হাবীবুল্লাহ মুহাম্মাদ ইকবাল
রমজান রহমাত, বরকত ও নাজাতের মাস। এই মাস আল্লাহ তাআলা এক বিশেষ অনুকম্পা ও নিয়ামাত। অধিক পরিমাণে আমলের মাধ্যমে বিপুল সওয়াব অর্জন ও নেকি লাভের মৌসুম। এ মাসেই পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে।
আল-কোরআনে এসেছে, ‘রমজান মাস, যার মধ্যে কোরআন নাজিল করা হয়েছে— লোকদের পথ প্রদর্শক এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট বর্ণনারূপে এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে।’ (সুরা আল-বাকারাহ, আয়াত : ১৮৫)
রমজান মাসের ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রমজান- বরকতময় মাস তোমাদের দুয়ারে উপস্থিত হয়েছে। পুরো মাস রোযা পালন আল্লাহ তোমাদের জন্য ফরয করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজাগুলো। দুষ্ট শয়তানদের এ মাসে শৃংখলাবদ্ধ করে দেয়া হয়। এ মাসে আল্লাহ কর্তৃক একটি রাত প্রদত্ত হয়েছে, যা হাজার মাস থেকে উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে (মহা কল্যাণ থেকে) বঞ্চিত হলো।’ (সুনান আত-তিরমিজি, হাদিস : ৬৮৩)
এ মাসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল রয়েছে, যেগুলো পালন করার মাধ্যমে আমরা জান্নাতে যেতে পারি, জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে পারি। এখানে রমজান মাসের আমল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তবে এ আমলগুলো করার জন্য শর্ত হলো দুইটি :
০১. ইখলাস-নিষ্ঠার উপস্থিতি
একনিষ্ঠতার সঙ্গে কেবল আল্লাহ তাআলার জন্যে আমল করা। সুতরাং যে আমল হবে টাকা উপার্জনের জন্য, নেতৃত্ব অর্জনের জন্য ও সুনাম-খ্যাতি অর্জনের জন্য— সে আমলে ইখলাস থাকবে না। অর্থাৎ এসব ইবাদাত বা নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হবে না; বরং তা ছোট শিরকে রূপান্তরিত হতে পারে।
পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আর তাদের কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে— তারই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে।’ (সুরা আল-বাইয়িনাহ, আয়াত : ০৫)
০২. ইবাদতের ক্ষেত্রে রাসুল (সা.)-এর অনুসরণ
সহি ও বিশুদ্ধভাবে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর যেসব ইবাদতের কথা উল্লেখ আছে— সেগুলো পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো বাড়ানো বা কমানোর সুযোগ নেই। কারণ, ইবাদত হচ্ছে— যা আল্লাহর রাসুল (সা.) শিখিয়ে দিয়েছেন। কোরআনে এসেছে, ‘রাসুল তোমাদের জন্য যা নিয়ে এসেছেন, তা তোমরা গ্রহণ করো; আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত হও।’ (সুরা হাশর, আয়াত : ০৭)
এ বিষয়ে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে এমন ইবাদত করল— যাতে আমাদের কোনো নির্দেশনা নেই; তা পরিত্যাজ্য হিসাবে গণ্য হবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৫৯০)
রমজান মাসের গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলো হলো-
এক. সিয়াম পালন করা
ইসলামের পাঁচটি রুকনের একটি রুকন হলো সিয়াম। আর রমজান মাসে সিয়াম পালন করা ফরজ। সেজন্য রমজান মাসের প্রধান আমল হলো সুন্নাহ মোতাবেক সিয়াম পালন করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে এই মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫)
সিয়াম পালনের ফজিলত সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ইখলাস নিয়ে অর্থাৎ একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে সন্তুষ্টি করার জন্য রমাদানে সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি : ২০১৪)
আরেক হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে কেউ আল্লাহর রাস্তায় (অর্থাৎ শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশী করার জন্য) একদিন সিয়াম পালন করবে, তার দ্বারা আল্লাহ তাকে জাহান্নামের অগ্নি থেকে সত্তর বছরের রাস্তা পরিমাণ দূরবর্তীস্থানে রাখবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৭৬৭)
দুই. সময় মতো নামাজ আদায় করা
সিয়াম পালনের সাথে সাথে সময় মতো নামাজ আদায় করার মাধ্যমে জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম হয়। কোরআন মাজিদে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় সালাত মুমিনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরজ।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১০৩)
এ বিষয়ে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী! কোন আমল জান্নাতের অতি নিকটবর্তী? তিনি বললেন, ‘সময় মতো নামাজ আদায় করা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৬৩)
তিন. সহিহ-শুদ্ধভাবে কোরআন শেখা
রমজান মাসে কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। এ মাসের অন্যতম আমল হলো- সহিহভাবে কোরআন শেখা। আর কোরআন শিক্ষা করা ফরজ করা হয়েছে। কেননা কোরআনে বলা হয়েছে, ‘পড়ো তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা আলাক, আয়াত : ০১)
আল্লাহর রাসুল (সা.) কোরআন শেখার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমরা কোরআন শিক্ষা করো এবং তিলাওয়াত করো।’ (মুসনাদ আলজামি, হাদিস : ৯৮৯০)
চার. অপরকে কোরআন পড়া শেখানো
রমজান মাস অপরকে কোরআন শেখানোর উত্তম সময়। এ মাসে আল্লাহর রাসুল (সা.) নিজে সাহাবিদের কোরআন শিক্ষা দিতেন। এ বিষয়ে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই, যে নিজে কোরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫০২৭)
আরেক হাদিসে ‘যে আল্লাহর কিতাব থেকে একটি আয়াত শিক্ষা দেবে, যত তিলাওয়াত হবে; তার সাওয়াব সে পাবে।’ (সহিহ কুনুযুস সুন্নাহ আন-নবুবিয়্যাহ : ০৭)
পাঁচ. সাহরি খাওয়া
সাহরি খাওয়ার মধ্যে বরকত রয়েছে এবং সিয়াম পালনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হাদিসে এসেছে, ‘সাহরি হলো বরকতময় খাবার। তাই কখনো সাহরি খাওয়া বাদ দিয়ো না। এক ঢোক পানি পান করে হলেও সাহরি খেয়ে নাও। কেননা সাহরির খাবার গ্রহণকারীকে আল্লাহ তাআলা ও তার ফেরেশতারা স্মরণ করে থাকেন।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস : ১১১০১)
ছয়. সালাতুত তারাবি পড়া
সালাতুত তারাবি বা তারাবির নামাজ পড়া এ মাসের অন্যতম আমল। তারাবি হক আদায় করে পড়তে হবে। হাদিসে এসেছে: ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব হাসিলের আশায় রমজানে কিয়ামু রমজান (সালাতুত তারাবিহ) আদায় করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (সহিহ আল-বুখারি, হাদিস : ২০০৯)
তারাবির সালাতের হক আদায় করে অর্থাৎ ধীরস্থীরভাবে আদায় করতে হবে। তারাবি জামাতের সঙ্গে আদায় করা সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত। হাদিসে আছে, ‘যে ব্যক্তি ইমামের সাথে প্রস্থান করা অবধি সালাত আদায় করবে (সালাতুত তারাবি) তাকে পুরো রাত কিয়ামুল লাইলের সাওয়াব দান করা হবে।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস : ১৩৭৭)
সাত. বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করা
এটি কোরআনের মাস। তাই এ মাসে অন্যতম কাজ হলো বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করা। হাদিসে এসেছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআনের একটি হরফ পাঠ করে, তাকে একটি নেকি প্রদান করা হয়। প্রতিটি নেকি দশটি নেকির সমান। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ।’ (সুনান আত-তিরমিজি, হাদিস : ২৯১০)
আল্লাহর রাসুল (সা.) রমজান ব্যতীত কোনো মাসে এত বেশি তিলাওয়াত করতেন না। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রমজান ব্যতীত অন্য কোনো রাতে আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে পূর্ণ কোরআন তিলাওয়াত করতে কিংবা ভোর পর্যন্ত সালাতে কাটিয়ে দিতে অথবা পূর্ণ মাস রোজা পালন করে কাটিয়ে দিতে দেখিনি।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৭৭৩)
আট. শুকরিয়া আদায় করা
রমজান মাস পাওয়া এক বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়। সেজন্য আল্লাহ তাআলার বেশি বেশি শুকরিয়া আদায় করা এবং আগামী রমজান পাওয়ার জন্য তাওফিক কামনা করা। রমজান সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ করো এবং তিনি তোমাদের যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করো এবং যাতে তোমরা শোকর করো।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৮৫)
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “আর যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আজাব বড় কঠিন’।’’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত : ০৭)
আয়েশা (রা.) বলেন, নবী (সা.) নিয়ামাতের শুকরিয়া আদায় করে বলতেন অর্থাৎ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য (সুনান আত-তিরমিজি, হাদিস : ২৭৩৮)
নয়. কল্যাণকর কাজ বেশি বেশি করা
এ মাসটিতে একটি ভালো কাজ অন্য মাসের চেয়ে অনেক বেশি উত্তম। সেজন্য যথাসম্ভব বেশি বেশি ভালো কাজ করতে হবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ‘এ মাসের প্রত্যেক রাতে একজন ঘোষণাকারী এ বলে আহবান করতে থাকে যে, হে কল্যাণের অনুসন্ধানকারী তুমি আরও অগ্রসর হও! হে অসৎ কাজের পথিক, তোমরা অন্যায় পথে চলা বন্ধ করো। (তুমি কি জান?) এ মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ তায়ালা কত লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন।’ (সুনান তিরমিজি, হাদিস : ৬৮৪)
দশ. তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া
রমজান মাস ছাড়াও সালাতুত তাহাজ্জুদ পড়ার মধ্যে বিরাট সাওয়াব এবং মর্যাদা রয়েছে। রমাদানের কারণে আরও বেশি ফজিলত রয়েছে। যেহেতু সাহরি খাওয়ার জন্য উঠতে হয় সেজন্য রমজান মাসে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করার বিশেষ সুযোগও রয়েছে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী (সা.) বলেছেন, ‘ফরজ সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হলো- রাতের সালাত অর্থাৎ তাহাজ্জুদের সালাত।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৮১২)
সম্পাদনা: ড.আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
Discussion about this post