরাজ’। কুরআনে যাকে ইসরা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মসজিদে হারাম থেকে যে সফরের শুরু হয়েছিল। বায়তুল মুকাদ্দাস হয়ে একে একে সাত আসমান ও সিদরাতুল মুনতাহা পেরিয়ে রফরফ নাম বিশেষ বাহনে আরশে আজিমে আল্লাহর প্রেমময় সান্নিধ্যে গিয়েছিলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ এ ঘটনার আলোকপাত করেন এভাবে-
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ
পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে (মুহাম্মাদ সা.) রাতের বেলায় মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যান্ত ভ্রমণ করিয়েছিলেন। যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ১)
কুরআনুল কারিমে ঘোষিত এ মেরাজই লাইলাতুল মেরাজ বা শবে মেরাজ। লাইলাতুন বা শব অর্থ হলো- রাত আর মেরাজ অর্থ উর্ধ্বগমন। শবে মেরাজ বা লাইলাতুল মেরাজের অর্থ দাঁড়ায়- ঊর্ধ্বগমনের রাত। হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআলার বিশেষ ব্যবস্থাপনায় সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় হজরত জিবরিল ও মিকাইল আহিমুস সালামের সঙ্গে প্রথমে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় যান। সেখান থেকে তিনি আল্লাহর সান্নিধ্যে উর্ধ্ব জগতের রওয়ানা হন।
হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ৫১ বছর বয়সে আরশে আজিমের এ যাত্রা শুরু হয়েছিল নবুয়তের ১১তম বছরের ২৬ রজব দিবাগত রাত তথা ২৭ রজবে। এটি ছিল প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম মোজেজার একটি।
আরশে আজিম ভ্রমণের এ ঘটনা কুরআনুল কারিমের সুরা নজমেও ওঠে এসেছে। এ সুরার প্রথম দিকে ধারাবাহিকভাবে আল্লাহ তাআলা এভাবে তুলে ধরেছেন-
وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى
‘নক্ষত্রের কসম, যখন তা অস্তমিত হয়।’
مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَى
‘তোমাদের সংগী (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পথভ্রষ্ট হননি এবং বিপথগামীও হননি।’
وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَى
‘আর তিনি প্রবৃত্তির তাড়নায়ও কথা বলেন না।’
إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى
‘(বরং তিনি যা বলেন তা) কুরআন ওহী, যা প্রত্যাদেশ হয়।’
عَلَّمَهُ شَدِيدُ الْقُوَى
‘তাঁকে শিক্ষা দান করেছেন এক শক্তিশালী ফেরেশতা (জিবরিল আ.),
ذُو مِرَّةٍ فَاسْتَوَى
সহজাত শক্তিসম্পন্ন, সে (জিবরিল আ.) নিজ আকৃতিতে প্রকাশ পেল।
وَهُوَ بِالْأُفُقِ الْأَعْلَى
উর্ধ্ব দিগন্তে,
ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى
অতঃপর নিকটবর্তী হল ও ঝুলে গেল।’
فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى
‘তখন দুই ধনুকের ব্যবধান ছিল অথবা আরও কম।’
فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى
‘তখন আল্লাহ তাঁর দাসের প্রতি যা প্রত্যাদেশ করবার, তা প্রত্যাদেশ করলেন।’
مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَى
‘রাসুলের অন্তর মিথ্যা বলেনি যা সে দেখেছে।’
أَفَتُمَارُونَهُ عَلَى مَا يَرَى
তোমরা কি বিষয়ে বিতর্ক করবে যা সে দেখেছে? [ সুরা নাজম ৫৩:১২ ]
وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى
‘নিশ্চয়ই সে তাকে আরেকবার দেখেছিল,
عِندَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى
সিদরাতুলমুন্তাহার কাছে,
عِندَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَى
যার কাছে অবস্থিত আছে বসবাসের জান্নাত।’
إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشَى
‘যখন বৃক্ষটি দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়ার, তা দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল।’
مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَى
‘তাঁর দৃষ্টিবিভ্রম হয়নি এবং সীমালংঘনও করেনি।’
لَقَدْ رَأَى مِنْ آيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَى
‘নিশ্চয়ই তিনি তার পালনকর্তার মহান নিদর্শনাবলী অবলোকন করেছেন।’ (সুরা নজম : আয়াত ১-১৮)
আরশে আজিমের এ সফরে বিশ্বনবি যা দেখলেন-
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান প্রভুর সান্নিধ্যে যাওয়ার এ সফরে পথিমধ্যে যাদের সাক্ষাৎ পেয়েছেন, সে সবের বর্ণনা এসেছে হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ বুখারিতে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম আসমানে হজরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আসমানে হজরত ইয়াহইয়া (আ.) ও হজরত ঈসা (আ.), তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হজরত ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হজরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হজরত মুসা (আ.) এবং সপ্তম আসমানে হজরত ইবরাহিম (আ.)। সবার সঙ্গেই তিনি সালাম ও ভাব বিনিময় করেছেন।
অতঃপর তিনি সিদরাতুল মুনতাহার কাছে গেলেন। সেখানে চারটি নদী দেখলেন; দুটি প্রকাশ্য ও দুটি অপ্রকাশ্য। অপ্রকাশ্য দুটি নদী জান্নাতের আর প্রকাশ্য নদী দুটি হলো নীল ও ফোরাত।
তারপর বায়তুল মামুরে পৌঁছালে তাঁকে এক পেয়ালা শরাব, এক পেয়ালা দুধ ও এক পেয়ালা মধু পেশ করা হয়। তিনি সেখানে দুধ পান করলেন, এটাই স্বভাবসুলভ (ইসলাম)। (বুখারি)
মেরাজের ঐতিহাসিক দিক-নির্দেশনা
মেরাজের ঐতিহাসিক রাতে মহান প্রভু তাঁর প্রিয় বন্ধু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনেক কল্যাণকর উপদেশ দিয়েছেন। তাহলো-
– শিরক না করা
لاَّ تَجْعَل مَعَ اللّهِ إِلَـهًا آخَرَ فَتَقْعُدَ مَذْمُومًا مَّخْذُولاً
আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো উপাস্য স্থির করো না। তাহলে তুমি নিন্দিত ও অসহায় হয়ে পড়বে।’ (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ২২)
– মা ও বাবার অবাধ্য না হওয়া
وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُواْ إِلاَّ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِندَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاَهُمَا فَلاَ تَقُل لَّهُمَا أُفٍّ وَلاَ تَنْهَرْهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوْلاً كَرِيمًا – وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও এবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব-ব্যবহা র কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে `উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বল তাদেরকে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা। তাদের সামনে ভালবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বলঃ হে পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন ‘ (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ২৩-২৪)
– আত্মীয়-স্বজন ও গরিবদের দান করা
وَآتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلاَ تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا – إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُواْ إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا
‘আত্নীয়-স্বজনকে তার হক দান কর এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও। এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ২৬)
– অপচয় না করার
وَلاَ تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا – إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُواْ إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا
এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ২৬-২৭)
– কৃপণতা না করা
وَلاَ تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلاَ تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَّحْسُورًا
‘তুমি একেবারে ব্যয়-কুষ্ঠ হয়ো না এবং একেবারে মুক্ত হস্তও হয়ো না। তাহলে তুমি তিরস্কৃতি, নিঃস্ব হয়ে বসে থাকবে।’ (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ২৮)
– সন্তানদের হত্যা না করা
وَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلاقٍ نَّحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُم إنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْءًا كَبِيرًا
‘দারিদ্রের ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমিই জীবনোপকরণ দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই তাদেরকে হত্যা করা মারাত্নক অপরাধ।’ (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৩১)
– ব্যভিচার না করা
وَلاَ تَقْرَبُواْ الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاء سَبِيلاً
‘আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।’ (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৩২)
– মানুষ হত্যা না করা
وَلاَ تَقْتُلُواْ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللّهُ إِلاَّ بِالحَقِّ وَمَن قُتِلَ مَظْلُومًا فَقَدْ جَعَلْنَا لِوَلِيِّهِ سُلْطَانًا فَلاَ يُسْرِف فِّي الْقَتْلِ إِنَّهُ كَانَ مَنْصُورًا
‘সে প্রাণকে হত্যা করো না, যাকে আল্লাহ হারাম করেছেন; কিন্তু ন্যায়ভাবে। যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয়, আমি তার উত্তরাধিকারীকে ক্ষমতা দান করি। অতএব, সে যেন হত্যার ব্যাপারে সীমা লঙ্ঘন না করে। নিশ্চয়ই সে সাহায্যপ্রাপ্ত।’ (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৩৩)
– ইয়াতিমের সম্পদ না খাওয়া
وَلاَ تَقْرَبُواْ مَالَ الْيَتِيمِ إِلاَّ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ حَتَّى يَبْلُغَ أَشُدَّهُ
আর ইয়াতিমের মালের কাছেও যেয়ো না, একমাত্র তার কল্যাণ আকাংখা ছাড়া; সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যৌবনে পদার্পন করা পর্যন্ত এবং অঙ্গীকার পূর্ণ কর। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৩৪)
– প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা
وَأَوْفُواْ بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْؤُولاً
‘এবং অঙ্গীকার পূর্ণ কর। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৩৪)
– মাপে সঠিক থাকা
وَأَوْفُوا الْكَيْلَ إِذا كِلْتُمْ وَزِنُواْ بِالقِسْطَاسِ الْمُسْتَقِيمِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً
মেপে দেয়ার সময় পূর্ণ মাপে দেবে এবং সঠিক দাঁড়িপালায় ওজন করবে। এটা উত্তম; এর পরিণাম শুভ।’ (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৩৫)
– জ্ঞানহীন কাজ না করা
وَلاَ تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولـئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْؤُولاً
‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার পিছনে পড়ো না। নিশ্চয় কান, চোখ ও অন্তর; এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।’ [ সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৩৬)
– পৃথিবীতে গর্বভরে না চলা
وَلاَ تَمْشِ فِي الأَرْضِ مَرَحًا إِنَّكَ لَن تَخْرِقَ الأَرْضَ وَلَن تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُولاً – كُلُّ ذَلِكَ كَانَ سَيٍّئُهُ عِنْدَ رَبِّكَ مَكْرُوهًا
‘পৃথিবীতে দম্ভভরে পদচারণা করো না। নিশ্চয় তুমি তো ভূ-পৃষ্ঠকে কখনই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না। এ সবের মধ্যে যেগুলো মন্দকাজ, সেগুলো তোমার পালনকর্তার কাছেও অপছন্দনীয়।’ (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৩৭-৩৮)
যেসব পাপের শাস্তি দেখেছেন বিশ্বনবি
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরশে আজিমের এ সফরে তিনি পাপ বা অন্যায়ের শাস্তি দেখেছেন। হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ বুখারি ও মুসলিমের বর্ণনায় ওঠে আসা শাস্তির বিবরণ তুলে ধরা হলো-
– বেনামাজির শাস্তি
বড় পাথর দিয়ে তার মাথায় আঘাত করা হচ্ছে, আঘাতে মাথা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, পুনরায় ভালো হয়ে যাচ্ছে, আবার আঘাত করা হচ্ছে।
– জাকাত না দেওয়ার শাস্তি
তাদের সামনে ও পেছনে পাওনাদারেরা থাকবে। তারা পশুর মতো চরবে আর নোংরা আবর্জনা ময়লা ও পুঁজ এবং কাঁটাযুক্ত আঠালো বিষাক্ত ফল খাবে, জাহান্নামের উত্তপ্ত পাথর ভক্ষণ করবে।
– চোগলখোরের শাস্তি
তাদের পার্শ্বদেশ হতে গোশত কেটে তাদের খাওয়ানো হচ্ছে; আর বলা হচ্ছে, যেভাবে তোমার ভাইয়ের গোশত খেতে, সেভাবে এটা ভক্ষণ করো।
– গিবতকারীদের শাস্তি
তাদের অগ্নিময় লোহার নখর দিয়ে তারা তাদের চেহারা ও বক্ষ বিদীর্ণ করছে। এসব দেখে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- হে জিবরিল আলাইহিস সালাম! এরা কারা? তিনি (জিবরিল) বললেন, এরা হলো সেসব লোক যারা পশ্চাতে মানুষের গোশত খেত (আড়ালে সমালোচনা করত)।
– সুদখোরের শাস্তি
সুদখোরদের বড় বড় পেট, যার কারণে তারা তাদের অবস্থান থেকে নড়াচড়া করতে পারছে না। তাদের সঙ্গে রয়েছে ফেরাউন সম্প্রদায়, তাদেরকে অগ্নিতে প্রবিষ্ট করানো হচ্ছে।
– ব্যভিচারী নারী ও পুরুষের শাস্তি
জেনাকার বদকার নারী, যারা ব্যভিচার করেছে এবং ভ্রূণ ও সন্তান হত্যা করেছে, তাদের পায়ে আংটা লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে; তারা আর্তচিৎকার করছে।
এক সম্প্রদায় তাদের সামনে একটি উত্তম পাত্রে উপাদেয় তাজা ভুনা গোশত এবং অন্য নোংরা একটি পাত্রে পচা মাংস। তারা উত্তম পাত্রের উন্নত তাজা সুস্বাদু গোশত রেখে নোংরা পাত্রের পচা মাংস ভক্ষণ করছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- হে জিবরাইল! (আ.) এরা কারা?
তিনি বললেন, এরা হলো ওই সব পুরুষ যারা স্বীয় বৈধ স্ত্রী রেখে অন্য নারীর কাছে গমন করেছে এবং ওই সব নারী যারা স্বীয় বৈধ স্বামী রেখে পরপুরুষগামিনী হয়েছে।
– খেয়ানত করার শাস্তি
এক লোক বিশাল লাকড়ির বোঝা একত্র করেছে, যা সে ওঠাতে পারছে না; কিন্তু আরও লাকড়ি তাতে বৃদ্ধি করছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- হে জিবরাইল! (আ.) এটা কী?
তিনি বললেন, এ হলো আপনার উম্মতের সে ব্যক্তি যে মানুষের আমানত আদায় করেনি; বরং আরও অধিক গ্রহণ করেছে।
– অশ্লীল বাক্য ব্যবহারকারী ও ফেতনা সৃষ্টিকারীদের শাস্তি
এসব লোকের জিহ্বা ও ঠোঁট অগ্নিময় লোহার কাঁচি দ্বারা কাটা হচ্ছে। পুনরায় তা আগের মতো হয়ে যাচ্ছে এবং আবারও তা কাটা হচ্ছে; আর তা এভাবেই চলছে।
– অহংকারীর শাস্তি
ছোট্ট একটি পাথর থেকে বিশাল এক ষাঁড় বের হলো; পুনরায় ওই ষাঁড় সে পাথরের ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করছিল; কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছিল না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- হে জিবরাইল! (আ.) এটা কী?
তিনি বললেন, এটা হলো সেসব লোকের দৃষ্টান্ত যারা বড় বড় দাম্ভিকতাপূর্ণ কথা বলে লজ্জিত হয়, পরে আর তা ফিরিয়ে নিতে পারে না।
– ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎকারীর শাস্তি
তাদের ওষ্ঠ-অধর যেন উটের ঠোঁটের মতো। তাদের মুখে আগুনের জ্বলন্ত কয়লা প্রবিষ্ট করানো হচ্ছে এবং তা তাদের পায়ুপথ দিয়ে বের হয়ে আসছে।
– মদ, মাদক ও নেশা গ্রহণকারীর শাস্তি
তারা জাহান্নামিদের শরীর থেকে নির্গত বিষাক্ত নোংরা পুঁজ পান করছে।
অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মালিক নামে জাহান্নামের রক্ষী ফেরেশতাকে দেখলেন। সে মলিন মুখ, হাসি নেই, বলা হলো জাহান্নাম সৃষ্টির পর থেকে সে কখনো হাসেনি। (বুখারি ও মুসলিম)
আরশে আজিম সফরের সেরা উপহার
মেরাজের রাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে উপহার পেয়েছেন নামাজ। প্রথমে আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য ৫০ ওয়াক্ত নামাজ দিয়েছিলেন। যা পরে ৫ ওয়াক্ত চূড়ান্ত করা হয়। আর যারা এ ৫ ওয়াক্ত নামাজ যথাযথভাবে আদায় করবে তাদের জন্য রয়েছে ৫০ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার সাওয়াব।
শবে মেরাজের এ সফর ছিল বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর একান্ত সাক্ষাত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে ঘটে যাওয়া আলৌকিক ঘটনার অন্যতম একটি নিদর্শন।
মুমিন মুসলমানের উচিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ সফরে পাওয়া নেয়ামতগুলো আঁকড়ে ধরা। শাস্তির বিবরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে তা থেকে বিরত থাকা। হুকুম আহকামগুলো যথাযথভাবে মেনে চলা। তবেই উম্মতের জন্য স্বার্থক হবে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আরশে আজিমের প্রেমময় এ সফর।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে শবে মেরাজের শিক্ষা নিজেদের জীবনে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
Discussion about this post