মাহমুদ আহমদ , ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
আজ ১২ রবিউল আউয়াল। আরবি বছরের তৃতীয় মাস। পবিত্র এ মাসে সর্বকালের ও সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ মানুষ এবং নবিকুল শিরোমণি হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমতরূপে প্রেরণ করেছেন। মহানবি (সা.) মানুষকে সব প্রকার পঙ্কিলতা, অনিয়ম, অনাচার, পাপাচার ও অন্ধকারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে আজীবন চেষ্টা চালিয়েছেন, সংগ্রাম করেছেন। অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা না পর্যন্ত তিনি ক্ষান্ত হন নাই। নিজে বহু কষ্ট করেছেন, নানা বাধা বিঘ্নের সম্মুখীন হয়েছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন, লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়েছেন, জীবনের ওপরে বার বার হুমকি এসেছে তবুও তিনি পিছিয়ে যাননি। একাধারে বিরামহীন চেষ্টা ও অক্লান্ত পরিশ্রম দ্বারা তিনি জয়যুক্ত হয়েছেন। এভাবে সেকালের ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আমি তোমাকে বিশ্বজগতের জন্য কেবল এক রহমত রূপেই পাঠিয়েছি।’ (সুরা আল আম্বিয়া: ১০৭) ‘আমি তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্যই সুসংবাদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।’ (সুরা সাবা: ২৮)
“মহানবির উম্মত হিসেবে তার ভালোবাসায় পবিত্র এ মাসে আমরা অঙ্গীকার করি মহানবির (সা.) আদর্শ গ্রহণে কোরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনার। আল্লাহতায়ালা আমাদের এর তৌফিক দান করুন, আমিন ”
সর্ব দিক থেকে সর্ব বিষয়ে মহানবির (সা.) আদর্শ ছিল অতুলনীয়। তিনি শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ছিলেন এক মূর্ত প্রতীক। যুগ যুগ ধরে যারা বিকৃত ও ভ্রষ্ট তাদের উন্নত আচার-ব্যবহার শেখানোর জন্য আর সৃষ্টি ও স্রষ্টার মাঝে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা ঘুচানোর জন্যই আল্লাহতায়ালা বিশ্বনবিকে প্রেরণ করেছেন। কীভাবে নিজের প্রভুর ভালোবাসা অর্জন করা যায় আর তার সৃষ্টির প্রাপ্য অধিকার প্রদান করতে হবে মহানবি (সা.) তা শিখিয়েছেন। বিশ্বনবির প্রতি আল্লাহতায়ালার নির্দেশ ছিল, ‘যাক্কির ফাইন্নায যিকরা তানফাউল মুমিনীন’ অর্থাৎ, তুমি উপদেশ দিতে থাক, নিশ্চয় উপদেশ প্রদান মুমিনদের কল্যাণ সাধন করে থাকে। (সুরা আয যারিয়াত: ৫৫) তিনি (সা.) যেরূপ সহানুভূতি, ভালোবাসা, আন্তরিকতা এবং পরিশ্রম করে নিরন্তর এ উপদেশ প্রদানের দায়িত্ব পালন করেছেন তা পবিত্র কোরআনে এভাবে উল্লেখ রয়েছে, হে মুহাম্মদ (সা.) তারা মুমিন হচ্ছে না বলে তুমি কি নিজ প্রাণ বিনাশ করে ফেলবে? (সুরা আশ শোয়ারা: ৪)
মহানবির উপদেশ দেওয়ার রীতিও ছিল বিষ্ময়কর। তার (সা.) প্রতি আল্লাহ্ তা’লার এই নির্দেশও ছিল, নিজ অনুসারীদের সাথে নম্রতা ও ভালোবাসাপূর্ণ আচরণ করবে। এ উদ্দেশ্যে তিনি (সা.) আপনজন অর্থাৎ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন এবং শিশুদের বোঝানোর জন্য তাদের সাথেও কোমল, প্রীতিপূর্ণ ও স্নেহসুলভ ব্যবহার করেছেন আর উম্মতের অন্যদের সাথেও আর নিজের সাহাবিদের সাথেও। আর সর্বদা এই নির্দেশকে দৃষ্টিপটে রেখেছেন যে, তোমার কাজ হলো, উপদেশ দেওয়া আর ধীরেসুস্থে বা প্রশান্তচিত্তে সুন্দরভাবে উপদেশ দিতে থাক। মহানবির (সা.) আদর্শ এতটাই অতুলনীয় ছিল যে, তিনি ইহুদির লাশকেও সম্মান দেখিয়েছেন।
হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, একবার এক ইহুদির লাশ বিশ্বনবির (সা.) সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর এতে মহানবি (সা.) সেই লাশের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে ছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না লাশটি তার সামনে থেকে চলে যায়। পাশ থেকে হজরত জাবের (রা.) বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! এটি তো ইহুদির লাশ। এতে আল্লাহর রাসুল উত্তর দিয়েছিলন, সে কি মানুষ ছিল না? (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৩১১)। যে নবি এক ইহুদির লাশকে সম্মান জানানোর জন্য তার সাথীদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সেই মহান নবির উম্মতের পক্ষে কীভাবে সম্ভব হতে পারে শুধু ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারণে কারও ওপর অন্যায় অত্যাচার করা এবং কারও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ধ্বংস করা?
তিনি (সা.) আমাদের সামনে এই আদর্শ স্থাপন করেছেন যে, যদি সমাজের সংশোধনের জন্য উন্নত মান প্রতিষ্ঠা করতে হয় তাহলে নিজের ঘর বা পরিবার থেকে সংশোধনের কাজ আরম্ভ কর। এর প্রভাবও পড়বে আর আল্লাহতায়ালার নিদের্শও এটিই যে, নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে আগুন থেকে রক্ষা কর। সেই পথে নিজে চল এবং তাদের পরিচালিত কর, যা আল্লাহতায়ালার নৈকট্য প্রদানকারী পথ, যা উন্নত নৈতিক গুণাবলি অর্জনের পথ। মহানবি (সা.) তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর বিষয়ের প্রতিও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মনোযোগ আকর্ষণ করতেন আর তাদের শেখাতেন, কিন্তু তা পরম ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে।
মহানবি (সা.) তার বাড়িতে স্ত্রী-কন্যাদের এবং বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াতকারী বহু শিশু-কিশোর এবং যুবকদের, যেমন হযরত আলী, হযরত যায়েদ, হাসান, হোসাইন, উসামা, আনাস, আব্দুল্লাহ্ বিন উমর এবং আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস প্রমুখদের অত্যন্ত স্নেহ, ভালোবাসা এবং দোয়ার সাথে এমন উন্নত শিক্ষা দিয়েছেন যে, তারা অনাগত প্রজন্মের জন্য আলোকবর্তিকায় পরিণত হয়েছেন। কিন্তু এই পুরো শিক্ষা-দীক্ষার সময় তিনি (সা.) কখনও কারও গায়ে হাত তুলেননি আর না-ই কখনও রাগ করে বাড়িতে কাউকে বকাঝকা করেছেন। বিশেষভাবে মহিলাদের সম্মান ও ইসলামের উন্নত শিক্ষা দিয়ে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন যে, কয়েক বছরের মধ্যেই আরব সমাজে মহিলাদের সেই সম্মান অর্জিত হয় যে, তাঁর কতক মহান সাহাবি কতক জটিল সমস্যার সমাধান করার জন্য তাঁর সহধর্মিণীদের কাছ থেকে মতামত নিতেন। মহানবির অনিন্দ্য সুন্দর নৈতিক গুণ ও নৈতিক চরিত্রের এমনই প্রভাব ছিল যে, তার সহধর্মিণীরা তার বাড়ির সাদামাটা এবং দারিদ্র্যপূর্ণ জীবনের মোকাবিলায় পার্থিব শোভা সৌন্দর্য ও ধন-সম্পদের সব প্রলোভন বা প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
মহানবির সর্বোত্তম নৈতিক গুণাবলি এবং ব্যাকুল চিত্তের দোয়া আর অনবরত সহানুভূতিপূর্ণ উপদেশের ফলেই প্রত্যেক হৃদয়ে, পরিবারে আর পরিবেশে পবিত্র পরিবর্তন আসা আরম্ভ হয়ে যেতো। তার সুন্দর ব্যবহার এরূপ হৃদয়কাড়া আর এমন আকর্ষণ-আবেদন ছিল আর তাতে এমন জ্যোতি ছিল যা হৃদয়কে মোহাবিষ্ট করতো। সাহাবা রেযওয়ানুল্লাহি আলাইহিম বর্ণনা করেন, তিনি পরম সহানুভূতিশীল, কোমল প্রকৃতি এবং সহিষ্ণু স্বভাবের অধিকারী ছিলেন।
প্রত্যেক মুসলমানের সাথে সদয় ব্যবহার করতেন। তিনি (সা.) বলতেন, কোমলতা বিষয়কে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে। যে বিষয় হতে নম্রতা বা কোমলতা বের করে দেওয়া হয় তা অসুন্দর হয়ে যায়। একজন সাহাবি বর্ণনা করেন, একবার এক যুদ্ধের সময় ভিড়ের কারণে আমার পা মহানবির (সা.) পায়ের ওপর পড়ে, আমার শক্ত জুতার কারণে তার প্রচণ্ড কষ্ট হয়, তখন তিনি (সা.) তার লাঠি দিয়ে একথা বলে আমার পা সরিয়ে দেন যে, বিসমিল্লাহ! তুমি আমার পা’কে ক্ষত-বিক্ষত করেছ। এতে আমার খুবই অনুশোচনা হয়। পুরো রাত চিন্তিত থাকি। পরের দিন কেউ আমার নাম ধরে ডেকে বলে, হুজুর (সা.) তোমাকে ডাকছেন। আমি চরম ভীতি নিয়ে এই ভেবে তার সমীপে উপস্থিত হই যে, সম্ভবত এখন শাস্তি পাবো। কিন্তু তিনি পরম স্নেহের সাথে বলেন, গতকাল আমি আমার লাঠি দ্বারা তোমার পা সরিয়ে দিয়েছিলাম এজন্য আমি খুবই লজ্জিত। এর বিনিময়ে এই আশিটি ছাগল উপহার দিচ্ছি, গ্রহণ করো আর এ বিষয়টি মন থেকে বের করে দাও অর্থাৎ ভুলে যাও। (মুসনাদ দারমি, হাদিকাতুস সালেহিন, পৃ: ৫৭)
কতই না চমৎকার শিক্ষা ছিল তার। অথচ আজ সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায়, শুধু অশান্তি আর অশান্তি। বিশ্বে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার নিরীহ-মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে শুধু ধর্মীয় মতাদর্শের পার্থক্যের কারণে। সবাই নিজ নিজ স্বার্থ অর্জনের জন্য ব্যস্ত। একে অপরের প্রতি নেই কোনো প্রেম ভালোবাসা। আমরা কি পারি না, যে শিক্ষা নিয়ে বিশ্বনবি (সা.) এ পৃথিবীতে এসেছিলেন, সেই শিক্ষার আলোকে নিজেদের জীবন গড়ে তুলতে? আমরা কি পারি না, সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একসাথে দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে? মহানবি (সা.) প্রেম-ভালোবাসা, দয়া এবং তার পবিত্রকরণ শক্তির প্রভাবে মানব হৃদয়কে জয় করেছিলেন এবং সমগ্র বিশ্বে এক মহান বিপ্লব সংঘটিত করেছিলেন। আমাদেরও তার আদর্শের প্রতিফলন নিজ জীবনে বাস্তবায়িত করতে হবে।
তাই আসুন, মহানবির উম্মত হিসেবে তার ভালোবাসায় পবিত্র এ মাসে আমরা অঙ্গীকার করি মহানবির (সা.) আদর্শ গ্রহণে কোরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনার। আল্লাহতায়ালা আমাদের এর তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
Discussion about this post