মো. শাহজাহান কবীর
স্বাধীনতা মহান আল্লাহর দেওয়া এক বড় নিয়ামত। মাতৃভূমির প্রতি যে বিশেষ অনুরাগ-আবেগ, মমতা ও ভালোবাসা, তারই নাম স্বদেশপ্রেম। ইসলামে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার জোরালো দিকনির্দেশনা রয়েছে। স্বদেশপ্রেম ও মাতৃভূমিকে ভালোবাসা এবং দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা ইমানের দাবি। তাই বহুল প্রচারিত আরবি প্রবাদ- ‘স্বদেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ।’ ধর্মপ্রাণ মানুষের হৃদয়-মনজুড়ে আরবি প্রবাদ বাক্যটি স্বদেশপ্রেমের প্রতি বিশেষ প্রভাব ফেলেছে।
মাতৃভূমির প্রতি হৃদয়ের টান এক মহান মানবীয় গুণ। এ গুণের অধিকারী ছিলেন নবী-রাসুল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম। ধর্মের বাণী মানুষকে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়েছে; কিন্তু ধর্মের প্রবক্তারা জীবন বিসর্জন দিয়ে ধর্মীয় সত্য প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। নবী ও রাসুলগণ এ পন্থায় দেশ ও সমাজের উপকার করে স্বদেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তাদের দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদেরও সেসব দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা উচিত।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা কেমন ছিল, তা সুস্পষ্টরূপে ফুটে ওঠে হিজরতের প্রাক্কালে মক্কাকে লক্ষ্য করে দেওয়া তার ভাষণে। মদিনায় হিজরতের প্রাক্কালে রাসুল (সা.) বলেছিলেন, ‘আল্লাহর নামে শপথ- হে মক্কা, তুমি আল্লাহর ভূখণ্ডগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম, তুমি আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় তার অন্যান্য ভূখণ্ড থেকে। আমি যদি তোমার কোল থেকে বহিস্কৃত না হতাম, আমি তোমার কাছ থেকে বের হয়ে যেতাম না।’
এ বাণী থেকে রাসুলের (সা.) মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন সহজেই বোঝা যায়। সাহাবায়ে কেরামগণ আমাদের মতোই দেহ-মনের মানুষ ছিলেন। হজরত আবু বকরও (রা.) রাসুলের (সা.) সঙ্গে মদিনায় হিজরত করেছিলেন। তাই বলে তার মন থেকে মক্কার প্রতি ভালোবাসা কখনও মুছে যায়নি।
মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা, তার সংরক্ষণের দায়িত্ব শুধু জন্মভূমি হওয়ার কারণেই জরুরি নয়। বরং যে জন্মভূমিতে বসে, যে রাষ্ট্রে বাস করে মুসলিম জনগণ মহান আল্লার দেওয়া বিধান অনুযায়ী জীবনযাপনের সুযোগ পাবে, তার প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা থাকা একান্ত জরুরি। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, আল্লাহর পথে এক দিন সীমান্ত রক্ষার কাজে নিযুক্ত থাকা হাজার দিনের মঞ্জিল অতিক্রম করা অপেক্ষা উত্তম।
স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের জন্য কিছু করা গৌরবের বিষয়। দেশ ও জাতির জন্য আত্মনিবেদিত মানুষ সমাজের চোখে যেমন সম্মানিত, তেমনি আল্লাহর কাছেও অত্যন্ত গৌরবময় মর্যাদার অধিকারী। দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় সীমান্তরক্ষীদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। দেশের সীমান্তরক্ষী অতন্দ্র প্রহরীদের সম্পর্কে রাসুল (সা.) ঘোষণা দিয়েছেন, ‘এক দিন ও এক রাত সীমান্ত পাহারা ক্রমাগত এক মাসের সিয়াম সাধনা ও সারা রাত নফল ইবাদতে কাটানো অপেক্ষা উত্তম (মুসলিম)।’
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি রাসুলকে (সা.) বলতে শুনেছি, ‘দুই প্রকারের চক্ষুকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না। প্রথমত, সেই চক্ষু যা আল্লাহর ভয়ে কাঁদে; দ্বিতীয়ত, আল্লাহর পথে সীমান্ত পাহারাদারি করতে করতে রাত কাটিয়ে দেয় বা বিনিদ্র রজনী যাপন করে’ (তিরমিজি)।
ইসলামে স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের গুরুত্ব অনেক। কারণ দেশের প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের মানুষের প্রতি যার মায়ামমতা নেই, সে দেশের জন্য উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারে না, দেশের জন্য কোনো কিছু ত্যাগ করতে পারে না। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে না পারলে মানসম্মান, স্বাধিকার ও ইমান-আমল রক্ষা করা যায় না।
দেশ ও জাতির প্রতি ভালোবাসা ইমান ও আদর্শভিত্তিকই হতে হবে। ইমানপ্রেমের মতো দেশপ্রেমও মুমিনের অস্তিত্বের অংশ। এ জন্য নিজের দেশ ও জাতির প্রতি স্বাধীন দেশের প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ নাগরিকের নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘সাবধান, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল ও তোমাদের প্রত্যেককেই দায়িত্বশীলতার জন্য জবাবদিহি করতে হবে (বুখারি)।’
দেশাত্মবোধ ও স্বদেশের প্রতি মমতা অনেক অন্যায় ও অপরাধপ্রবণতা থেকে মানুষকে বিরত রাখতে পারে। তাই দেশের প্রকৃত উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন করতে হলে অবশ্যই দেশের প্রতিটি নাগরিকের অন্তরে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। স্বদেশের প্রতি অনুগত থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশমাতৃকাকে ভালোবাসা সবার ইমানি দায়িত্ব ও পবিত্র কর্তব্য।
মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন, তিনি যেন তাদের জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করেন এবং আমাদের দেশের স্বাধীনতা রক্ষা ও দেশকে ভালোবাসার তাওফিক দান করুন।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
Discussion about this post