প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওতের শুরুর যুগের কথা। মক্কার কুরাইশ কাফেরদের অত্যাচারের মাত্রা যখন দিন দিন কঠোরতর হচ্ছিল, আল্লাহ তাআলা তেমনি এক রাতে আকস্মিকভাবেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে গেলেন আরশে আজিমের কাছে। প্রথমে মসজিদে হারাম থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস, এরপর সেখান থেকে উপরের দিকে যাত্রা। একেক আসমান অতিক্রম করে, সাত আসমান পেরিয়ে তাঁকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর আবার সে রাতেই ফিরে আসেন মক্কায়। এ ঘটনাকে আমরা ‘মেরাজ’ বলে স্মরণ করি। মেরাজ শব্দের অর্থই হলো ঊর্ধ্বারোহণ। ঘটনাটি সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমসহ হাদীসের আরও বহু গ্রন্থে সবিস্তারে উল্লেখিত হয়েছে। আর পবিত্র কুরআনে এসেছে-
سُبْحٰنَ الَّذِیْۤ اَسْرٰی بِعَبْدِهٖ لَیْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ اِلَی الْمَسْجِدِ الْاَقْصَا الَّذِیْ بٰرَكْنَا حَوْلَهٗ لِنُرِیَهٗ مِنْ اٰیٰتِنَا.
পবিত্র ও মহিমময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন আলমাসজিদুল হারাম থেকে আলমাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাঁকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্যে। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ১
প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাটির পৃথিবী থেকে সাত আকাশের বাধা অতিক্রম করিয়ে মহান রাব্বুল আলামীন এই যে কাছে নিয়ে গেলেন, এরপর আবার তিনি ফিরেও এলেন এই পৃথিবীতে, জানা কথা, এই সম্মান কেবলই তাঁর। নবী হযরত মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতেন বলে তিনি পরিচিত ‘মূসা কালীমুল্লাহ’ নামে। কিন্তু কথা বলার জন্যে একেবারে কাছে ডেকে নেয়া- এখানে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনন্য। নবী-রাসূলের মহান কাফেলার তিনি সর্দার- সায়্যিদুল মুরসালীন ওয়ান নাবিয়্যীন। এ মর্যাদাবানদের মাঝেও তিনি মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ। তাই এ বিরল সম্মান তিনি পেয়েছেন- এটাকে স্বাভাবিক বিষয় হিসেবেও ধরে নেয়া যায়। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, মানব-ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে তিনি যে বিরল সম্মান পেয়েছেন, সে ঘটনার বর্ণনায় মহান প্রভু তাঁকে কী বলে পরিচয় করাচ্ছেন। উপরের আয়াতেই বিষয়টি স্পষ্ট- পবিত্র ও মহিমময় তিনি, যিনি তাঁর ‘বান্দা’কে রজনীতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন …। এত সম্মান ও মর্যাদা যাকে দিলেন, তাঁর তো অনেক পরিচয়ই ছিল। তিনি আল্লাহর নবী, রাসূল। তিনি নবী-রাসূলগণের সর্দার। তিনি সর্বশেষ নবী। কিন্তু এসব কিছুই না বলে আল্লাহ তাআলা এ ঘটনায় তাঁর পরিচয় দিচ্ছেন নিজের বান্দা বলে। আল্লাহর যথার্থ বান্দা হতে পারার মাহাত্ম্য এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। বান্দা হওয়ার পরিচয়ে যে যত বেশি সফল, আল্লাহ তাআলার নিকট তার মর্যাদা ততটাই উন্নত। ইবাদত শব্দের অর্থই হলো দাসত্ব ও বন্দেগি। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দাসত্ব পূর্ণ মাত্রায় সম্পাদন করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি সকল সৃষ্টির সেরা, মানব-ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পুরুষ, আল্লাহর শ্রেষ্ঠ বান্দা।
এ দাসত্বের গুণ যে যতটা বেশি হাসিল করতে পারবে, মহান প্রভুর সামনে সে নিজেকে ততটাই তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র জ্ঞান করবে। নিজেকে এভাবে তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র মনে করার নামই বিনয়। বান্দা খাঁটি মনে বিশ্বাস করবে, আমার যা কৃতিত্ব এর কিছুই আসলে আমার নয়, এসবই আমার প্রতি আমার আল্লাহর দান। আমার যা সম্পদ এগুলো আসলে কিছুই আমার অর্জন নয়, সবই আল্লাহ আমাকে দান করেছেন। দুনিয়াতে প্রাপ্ত সবকিছুকেই যখন আল্লাহর নিআমত হিসেবে কেউ মেনে নেবে, তখন অনিবার্যভাবেই সে হয়ে উঠবে কৃতজ্ঞ ও বিনয়ী। আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগিতে যখন বিনয় ও কৃতজ্ঞতার পরশ থাকবে, সকল প্রাপ্তিকেই যখন সে কেবলই আল্লাহর দান বলে মেনে নেবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সে মুক্ত থাকবে অহংকার ও বড়াই থেকে। অবচেতনভাবেই তার আচার-আচরণ হবে বিনয় ও নম্রতায় পূর্ণ।
এ বিনয় যার যতটা হাসিল হবে, বান্দা হিসেবে সে ততটাই সফল। আল্লাহ পাকের বিধিবিধানের সামনে সে ততটাই নিজেকে সঁপে দিতে পারবে। শোকর আর কৃতজ্ঞতায় ততটাই আপ্লুত হবে তার হৃদয়-মন। বাহ্যত নিজের শ্রমে-ঘামে কিংবা অর্থ-মেধায় অর্জিত সফলতাকেও যখন সে আল্লাহর দান বলে বিশ্বাস করবে, তার স্তরে উন্নীত নয় এমন কাউকে দেখে তখন তার মনে অহংকারের পরিবর্তে যোগ হবে কৃতজ্ঞতার এক নতুন মাত্রা। পরম বিনয়ে সে মনে মনে বলবে- সকল কৃতজ্ঞতা সেই আল্লাহর, যিনি আমাকে তাঁর অনেক সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। বাস্তবিক অর্থেই যে নিজেকে এভাবে মিশিয়ে দিতে পারে মাটির সঙ্গে, মাটির পৃথিবীতেই তাকে সম্মানের আসনে বসিয়ে আল্লাহ তাআলা তাকে পুরস্কৃত করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুস্পষ্ট ঘোষণা-
مَنْ تَوَاضَعَ لِلَّهِ رَفَعَهُ اللهُ، فَهُوَ فِي نَفْسِه صَغِيرٌ، وَفِي أَعْيُنِ النَّاسِ عَظِيمٌ.
আল্লাহর জন্যে যে বিনয়ী হয় আল্লাহ তাকে সমুন্নত করেন; তখন সে নিজের চোখে তুচ্ছ হলেও মানুষের চোখে অনেক বড় বিবেচিত হয়। -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৭৭৯০
এ বিনয় যখন কারও হাসিল হবে তখন এর আলামত প্রকাশ পাবে তার ওঠা-বসায় কথা-বার্তায় এমনকি হাঁটা-চলায়ও। আল্লাহ তাআলার প্রকৃত সেই বান্দাদের বৈশিষ্ট্যাবলি পবিত্র কুরআনে এভাবে উল্লেখিত হয়েছে-
وَ عِبَادُ الرَّحْمٰنِ الَّذِیْنَ یَمْشُوْنَ عَلَی الْاَرْضِ هَوْنًا وَّ اِذَا خَاطَبَهُمُ الْجٰهِلُوْنَ قَالُوْا سَلٰمًا.
‘রাহমান’-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে… । -সূরা ফুরকান (২৫) : ৬৩
আরেক আয়াতে হাঁটাচলায়ও বিনয়-নম্রতার আদেশ করা হয়েছে এভাবে-
وَ لَا تَمْشِ فِی الْاَرْضِ مَرَحًا اِنَّكَ لَنْ تَخْرِقَ الْاَرْضَ وَ لَنْ تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُوْلًا.
ভূপৃষ্ঠে দম্ভভরে বিচরণ করো না, তুমি তো কখনোই পদভারে ভূপৃষ্ঠ বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনোই পর্বতপ্রমাণ হতে পারবে না। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৩৭
প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচার-আচরণ ছিল বিনয় ও নম্রতার অনন্য দৃষ্টান্ত। মানুষের সঙ্গে তিনি যেভাবে মিশে যেতেন, তাতে অপরিচিত কেউ দেখলে চিনতেই পারত না- তিনি আল্লাহর রাসূল। সমাজের অসহায় ও নিম্নশ্রেণির লোকদের কাছেও তিনি ছিলেন আপনজনদের চেয়েও বড় আপন। যে কেউ যখন তখন তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারত। হাদীস শরীফে তাঁর এ বৈশিষ্ট্য এভাবে বর্ণিত হয়েছে করেছেন-
أَجْوَدُ النَّاسِ صَدْرًا، وَأَصْدَقُ النَّاسِ لَهْجَةً، وَأَلْيَنُهُمْ عَرِيكَةً، وَأَكْرَمُهُمْ عِشْرَةً، مَنْ رَآهُ بَدِيهَةً هَابَهُ، وَمَنْ خَالَطَهُ مَعْرِفَةً أَحَبَّهُ.
‘তিনি ছিলেন প্রশস্ত হৃদয়-মহানুভব।, সত্যবাদিতায় সর্বাগ্রে, নম্রতা আর কোমলতায় অনন্য, আচার-আচরণে অভিজাত প্রথম যে তাঁকে দেখত ভয় করত, কিন্তু যে-ই তাঁর সঙ্গে মিশতো তাঁকে ভালোবাসত। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৬৩৮
খোদ কুরআনে কারীমেই আলোচিত হয়েছে তাঁর নম্রতা ও বিনয়ের কথা-
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَ لَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِیْظَ الْقَلْبِ لَا نْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ ۪.
আল্লাহর দয়ায় তুমি তাদের প্রতি কোমলহৃদয় হয়েছিলে। যদি তুমি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৫৯
কী ঘরে কী বাইরে- সর্বত্রই তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ বিনয়ের ধারক। নিজ হাতে ঘরের কাজকর্ম করতেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা.-কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি ঘরের কাজকর্ম করতেন? তিনি জবাবে বললেন :
نَعَمْ، كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْصِفُ نَعْلَهُ، وَيَخِيطُ ثَوْبَهُ، وَيَعْمَلُ فِي بَيْتِه كَمَا يَعْمَلُ أَحَدُكُمْ فِي بَيْتِه.
হাঁ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জুতা সেলাই করতেন, কাপড় সেলাই করতেন, ঘরের কাজকর্মও করতেন, যেভাবে তোমরা তোমাদের ঘরে কাজ করে থাক। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৫৩৪১
এক হাদীসে তো ঘরণীদের সঙ্গে তাঁর আচরণ কেমন ছিল তাও বর্ণিত হয়েছে-
خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لأَهْلِي.
তোমাদের মাঝে সেই উত্তম, যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম। আর আমি আমার স্ত্রীর কাছে সর্বোত্তম। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৮৯৫
অহংকার ছাপিয়ে বিনয় ও নম্রতাকে আপন করে নিতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন শোকর ও কৃতজ্ঞতার- এ কথা অনস্বীকার্য। আবার সেই বিনয় যেন শোকরের পথ রুদ্ধ করে না দেয় সেদিকেও সচেতন দৃষ্টি কাম্য। নামায আদায়ের সময় যেমন বিনয়ের সঙ্গে দাঁড়াতে হবে প্রভুর সামনে, বিনয়ের সঙ্গেই যেমন লুটিয়ে পড়তে হবে সিজদায়, তেমনি এটাও মনে করতে হবে- আল্লাহ তাওফীক দিয়েছেন বলেই নামায পড়তে পেরেছি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন-
أَنَا سَيِّدُ ولد آدَمَ، وَلاَ فَخْرَ، وَأَنَا أَوَّلُ مَنْ تَنْشَقُّ الأَرْضُ عَنْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَلاَ فَخْرَ، وَأَنَا أَوَّلُ شَافِعٍ، وَأَوَّلُ مُشَفَّعٍ، وَلاَ فَخْرَ، وَلِوَاءُ الْحَمْدِ بِيَدِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَلاَ فَخْرَ.
আমি আদম-সন্তানের সর্দার, তবে এতে বড়াইয়ের কিছু নেই; কেয়ামতের দিন আমার কবরের মাটিই প্রথম সরানো হবে, তবে এটা বড়াইয়ের কোনো বিষয় নয়, আমিই প্রথম সুপারিশ করব, আমার সুপারিশই প্রথম গৃহীত হবে, এতেও অহংকার করার কিছু নেই, কেয়ামতের দিন ‘হামদে’র পতাকা আমার হাতে থাকবে, তবে এতেও কোনো বড়াই নেই। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৪৩০৮
একদিকে নিআমতের বর্ণনা, সঙ্গে সঙ্গে বিনয় ও নম্রতা- এ হাদীস আমাদেরকে এ শিক্ষা-ই দেয়। তাই অতিরিক্ত বিনয় প্রকাশ করতে গিয়ে এমন কোনো কথা বলা যাবে না, যা আবার শোকর ও কৃতজ্ঞতার পরিপন্থী। নামায আদায়ের পর আল্লাহ তাআলা যে তৌফিক দিলেন সেজন্যে কৃতজ্ঞ না হয়ে যদি কেউ বলে, ‘আমার এ নামায দিয়ে কী হবে’ কিংবা ‘আমাদের নামায তো আসলে কোনো নামাযই নয়’। মনে রাখতে হবে, এ জাতীয় বিনয় আসলে শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো কাক্সিক্ষত বিষয় নয়।
দয়াময় আল্লাহর প্রকৃত বান্দা হতে চাইলে জীবনের সর্বক্ষেত্রেই প্রয়োজন- বিনয়। ইবাদত-বন্দেগি থেকে শুরু করে ঘরে-বাইরে সবার সঙ্গে আচরণে সে বিনয় অপরিহার্য। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি কামনায় নিজেকে নীচু করে দেয়ার এ প্রশিক্ষণে যে প্রশিক্ষিত হতে পারবে, অবচেতনভাবেই সম্মান তার কাছে এসে ধরা দেবে; দুনিয়া ও আখেরাতে। দুনিয়ার মানুষের ভালোবাসায় সে সিক্ত হবে, হাসিল হবে মহান প্রভুর নৈকট্যও।
Discussion about this post