ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা
রমজান মাস যথার্থভাবে উদযাপনের জন্য একটু আগে থেকেই এর প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে রমজান যতই ঘনিয়ে আসত, রমজান নিয়ে তাঁর আগ্রহ, আলোচনা ও আমলের মাত্রা ততই বেড়ে যেত এবং তিনি সাহাবিদের রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিতেন। শবেবরাত তথা মধ্য শাবান থেকে সাহাবায়ে কেরামের কাজকর্মে রমজানের পূর্ণ আমেজ পরিলক্ষিত হতো। রমজানের প্রস্তুতিমূলক কয়েকটি কাজ নিম্নরূপ—
শাবান মাসের হিসাবে সতর্কতা : রমজান কখন শুরু হবে তা বোঝার জন্য শাবান মাসের হিসাব রাখার বিকল্প নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও এই মাসে খুব সতর্কতার সঙ্গে চাঁদের হিসাব রাখতেন এবং অন্যদের এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসের খুব হিসাব করতেন। এ ছাড়া অন্য কোনো মাসের এত হিসাব করতেন না। এরপর রমজানের চাঁদ দেখে রোজা রাখতেন। আকাশ মেঘলা থাকার কারণে চাঁদ দেখা না গেলে শাবান মাস ৩০ দিনে গণনা করতেন, অতঃপর রোজা রাখতেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৩২৫)
শাবান মাসে রোজার অভ্যাস গড়ে তোলা : রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে মহানবী (সা.) শাবান মাসে খুব বেশি পরিমাণে রোজা রাখতেন। ইমাম বুখারি (রহ.) তার সহিহ বুখারিতে ‘শাবান মাসের রোজা’ শিরোনামে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় স্থাপন করেছেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসে লাগাতার রোজা রাখতেন, আমরা বলতাম, তিনি আর রোজা ছাড়বেন না। আবার তিনি এভাবে রোজা ছাড়তেন, আমরা বলতাম, তিনি আর রোজা রাখবেন না। আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে রমজান ছাড়া কোনো পুরো মাসের রোজা পালন করতে দেখিনি এবং শাবান মাসের চেয়ে কোনো মাসে বেশি রোজা পালন করতে দেখিনি। (বুখারি, হাদিস : ১৮৬৮; মুসলিম, হাদিস : ২৭৭৭)
রমজানের দু-এক দিন আগে রোজা না রাখা : রমজানের প্রস্তুতির মধ্যে এটিও একটি বিষয় যে রমজানের মর্যাদা রক্ষার জন্য এর দু-এক দিন আগে রোজা না রাখা। রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের দু-এক দিন আগে রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন। তবে কেউ আগে থেকে মাসের শেষে দু-এক দিন রোজা রাখতে অভ্যস্ত হলে তার ব্যাপার আলাদা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন রমজানের এক দিন কিংবা দুই দিন আগে অবশ্যই রোজা না রাখে। তবে হ্যাঁ, কারো (আগে থেকেই) এদিনে রোজা রাখার অভ্যাস থাকলে সে ওই দিনেও রোজা রাখতে পারে।’ (বুখারি, হাদিস : ১৮১৫; মুসলিম, হাদিস : ২৫৭০)
রমজানের ব্যক্তিগত প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা : রমজান মুমিনের চাওয়া-পাওয়ার উপযুক্ত সময়। জীবন পরিবর্তনের এক বাস্তব বিরল সুযোগ হিসেবেই রমজান আগমন করে। রমজানকে গতানুগতিক ধারায় কাটিয়ে দেওয়া সুস্থ বিবেকের কাজ নয়। কাজেই আল্লাহর আনুগত্যে রমজানের রাত-দিন কাটানোর জন্য কার্যকর একটি পরিকল্পনা তৈরি করা উচিত। এ পরিকল্পনায় কয়েকটি জিনিস থাকতে পারে—
১. রমজানে বেশি সময় ইবাদতে কাটানোর জন্য কিছু কাজকর্ম, অনুষ্ঠান, ভ্রমণ ইত্যাদি রমজানপূর্ব সময়ে সেরে নেওয়া।
২. বিশেষ কোনো রোগ-ব্যাধি থাকলে রমজানের আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রমজানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করা।
৩. হাট-বাজারে সময় নষ্ট না করার জন্য যথাসম্ভব হাট-বাজার রমজানের আগেই সেরে নেওয়ার চেষ্টা করা।
৪. রমজানে পালনীয় ইবাদত-বন্দেগি সংক্রান্ত বিধি-বিধান রমজানের আগেই জেনে নেওয়া।
রমজানের পারিবারিক প্রস্তুতি : রমজানের বরকত ও পুণ্য অর্জনে পরিবারকে মনোযোগী ও আগ্রহী করতে পারিবারিক তালিম করা এবং পরিবারের কোনো সদস্য কোরআন তিলাওয়াত করতে না পারলে তাকে শেখানোর ব্যবস্থা করা। রমজানের কাজকর্মের ভিড়ে পরিবারের নারী সদস্যরা যেন আমল করতে অপরাগ না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখে প্রত্যেক সদস্য বিভিন্ন কাজ ভাগাভাগি করে নেওয়া এবং পরস্পরকে সহযোগিতা করা। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।’ (সুরা : তাহরিম, আয়াত : ৬)
রমজানের সামাজিক প্রস্তুতি : রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানপূর্ব সময়ে সমাজের লোকদের রমজান আগমনের বার্তা দিতেন, রমজানের সুসংবাদ জানাতেন এবং পাড়া-প্রতিবেশীসহ সবাইকে রোজা রাখার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতেন। রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় এ মাস আসার আগেই সামাজিকভাবে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে; যেমন—রমজানের মর্যাদাসমূহের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা, রমজানের প্রস্তুতিমূলক সভা-সমাবেশ, সেমিনারসহ প্রচারমাধ্যমে রমজানের আলোচনা বৃদ্ধি করা। এসবের মাধ্যমে সামাজিকভাবে সবাই রমজানের জন্য প্রস্তুত ও আগ্রহী হয়ে উঠবে। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি উপদেশ দিতে থাকো, কারণ উপদেশ মুমিনদের উপকারে আসবে।’ (সুরা : জারিয়াত, আয়াত : ৫৫)
রমজানের অর্থনৈতিক প্রস্তুতি : রমজানপূর্ব সময়ে অর্থনৈতিকভাবেও প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত। যেমন—রমজানে সাহরি-ইফতার, অন্যকে সহযোগিতা করা, জাকাত আদায় ইত্যাদি খাত তৈরি হয়। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস কেনা থেকে বিরত থেকে এসব জরুরি খাতে অর্থ ব্যয়ের প্রস্তুতি গ্রহণ করা। এ ছাড়া রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়িয়ে বাড়তি ফায়দা লোটার চেষ্টা না করা। এটি শুধু চরম অন্যায়ই নয়, অমানবিকতাও বটে। এ ব্যাপারে সবার সচেতন হতে হবে। উমর (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘কেউ যদি মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকে রাখে (কৃত্রিম উপায়ে খাদ্য গুদামজাত করে সংকট তৈরি করে) আল্লাহ তার ওপর মহামারি ও দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২১৫৫)
পরিশেষে বলা যায়, রমজান মহান আল্লাহর অপূর্ব রহমতের বারিধারায় সমৃদ্ধ, ইবাদতের বসন্ত, মুমিনের প্রার্থিত একটি মাস। আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে যথার্থভাবে রমজান উদযাপন করতে পারাই সবার কাম্য হওয়া উচিত। আল্লাহ সবাইকে তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post