মুফতি মাওলানা মুহাম্মাদ এহছানুল হক মুজাদ্দেদী
সব প্রশংসা আল্লাহতায়ালার জন্য, যিনি রব্বুল আলামিন। দরুদ ও সালাম প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর, যিনি মুমিনের ইমান। তাঁর পরিবারবর্গ ও বংশধর, সাহাবায়ে কিরাম (রা.), আল্লাহর নেককার বান্দাদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষণ হোক অঝর ধারায়। নিশ্চয়ই শুভ পরিণতি কেবল মুত্তাকিদের জন্যই নির্ধারিত। রাতের তাহাজ্জুদ নামাজ হলো আম্বিয়া আলাইহিস সালামদের সুন্নাত, আল্লাহতায়ালার মাহবুব বান্দাদের অভ্যাস আর আল্লাহর সঙ্গে বান্দার গভীর সম্পর্ক স্থাপন তথা নৈকট্য ও সন্তোষ অর্জনের অন্যতম পন্থা। তাহাজ্জুদের ফজিলত প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ নামাজ কায়েম করুন; এটা আপনার জন্য এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায়, আপনার প্রতিপালক আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন মাকামে মাহমুদে (প্রশংসিত স্থানে)।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৭৯)। তিনি আরও বলেন, ‘তারা শয্যা ত্যাগ করে আকাঙ্ক্ষা ও আশঙ্কার সঙ্গে তাদের প্রতিপালককে ডাকে এবং আমি তাদের যে রুজি প্রদান করেছি, তা থেকে তারা দান করে।’ (সূরা সিজদা : ১৬)।
তাহাজ্জুদ নামাজ নফসের রিয়াজাত ও তারবিয়াতের এক বিশেষ মাধ্যম। কারণ প্রভুর প্রেমে গভীর রাতে সুখশয্যা ত্যাগ করেই আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হতে হয়। এ নামাজ মন ও চরিত্রকে নির্মল ও পবিত্র করা এবং সত্য পথে অবিচল রাখার জন্য অপরিহার্য ও অতীব কার্যকর পন্থা। পবিত্র কোরআনের সূরা মুজ্জাম্মিলে এর উল্লেখ করা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই রাতে ঘুম থেকে ওঠা মনকে দমিত করার জন্য খুব বেশি কার্যকর এবং সে সময়ের কোরআন পাঠ বা জিকির একেবারে যথার্থ।’ (সূরা মুজাম্মিল : ৬।) অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘আর আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা, যারা তাদের রবের দরবারে সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকেই রাত কাটিয়ে দেয়।’ (সূরা ফুরকান : ৬৪)। ইসলামের প্রাথমিক যুগে কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ী হওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা ছিল যে তারা রাতের শেষ ভাগে আল্লাহ দরবারে চোখের পানি ফেলতেন আর ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। যেমন কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা ছিল কঠিন পরীক্ষায় পরম ধৈর্যশীল, অটল-অবিচল, সত্যের অনুসারী, পরম অনুগত। আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ উৎসর্গকারী এবং রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৭)।প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসেও তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্বের কথা উল্লেখ রয়েছে। মিশকাতুল মাসাবিহ গ্রন্থকার সুনানে আহমদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি। আফদালুস সালাতি বাদাল মাফরুদাতি সালাতুল লাইলি’ অর্থাৎ ‘ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদের নামাজ।’ হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য এক হাদিসে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা প্রতি রাতেই নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হন যখন রাতের শেষ তৃতীয় ভাগ অবশিষ্ট থাকে। তিনি তখন বলতে থাকেন কে আছো যে আমায় ডাকবে, আর আমি তার ডাকে সাড়া দেব? কে আছো যে আমার কাছে কিছু চাইবে, আর আমি তাকে তা দান করব? কে আছো যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আর আমি তাকে ক্ষমা করব?’ (বুখারি ও মুসলিম)।
শরহে সুন্নাহর বরাত দিয়ে মিশকাতুল মাসাবিহ গ্রন্থকার বর্ণনা করেন, হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ খুশি হন। এক. যে ব্যক্তি তাহাজ্জুদের জন্য ওঠে এবং নামাজ পড়ে। দুই. মুসল্লি যারা নামাজের জন্য সারিবদ্ধভাবে কাতারে দাঁড়ায়। তিন. মুজাহিদ যারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করার জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায়।’ অনুরূপ আরেকটি হাদিস রয়েছে, হজরত জাবির (রা.) বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি। রাতের মধ্যে এমন একটি মুহূর্ত আছে যদি কোনো মুসলমান তা লাভ করে এবং আল্লাহর কাছে ইহ ও পরকালের কোনো কল্যাণ চায় আল্লাহ নিশ্চয়ই তাকে তা দেন। (মুসলিম)।
আসুন, আমরা তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করি, মনকে পবিত্র করি, আল্লাহর প্রিয় বান্দা হই। আল্লাহতায়ালা সবাইকে তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : মুফাসসিরে কোরআন, ইসলামী মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।
প্রিন্সিপাল, মণিপুর বাইতুর রওশন মাদ্রাসা কমপ্লেক্স, মিরপুর, ঢাকা
Discussion about this post